Chapter Index

    পুরাকালে পরীরা যখন মানুষের চেহারায় পৃথিবীতে বাস করত সেই সময় একটি ভাল পরী ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে একবার ভারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কোথাও আশ্রয় পাবার আগেই রাত হয়ে গেল। সেই সময় সে দেখতে পেল সামনা-সামনি দুটি বাড়ি রয়েছে। একটি বেশ বড়সড়, সুন্দর, একজন বড়লোকের। অন্যটি ছোট্ট, ভাঙাচোরা, কোন এক দরিদ্র চাষীর।

    পরী ভাবল, বড়লোকটির বাড়িতেই যাই—আমাকে একটু আশ্রয় দিতে ওঁর কী আর অসুবিধে হবে! ভেবে সে সুন্দর বাড়িটির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল। কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে ধনী লোকটি জানলা খুলে আগন্তুককে জিজ্ঞেস করলেন—কী চাও তুমি?

    পরী বললে—এক রাতের মত আমি আশ্রয় চাইছি।

    সুন্দর বাড়ির মালিক তাই শুনে পথচারিণীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ করলেন। দেখলেন তার পোশাক মলিন, ছিন্ন। কিন্তু তার পকেটের মধ্যে কত সোনা-দানা আছে তা আর তিনি দেখতে পেলেন না। তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন—তোমাকে তো ঘরে আসতে দিতে পারি না! আমার ঘর-ভর্তি মূল্যবান সব বস্তু আছে। যে এসে দরজায় ধাক্কা দেবে তাকেই যদি আমায় আশ্রয় দিতে হয় তাহলে খুব শিগগিরই ভিখারীর লাঠি হাতে আমাকেই রাস্তায় নামতে হবে। অন্য কোথাও দেখ—এখানে হবে না। বলে সে পরীকে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে দিলে।

    পরী তখন জমকালো বাড়িটা পিছনে রেখে অন্য বাড়িটির দিকে এগোলো। দরজায় ধাক্কা দেবার সঙ্গে সঙ্গে গরিব লোকটি এসে দরজা খুলে দিয়ে পথচারিণীকে ভিতরে আসতে বললে। বললে—রাতে আমাদেরই কাছে তুমি থাকো। অন্ধকার হয়ে গেছে, এখন আর তুমি কোথাও যেতে পারবে না।

    এই অভ্যর্থনায় পরী ভারি খুশি হল। সে ভিতরে এসে ঢুকল। চাষানী এসে তাকে স্বাগত জানালো, বললে—তুমি এখানটা নিজের বাড়ির মত মনে কোরো। আমাদের খুব বেশি নেই, কিন্তু যা আছে খুব আনন্দের সঙ্গেই তোমায় আমরা তা দেব।

    চাষানী উনুনে আলু চড়িয়ে দিল। যতক্ষণ আলু সিদ্ধ হতে থাকল সে বসে গেল ছাগলীকে দুইতে যাতে অতিথি একটু দুধ খেতে পান। টেবিলে চাদর পাতা হতেই পরী এসে বসলেন, আর সবাই মিলে একসঙ্গে খেলেন। সেই সামান্য খাবার খেতে পরীর বড় ভাল লাগল।

    খাওয়া শেষ হলে যখন শোবার সময় হল চাষানী চাষাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে—দেখ স্বামী, আজকে আমরা দুটিতে বরং খড়ের বিছানা করে তাতে ঘুমোই। অতিথি আমাদের বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করুক। সারাদিনের পথশ্রমে নিশ্চয় ও ক্লান্ত।

    চাষা বললে—এ তো খুব ভাল কথা। আমি নিজে গিয়ে বলছি ওকে।

    পরী প্রথমে কিছুতেই রাজি হতে চায় না। কিন্তু তারা এত পীড়াপীড়ি করতে লাগল যে শেষ অবধি পরী আর না বলতে পারল না। গরব চাষা আর তার স্ত্রী খড়ের বিছানায় শুলো। পরী আরামে ঘুমোলো তাদের বিছানায়।

