Chapter Index

    লোহার হান্স্‌

    এক ছিলেন রাজা। রাজার প্রাসাদের চারিদিক ঘিরে ছিল বন, আর সেই বন ভরা ছিল শিকারের জন্তু। একদিন রাজা একজন শিকারীকে একটি হরিণ মেরে আনতে পাঠালেন। কিন্তু শিকারী সেই যে গেল আর ফিরল না।

    রাজা বললেন—কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে নিশ্চয়।

    পরের দিন রাজা আরো দু-জন শিকারীকে পাঠালেন হারিয়ে-যাওয়া মানুষটার খোঁজ করতে। কিন্তু তারাও ফিরে এল না। পরের দিন তাঁর রাজ্যের যত শিকারী সবাইকে ডেকে রাজা বললেন—সারা বন চষে ফেল। যেমন করে পারো তিনজন শিকারীকে খুঁজে বার করা চাই।

    কিন্তু শিকারীর দলের একটিও মানুষ, এমনকি তাদের সঙ্গে যে শিকারী কুকুরের দল গিয়েছিল তার একটি কুকুরও ফিরল না। এর পর থেকে কেউই আর বনের মধ্যে ঢুকতে সাহস করত না। সেই থেকে একেবারে নিস্তব্ধ নিরালা হয়ে পড়ে রইল সেই অরণ্য। শুধু মাঝে মাঝে একটা ঈগল কিংবা বাজপাখিকে দেখা যেত বনের মাথায় চক্কর দিয়ে উড়ছে।

    এইভাবে অনেক বছর কেটে গেল। তারপর একদিন এক পরদেশী শিকারী রাজার সঙ্গে দেখা করে বললে যে সে ঐ বিপদভরা বনের মধ্যে ঢুকতে চায়। রাজা তাকে অনুমতি দিতে চাইলেন না। বললেন—জায়গাটা মোটেই ভাল না। আমার ভয় হয়, একবার যদি তুমি ভিতরে ঢোকো, আর কোনদিন বার হতে পারবে না, অন্যেরা যেমন পারেনি।

    শিকারী বললে—মহারাজ, ঝুঁকি আমার। ভয় কাকে বলে আমি জানি না।

    কাজেই শিকারী তার কুকুর নিয়ে বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। অল্পক্ষণের মধ্যেই কুকুরটা একটা শিকার দেখতে পেয়ে তার পিছনে তাড়া করল। কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতেই একটা গভীর পুকুরের কাছে পৌঁছে দেখল, আর যাওয়া যায় না। জলের মধ্যে থেকে একটা মস্ত হাত উঠল। হাতটা উঠেই কুকুরটাকে ধরে জলের মধ্যে টেনে নিলে।

    শিকারী সব দেখলে। দেখে সে ফিরে গিয়ে তিনজন লোক ডেকে নিয়ে এল, সঙ্গে তিনটে বড়-বড় বালতি। বালতি.করে পুকুরের জল তোলা শুরু হল। যখন জল পুকুরের নিচে এসে পৌঁছেছে, দেখা গেল একজন বুনো মানুষ। মরচে পড়া লোহার মতো তার গা, মাথার চুল মুখের উপর দিয়ে হাঁটু অবধি এসে পড়েছে। জলের মধ্যে সে লুকিয়ে বসে ছিল। তারা বুনো মানুষটাকে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেল। বুনো মানুষকে নিয়ে চারিদিকে খুব উত্তেজনা দেখা দিল। রাজা তার জন্যে রাজবাড়ির উঠোনে এক লোহার খাঁচা করালেন। রাজা বলে দিলেন, খাঁচার দরজা যদি কেউ খোলে তো তার গর্দান যাবে। এই বলে খাঁচার চাবি রানীর কাছে রেখে দিলেন। এর পর থেকে বনের পথে যাওয়া-আসা সহজ হল। আর কোন ভয় রইল না।

    রাজার একটি ছেলে ছিল, আট বছর তার বয়েস। একদিন সে রাজবাড়ির উঠোনে খেলা করছে। খেলা করতে করতে তার সোনার গোলাটা গিয়ে পড়েছে খাঁচার মধ্যে। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে বললে—আমার গোলা ফিরিয়ে দাও।

