Chapter Index

    হাঁদুরামের সোনার হাঁস

    একটি লোক ছিল তার ছিল তিন ছেলে। ছোট ছেলেটি হাঁদা ছিল বলে তার নাম ছিল হাঁদুরাম। সবাই তাকে বকত, ঘেন্না করত।

    বড় ছেলে বনে যাচ্ছিল কাঠ কাটতে। যাতে তার খিদে তেষ্টা না পায় সেজন্যে তার মা তাকে মিষ্টি কেক দিলেন আর দিলেন মিষ্টি সরবত।

    বনের মধ্যে তার সঙ্গে এক ছোট্ট বেঁটে পাকাচুল বুড়োর দেখা। বুড়ো তাকে নমস্কার জানিয়ে বললে—তোমার পকেটে যে কেক আছে আর বোতলে যে সরবত আছে তার থেকে একটু আমায় দাও না! বড় খিদে, বড় তেষ্টা পেয়েছে।

    চালাক ছেলে বললে—তোমায় যদি কেক আর সরবত দিই তাহলে আমার নিজের জন্যে কতটুকু থাকে? যাও ভাগো!

    বেঁটে লোকটিকে সেখানে ফেলে সে চলে গেল নিজের পথে। কিন্তু একটা গাছ কাটতে কাটতে হঠাৎ তার নিজেরই হাতে একটা চোপ এসে লাগল। আর কাঠ কাটা হল না—রক্তমাখা হাত বাঁধতে বাড়ি যেতে হল।

    এ সবই করালো ঐ বেঁটে বুড়ো পাকাচুল মানুষটি।

    মেজভাইকে যেতে হল বনে কাঠ কাটতে আর বড়ভাইয়ের মতো তাকেও তার মা দিলেন মিষ্টি কেক আর মিষ্টি সরবত। এর সঙ্গেও দেখা হল সেই পাকাচুল বেঁটে লোকটির। সে বললে—এক টুকরো কেক আর একটু সরবত দাওনা! মেজভাইও বুদ্ধিমানের মতো উত্তর দিল—তোমায় যদি দিই তাহলে আমার বাকি থাকে কি? সরে পড় এখান থেকে। বলে সে এগিয়ে গেল।

    মেজভাইয়েরও শাস্তি পেতে দেরি হল না। গাছে কয়েকটা কোপ দেবার পর তার নিজের পায়েই পড়ল একটা কোপ। তার আর নিজের চলবার ক্ষমতা রইল না। কাঁধে করে বাড়ি আসতে হল।

    তখন হাঁদুরাম বললে—বাবা, আমাকে কাঠ কাটতে দাও।

    বাবা বললেন—কাঠ কাটতে গিয়ে তোমার দাদারা কি বাধিয়ে বসেছে দেখ। তুমি ছাড়। তুমি ও কাজের কিছুই জান না। কিন্তু হাঁদুরাম এত করে বলতে লাগল যে শেষ পর্যন্ত তার বাবা বললেন—বেশ, যাও হাত-পা কেটে এস, তবে তোমার শিক্ষা হবে!

    তার মা তাকে একটা আধপোড়া কেক আর খানিকটা টক সরবত দিয়ে পথে এগিয়ে দিলেন। বনের কাছে গিয়ে দাদাদের মতো তারও দেখা হল সেই বেঁটে পাকাচুল মানুষটির সঙ্গে।

    লোকটি বলল—তোমার কেকের একটি টুকরো আর সরবতের একটু আমায় দাও না! বড় খিদে, বড় তেষ্টা পেয়েছে।

    হাঁদুরাম বললে—মা আমায় যা কেক দিয়েছে তা আধপোড়। সরবতও টক। এতে যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে কোথাও বসে এস একসঙ্গে খাই।

    তখন তারা বসল। কিন্তু হাঁদুরাম তার কেক বার করে কামড় দিয়ে দেখে, চমৎকার খেতে। সরবতে চুমুক দিয়ে দেখে, অমন মিষ্টি সরবত আর হয় না। তারা তৃপ্তি করে কেক সরবত খেল। বেঁটে লোকটি বললে—তোমার মন যখন এত ভাল, পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে তুমি যখন তোমার খাবার খেতে চাও, আমি তোমায় খানিকটা সৌভাগ্য দেব। ঐ দেখ একটা বুড়ো গাছ। ওটাকে কেটে ফেল গে। ওর শিকড়ের নিচে কিছু একটা পাবে।