    সকালে উঠে পরী দেখল, চাষানী আগেই উঠে তার জন্যে বাড়িতে যা ছিল তাই দিয়ে প্রাতরাশ রান্না করছে। পরী খেতে বসল। ঘরের মধ্যে যে রোদের আলো এসে পড়ল তাতে করে চাষা আর চাষানীর মুখ তৃপ্তিতে আর আনন্দে এমনই উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল যে পরীর তাদের ছেড়ে যেতে ভালই লাগছিল না।

    পরী যাবার সময় তাদের কাছে বিদায় চাইল, তাদের আতিথ্যের জন্যে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু দরজার কাছে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে—তোমরা আমাকে দয়া দেখিয়েছ, স্নেহ করেছ, আমাকে গরিব জেনে আমার প্রয়োজনে সাহায্য করেছ। এর প্রতিদান দেবার ক্ষমতা আমার আছে। তোমাদের তিনটি ইচ্ছা আমি পূরণ করব।

    চাষা বললে—আমরা দুটিতে যতদিন বাঁচি যেন সুস্থ সবল থাকি আর আমাদের সামান্য প্রয়োজন সব সময় যাতে মেটে এই তো হবে আমাদের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। এ ছাড়া আর তৃতীয় কোন ইচ্ছা আমি ভাবতেই পারি না।

    পরী বললে—এই পুরোনো ঘরের বদলে তোমরা একটি নতুন বাড়ি চাও না?

    চাষী চাষানী একসঙ্গে বলে উঠল—হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তিনটি ইচ্ছা পূর্ণ হলে আর আমাদের কিছুই দরকার হবে না।

    পরী তখন তাদের পুরোনো ঘরকে একটি নতুন কুটিরে পরিণত করে দিয়ে, তাদের অন্য দুটি ইচ্ছাও পূর্ণ হবে বলে অঙ্গীকার করে নিজের পথে চলে গেল। দুপুরবেলা সামনের বাড়ির বড়লোকটি তাঁর জানলা দিয়ে এবার মুখ বাড়িয়ে ছিলেন। একেবারে অবাক! যেখানে এক পুরোনো ভাঙা-চোরা ঘর ছিল সেখানে একটি সুন্দর নতুন কুটির দাঁড়িয়ে—মাথায় তার লাল টালির ছাদ। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে অবশেষে তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন—বল তো গিন্নি কী করে হল এটা? কালকে একটি জরাজীর্ণ ঘর ঐখানে দাঁড়িয়ে ছিল, আর আজকে এমন সুন্দর এক কুটির! যাও তো, দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এস কী হল এটা!

    গিন্নি গেলেন গরিব চাষীকে জিজ্ঞেস করতে কী উপায়ে এই পরিবর্তন ঘটল।

    চাষী বললে—কাল সন্ধ্যাবেলায় একটি গরিব পথচারিণী আমাদের দরজায় এসে এক রাতের মত আশ্রয় চেয়েছিল। গরিবের মতো পোশাক। তাহলেও আমাদের ঘরে যা ছিল দিলুম, আমাদের বিছানায় শুতে দিলুম। আজ সকালে যখন সে চলে গেল, বললে আমাদের তিনটি ইচ্ছা সে পূরণ করবে। আমরা চাইলুম আমাদের স্বাস্থ্য যাতে খারাপ না হয়, রোজকার রুটি যাতে কম না পড়ে। বললুম ওই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। শেষে সেই পথিক আমাদের ভাঙা ঘর বদলে এই নতুন সুন্দর কুটিরটিও করে দিয়ে গেছেন।

    শুনে বড়লোকের গিন্নি দৌড়ে ফিরে গেলেন নিজেদের বাড়িতে। কর্তাকে সব বললেন। কর্তা শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন—ওঃ, আমার নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে! আগে যদি জানতে পারতুম! বিদেশিনীটি আমারই কাছে প্রথম এসেছিল। এমন ময়লা ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় পরে এসে রাতের আশ্রয় চেয়েছিল যে আমি বিদায় করে দিয়েছিলুম।