    বুনো লোকটা বললে—যতক্ষণ না খাঁচার দরজা খুলে দিচ্ছ, পাবে না।

    ছেলেটি বললে—তা আমি পারব না। বাবার বারণ আছে। বলে সে পালিয়ে গেল।

    পরদিন ছেলেটি আবার এল তার গোল ফেরত চাইতে। লোকটি আবার বললে—তবে দরজা খুলে দাও! রাজপুত্র দরজা না খুলে ফের পালিয়ে গেল।

    তিন দিনের দিন রাজা গেলেন শিকারে। সেই সময় রাজপুত্র খাঁচার কাছে এসে বুনো মানুষটিকে বললে—দরজা খোলবার ইচ্ছে থাকলেও আমার দরজা খোলবার উপায় নেই। চাবি কোথায় পাব?

    বুনো লোকটি বললে—তোমার মায়ের বালিশের নিচে চাবি আছে। খুব সহজেই নিয়ে আসতে পারো।

    রাজপুত্রের গোলা ফিরে পাবার জন্যে বড় লোভ হল। সে আর কিছু না ভেবে চাবি নিয়ে এল। চাবি খুলতেই বুনো মানুষ বার হয়ে এসে ছেলেটিকে তার গোলা ফিরিয়ে দিলে। তারপর দিলে দৌড়। রাজপুত্র ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন—ও বুনো মানুষ, ও বুনো মানুষ, পালিও না! আমাকে তাহলে মারবে!

    বুনো মানুষ তাই শুনে ফিরে দাঁড়ালো। তারপর চট্‌ করে ছেলেটিকে নিজের কাঁধে তুলে তাড়াতাড়ি পা ফেলে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    রাজা বাড়ি ফিরতেই তাঁর চোখে পড়ল, খাঁচা খালি। রানীকে জিজ্ঞেস করলেন—কেমন করে হল এটা? রানী তো কিছুই জানতেন না, তিনি চাবি খুঁজতে চললেন। গিয়ে দেখলেন, চাবি নেই। রাজপুত্রকে ডাকা হল, কিন্তু তারও কোন সাড়া নেই। মাঠে লোক পাঠালেন রাজা ছেলেকে খুঁজতে, কিন্তু বৃথাই। ছেলে হারিয়ে গেছে। রাজা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারলেন কী হয়েছে। সারা রাজবাড়িতে বিষাদের ছায়া নেমে এল।

    বুনো মানুষটি যখন গভীর বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল, সে রাজপুত্রকে তার কাঁধ থেকে নামিয়ে বললে—তোমার আর বাপ-মার সঙ্গে কোনদিন দেখা হবে না। তবে, আমার কাছেই তুমি থাকবে, কারণ আমাকে তুমি দয়া দেখিয়েছ, আমাকে তুমি মুক্তও করেছ। আমি যা বলব তা যদি তুমি শোন তাহলে তোমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমার অনেক সোনা-দানা ধনরত্ন আছে। পৃথিবীতে এত কারো নেই।

    শুকনো শেওলা দিয়ে সে ছেলেটির জন্যে একটি বিছানা করে দিলে। রাজপুত্র তাতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরের দিন বুনো মানুষটি রাজপুত্রকে এক ঝরনার ধারে নিয়ে গিয়ে বললে—এই যে ঝরনা দেখছ, এ হচ্ছে সোনার ঝরনা। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ উজ্জ্বল এর জল। এর ধারে বসে তোমায় পাহারা দিতে হবে। দেখবে যাতে কোন জিনিস জলের মধ্যে না পড়ে, জল যেন অপবিত্র না হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে আমি দেখে যাব তুমি আমার হুকুম তামিল করেছ কি না।

