Chapter Index

    একটি ভারি ছোট্ট মিষ্টি খুকি ছিল। যে তাকে দেখত সেই তাকে ভালোবাসত। আর সবচেয়ে ভালোবাসতেন তাকে তার দিদিমা। তিতি নাতনিকে নিয়ে সারাদিন কী যে করবেন ভেবে পেতেন না। একবার তিনি তাকে একটি ছোট্ট লাল মখমলের মাথা-ঢাকা ঝোলা কোট করে দিলেন। সেই কোট পরে তাকে এমন চমৎকার মানালো আর খুকিটির সেটি এত ভাল লাগল যে সে আর অন্য কিছুই গায়ে দিতে চাইত না। সেই থেকে সবাই তাকে লাল-ঢাকা খুকি বলে ডাকত।

    একদিন তার মা তাকে ডেকে বললেন— এদিকে শোন তো লাল-ঢাকা খুকি! এই কেক আর সরবত নিয়ে তোমার দিদিমার কাছে যাও তো। তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন, অসুখ করেছে। এই খেলে তাঁর উপকার হবে। তাড়াতাড়ি যাও, রোদের তাপ বেড়ে ওঠবার আগে। রাস্তায় এদিক-ওদিক কোরো না, হেঁচট খেয়ে পোড়ো না, বোতল ভেঙো না ; দিদিমা তাহলে আর সরবত খেতে পাবেন না। দিদিমার কাছে যখন পৌঁছবে দিদিমাকে ভালো করে নমস্কার বলতে ভুলো না।

    লাল-ঢাকা খুকি বললে— যা বলছ মা সবই করব।

    দিদিমা বেশ কিছু দূরে বনের মধ্যে থাকতেন— গ্রাম থেকে আধঘণ্টার পথ। বনের কাছে আসতেই খুকির সঙ্গে এক নেকড়ের দেখা। কিন্তু নেকড়েরা যে কী রকম দৌরাত্ম করে খুকিটি তার কিছুই জানত না, তাই সে নেকড়ে দেখে একটুও ভয় পেল না।

    নেকড়ে বললে— নমস্কার, লাল-ঢাকা খুকি।

    খুকি বললে— নমস্কার নেকড়ে মশাই।

    —এত সকালে কোথায় চললে লাল-ঢাকা খুকি?

    —দিদিমার বাড়ি।

    —তোমার ঝুড়িতে কী?

    —কেক আর সরবত। কাল আমরা কেক তৈরি করেছি, তারই একটা নিয়ে যাচ্ছি দিদিমার জন্যে। এইরকম কিছু খেলে তবে দিদিমার শরীর ভালো হবে।

    —তোমার দিদিমা থাকেন কোথা লাল-ঢাকা খুকি?

    —এখান থেকে পোয়া ঘণ্টার পথ বনের মধ্যে। বাদাম গাছের বেড়ার কাছে যে ওক গাছ, তারই নিচে দিদিমার বাড়ি। আপনি দেখেছেন নিশ্চয়।

    নেকড়ে ভাবলে, এই নরম কচি মেয়েটাকে খেতে বেড়ে লাগবে। বুড়িটার চেয়ে অনেক ভালো। তা হোক, চালাকি করে দুটোকেই খেতে হবে।

    সে লাল-ঢাকা খুকির সঙ্গে খানিকক্ষণ হাঁটল, তারপর বললে— কী সুন্দর ফুল! একটু চারিদিকে তাকিয়ে দেখছ না কেন লাল-ঢাকা খুকি? পাখিদের গান, তা-ও বোধহয় তোমার কানে ঢুকছে না? এত গম্ভীর হয়ে চলেছ যে মনে হচ্ছে তুমি স্কুলে যাচ্ছ! বনের মধ্যে দেখছ না সবকিছু কেমন আনন্দে ভরে উঠেছে?

    লাল-ঢাকা খুকি চোখ তুলে দেখল। যখন দেখল গাছের ডালের ফাঁকে সূর্যের আলো নাচছে, আর চারিদিকে রঙিন ফুলের মেলা, সে ভাবলে— একগোছা টাটকা ফুল তুলে যদি দিদিমাকে দিই তিনি নিশ্চয় খুব খুশি হবেন। এখনও একটুও বেলা হয়নি। ফুল তোলবার যথেষ্ট সময় রয়েছে।

    এই ভেবে সে পথ ছেড়ে গাছ-পালার মধ্যে গিয়ে ঢুকল ফুল তুলতে। যতবার সে একটা সুন্দর ফুল তোলে ততবারই দেখে, একটু দূরে তার চেয়েও ভাল আর-একটা ফুল রয়েছে। এমনি করে সে একটু একটু করে গভীর থেকে আরো গভীর বনে ঢুকে পড়ল।

    এই সুযোগে নেকড়ে বাঘ সোজা দিদিমার বাড়ি পৌঁছে দরজায় ধাক্কা দিলে।

    —কে ধাক্কা দেয়?