    এই বলেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    হাঁদুরাম গাছটাকে কেটে ফেললে। যখন গাছটা পড়ে গেল—অবাক কাণ্ড!—শিকড়ের মাঝখানে দেখা গেল একটা হাঁস বসে রয়েছে—তার সমস্ত পালক সোনার। সে হাঁসটাকে তুলে নিয়ে এক সরাইখানায় গিয়ে হাজির হল রাত কাটাবার জন্যে। সরাইয়ের মালিকের তিনটি মেয়ে ছিল। তারা অবাক হয়ে হাঁসটার দিকে দেখে ভাবল—এ আবার কী রকম পাখি? তাদের বড় লোভ হল একটা সোনার পালক নেবার।

    হাঁদুরাম যখন বাইরে গেছে, বড় মেয়ে এসে হাঁসের একটা ডানা ধরে তার থেকে পালক ছিঁড়ে নেবার চেষ্টব করল। কিন্তু হাঁসের ডানায় তার হাত গেল আটকে—সে আর কিছুতেই তা ছাড়াতে পারলে না।

    একটু পরেই এল মেজ মেয়ে সোনার পালক চুরি করতে। কিন্তু যেই না সে তার দিদির গায়ে হাত দিয়েছে অমনি তারও হাত গেল আটকে।

    শেষে ছোট মেয়েও এল একই উদ্দেশ্যে। তাকে দেখে তার দিদিরা চেঁচিয়ে উঠল—সরে যাও এখান থেকে! দোহাই, পালাও!

    সে ভাবলে, ওরা যখন রয়েছে, আমি পালাবো কেন? ভেবে সে ছুটে গেল দিদিদের কাছে। যেই দিদির গায়ে হাত পড়ল অমনি সেও আটকে গিয়ে ঝুলতে লাগল। এমনি করে সারা রাত কাটাতে হল তাদের।

    সকালবেলা হাঁদুরাম হাঁসটাকে বগলে, নিল। সে লক্ষই করল না যে হাঁসের সঙ্গে তিনটে মেয়ে ঝুলে আছে। হাঁদুরামের পিছনে পিছনে কোন রকমে তাল রেখে তাদের ছুটতে হল।

    তারা যখন মাঠের মাঝখানে, তখন যাজক মশায় আসছিলেন সেদিক দিয়ে। যাজক মশায় সেই মিছিল দেখে বলে উঠলেন—ছি ছি বেহায়া মেয়েরা! ঐ ছেলেটার পিছনে অমন করে ছুটতে তোমাদের লজ্জা করছে না। এমন কি ভদ্র মেয়েরা করে?

    বলে তিনি ছোট মেয়ের হাত ধরে দিলেন এক টান। কিন্তু যেই না তার হাতে হাত লাগা অমনি তিনিও গেলেন আটকে। তাঁকেও পিছনে পিছনে ছুটতে হল।

    একটু পরে যাজকের চাকর এল। সে যখন দেখল তিনটি মেয়ের পিছনে তার প্রভু ছুটেছেন সে অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল—ধর্মাবতার প্রভু! আপনি এত জোরে ছুটেছেন কোথায়? আপনি কি ভুলে গেছেন আমাদের এখন এক নামকরণ উৎসবে যেতে হবে? বলে সে যাজকের আস্তিন ধরে টানল। টানতেই সে-ও গেল আটকে।

    একের পিছনে আর এক, এই পাঁচজন যখন রাস্তা দিয়ে চলেছে, সেই সময় দু-জন চাষী যাচ্ছিল তাদের নিড়েন নিয়ে। যাজক তাদের ডেকে বললেন তাঁকে আর তাঁর চাকরকে ছাড়িয়ে দিতে। কিন্তু যেই না তারা চাকরকে ছুঁলো অমনি ওদের ছাড়াবে কি, নিজেদেরই ছাড়াতে পারল না। হাঁদুরাম আর তার হাঁসের পিছনে এবার সাত জন লোক হল।

    ক্রমে তারা এক শহরে এসে পৌঁছল। সেখানে ছিলেন এক রাজা। তাঁর একমাত্র মেয়ে এমনই গোমড়া যে, কেউ বা কিছুই তাঁকে হাসাতে পারত না। তাই রাজা ঘোষণা করেছিলেন, যে রাজকন্যাকে হাসাতে পারবে সে তাঁকে বিয়ে করবে।

    হাঁদুরাম এই শুনে তার হাঁস আর পিছনের মিছিল নিয়ে রাজকন্যার সামনে হাজির হল। সেই মজার মিছিল দেখে রাজকন্যা এমন হাসি শুরু করলেন যে মনে হল তিনি আর থামবেন না!

