কাঁপুনি শেখার গল্প
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক বাপের দুই ছেলে। বড় ছেলে চালাক চতুর বুদ্ধিমান। আর ছোট ছেলে এত বোকা যে সে কিছু শিখতেও পারত না, বুঝতেও পারত না। লোকে বলত এই বোকা ছেলে বাপের পক্ষে এক মস্ত বোঝা হয়েছে।
বাপের যা কিছু কাজ বড় ছেলে জ্যাককেই করতে হত, এমনকি চিঠিপত্র খবরাখবর নিয়ে যাওয়া—সব। ছোট ভাই হান্স না পারত বুঝতে না পারত মনে রাখতে। কিন্তু জ্যাক ছিল বেজায় ভীরু। বাপ যদি তাকে সন্ধেবেলায় কোথাও পাঠাতে চাইত আর পথে পড়ত গোরস্থান, জ্যাক বলত— না বাবা ওখান দিয়ে আমি যেতে পারব না! ভয়ে আমার কাঁপুনি লাগে!
ছোট ছেলেটি এক কোণে বসে তাই শুনত আর চোখ বড় বড় করে বলত— ভয়ে কাঁপুনি জিনিসটা কী? নিশ্চয় ভারি চমৎকার কিছু!-ভয়ে যদি আমি হি-হি করে কাঁপতে পারতুম, কী ভালই লাগত!
শেষে একদিন তার বাবা তাকে বেশ স্পষ্ট করে বললেন— শোন্, সারাদিন তুই কোন কাজ করিস না—এ তার চলবে না। এখন তুই বড় হচ্ছিস, গায়ে জোর হচ্ছে : এবার তোকে নিজে হাতে রোজগার করা শিখতে হবে। দ্যাখ্ তোর বড় ভাই কেমন কাজের, আর তুই সারাদিন দৌড়-ঝাঁপ করে সময় কাটাস।
ছোট ছেলেটা বললে— দেখুন বাবা, আপনি যখনই বলবেন তখনই আমি নিজে হাতে রোজগার করা শিখব। কিন্তু একবার যদি ভয়ের কাঁপাটা শিখে নিতে পারতুম তাহলে আর আমার ভাবনা থাকত না।
তার এই বক্তৃতা শুনে দাদা হাসল আর মনে মনে বললে— ভাইটির মাথায় কোনই বুদ্ধি নেই। ওকে রাস্তা ঝাঁট দিতে হবে এই বলে দিলুম—নইলে উপপাস। এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
তার বাবা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন— ও শিখে কি রোজগার করা যায় রে, বোকা? অন্য কিছু শিখতে হয়। কিন্তু কাঁপুনি তোকে শিগগিরই শিখতে হবে সন্দেহ নেই।
ঠিক এই সময় গির্জের যাজক তাদের বাড়িতে এসে ঢুকলেন। ছোট ছেলেটিকে নিয়ে বাবা কী বিপদে পড়েছেন সব বললেন যাজককে।
—যখন বললুম যাতে রোজগার করতে পারিস তার জন্যে কিছু শেখ্,কী উত্তর দিল জানেন যাজকমশাই?
যাজক বললেন— নিশ্চয় বোকার মত কিছু?
—বোকার মত বলে বোকার মত? বলে, শিখতে যদি হয় ভয়ের কাঁপা শিখব। এখনও ভয়ে কাঁপতে জানি না।
যাজক বললেন— বেশ ভো ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি ঠিক শিখিয়ে দেব। আমার কাছে থাকলে ভয়ের কাঁপুনি শিখতে বেশিদিন লাগবে না
বাপ শুনে খুব খুশি হলেন। বোকা ছেলে যদি যাজকের কাছ থেকে কিছু উপকার পায় তো তার পক্ষে ভালই হবে। যাজক সেইদিনই তার ভার নিলেন ; নিয়ে তাকে গির্জের চুড়োর ঘরে নিয়ে গিয়ে কেমন করে গির্জের ঘণ্টা বাজাতে হয় দেখিয়ে দিলেন। বেশ লাগল তার কাজটা। দু-দিন ঘণ্টা বাজাবার পর তিনদিনের দিন মাঝরাতে যাজকমশাই এসে ঢুকলেন তার ঘরে। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন— যাও আজ তোমায় রাত বারোটার ঘণ্টা বাজাতে হবে। গির্জের সবচেয়ে উঁচু যে চুড়ো সেইখানে ওঠ গিয়ে।
যাজক মশাই মনে মনে বললেন— এইবার তোমায় ভয়ের কাঁপুনি কাকে বলে শেখাচ্ছি, দাঁড়াও। এই বলে তিনি নিজের ঘরে ফিরে না গিয়ে যে কাণ্ড করলেন তা এবার বলছি। ছেলেটি তার ঘর থেকে বেরিয়ে কবরখানা হয়ে সিঁড়ি বেয়ে চুড়োর ঘরে উঠতে লাগল। তার মনে বিন্দুমাত্র ভয় ছিল না। কিন্তু যেই সে ঘণ্টার দড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছল, দেখতে পেলে সাদা পোশাক পরা এক মূর্তি সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সে চেঁচিয়ে বললে— কে ওখানে? কিন্তু মূর্তি নড়লও না চডলও না, জবাবও দিলে না। ছেলেটি বললে— জবাব দাও, আর না হলে এখান থেকে ভাগো। এখানে তোমার কী কাজ?