    গিন্নি বললেন—যা হয়েছে হোক। এখন ওঠ তো! ঘোড়ায় চড়ে দৌড়ে গিয়ে ধর সেই মেয়েকে! যদি ধরতে পারো তাহলে তুমিও তিনটি ইচ্ছা চেয়ে নিয়ে তার কাছ থেকে।

    এই সদুপদেশ শুনে বড়লোক ঘোড়ায় জিন পরিয়ে পথচারিণীর পিছু-পিছু ছুটলেন। শেষে অনেক দূরে গিয়ে ধরে ফেললেন তাকে। তখন যত ভদ্র যত নম্র যত বিনীত হতে পারেন তত হয়ে বললেন—আপনাকে আমি কাল বাড়িতে আসতে বলতে পারিনি বলে কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে সে সময় আমার বাড়ির চাবিটা খুঁজছিলুম। চাবি পাবার পর দেখলুম আপনি আর নেই। সে যাই হোক, আবার যদি আপনি এদিক দিয়ে ফেরেন নিশ্চয় আমার বাড়িতে থেকে যাবেন।

    পরী বললে—বেশ বেশ, যদি কোনদিন আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে যাই তো আসব।

    তারপর সেই ধনী লোকটি গরিব মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন—আমার প্রতিবেশীর যেমন আপনি তিনটি ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন, তেমনি আমারও কি করবেন?

    পরী বললে—অনায়াসে করতে পারি। কিন্তু আপনার আর তাতে কী লাভ হবে? আপনার তো চাইবার কিছু নেই।

    কর্তা বললেন—যদি জানতে পারি আমার কামনা পরিপূর্ণ হবে তাহলে ভেবে-চিন্তে নিশ্চয় কিছু চাইতে পারি যাতে আমার ভাগ্য ফিরে যায়।

    পরী বললে—বেশ, তবে ঘোড়ায় করে বাড়ি ফিরুন এখন। তিনবার আপনি ইচ্ছা করুন। যা চাইবেন তাই পাবেন।

    ইচ্ছা-পূরণের অঙ্গীকার পেয়ে কর্তা ঘোড়ার পিঠে বাড়ি ফিরে চললেন গভীর চিন্তা করতে করতে—কী চাওয়া যায়? এমনি একমনে ভাবতে ভাবতে চলেছেন, এদিকে ঘোড়ার লাগাম যে এত আলগা হয়ে ঝুলে পড়েছে সেদিকে খেয়ালই নেই। তার ফলে ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে শুরু করল। সেই লাফালাফিতে কর্তার চিন্তার স্রোতে বাধা পড়ল। কী ভাবছিলেন তিনি ভুলে গেলেন। ঘোড়াকে এক ঘা কষিয়ে বললেন—শান্ত হও বেস্! কিন্তু ঘোড়া শান্ত তো হলই না, বরং এত লাফাতে লাগল যে তিনি পড়ে যান আর-কি! কর্তা চটে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন—করছিস কী তুই? ইচ্ছে করছে তোর ঘাড়টাকে মটকে দিতে!

    যেই না বলা অমনি ঘোড়াটা উল্টে পড়ে গেল। কর্তা দেখলেন ঘাড় ভাঙা অবস্থায় ঘোড়া মরে পড়ে রয়েছে। তাঁর প্রথম ইচ্ছা পূর্ণ হল।

    কর্তার স্বভাব ছিল কৃপণ। ঘোড়াটা গেলেও তার জিন আর লাগাম তিনি ফেলে যেতে পারলেন না। কাজেই ফিতে কেটে সেগুলিকে নিজের পিঠে ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। যাই হোক, এই ভেবে সান্ত্বনা পেলেন যে এখনও তাঁর দুটো ইচ্ছা পূর্ণ হতে বাকি আছে।