    ছেলেটি ঝরনার ধারে বসে জল দেখতে লাগল। হঠাৎ হয়ত চোখে পড়ত, একটি সোনার মাছ কিংবা সোনার সাপ জলের মধ্যে দিয়ে ছুটে পালালো। খুব সাবধানে সে পাহারা দিত, যাতে জলে কিছুই এসে না পড়ে। একদিন এমনি যখন বসে আছে, হঠাৎ তার আঙুল ব্যথা করতে লাগল। ব্যথায় আর কিছু ভাবতে না পেরে সেই আঙুলটা সে ডুবিয়ে দিল জলে। তখনই তাড়াতাড়ি আঙুলটা তুলে নিয়ে দেখল, আঙুলের উপর সোনা ধরে গেছে। অনেক চেষ্টা করল সোনাটা মুছে ফেলতে, কিন্তু সোনার দাগ কিছুতেই উঠল না। সন্ধেবেলা বুনো মানুষটি ফিরে এল, এসে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললে—আজকে ঝরনায় কী হয়েছে?

    ছেলেটি আঙুলটা পিছনে লুকিয়ে থেকে বললে—কিছুই হয়নি! কিছুই হয়নি!

    বুনো মানুষ বললে—তোমার আঙুল জলে ডুবিয়েছিলে। এবারকার মতো কিছু বললুম না, কিন্তু এমন যেন আর কখনো না হয়।

    পরদিন সকালে ছেলেটি আবার ঝরনার ধারে বসল পাহারা দিতে। সেদিনও তার আঙুলে বড় ব্যথা। ব্যথার চোটে হাত তুলে চুলের মধ্যে যেই না আঙুল ঘসা, অমনি তার একটি চুল খসে পড়ল জলের মধ্যে। জল থেকে চুলটি তুলতে না তুলতেই সেটি সোনা হয়ে গেল। বুনো মানুষ সন্ধেবেলায় ফিরেই বুঝতে পারল কী হয়েছে।

    সে বললে—ঝরনার মধ্যে তুমি একটা চুল ফেলেছ। বেশ, এবারকার মতোও আমি ক্ষমা করলুম। কিন্তু তিনবার যদি হয় তাহলে ঝরনা অপবিত্র হবে, তুমি আর আমার সঙ্গে থাকতে পাবে না।

    তৃতীয় দিন ছেলেটি ঝরনার ধারে বসে আছে। আজ তার আঙুলে যতই ব্যথা হোক সে জলেও হাত ডোবাবে না, মাথায়ও হাত ঘসবে না। কিন্তু সময় আর কাটতে চায় না। ছেলেটি নিজের মুখের ছায়া জলের মধ্যে দেখতে পায় না। নিজের চোখটিকে ভাল করে দেখবার জন্যে যেই সে জলের কাছে মুখ এনেছে অমনি তার লম্বা চুল কাঁধের উপর থেকে ঝুলে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল। চমকে লাফিয়ে উঠল রাজপুত্র, কিন্তু ততক্ষণে তার সমস্ত মাথা-ভরা চুল সোনা হয়ে গেছে। জ্বলন্ত রোদের মতো ঝক্‌মক্‌ করছে সমস্ত মাথা। ছেলেটির হল মহা ভয়। সে পকেট থেকে রুমাল বার করে মাথায় বেঁধে মাথা ঢেকে ফেলল। বুনো মানুষের কাছে কিছুই অজানা থাকত না। সে এসেই বললে—মাথা থেকে রুমালটা খোল। রুমাল খুলতেই একমাথা সোনার চুল বেরিয়ে পড়ল।

    —পরীক্ষায় তুমি সফল হওনি। কাজেই তোমার আর এখানে থাকা চলবে না। পৃথিবী ঘুরে তোমায় দেখতে হবে—সেখানে তমি বুঝরে দারিদ্র্য কাকে বলে। তবে, তোমার মনটা ভাল। তাই তোমায় আমি একটি বর দেব। যদি কখনো তোমার বিশেষ প্রয়োজন ঘটে তাহলে বনে গিয়ে ডেকো—লোহার হান্স! ডাকলে আমি চলে আসব তোমায় সাহায্য করতে।