যাজক নিজে কাপড় মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছেলেটিকে ভয় দেখাবার জন্যে। তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন। তিনি চান ছেলেটি তাঁকে ভূত ভাবুক। কিন্তু হান্স ভয় পেল না, ভূতও ভাবল না। সে আবার চেঁচিয়ে বললে— কী চাও তুমি এখানে? যদি ভালো লোক হও তো উত্তর দাও, না হলে তোমায় সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে ফেলে দেব।
যাজক ভাবলেন, মুখে বললেও সত্যিই কি আর তাই করবে? তাই তিনি কোনো জবাব দিলেন না, চুপটি করে রইলেন যেন পাথরে গড়া। হান্স বললে— আর-একবার আমি জিজ্ঞেস করছি, তুমি কী চাও? তবুও যখন কোনো জবাব এল না সে সেই নকল ভূতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দিল এক ধাক্কা। দিতেই সে গড়াতে গড়াতে দশ ধাপ সিঁড়ির নিচে গিয়ে পড়ল। পড়েই স্থির।
হান্স তখন ঘণ্টার কাছে গিয়ে ঢং ঢং করে গুণে গুণে বারো বার বাজিয়ে দিলে। তারপর ঘরে গিয়ে কোনো কথা না বলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
যাজকের স্ত্রী অনেকক্ষণ তাঁর স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করে যখন দেখলেন তিনি বাড়ি ফিরলেন না তখন তাঁর ভয় হল। তিনি হান্সকে ঠেলে তুললেন। বললেন— হান্স, আমার স্বামীর ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন বল তো? তিনি তো তোমার সঙ্গে গির্জের চূড়ায় গিয়েছিলেন না?
—আমি যখন ঘণ্টা-ঘরের কাছে যাচ্ছিলুম সিঁড়ির মাথায় কে একজন সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বারবার জিজ্ঞেস করাতেও সে কোন উত্তর দিল না। আমি ভাবলুম তাহলে নিশ্চয় চোর। তাই তাকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দিলুম। চলুন গিয়ে দেখা যাক কে। যদি আপনার স্বামী হন তাহলে আমায় ক্ষমা করবেন। আমি তো জানতুম না!
পুরোহিতের স্ত্রী ঘণ্টাঘরের নিচে ছুটে গিয়ে দেখলেন, তাঁর স্বামী এক কোণে, পড়ে গোঙাচ্ছেন। তাঁর একটা পা ভেঙে গেছে। তিনি তখন হান্সের বাবার কাছে গিয়ে ভীষণ বকাঝকা শুরু করলেন। চেঁচিয়ে বললেন— তোমার ছেলে আমার বাড়ি অপয়া করে দিয়েছে। আমার স্বামীকে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে ফেলে তাঁর পা ভেঙে দিয়েছে। আর তার স্থান আমার বাড়িতে হবে না। এখনই তাকে নিয়ে যাও।
হান্সের বাবা বেজায় বিরক্ত হলেন। ছেলেকে ফিরিয়ে আনিয়ে বকতে লাগলেন— হতভাগা ছেলে! হাড়মাস আমার ভাজা ভাজা করে ছাড়ল!
ছেলেটি বললে— শুনুন বাবা, কী হয়েছিল! আমি কোনো দোষ করিনি। দেখলুম রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে প্রকাণ্ড একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলুম নিশ্চয় ওর কোনো বদ মতলব। কী করে বুঝব যে যাজক মশাই? তিন বার আমি তাকে সাবধান করে দিয়েছি। কোন উত্তর নেই। বার বার যদি আমার কথার উত্তর না দেয় তাহলে আর আমি কী করতে পারি?
বাবা বললেন— হাঁ হ্যাঁ, তুমি হচ্ছ আমার জীবনের কাঁটা! বেরোও আমার চোখের সামনে থেকে, আর যাতে তোমার মুখ না দেখতে হয়!
—হ্যাঁ বাবা, কালই আমি চলে যাচ্ছি। তাতে আমার একটুও দুঃখ হবে না। আসল কথা, যদি আমি ভাল করে ভয়ের কাঁপুনি আর খিঁচুনি শিখতে পারি তাহলে কি আর রোজগারের ভাবনা থাকে?
বাবা বললেন— যা খুশি শেখ গে, আমার কাছে সবই সমান। এই নাও পঞ্চাশটা টাকা। নিয়ে যেখানে খুশি চলে যাও। কিন্তু কাউকে বোলো না তোমার গ্রামের নাম কি অথবা কে তোমার বাবা। তোমায় ছেলে বলে পরিচয় দিতে আমার ঘেন্না করে!