    —আমি লাল-ঢাকা খুকি, তোমার জন্যে কেক আর সরবত এনেছি। দরজা খোল।

    বুড়ি চেঁচিয়ে বললে— হুড়কোটা নামিয়ে দাও। আমি বড় দুর্বল, উঠতে পারব না।

    নেকড়ে হুড়কো নামিয়ে দিতেই দরজা খুলে গেল। কোন কথা না বলে নেকড়ে সোজা বিছানার কাছে গিয়ে বুড়ি বেচারাকে এক গ্রাসে কপাৎ করে গিলে ফেললে। তারপর বুড়ি যে জামা পরেছিল তাই পরে, যে টুপি পরেছিল তাই পরে বিছানায় ঢুকে মশারি টেনে দিলে।’

    লাল-ঢাকা খুকি এত ফুল তুলল যে সে আর বইতে পারে না। তখন তার দিদিমার কথা মনে পড়ল। দিদিমার বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখলে, দরজা খোলা। ব্যাপারটা বুঝল না। তার আশ্চর্য লাগল। তারপর যখন সে ঘরে ঢুকল, তার মনে হল সবই যেন কেমন অদ্ভুত। কেন সে নিজেই জানে না, কিন্তু তার ভয় করতে লাগল। সে ভাবলে— বরাবর তো আমার দিদিমার কাছে আসতে খুব আনন্দ হয়, এবার এমন কেন হচ্ছে?

    লাল-ঢাকা খুকি বললে— প্রণাম হই দিদিমা। কিন্তু কোনো জবাব এল না।

    তখন সে বিছানার কাছে গেল। গিয়ে মশারি খুলে দিলে। দেখল বিছানায় দিদিমা শুয়ে আছেন কিন্তু টুপি দিয়ে মুখ ঢাকা, আর কেমন যেন অদ্ভুত দেখতে হয়েছে তাঁকে।

    —ও দিদিমা, তোমার কানগুলো অমন লম্বা কেন?

    —তোমায় কথা ভাল করে শুনব বলে, নাতনি।

    —দিদিমা তোমার চোখ অমন বড়-বড় কেন?

    —তোমায় ভাল করে দেখব বলে, নাতনি!

    —অমন বড় বড় হাত কেন তোমার দিদিমা?

    —তোমায় ভাল করে ধরব বলে।

    —ও দিদিমা, কী বড়-বড় দাঁত তোমার!

    —তোমায় ভাল করে খাব বলে!

    এই না বলে নেকড়ে বিছানা থেকে এক লাফে বেরিয়ে কপ করে বেচারা লাল-ঢাকা খুকিকে একগ্রাসে গিলে ফেলল। পেট ভরে খেয়ে নেকড়ে আবার বিছানায় গিয়ে ঢুকল আর একটু পরেই রীতিমত আওয়াজ করে নাক ডাকাতে লাগল।

    বাডির পাশ দিয়ে একজন শিকারী যাচ্ছিল, সে সেই শব্দ শুনে ভাবল— বাপ্‌রে বুড়ি কী জোর নাক ডাকাচ্ছে! দেখি একবার ঢুকে! সব ঠিক আছে তো!

    এই ভেবে সে বাড়িতে ঢুকে দেখে, বুড়ির বিছানায় নেকড়ে বাঘটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

    শিকারী বললে— ওরে ব্যাটা পুরোনো পাপী! তোকে আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি!

    সে বন্দুক তুলে তাকে মারতে যাবে, এমন সময় তার মনে হল, নেকড়েটা হয়ত বুড়িকে খেয়েছে, চেষ্টা করলে এখনও বুড়িকে বাঁচানো যায়। পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বার করে শিকারী ঘুমন্ত নেকড়ের পেট কাটতে শুরু করে দিলে। একটু কাটতেই লাল রঙের একটা জামা চোখে পড়ল। আর দু-একটা চোপ লাগাতেই লাল-ঢাকা খুকি লাফিয়ে বেরিয়ে এসে বললে— উঃ কী ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলুম! নেকড়ের ভিতরটা কী অন্ধকার! তারপর বুড়ি দিদিমা বেরিয়ে এলেন। তখনও বেঁচে আছেন, কিন্তু দম প্রায় বন্ধ।

    লাল-ঢাকা খুকি কতকগুলো বড় বড় পাথর নিয়ে এল ; তাই দিয়ে নেকড়ের পেটটা ভরে সেলাই করে দিলে। নেকড়ে ঘুম ভেঙে উঠে লাফিয়ে পালাতে গেল। কিন্তু পাথরের ভারে টলে পড়ল, আর সেইখানেই মারা গেল।

    এবার সকলেই খুশি হল। শিকারী নেকড়ের ছাল ছাড়িয়ে ছালটা নিয়ে বাড়ি গেল। দিদিমা নাতনির আনা কেক আর সরবত খেলেন। খেয়ে তিনি গায়ে বল পেলেন। লাল-ঢাকা খুকি মনে মনে বললে— মা যদি বারণ করেন তাহলে আর আমি কখনও বনের মধ্যে পথ ছেড়ে এদিকে ওদিকে ঘুরব না!

    টীকা