    রাজার ছেলে বন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। পথে বিপথে চলল সে। চলতে চলতে শেষে হাজির হল এক মস্ত শহরে। গিয়ে সে কাজ খুঁজল, কিন্তু কোন কাজ পেল না। কোন কাজই জানত না যাতে করে দু-পয়সা রোজগার হয়। অবশেষে সে রাজপ্রাসাদে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেখানে কোন চাকরি খালি আছে কি না। রাজার কর্মচারীরা ভেবেই পেলেন না তাকে কী কাজ দেওয়া যায়। কিন্তু ছেলেটির চেহারা দেখে তাঁদের বড় ভাল লাগল। তাই তাঁরা বললেন—আচ্ছা তুমি থাকো এখানে। শেষে রাজবাড়ির বাবুর্চি বললে—ও আমার কাছে থাক। কাঠ বয়ে আনুক, জল তুলুক, ছাই ঝাঁট দিক।

    একদিন হাতের কাছে আর কাউকে না পেয়ে বাবুর্চি তাকে বললে—আজ তুমি রাজার কাছে খাবার নিয়ে যাও। ছেলটি মাথায় একটি টুপি পরে তার সোনার চুল ঢেকে রাজার কাছে খাবারের থালা নিয়ে হাজির। এমন বেয়াদবি রাজা জীবনে কখনো দেখেননি, তিনি বললেন—রাজা-রাজড়ার সামনে যখন আসবে তখন টুপি খুলে আসতে হয় জানো না?

    ছেলেটি বললে—হায় মহারাজ! আমি তো টুপি খুলতে পারব না। আমার মাথায় একটা বিশ্রী কাটা!

    রাজা তখন রাঁধুনিকে ডেকে পাঠিয়ে ধমক দিয়ে বললেন—এমন ছেলেকে কেন সে কাজে নিয়েছে? এখনি তাকে বিদায় করা হোক! রাঁধুনির ছেলেটির জন্যে দুঃখ হল। সে মালীর কাছে গিয়ে মালীর একটি কাজের লোকের সঙ্গে এই ছেলেটিকে বদল করে নিল।

    সেই থেকে ছেলেটি বাগানে মাটি খুঁড়ত, নিড়োতো, গাছে জল দিত আর খাটত সারাদিন—রোদ বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে। একদিন গ্রীষ্মকালে সে একাই বাগানে কাজ করছে। ভারি গরম সেদিন। সে মাথা থেকে টুপিটা খুলে ফেলল একটু ঠাণ্ডা হবার জন্যে। তার মাথায় রোদ এসে পড়তে এমনই চক্‌চক্‌ করে উঠল যে তার আলো ঠিকরে গিয়ে পড়বি তো পড় একেবারে রাজকন্যার শোবার ঘরে। হঠাৎ আলো দেখে রাজকন্যা উঠে বসলেন দেখতে। দেখলেন বাগানে একটি ছেলে কাজ করছে। তিনি চেঁচিয়ে বললেন—কে ওখানে কাজ করছ, একটি ফুলের তোড়া নিয়ে এস তো!

    ছেলেটি তাড়াতাড়ি তার মাথায় টুপি পরে একগোছা বুনো ফুল তুলে তোড়া করে বাঁধল। রাজকন্যার কাছে যাবার পথে মালীর সঙ্গে দেখা। মালী বললে—তোমার কী আক্কেল! রাজকন্যাকে কি এইরকম ঘাসের ফুলের তোড়া দিতে হয়? ফেলে দিয়ে শিগগির ভাল ভাল দামি দামি ফুল দিয়ে একটা তোড়া তৈরি কর।

    ছেলেটি বললে—তা কেন? বাগানের ফুলের চেয়ে বুনো ফুলের গন্ধ অনেক মিষ্টি। রাজকন্যা এই পছন্দ করবেন।

    রাজকন্যার ঘরে ঢুকতেই রাজকন্যা বললেন—টুপি খুলে দাঁড়াও। আমার সামনে টুপি পরে আসা তোমার উচিত নয়।