হান্স বললে— আপনি যেমন বলছেন ঠিক তাই আমি করব।
পরদিন সকাল হতেই ছেলেটি পকেটে পঞ্চাশটি টাকা ফেলে নামল এসে বড় রাস্তায়। নিজের মনে বলতে লাগল— কবে আমি ভয়ে কাঁপতে শিখব? কবে আমি খিঁচুনি শিখব? কবে আমি ভয় পেতে শিখব?
একটু পরেই একজন লোকের সঙ্গে দেখা। তখনও সে বিড়বিড় করে কাঁপুনি শেখার কথা বলছে। শুনে তিনি বুঝলেন যে এ ছেলেটি ভয় কাকে বলে জানে না। তিনি ছেলেটির সঙ্গে ছেলেটির সঙ্গে কিছুদূর হেঁটে এক জায়গায় এসে পৌছলেন। সেখানে দেখা গেল একটা ফাঁসি-কাঠ।
লোকটি বললে— ঐ যে দেখতে পাচ্ছ একটি গাছ, ওখানে সাতজন লোকের দড়িওয়ালার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। দড়িওয়ালার মেয়ের সঙ্গে বিয়ের মানে বুঝছ তো? ঐ চেয়ে দেখ, ওরা সবাই শিখছে কেমন করে ঝুলতে হয় আর দুলতে হয়। তুমি যদি এইখানে চুপটি করে বসে বসে ওদের দেখ তাহলে আজ রাত্রের মধ্যেই তুমি শিখে ফেলতে পারবে কাঁপুনি কাকে বলে।
ছেলেটি বললেন— বাঃ, এমন সুযোগ তো কখনও পাইনি! বেশ সহজ রাস্তাই তো পাওয়া গেল। আপনি কাল সকালে একবার আমার কাছে আসবেন। এতে যদি আমা শেখা হয়ে যায় তাহলে আমার পঞ্চাশটি টাকা আপনাকে দিয়ে দেব।
হান্স গিয়ে বসল ফাঁসি-কাঠের তলায়। বসে অপেক্ষা করতে লাগল কখন রাত হয়। শীত করে আসায় সে একটা আগুন জ্বালালে। কিন্তু মাঝরাতে যখন একটা কনকনে আর শনশনে হাওয়া উঠল তখন আগুনটাকে বড় করে দিয়েও দেখে, তার শীত যায় না।
হাওয়ায় ফাঁসিতে লটকানো দেহগুলি এদিক-ওদিক করে দুলতে থাকল। হান্স ভাবলে, আগুনের ধারে বসেই যদি আমার এত শীত করে, আহা, ও বেচারারা ঐ খোলা হাওয়ায় নিশ্চয় একেবারে জমে যাচ্ছে। তার মনে দয়া হল। ফাঁসি-কাঠে উঠে গিয়ে দড়ি আলগা করে সে একে-একে সাতটা মড়াই নামিয়ে আনল। তারপর মড়াগুলোকে কাছে বসিয়ে আগুনে খোঁচা দিয়ে এমন গনগনে করে দিল যে তাদের কাপড় পুড়ে যেতে লাগল। তাতেও মড়াগুলো নড়ে বসে না দেখে হান্স বললে— সরে বসো না! দেখ না, কাপড় পুড়ে যাচ্ছে! না বসো তো আবার তোমাদের টাঙিয়ে দিয়ে আসব। কিন্তু মড়াগুলো তার কথা শুনতে পেলো না। তারা বসেই রইল, তাদের ছেঁড়া কাপড়ও পুড়তে লাগল। হান্স তখন রেগে গেল। বললে, যদি সরে না বসো তাহলে ভাল হবে না। তোমাদের পুড়তে দিতে পারব না আমি। আবার টাঙিয়ে আসব। এই বলে সে আবার সাতটা মড়াকে নিয়ে গিয়ে সারবন্দী করে টাঙিয়ে দিয়ে এসে আগুনের ধারে শুয়ে পড়ল।
পঞ্চাশ টাকার লোভে লোকটি সকালবেলা এসে হাজির। তিনি বললেন— আশা করি তুমি এবার ভয়ে কী করে কাঁপতে হয় তা শিখে ফেলেছ?
সে বললে— কই আর শিখলুম? ঐ যাঁরা ঝুলছেন তাঁরা তো এর একটি কথাও বললেন না। আমি যখন ওঁদের সকলকে নামিয়ে আগুনের ধারে বসিয়ে দিলুম, কেউ নড়ে পর্যন্ত বসলেন না, কাপড়ই পুড়ে যেতে লাগল ওঁদের। আবার যদি আমি ওঁদের টাঙিয়ে দিয়ে না আসতুম তো ওঁরা পুড়েই যেতেন।
শুনে লোকটি এমন ভয় পেয়ে গেল যে আর একটি কথা না বলে উঠে চলে গেল। পঞ্চাশ টাকার কথা উচ্চারণও করলে না।
হান্স তখন আবার চলতে আরম্ভ করলে আর নিজের মনে বলতে থাকল— ভয়ের কাঁপুনি জিনিসটা কী? খিঁচুনি জিনিসটা কী? কেমন করে তা শিখি?