    গরম বালি আর দুপুরের আগুনের মতো রোদের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তিতে আর উত্তাপে তাঁর মাথা প্রায় খারাপ হয়ে গেল। জিনের ভারে নুয়ে পড়ছেন—সব সময় মনে হচ্ছে যেন পড়ে যাবেন। কী যে চাইবেন কিছুতেই মনস্থির করে উঠতে পারছেন না। নিজেকে নিজে বললেন—সমস্ত পৃথিবীর যত কিছু ধনদৌলত সব যদি আমায় চাইতে হয়, তাই বা চাইব কী করে? ঠিক কি-কি জিনিস চাইব তা-ই তো জানি না। যাই হোক, এমনভাবে চাইতে হবে যাতে করে দুটো ইচ্ছে পূরণ হলেই আর কিছু চাইবার থাকবে না। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন—আহা, আমি যদি সেই ব্যাভেরিয়ার চাষীর মতো হতুম যাকে তিনবার ইচ্ছে করতে বলা হয়েছিল! প্রথম ইচ্ছায় সে এক গেলাস বিয়ার চাইল। দ্বিতীয় ইচ্ছায় যত খেতে পারে তত বিয়ার। তৃতীয় ইচ্ছায় এক পিপে-ভর্তি বিয়ার। প্রত্যেক বারেই সে ভেবেছিল সে যা চাইছে তাই পাচ্ছে। কিন্তু শেষে মনে হল সে যা পেল তা কিছুই নয়।

    হঠাৎ তাঁর মনে হল বাড়িতে ঠাণ্ডা ঘরে তাঁর গিন্নি কেমন আরামে বসে আছেন। হয়ত চমৎকার কিছু খাচ্ছেন। তিনি নিজে সেখানে না থেকে এই গরমের মধ্যে হাঁটছেন এটা ভেবে তাঁর এমন বিরক্তি এত রাগ হল যে বিশেষ কিছু না ভেবেই তিনি বললেন—আমার ইচ্ছে করছে এই জিনটা আমার পিঠ থেকে খসে পড়ুক আর গিন্নি এর উপর চেপে বসুক যাতে একেবারে নড়তে না পারেন।

    শেষ কথাটি তাঁর মুখ থেকে বেরোতে না বেরোতেই ঘোড়ার জিন অদৃশ্য হয়ে গেল। তিনি বুঝলেন তাঁর দ্বিতীয় ইচ্ছাও পূর্ণ হয়েছে।

    কর্তা ঘেমে উঠলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছুটলেন তিনি বাড়ির দিকে। কারণ এখন ঘরে গিয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়ে একা বসে শেষ ইচ্ছার জন্যে একটা বড় কিছু ভাবতে হবে। কিন্তু ঘরের দরজা খুলেই দেখতে পেলেন তাঁর স্ত্রী বসে রয়েছেন ঘোড়ার জিনের উপর। সেখানে তিনি আটকানো। নড়বার কোন উপায় নেই।

    কর্তা বললেন—ঐখানেই সুখে বসে থাকো তুমি। পৃথিবীর সমস্ত ধনদৌলত এখন আমি চাইতে পারি। তুমি যদি বসে থাকতে রাজি হও তাহলেই আমার ইচ্ছা-পূরণের সুযোগ হয়।

    গিন্নি ভীষণ চটে বললেন—আহাম্মক, এখানেই যদি আমায় সারা জীবন বসে থাকতে হয় তাহলে আমার তামাম পৃথিবীর ধন-দৌলত পেয়ে কী লাভ? না না, ও চলবে না। তুমি আমায় ইচ্ছে করে এখানে উঠিয়েছ, তুমিই এবার ইচ্ছে করে আমায় নামাও।

    খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও অগত্যা কর্তাকে ইচ্ছে করতে হল গিন্নি যাতে মুক্ত হয়ে জিন থেকে নেমে আসতে পারেন। সেই মুহূর্তে তার ইচ্ছা পূর্ণ হল।

    সেই স্বার্থপর ধনী শেষ অবধি তাঁর তিনটি ইচ্ছা পূরণের যা ফল পেলেন তা হচ্ছে—রাগ, বিরক্তি, নানা অসুবিধা, স্ত্রীর কটুবাক্য, ঘোড়াটি হারানো। গরিব লোকটি ছিল দানশীল ও দয়ালু। সে জীবনের শেষ অবধি সুখ শান্তি সমৃদ্ধি পেল।

    টীকা