    ছেলেটি বললে—আমার মাথায় একটা ঘা, তাই টুপি খুলতে পারছি না।

    রাজকন্যা তখন নিজেই এগিয়ে এসে এক ঝটকায় তার মাথা থেকে টুপিটা খুলে নিলেন। আর অমনি তার সব সোনার চুল ঝরনার জলের মতো তার কাঁধের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। দেখতে হল চমৎকার। ছেলেটি পালাবার চেষ্টা করতেই রাজকন্যা তার হাত ধরে তার হাতে একমুঠো মোহর দিয়ে দিলেন। ছেলেটির মোহরে বা সোনায় কোন লোভ ছিল না। সে সেগুলি নিয়ে মালীর ছেলেদের দিয়ে দিল খেলতে।

    পরের দিন রাজকন্যা আবার তাকে ডেকে পাঠালেন একগোছা বুনো ফুল তুলে দিয়ে যাবার জন্যে। ফুলগুলি নিয়ে আসতেই রাজকন্যা তার টুপিতে টান দিয়েছেন; কিন্তু ছেলেটি দু-হাতে মাথার টুপি চেপে ধরে রইল। রাজকন্যা আবার তাকে একমুঠো মোহর দিলেন। ছেলেটি আগের দিনেরই মতো সেগুলি মালীর ছেলেদের দিয়ে দিল। তৃতীয় দিনেও আবার সেই একই ব্যাপার। রাজকন্যা তার মাথার টুপি খুলে নিতে পারলেন না, ছেলেটিও নিজের কাছে মোহর রাখল না।

    এর কিছুদিন পরেই রাজ্যে শত্রু এসে হানা দিল। রাজা যোদ্ধাদের সবাইকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের শক্তিশালী বিরাট সেনানীর বিরুদ্ধে রাজার যোদ্ধারা লড়াইয়ে জিততে পারবে কি না সে সম্বন্ধে রাজার সংশয় গেল না। মালীর সাকরেদ এসে বললে—আমার যুদ্ধ করা অভ্যাস আছে। আমায় একটা ঘোড়া দিন, আমি যাব।

    তার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। বললে—আমরা চলে গেলে আস্তাবল খুঁজে দেখো, সেখানে একটা ঘোড়া পাবে, আমরা রেখে যাব।

    যোদ্ধারা চলে যেতে ছেলেটি আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া বার করল। পা তার খোঁড়া, খুঁড়িয়ে চলে ঠুক্‌-ঠুক্‌ করে। যাই হোক সে তাতেই চড়ে বনের দিকে চলল। বনের কিনারায় পৌঁছে সে তিনবার ডাকলে—যত জোরে পারে গলা ছেড়ে—লোহার হান্স—লোহার হান্স—লোহার হান্স! পাথর আর গাছপালা প্রতিধ্বনি করে ফিরিয়ে দিল তার ডাক।

    সঙ্গে সঙ্গে বুনো মানুষটি এসে বললে— কী চাও তুমি?

    —যুদ্ধে যাবার জন্যে আমি একটি ভাল ঘোড়া চাই।

    —ঘোড়া দেব। আরো কিছু চাও?

    —যা দেবেন দিন।

    বুনো মানুষ তখন বনে গিয়ে ঢুকল।

    একটু পরেই বন থেকে বেরিয়ে এল একজন সহিস, সঙ্গে একটা টগবগে তেজী ঘোড়া। ঘোড়ার নাক দিয়ে ঘড়-ঘড় আওয়াজ বার হচ্ছে। তাদের পিছনে একদল ঘোদ্ধা, গায়ে তাদের বর্ম; হাতের তলোয়ার রোদে চক্‌চক্‌ করছে। ছেলেটি তার তিনপেয়ে ঘোড়াটি সহিসের হাতে দিয়ে টগবগ ঘোড়ায় চড়ে যোদ্ধাদলের আগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।

    যখন সে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছল, তার আগেই রাজার দলের বহু সৈনিক মারা পড়েছে, আর বাকি সৈন্যদেরও সময় প্রায় হয়ে এসেছে। সেই সময় তার লৌহ-সৈনিকদের নিয়ে ছেলেটি শত্রুকে আক্রমণ করে কচুকাটা করে ফেললে। সামনে যে পড়ল তাকে আর আস্ত রাখল না। যারা পালাতে চেষ্টা করল ছেলেটি তাদের পিছনে ছুটে গিয়ে তাদেরও কেটে ফেললে।

    যুদ্ধজয় করে সে রাজার কাছে ফিরে না গিয়ে তার যোদ্ধার দল নিয়ে সোজা ফিরে গেল বনে। বনে গিয়ে ডাকল লোহার হান্সকে।

    বুনো মানুষ এসে জিজ্ঞেস করলে— কী চাও তুমি?