একজন গাড়িওয়ালা ঘোড়া আর গাড়ি নিয়ে আসছিল, সে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল— কে গো তুমি?
—জানি না।
—এখানে এসেছ কেন?
—তা বলতে পারব না।
—তোমার বাবা কে?
—বলবার সাহস নেই।
—বিড়বিড় করে কী বলছিলে এতক্ষণ?
—আমি ভয়ে কাঁপা শিখতে চাই।
গাড়িওয়ালা বললে— যে কথার মানে হয় না এমন কথা বোলো না। আমার সঙ্গে এসো। আমি তোমায় দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। দেখবে যে আরো অনেক ভালো জিনিস শেখবার আছে।
হান্স গাড়িওয়ালার সঙ্গে চলল। সন্ধেবেলা তারা এক সরাইখানায় এসে পৌঁছল রাত কাটাবার জন্যে। ঘরে ঢুকতেই হান্স বিড়-বিড় করে উঠল— ওঃ, যদি ভয়ের কাঁপুনিটা শিখে নিতে পারতুম!
সরাইওয়ালার কানে গেল কথাটা। তিনি হেসে বললেন— এই যদি তোমার ইচ্ছে, তাহলে আমি একটা জায়গা জানি যেখানে খুব সহজে তুমি ভয়ের কাঁপুনি শিখতে পারবে।
সরাইওয়ালার বৌ বললেন— চুপ কর! কৌতূহল দেখাতে গিয়ে কত লোকের প্রাণ গেছে। এই সুন্দর নীল-চোখ ছেলেটিকে ওখানে কি পাঠাতে আছে? ষাট!
কিন্তু হান্স শুনে লাফিয়ে উঠল, বললে— আপনি যেমন বলছেন সত্যিই যদি জায়গাটা অত খারাপ হয় তাহলে আমি একবার গিয়ে দেখি। আমি শুধু ভয়ে কাঁপা শিখতে চাই। আর কিছু চাই না। বলুন আমায় কী করতে হবে। এই বলে হান্স সরাইওয়ালার সঙ্গে লেগে রইল। যতক্ষণ না তিনি সব বুঝিয়ে বললেন, ছাড়ল না।
সরাইওয়ালা শেষে বললেন— এখান থেকে খুব দূরে নয়, এক মায়াপুরী আছে। সেই প্রাসাদের মধ্যে থাকলেই তুমি ভয়ের কাঁপুনি ভয়ের খিঁচুনি শিখতে পারবে। এ দেশের রাজা বলেছেন, যদি কেউ তিন রাত সেই প্রাসাদে শুয়ে কাটাতে পারে তাহলে তিনি তাকে রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দেবেন। আর রাজকন্যার মত অমন রূপসী কন্যা দুনিয়ায় নেই। প্রাসাদে বহু ধনরত্ন ভূতেরা পাহারা দেয়। সেই ভূতদের মেরে তাদের হাত থেকে যদি কেউ ঐ রত্ন উদ্ধার করতে পারে তাহলে তার মত বড়লোক আর কেউ থাকবে না। অনেক আশা নিয়ে অনেক লোক সেই মায়াপুরীতে গিয়ে ঢুকেছে কিন্তু তারা কেউ কোনদিন ফেরে নি।
হান্সের এসব শুনে একটুও ভয় হল না। তার পরদিন সকালবেলা সে রাজার সঙ্গে দেখা করতে চলল। তাকে দেখে রাজার বেশ ভালই লাগল। রাজা বললেন তুমি কী সত্যিই ঐ মায়াপুরীতে তিন রাত কাটাতে চাও?
হান্স বললে— মহারাজ, আমায় অনুমতি দিন।
রাজা বললেন— তুমি কিন্তু সঙ্গে করে আর কোন প্রাণীকে নিয়ে যেতে পারবে না। আর কিছু তোমার দরকার?
হান্স বললে— আমায় শুধু একটু আগুন করবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একটা কুঁদ যন্ত্র, একটা বড় ছুরি আর একতক্তা কাঠ।
রাজা বললেন— বেশ। হান্স তখন এইসব নিয়ে দিন থাকতে প্রাসাদে গিয়ে উঠল। যখন রাত হল সে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে আশ্রয় নিল। একটা আগুন জ্বালালো। আগুনটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল। আগুনের ধারে কাঠের তক্তাটা আর কুঁদ-যন্ত্র রেখে তক্তাটার উপর বেশ আরাম করে চেপে বসল। বসেই বললে— আহা, কবে আমি ভয়ে কাঁপা শিখব? এখানে শিখতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না। এখানে যে দিব্যি আরাম!
