ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক ছিল ইঁদুর, এক পাখি আর এক সসেজ। সসেজ হচ্ছে এক রকম মাংসের ছোট ছোট পাশ-বালিশের মতো— সায়েবরা সিদ্ধ করে বা ভেজে খায়। তিন বন্ধুর সংসার, ভারি সুখময়, শান্তিময়— কোনো কিছুরই অভাব নেই। পাখির কাজ ছিল রোজ বনে উড়ে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে আনা। ইঁদুরের কাজ ছিল জল তোলা, উনুন ধরানো আর খাবার টেবিল পাতা। আর সসেজ ছিল এদের রাঁধুনি। সেই রান্না-টান্না করত। সুখেই ছিল তারা— কিন্তু নিজের অবস্থায় সন্তুষ্ট আর থাকতে পারল কই। যে যত পায়, আরো যেন চায়। একদিন আমাদের এই পাখির সঙ্গে অন্য এক পাখির দেখা। আমাদের পাখি মুখে এক গাল হাসি ফুটিয়ে অন্য পাখিকে তাদের সুখের সংসারের কথা তারিয়ে তারিয়ে বললো। শুনে অন্য পাখি বললে— তোমার মতো বোকা তো দেখিনি। তোমাদের সংসারে তুমিই তো সবচেয়ে বেশী খাটো। অন্য দুজন কি করে? বাইরেই যায় না— দিব্যি ঘরে বসে আরামে দিন কাটায়!
ইঁদুর উনুন জ্বালিয়ে, জল তুলত আর তারপর যতক্ষণ না টেবিল পাতার সময় হয় ততক্ষণের জন্যে জিরোতে যেতো। সসেজ হাঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো রান্না ঠিক হচ্ছে কি না, তার পর করতো কি ডিনারের ঠিক আগে সে নিজের শরীরটা সুরুয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে কয়েকবার নাড়িয়ে দিত; তাতেই সসেজের গন্ধে খাবারটা ভুরভুর করে ভারি সুস্বাদু হয়ে উঠত। তারপরই পাখি ফিরত বাড়ি— পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে বসত। তারপর সকলে মিলে পেট ভরে খেয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ত— ঘুম ভাঙতো না সকালের আগে। ভারি স্বচ্ছন্দ ছিল তাদের জীবন।
কিন্তু পাখির মাথায় কি ঢুকলো, সে ঠিক করল পরের দিন থেকে সে আর কাঠ আনবে না। সে বললে, অনেক দিন সে তাদের গোলামি করেছে, আর নয়। এবার তাদের নতুন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। ইঁদুর আর সসেজ অনেক বোঝালে, কিন্তু পাখি অনড়। তখন তারা করল কি, কড়ি ফেলে দেখল কার ভাগ্যে কি ওঠে। দেখা গেল সসেজের ভাগ্যে উঠেছে কাঠ বওয়া, ইঁদুরের ভাগ্যে রান্না করা আর পাখির ভাগ্যে জল তোলা আর উনুনে আঁচ দেওয়া।
এর ফল হল কি দেখ। সসেজ গেল কাঠ কুড়োতে, পাখি উনুন ধরাতে আর ইঁদুর হাঁড়ি ঠেলতে। তারপর সসেজ যতক্ষণ না পরের দিনের কাঠ নিয়ে ফেরে সবাই তার জন্যে অপেক্ষা করে রইল। কিন্তু তার ফিরতে এত দেরি হতে লাগল যে সকলের চিন্তা হল, নিশ্চয় কোনো বিপদ হয়েছে। পাখি এগিয়ে গেল দেখতে সসেজকে দেখা যায় কি না। কিছুদূর গিয়েই তার দেখা হল কুকুরের সঙ্গে। শুনল কুকুরের খাদ্য হচ্ছে সসেজ, কাজেই কুকুর তাকে আহার করেছে। পাখি আদালতে কুকুরের নামে নালিশ ঠুকতেই কুকুর বলল, সসেজের কাছে জাল-করা চিঠি ছিল। জালিয়াত বলেই সে তার শাস্তি পেয়েছে— প্রাণ গেছে।
মনের দুঃখে পাখি পিঠে কাঠ বোঝাই করে বাড়ি ফিরল। ইঁদুরকে বলল সব কথা। ভারি মুশকিলে পড়ল দুজনে। তবু ভাবল, যা হবার হয়েছে, এখন দুজনেই একত্র থাকা যাক। পাখি টেবিলে চাদর পাতলো, ইঁদুর রান্না করতে লাগলো। তারপর সুরুয়া নামাবার ঠিক আগে, সসেজ যেমন করত, ইঁদুর গিয়ে ঢুকল সুরুয়ার মধ্যে সুরুয়া নাড়াতে। ফুটন্ত সুরুয়ায় তার চামড়া আর লোম তো গেলই, প্রাণও গেল।
পাখি যখন হাতা নিয়ে হাঁড়ি থেকে সুরুয়া তুলতে এল, রাঁধুনিকে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। এদিকে খুঁজল ওদিকে খুঁজল, কাঠের স্তূপ উলটে দেখল কিন্তু রাঁধুনি কোথাও নেই। সেই সময় হঠাৎ কাঠে আগুন ধরে গেল। পাখি ছুটল তাড়াতাড়ি জল আনতে। কিন্তু হাত থেকে বালতি গেল কুয়োর মধ্যে পড়ে আর তার পিছনে নিজেও। পড়ে গিয়ে সে আর উঠতে পারল না। তিন বন্ধুর শেষ বন্ধুও ডুবে মরল।