    —তোমার ঘোড়া ফিরিয়ে নাও। তোমার সৈন্য ফিরিয়ে নাও। আমার তিনপেয়ে ঘোড়া ফিরিয়ে দাও।

    তিনপেয়ে ঘোড়ায় চড়ে সে বাড়ি ফিরে চলল।

    রাজা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাসাদে ফিরতে রাজকন্যা ছুটে এলেন বাবার কাছে। কত প্রশংসা করলেন বাবাকে যুদ্ধে জেতার জন্যে। কিন্তু রাজা বললেন— আমি তো যুদ্ধ জিতিনি, একজন অজানা বীর তাঁর সৈন্য নিয়ে আমায় সাহায্য করতে এলেন, তিনিই আমায় জিতিয়ে দিয়েছেন।

    রাজকন্যা বললেন—কে সেই বীর?

    রাজা বললেন—তা তো জানি না। তিনি শত্রুদের তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর আর তাঁকে দেখা গেল না।

    রাজকন্যা গিয়ে মালীকে জিজ্ঞেস করলেন—তার সেই বাগানের ছোকরা কোথায়? মালী হাসতে হাসতে জবাব দিল—এইমাত্র তিনি তাঁর তেপেয়ে ঘোড়ায় চড়ে ফিরলেন। লোকে ঠাট্টা করে বলছে—যুদ্ধ করে ফিরলে দুল্‌কি-দাদা? কোন ঝোপের মধ্যে গিয়ে শুয়েছিলে দুল্‌কি-দাদা? আমার সাকরেদ জবাব দিলে—আমি তো যা করবার করেছি, আমি না থাকলে বিপদের উপর বিপদ হত। শুনে লোকেরা হো হো করে হাসছে।

    রাজা তাঁর মেয়েকে বললেন—আমি একটা মস্ত ভোজ দেব। তিন দিন ধরে চলবে ভোজ। তুমি সোনার আপেল ছুঁড়বে। যোদ্ধা আর বীরেরা সেই আপেল ধরবেন। হয়ত সেই অজানা বীরও আসতে পারেন।

    ভোজের কথা প্রচার হতেই ছেলেটি বনে গিয়ে লোহার হান্সকে ডাকলে।

    বুনো মানুষ জিজ্ঞেস করলে—কী চাও তুমি?

    —রাজকন্যার সোনার আপেল আমি ধরতে চাই।

    বুনো মানুষ বললে—আপেল তুমি পাবে। তোমায় একটা ভাল পোশাক দেব। আর খয়েরি রঙের এক ঘোড়া।

    ভোজের প্রথম দিন বীরবেশী যোদ্ধাদের মধ্যে গিয়ে ছেলেটিও দাঁড়ালো। কেউ তাকে চিনতে পারলেন না। রাজকন্যা কয়েক পা এগিয়ে এসে বীরদের মধ্যে আপেলটি ছুঁড়ে দিলেন। বীরদের মধ্যে ছেলেটিই আপেলটিকে লুফে নিল। নিয়েই সে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।

    দ্বিতীয় দিন লোহার হান্স তাকে দিল এক ছাই রঙের ঘোড়া। সেদিনও সে আপেল ধরে নিল। আর নিয়েই এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে আগের মতোই ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।

    রাজা চটে গেলেন। বললেন—এ কী ব্যবহার? ওর উচিত আমার কাছে এসে ওর নাম বলা।

    তিনি হুকুম জারি করলেন—এবার যদি যোদ্ধাটি পালায় তাহলে তার পিছনে ঘোড়সওয়ার ছুটে তাকে ধরে আনবে।