কিন্তু মাঝরাতে যেই সে আগুনটাকে খোঁচা দিয়ে গনগনে করে তুলেছে অমনি হঠাৎ এক কোণ থেকে একটা বেড়ালের গলা শোনা গেল— মিউ, মিউ! কী ঠাণ্ডারে বাবা!
হান্স বললে— আচ্ছা বোকা তো! ওখানে ঠাণ্ডার মধ্যে বসে আছ কেন? আগুনের ধারে এসে বসে গরম হয়ে নাও।
বলতেই দুটো প্রকাণ্ড কালো বেড়াল লাফ দিয়ে এসে আগুনের দুপাশে বসল। বসে হান্সের দিকে কটমট করে রাগত চোখে তাকিয়ে রইল। আগুনরে তাপে একটু গরম হবার পর তারা বললে— বন্ধু, একটু তাস খেলবে নাকি?
হান্স বললে— নিশ্চয়, নিশ্চয়। কিন্তু আগে তোমাদের পাগুলো বাড়াও দেখি। নখ পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
বেড়ালরা তাদের থাবা বাড়িয়ে দিল। হান্স বললে— বাস্রে! কত বড় বড় নখ তোমাদের! যাক, তোমাদের আঙুল যখন দেখেই নিয়েছি তখন আর তোমাদের সঙ্গে তাস খেলে দরকার নেই।
এই বলেই বেড়ালদুটোকে দু-ঘায়ে মেরে ফেলল। মেরে তাদের জানলার বাইরে দিয়ে গড়খাইয়ে ফেলে দিয়ে আবার আগুনের ধারে এসে বসল। ভাবলে এইবার বোধহয় একটু বিশ্রাম পাওয়া যাবে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত যেতে না যেতেই ঘরের চার কোণ থেকে দলে দলে কালো বেড়াল আর কালো কুকুর বেরিয়ে আসতে থাকল একের পিছনে এক— তার যেন শেষ নেই। তারা ম্যাও ম্যাও করে, ঘেউ-ঘেউ করে আগুনের উপর লাফ ঝাঁপ দিতে থাকল ; মনে হল যেন আগুন নিভিয়ে ফেলতে চায়।
হান্স খানিকক্ষণ চুপটি করে দেখল, তারপর রেগে গেল। সেই কাঠের তক্তাটা হাতে করে সে চিৎকার করে উঠল— ভাগো এখান থেকে হতভাগার দল! বলে তাদের পিছনে তাড়া করল। অনেকগুলো পালিয়ে গেল আর বাকি জন্তুগুলোকে সে তার তক্তার ঘায়ে মেরে গড়খাইয়ে ফেলে দিল।
ঘর থেকে জন্তুগুলোকে তাড়িয়ে সে আবার আগুন জ্বালল আর তার পাশে বসে হাত পা তাপাতে থাকল। ঘুম পেয়ে এল। এমনই ঘুমের ঝোঁক যে চোখ খোলা রাখাই কষ্ট। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখে, এক কোণে একটা বিছানা।— বাঃ! শোবার বেশ তোফা জায়গা পাওয়া গেছে। এই বলে উঠে সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। যেই না চোখ বুজে ঘুমোতে যাওয়া, অমনি বিছানাটা নড়ে উঠে ঘরের মধ্যে চলে বেড়াতে লাগল। তারপর ক্রমে চলার বেগ বাড়তে বাড়তে শেষে ঘোড়দৌড়ের মতো সারা প্রাসাদে ঘুরে বেড়াতে লাগল বিছানাটা।
হান্স চেঁচিয়ে বললে— বেশ তো মজা! আরো ছোট না! বলতেই এমন জোরে বিছানাটা দৌড়তে লাগল যে মনে হল তাতে ছ-টা ঘোড়া জোতা হয়েছে। দরজার মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে প্রাসাদের ফটকের দিকে ছুটল। ফটকের গায়ে লাগালো জোরে এক ধাক্কা। খাটটা উল্টে গিয়ে হান্সের উপর বালিশ কম্বল তোশক সব চাপা পড়ল। মনে হল পাহাড়ের তলায় সে পড়েছে। হাঁচড়ে পিছড়ে কোনরকমে বেরিয়ে হান্স বললে— এইভাবে গাড়ি চড়তে যার ভাল লাগে লাগুক। আমার বাপু পোষায় না। বলে সে ফিরে গিয়ে আগুনের ধারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে রাজা এলেন প্রাসাদে। তিনি যখন দেখলেন হান্স আগুনের ধারে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, ভাবলেন ভূতরা তাকে মেরে রেখে গেছে। রাজা বললেন— হায় হায়, এমন সুন্দর ছেলেটা এইভাবে প্রাণ দিল! আমার বড় দুঃখ হচ্ছে।
হান্সের কানে কথাটা যেতেই সে লাফিয়ে উঠল ; বললে— না মহারাজ। এখনও মরিনি আমি। রাজা তাকে অক্ষত দেখে খুব আশ্চর্য হলেন, খুশিও হলেন। বললেন— কেমন করে রাত কাটালে তুমি?
