Chapter Index

    আদম আর ঈভকে যখন স্বর্গের নন্দনকানন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল তাঁরা আর কি করেন, এক অনুর্বর জমিতে গিয়ে নিজেদের জন্যে ঘর বাঁধলেন। আদম মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই জমি চাষ করে তাতে ফসল ফলাতো যাতে দুটি খাবার জোটে আর ঈভ বসে বসে চরকা কাটতেন। প্রতি বছর ঈভের একটি করে সন্তান হত, কেউ হত সুন্দর কেউ অসুন্দর।

    এই ভাবে অনেক বছর কেটে যাবার পর ঈশ্বর এক দেবদূত পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের বলবার জন্যে যে তিনি তাঁদের ঘর-সংসার দেখতে আসছেন। শুনে ঈভ ভারি খুশী। তিনি ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগে গেলেন, ফুল দিয়ে সব সাজালেন, মাদুর বুনে মেঝেতে বিছিয়ে দিলেন। তারপর তাঁর ছেলেমেয়েদের বার করে আনলেন। কিন্তু শুধু সুন্দর ছেলেদের। তাদের স্নান করিয়ে পরিষ্কার করলেন, চুল আঁচড়ে দিলেন, গায়ে পরিয়ে দিলেন কাচা জামা আর তাদের বার বার উপদেশ দিলেন ঠাকুরের সামনে যেন ভদ্র ব্যবহার করে। তিনি এলে যেন সবাই মাথা নীচু করে প্রণাম জানায় আর ঠাকুর যা জিজ্ঞেস করবেন তার উত্তর যেন ভদ্রভাবে দেয়। অসুন্দর ছেলেদের লুকিয়ে রেখে দেওয়া হল। একজন লুকোলো খড়ের তলায়, একজন মাচায় উঠল, একজন শুকনো ঘাসের মধ্যে, একজন উনুনের পিছনে, একজন মাটির নীচের ঘরে, একজন স্নানের টবে, একজন পিপের পিছনে, একজন পুরোনো জোব্বা মুড়ি দিয়ে, দুজন কাপড়ের পুঁটলি খুলে তার মধ্যে আর দুজন জুতো তৈরী করার জন্যে যে চামড়ার স্তূপ ছিল তারই মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।

    ঈভ তৈরী হতে না হতেই বাড়ির দরজায় কে কড়া নাড়ল। আদম দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখলেন ভগবান উপস্থিত। পরম শ্রদ্ধাভরে আদম দরজা খুলতেই ঠাকুর ঢুকলেন। ঢুকে দেখলেন সারি বেঁধে সুন্দর সুন্দর ছেলেরা সব দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা মাথা নীচু করে তাঁকে প্রণাম করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।

    ভগবান তাদের আশীর্বাদ করা শুরু করলেন। প্রথম ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বললেন—তুমি হবে ক্ষমতাশালী রাজা। আর একজনকে বললেন—তুমি হবে রাজপুত্র! আর একজনকে—তুমি মন্ত্রী। তারপর—তুমি বড় জমিদার, তুমি ছোট জমিদার, তুমি তালুকদার, তুমি ব্যবসাদার, তুমি পণ্ডিত। এমনি করে সবার উপর তিনি তাঁর আশীবাদ বর্ষণ করলেন।

    ঈভ যখন দেখলেন ঠাকুর এত সহজে দু-হাতে আশীবাদ ছড়াচ্ছেন তখন তিনি ভাবলেন—আমার কুৎসিত ছেলেগুলোকেও তো নিয়ে এলে হত—ভগবান নিশ্চয় তাদের এমনি ভাবে আশীর্বাদ করবেন। দৌড়ে গিয়ে তিনি তাদের খড়ের গাদা, ঘাসের গাদা, উনুন, যে যেখানে লুকিয়েছিল সেখান থেকে টেনে বার করলেন। নোংরা ময়লা, ধুলোমাখা ছেলের দল সামনে এসে দাঁড়ালো।

    ঠাকুর একটু হেসে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন—এদেরও আমি আশীর্বাদ করব। প্রথম ছেলেটির মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন—তুমি হবে কৃষক। আর একজনকে বললেন—তুমি হবে জেলে। তারপর বলে চললেন—তুমি হবে কামার, তুমি মুচি, তুমি জোলা, তুমি হাড়ি, তুমি দর্জি, তুমি নাবিক, তুমি চাকর, আর শেষে বললেন—তুমি হবে মেথর।

    ঈভ তাই শুনে বললেন—ঠাকুর, আপনার পুরস্কারগুলি আপনি এমন অসমানভাবে বেটে দিলেন কেন? যাই বলুন না, এরা সবাই আমারই ছেলে, আমিই এদের জন্ম দিয়েছি, মানুষ করেছি। আপনার দয়া সকলের উপরেই তো সমান হওয়া উচিত।

    ঠাকুর জবাব দিলেন—ঈভ, তুমি এ জিনিস তাহলে বোঝোনি।তোমার ছেলেপুলে দিয়েই পৃথিবী পূর্ণ হতে চলেছে—আর কারো ছেলে দিয়ে নয়। তারা যদি সবাই হয় রাজা-মহারাজা আর লাট-বেলাট তাহলে শস্য ফলাবে কে, শস্য কাটবে কে, নিড়োবে কে, রুটিই বা সেঁকবে কে? কামার হবে কে? রাজমিস্ত্রী, কুলি-মজুর আর দর্জি? প্রত্যেক ধরনের কাজের লোকই তো দরকার, যাতে করে একে অপরকে সাহায্য করতে পারে—যেন এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো।

    ঈভ বললেন—হ্যাঁ ঠাকুর। আমায় ক্ষমা করুন। না ভেবেই বলেছিলুম। আমার ছেলেদের প্রতি আপনার আশীর্বাদ মাথায় করে নিলুম।

    টীকা