    কাজেই হাঁদুরাম বিয়ের প্রস্তাব জানালো। কিন্তু রাজার জামাইকে পছন্দ হল না। তিনি নানারকম শর্তের কথা বলতে লাগলেন। প্রথমত সে এমন কাউকে নিয়ে আসুক যে একজালা সরবত খেয়ে ফেলতে পারে।

    হাঁদুরামের মনে হল হয়ত সেই বেঁটে পাকাচুল মানুষটি তাকে সাহায্য করতে পারবে। হাঁদুরাম বনে গেল তাকে খুঁজতে। যেখানে সে গাছটা কেটেছিল, দেখল ঠিক সেইখানে মুখ শুকিয়ে বসে রয়েছে সেই লোকটি।

    হাঁদুরাম বললে কী হয়েছে ভাই তোমার?

    সে জবাব দিলে—উঃ, আমার এমন তেষ্টা পেয়েছে, কিছুতেই তেষ্টা মিটছে না! এক পিপে সরাব খেয়েছি কিন্তু ওটুকুতে আমার কী হবে?

    হাঁদুরাম বললে—এই যদি হয় তাহলে আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি। এসো আমার সঙ্গে—তুমি যত পান করতে চাও করিয়ে দেব।

    সে তাকে রাজবাড়িতে নিয়ে গেল। এক জালা সরবত শেষ করতে তার আর কতক্ষণ? আরো জালা জালা সরবত সে শেষ করল। তখন রাজা হার মানলেন।

    কিন্তু হাঁদুরাম রাজকন্যা চাইতেই রাজা বিরক্ত হলেন। হাঁদুরাম যার নাম তাকে তিনি জামাই করেন কী করে? তিনি আবার নতুন শর্ত করলেন। এবার হাঁদুরাম যাক, একজন লোন নিয়ে আসুক যে এক পাহাড় রুটি খেয়ে ফেলতে পারে।

    হাঁদুরাম কোন চিন্তা না করে সোজা বনে গেল। ঠিক সেই একই জায়গায় সে দেখল একজন লোক বসে বসে তার কোমরে একটা দড়ি কষে কষে বাঁধছে। তার মুখ অত্যন্ত ভার।

    লোকটি বললে—একটা চুল্লিতে যত রুটি সেঁকা যায় সব খেয়ে আমি শেষ করেছি। কিন্তু আমার যা খিদে তাতে ও আর কী? আমার পেট ভরছে না। দড়ি বেঁধে তাই পেট কমাচ্ছি রোজই।

    শুনে হাঁদুরাম খুব খুশি হল। সে বললে—উঠে এস আমার সঙ্গে। তুমি যত চাও খাওয়াবো।

    এই বলে তাকে রাজবাড়িতে নিয়ে গেল। রাজ্যে যত ময়দা আছে সমস্ত রাজার হুকুমে এক জায়গায় জড়ো করে পাহাড়-প্রমাণ রুটি সেঁকা হয়েছিল। বনের মানুষটি সেই পর্বতের সামনে বসে খেতে শুরু করলে। দিন শেষ হবার আগেই পাহাড় ফুরিয়ে গেল।

    হাঁদুরাম আবার এসে রাজকন্যাকে চাইল। কিন্তু রাজা এবারে শর্ত করলেন, একটা জাহাজ এনে দিতে হবে যা জলেও ভাসবে, ডাঙায়ও ভাসবে।

    রাজা বললেন—সেই নৌকোয় করে তুমি এসো, তাহলেই আমার মেয়েকে পাবে।

    হাঁদুরাম সোজা বনে চলে গেল। সেখানে সেই বেঁটে পাকাচুলো লোকটি বসে ছিল। সে বললে—তোমার জন্যে আমি খেয়েছি, পান করেছি। তুমি আমার উপর একসময় সদয় হয়েছিলে বলে আমি তোমায় জাহাজও দেব।

    বলে সে তাকে এমন এক জাহাজ দিল যা জলেও চলে ডাঙায়ও চলে। রাজা তখন আর রাজকন্যাকে ধরে রাখতে পারলেন না। বিয়ে হয়ে গেল। রাজার মৃত্যুর পর হাঁদুরাম রাজত্ব পেল। সে তার বৌ নিয়ে সুখে রাজত্ব করতে লাগল।

    টীকা