হান্স বললে— চমৎকার কাটল। বলে যা যা ঘটেছিল সব রাজাকে বর্ণনা করল। রাজা শুনে খুব আমোদ পেলেন।
সরাইয়ে ফিরতে সরাইওয়ালা বড়-বড় চোখ করে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললে— তোমাকে যে আবার জীবন্ত দেখব এ কখনও ভাবিনি। যাই হোক আশা করি তুমি কাঁপুনি শিখেছ এবার?
সে নিশ্বাস ছেড়ে বললে— পারলুম কই? আমার বোধহয় চেষ্টা করাই বৃথা! ভয় পেতেই শিখছি না, কাঁপব কী করে?
দ্বিতীয় রাত্রে সে আবার সেই পুরোনো প্রাসাদে গিয়ে ঢুকল। আগুনের ধারে বসে গুনগুন করে গাইতে লাগল— কবে আমি শিখব কাঁপুনি! কবে আমি শিখব খিঁচুনি!
মাঝরাতে হঠাৎ একটা শব্দ। কি যেন একটা পড়ল। তারপর খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর একটা ভীষণ চিৎকারের সঙ্গে একটা মানুষের আধখানা দেহ চিমনির ভিতর দিয়ে গড়াতে গড়াতে হান্সের সামনে এসে পড়ে গেল।
হান্স বললে— বাপ্রে বাপ্! এত গোলমাল এত চিকার, আর মাত্র আধখানা মানুষ? বাকি আধখানা কোথায়? বলতেই আবার একটা চিৎকার গেলামাল উঠল আর বাকি আধখানা দেহ চিমনির মধ্যে দিয়ে এসে নামল।
হান্স উঠে দাঁড়িয়ে বললে— রোসো আগে আগুনটাকে একটু উস্কে দি। আগুনে খোঁচা দিয়ে সে ফিরে এসে যখন বসল, দেখলে মানুষের টুকরো দুটো জুড়ে গেছে। জুড়ে হয়েছে একটি বিশ্রী চেহারার লোক। হান্স বললে— ওকি, আমি তো আমার জায়গা তোমায় ছেড়ে দিই নি! ওঠ ওখান থেকে।
কিন্তু বিশ্রী লোকটা উঠল না। বসেই রইল সেখানে। হান্স ছিল ভারি চটপটে। সে পিছন থেকে হঠাৎ এক ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে হটিয়ে চট করে তার নিজের জায়গায় বসে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে চিমনি দিয়ে ঐরকম বিশ্রী চেহারার আরো নটা মানুষ গড়াতে গড়াতে নেমে এল— প্রত্যেকের হাতে একটা করে মানুষের ঊরুর হাড়। প্রথম মানুষটার হাতে দুটো খুলি। তারা নটা ঊরুর হাড় দিয়ে আর খুলিদুটো দিয়ে ‘স্কিট্ল্’ খেলা শুরু করে দিল।
খানিকক্ষণ তাদের দিকে দেখে হান্স বললে— আমিও খেলব নাকি?
তারা বললে— খেল না, যদি পয়সা থাকে।
সে বললে— পয়সা আমার যথেষ্ট আছে। কিন্তু তোমাদের গোলাদুটি .তো ঠিক হোল নয়! বলে সেদুটো নিয়ে তার কুঁদযন্ত্রে ঘুরিয়ে গোল করে দিল।
—এইবার গড়াবে ভালো। এসো এইবার খেলা যাক।
সেই অদ্ভুত লোকগুলো মহা উৎসাহে খেলা শুরু করে দিলে আর হান্সের কয়েকটা টাকা তারা জিতেও নিলে। কিন্তু হঠাৎ মোরগ ডেকে উঠতেই তারা তার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। তারা চলে যেতেই সে শুয়ে পড়ল আর যতক্ষণ না রাজা এসে পৌঁছলেন বেশ শান্তিতে ঘুমিয়ে নিল। রাজা এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন— কী হল হান্স? সারা রাত কাটল কেমন?
হান্স বললে— কতকগুলি বিশ্রী চেহারার মানুষের সঙ্গে আমি স্কিট্ল্ খেললুম। মানুষের হাড় হল স্কিটল্ আর মানুষের খুলি হল গোলা। দু-একবার আমি জিতলুম। দু’ টাকা হারলুম সব নিয়ে।।
রাজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন— তুমি ভয়ে কাঁপোনি?
—কই আর কাঁপলুম? কাঁপলে তো খুশি হতুম। ওঃ! কবে যে শিখব কাঁপুনি আর খিঁচুনি!
তৃতীয় রাতে হান্স আবার গিয়ে বসল তার বেঞ্চির উপর আগুনের ধারে। মনের দুঃখে একঘেয়ে সুরে বললে— হায়, কবে আমি কাঁপতে শিখব!