    তৃতীয় দিন লোহার হান্স তাকে দিল এক তেজী কালো ঘোড়া।

    আবার সে আপেল ধরল। কিন্তু যেই সে ঘোড়া ছুটিয়ে পালাতে যাবে, রাজার অনুচরেরা তাকে তাড়া করল। একজন অনুচর এত কাছে এল যে তার পায়ে আঘাত করল। তবুও তারা তাকে ধরতে পারল না। কিন্তু দারুণ তেজে যখন তার ঘোড়া লাফ দিয়ে ছুটেছে সেই সময় তার মাথা থেকে শিরস্ত্রাণ খুলে গেল আর সবাই দেখতে পেল, তার মাথায় সোনার চুল। কাজেই তারা ফিরে গিয়ে রাজাকে বললে তারা কী দেখেছে।

    পরের দিন রাজকন্যা মালীকে ডেকে তার সাকরেদদের কথা জিজ্ঞেস করলেন।

    —সে তো বাগানে কাজ করছে। ছেলেটো ভোজে গিয়েছিল; কাল রাত্রে সবে ফিরেছে। আমার ছেলেদের তিনটে সোনার আপেল দিয়েছে। বললে নাকি বাজি জিতেছে।

    রাজা শুনে হুকুম দিলেন—ছোকরাকে তাঁর সামনে আনা হোক। যখন সে এল তখনও তারা মাথা টুপি দিয়ে ঢাকা। কিন্তু রাজকন্যা গিয়েই তার টুপি এক টানে খুলে ফেললেন। খুলতেই তার সমস্ত সোনার চুল কাঁধের উপর দিয়ে এলিয়ে পড়ল। এত সুন্দর সে চুল, যে দেখল সে-ই অবাক হয়ে গেল।

    রাজা জিজ্ঞেস করলেন—তুমিই কি প্রত্যেক দিন বীর সেজে এক-একটি নতুন নতুন রঙের ঘোড়ায় চেপে তিনটি সোনার আপেল লুফে নিয়েছিলে?

    সে বললে—হ্যাঁ। এই বলে পকেট থেকে আপেলগুলি বার করে রাজার হাতে দিয়ে বললে—আরও যদি প্রমাণ চান এই দেখুন আমার পায়ে আপনার অনুচর মেরেছে। আমিই হচ্ছি সেই বীর যে আপনাকে যুদ্ধে জিতিয়ে দিয়েছিল।

    —এত যদি তুমি করতে পারো তাহলে তো তুমি মালীর ছেলে নও! বল তোমার বাবা কে?

    —আমার বাবা একজন শক্তিশালী রাজা।

    রাজা বললেন—বুঝলুম এবার। দেখ বাপু, তোমার কাছে আমরা এত ঋণী যে তোমাকে কী দিয়ে খুশি করতে পারি বুঝতেই পারছি না। তুমিই বল।

    সে বললে—আপনার কন্যাকে দিন।

    রাজকন্যা হেসে বললেন—দেখুন বাবা, উনি ঘুরিয়ে কথা বলতে জানেন না। সোজা বলছেন। আমি অবশ্য অনেক দিনই বুঝেছি যে উনি মালীর ছেলে নন।

    বিয়েতে ছেলেটির বাপ মা, রাজা আর রানী দু-জনেই এলেন। এতদিনের হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে তাঁদের আর আনন্দের শেষ রইল না।

    যখন বিয়ের ভোজ চলছে, হঠাৎ বাজনা বন্ধ হয়ে গেল। দরজা গেল খুলে, আর সবাই দেখলে—একজন মস্ত রাজা আর তাঁর পিছনে সারি-সারি অনুচর। সার বেঁধে সবাই এসে সভায় ঢুকছেন। মস্ত রাজা বরের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কোলাকুলি করে বললেন—আমি হচ্ছি লোহার হান্স। জাদু করে আমাকে বুনো মানুষ করে রেখেছিল। তুমি সে জাদু ভেঙেছ। আমি আজ মুক্ত। আমার যত কিছু সম্পত্তি আছে আজ থেকে সবই তোমার।

    টীকা