হঠাৎ ঘরের মধ্যে ছ-জন লম্বা লোক এসে ঢুকল, তাদের কাঁধে একটা কাফিন, তার মধ্যে এক মরা মানুষ।
হান্স বললে— ও, বুঝেছি তোমরা কী এনেছ। ওর মধ্যে আমার খুড়তুতো ভাইয়ের দেহ আছে। দুদিন আগে সে বেচারা মারা গেছে। দেখি একবার ওর চেহারাটি?
লোকগুলো কাফিনটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে ঢাকা খুলে ধরল। হান্স মড়ার মুখে হাত দিয়ে বললে— এ যে বরফের মতো ঠাণ্ডা! দাঁড়াও এখনি গরম করে দিচ্ছি। বলে আগুনের কাছে গিয়ে নিজের হাত তাতিয়ে মড়ার মুখের উপর বুলিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু মড়ার মুখ যেমন ঠাণ্ডা তেমনই রয়ে গেল।
শেষে সে কাফিনের মধ্যে থেকে তাকে তুলে নিয়ে আগুনের কাছে গিয়ে নিজের কোলে শুইয়ে দিলে। তারপর তার হাত আর বুক ঘসতে লাগল যাতে রক্তচলাচল হতে পারে। কিন্তু কোন ফল হল না। শব যেমন ঠাণ্ডা ছিল তেমনিই রয়ে গেল। তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল, দুজন মানুষ একসঙ্গে যখন বিছানায় শুয়ে থাকে তখন দুজনেই দুজনকে গরম করে। কাজেই সে মড়াটাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে তাকে ঢেকে দিলে। তারপর ঢাকার তলায় নিজেও গিয়ে শুলো। খানিকক্ষণ পরে মনে হল যেন মড়া খানিকটা গরম হয়েছে। দেখতে দেখতে রক্তচলাচল শুরু হল আর শেষে মড়া নড়ে বসল, কথাও কইল।
হান্স বললে— দেখছ ভাই, গরম করে তোমায় আমি বাঁচিয়ে তুললুম যেমন বলেছিলুম ঠিক তেমনি।
কিন্তু মরা লোকটা লাফিয়ে উঠে বললে— তা ঠিক। কিন্তু আমি তোমায় গলা টিপে মারব।
হান্স বললে— কী রকম? এই কি তোমার কৃতজ্ঞতা? তার চেয়ে বরং তুমি তোমার কাফিনেই ফিরে যাও। বলে সে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে তার দেহটাকে ধরে কাফিনের মধ্যে ভরে ঢাকনা এঁটে বন্ধ করে দিলে।
তখন ছ-জন লম্বা লোক ঘরে ঢুকে কাফিনটা কাঁধে তুলে বার করে নিয়ে গেল!
হান্স বললে— যাক, ওটা তো হল। বেশ বুঝছি, আমার আর কাঁপুনি শেখা হবে না।
যেই এ কথা বলা অমনি আগের লোকগুলির চেয়েও আরো অনেক লম্বা একজন লোক ঘরে এসে ঢুকল। তার চোখের দৃষ্টি অতি ভীষণ। লোকটা বুড়ো, মুখে লম্বা সাদা দাড়ি।
লোকটা বললে— হতভাগা ছেলে! দাঁড়াও তোমায় শেখাচ্ছি কাঁপুনি কাকে বলে— তোমায় এবার মরতে হবে!
হান্স বললে— অত তাড়াতাড়ি নয় বন্ধু! আমার অনুমতি না নিয়ে তুমি আমায় মারতে পারবে না।
দৈত্যটা বললে— তোমায় আমি এখনই মাটিতে পুঁতে ফেলব।
—আস্তে বন্ধু, আস্তে। গর্ব কোরো না। তোমার গায়ে জোর আছে বটে কিন্তু দেখতেই পাবে, তোমার চেয়ে আমার জোর বেশি।
বুড়ো বললে— দেখাও তবে। তোমার জোর যদি আমার চেয়ে বেশি হয় তবে তোমায় আমি ছেড়ে দেব। এস আমার সঙ্গে। পরীক্ষা করা যাক।
বলে বুড়ো হান্সকে নিয়ে চলল মাটির নিচে এক লম্বা অন্ধকার গলি দিয়ে। গলির শেষে কামারশালার আগুন দেখা গেল। তারপর তারা এসে হাজির হল এক চুল্লির সামনে। সেখানে একটা নেহাই। বুড়ো একটা কুড়ুল নিয়ে নেহাইটা এক কোপে দু-টুকরো করে কেটে ফেলল।
হান্স বললে— ও আর এমন কী? দেখ আমি কী করি। বলে সে কুড়লটা তুলে নিয়ে আর একটা নেহাইয়ের কাছে এগিয়ে গেল। দৈত্য হান্সের কথায় এত অবাক হয়ে গেল যে সে চলল হান্সের পিছনে পিছনে। কী করে দেখবার জন্যে বুড়ো মাথা নিচু করতেই যেই তার দাড়ি গিয়ে পড়ল নেহাইয়ের উপর অমনি সঙ্গে সঙ্গে হান্স কুড়ুলের ঘায়ে নেহাইটাকে চিরে ফেলে বুড়োর দাড়িশুদ্ধ তাতে আটকে ফেললে।
হান্স বললে— এবার তোমায় হাতে পেয়েছি বুড়ো! মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও। বলে একটা লোহার ডাণ্ডা তুলে নিয়ে বুড়োকে পেটাতে লাগল। বুড়ো বললে— ছেড়ে দাও ভাই! প্রাসাদের মধ্যে যত রত্ন মাণিক্য লুকোনো আছে সব তোমায় দিয়ে দেব প্রতিজ্ঞা করলুম।
এই শুনে হান্স নেহাই থেকে টেনে তার কুড়ুল বার করে বুড়োর দাড়ি ছেড়ে দিল। বুড়ো তার কথামত হান্সকে নিয়ে প্রাসাদে ঢুকে মাটির নিচে এক ঘর দেখিয়ে দিলে, তাতে তিনটে বড় বড় সিন্দুক ভর্তি সোনা।
বুড়ো বললে— একটা সিন্দুক গরিবদের জন্যে, একটা রাজার আর অন্যটা তোমার।
হান্স তাকে ধন্যবাদ জানাতে যাবে এমন সময় মোরগ ডেকে উঠল। আর মোরগ ডাকতেই বুড়ো কোথায় মিলিয়ে গেল। ছেলেটি অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল একা 1
অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে খানিক ঘোরবার পর শেষে সেই মাটির তলার ঘরে ভোরের আলো প্রবেশ করল। তখন সে তার ঘরে পৌঁছে আগুনের ধারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাজা এসে তাকে জাগালেন। ছেলেটি বেঁচে আছে দেখে রাজা খুশি হয়ে বললেন— তাহলে এইবার তুমি কাঁপুনি শিখেছ নিশ্চয়?
হান্স বললে— কই, না! ভয় পাবার মতো কিছুই তো হল না। আমার মরা খুড়তুতো ভাই আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। একটা দেড়ে বুড়ো আমার সঙ্গে বাজি রেখে জেতবার চেষ্টা করলে। কিন্তু আমিই তাকে হারিয়ে দিলুম। সে তখন আমায় দেখিয়ে দিল কোথায় সোনা লুকোনো আছে। এইসব লোক দেখে কি আর কাঁপুনি আসে!
রাজা বললেন— তবে তো তুমি প্রাসাদের মায়া কাটিয়ে দিয়েছ। আমার অঙ্গীকার মত আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব।
হান্স বললে— সে তো ভালো কথা। কিন্তু এখনও আমি কাঁপুনি শিখতে পারলুম না এই দুঃখু।
প্রাসাদ-পুরী থেকে সোনা তুলে আনা হল। খুব ধুম করে বিয়ে হল। কিন্তু হান্সের মনে সুখ নেই। রাজকন্যার ভালবাসাতেও তার তৃপ্তি হয় না। সারাক্ষণ সে বলে— কবে আমি কাঁপুনি শিখব?
রাজকন্যা ভারি মুশকিলে পড়লেন। শেষে রাজকন্যার দাসী বললে— দেখুন রাজকন্যা, আমি আপনাকে বুদ্ধি দিতে পারি। রাজজামাতার কিসে কাঁপুনি ধরবে আপনাকে আমি শিখিয়ে দেব।
বলে দাসী চলে গেল রাজ-উদ্যানের মধ্যে দিয়ে যে ছোট নদী বয়ে যায় তার ধারে। নদী থেকে এক বালতি ঠাণ্ডা জল তুলে নিয়ে এল, তার মধ্যে ছোট-ছোট মাছ কিলবিল করছে।
দাসী বললে— শুনুন রাজকন্যে। রাজজামাতা যখন বিছানায় শুয়ে ঘুমোবেন, এই বালতি-শুদ্ধ জল তাঁর গায়ে ঢেলে দেবেন। দেখবেন কাঁপুনি শিখতে পারেন কি না। ঠিক পারবেন। রাজজামাতাও সুখী হবেন।
সেদিন রাত্রে হান্স যখন বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে রাজকন্যা ধীরে ধীরে তার গা থেকে চাদর টেনে নিলেন, তারপর সেই মাছের চারা ভরা ঠাণ্ডা জল তাঁর গায়ে ঢেলে দিলেন। ছোট ছোট মাছগুলি হালের গায়ে পড়ে কিলবিল করে বেড়াতে লাগল, আর হান্স হঠাৎ জেগে উঠে বললে— ওঃ কী কাঁপুনি ধরছে! ব্যাপারখানা কী? বিছানার পাশে বালতি হাতে রাজকন্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হান্স বুঝল ব্যাপারখানা।
সে বললে— রাজকন্যা, এবার আমি খুশি। কেমন করে কাঁপতে হয় তুমি আমায় শিখিয়েছ। সেই থেকে হান্স বৌ নিয়ে সুখে জীবন কাটাতে লাগল। সে কাঁপুনি শিখে ফেলেছে— যদিও ভয় করতে শেখেনি।