Chapter Index

    এক সময় এক রানী ছিলেন, তাঁর ছিল একটি কচি মেয়ে। একদিন খুকিটি এমন দুষ্টুমি করছিল যে কিছুতেই মায়ের কথা শুনছিল না।

    রানীর ধৈর্যচ্যুতি হল। রাজপ্রাসাদের চারিদিকে দাঁড়কাক উড়ছিল। রানী জানলা খুলে বললেন—যা তুই দাঁড়কাক হয়ে উড়ে, তাহলে আমার হাড়ে বাতাস লাগে!

    যেই না বলা অমনি খুকিটি দাঁড়কাক হয়ে জানলা দিয়ে উড়ে পালিয়ে গেল। উড়তে উড়তে সোজা চলে গেল সে এক অন্ধকার বনের মধ্যে। তার কী যে হল তার বাপ-মা আর কোন খবর পেলেন না।

    একদিন একটি লোক বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, সে শুনল দাঁড়কাক ডাকছে।

    কাছে আসতে শুনলে দাঁড়কাক বলছে—আমি এক রাজকন্যা। জাদুতে দাঁড়কাক হয়ে গেছি। কিন্তু তুমি এই জাদু ভাঙতে পারো।

    লোকটি বললে—কী করতে হবে বল?

    —বনের মধ্যে আরো গভীরে ঢুকে পড়। সেখানে দেখবে এক বাড়ি, তার মধ্যে এক বুড়ি। বুড়ি তোমায় খাবার লোভ দেখাবে, কিন্তু কিচ্ছু ছুঁয়ো না। কিছু যদি মুখে দাও, তাহলে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়বে, আর আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। বাড়ির পিছনে এক বাকলের স্তূপ আছে। তারই উপর দাঁড়িয়ে তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো। পর-পর তিন দিন আমি আসব ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। চার ঘোড়ায় টানবে। প্রথম দিনে টানবে সাদা ঘোড়া, দ্বিতীয় দিনে খয়েরি, তৃতীয় দিনে কালো। তুমি যদি লেগে না থাকো তো আমি উদ্ধার হব না।

    লোকটি বললে—বেশ, তুমি যা বলছ তাই করব।

    কিন্তু দাঁড়কাক বললে—হায়! আমি জানি তুমি আমায় উদ্ধার করতে পারবে না। বুড়ি যা দেবে তাই তুমি খাবে, আমার জাদুও কাটবে না।

    লোকটি আবার বললে—আমি, বুড়ির কাছ থেকে কিছুই খাব না। কিন্তু বাড়ির কাছে আসতেই বুড়ি বললে—আহা বেচারি! কত ক্লান্ত তুমি! এস বোসো তোমায় খাবার দি।

    লোকটি বললে—আমি খাবারও খাবো না, জলও ছুঁবো না।

    কিন্তু বুড়ি ছাড়ল না, বললে—বেশ তুমি যদি খাবার না খাও, অন্তত এই গেলাস থেকে এক চুমুক খাও। এক চুমুকে আর কী হবে?

    অগত্যা গেলাসে মুখ দিয়ে সে এক চুমু খেল।

    ঘড়িতে প্রায় যখন দুটো বাজে, সে বাগানে গিয়ে বাকলের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে রইল দাঁড়কাকের জন্যে। হঠাৎ তার দেহের উপর যেন রাজ্যের ক্লান্তির বোঝা নেমে এল। পায়ের উপর আর দাঁড়াতেই পারল না। ভাবল ঘুমোবো তো না, একটু শুই। কিন্তু শুতে না শুতেই তার চোখ বুজে এল আর সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। এমনই ঘুম, যে পৃথিবী উল্টে গেলেও তা ভাঙত না।

    ঠিক দুটোর সময় চার সাদা ঘোড়ার গাড়ি করে দাঁড়কাক এসে হাজির। সে বেচারার ভারি দুঃখ। বললে—আমি জানি ও ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ি থেকে নেমে তার কাছে গিয়ে দাঁড়কাক তাকে ঝাঁকাতে লাগল, তার নাম ধরে ডাকতে লাগল; কিন্তু সে জাগল না।

    পরের দিন রাত্রে খাবার সময় বুড়ি আবার নানারকম খাবার জিনিস নিয়ে এল কিন্তু সে বললে—কিছু খাও না। কিন্তু বুড়িও ছাড়ল না, যতক্ষণ-না সে একটু কিছু মুখে দেয়। শেষে বুড়ি তাকে গেলাস থেকে এক চুমুক সরবত খাইয়ে ছাড়ল।

    দুটো যখন বাজে বাজে সে আবার বাগানে গিয়ে বাকলের স্তূপের উপর দাঁড়ালো দাঁড়কাকের জন্যে। কিন্তু হঠাৎ সে এত ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে সেইখানেই লুটিয়ে পড়ে অঘোর ঘুমে তলিয়ে গেল।

    দাঁড়কাক তখন তার খয়েরি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে এল; সে বললে—আমি জানি আজকে আবার ও ঘুমিয়ে পড়েছে। দাঁড়কাক তার কাছে গিয়ে দেখল সে ঘুমোচ্ছ। তাকে জাগানো গেল না।

    পরদিন বুড়ি তাকে বললে—করছ কী তুমি? খাবার খাবে না, জল খাবে না, এ রকম করলে তো মারা যাবে!

    সে বললে—আমার খাওয়া বারণ, খেতে আমি চাইও না। বুড়ি তার সামনে খাবার আর সরবত রেখে দিয়ে চলে গেল। বুড়ি চলে যেতে সে আর পারল না, সরবতটুকু খেয়ে শেষ করল।

    সময় হলে সে বাগানে গিয়ে বাকলের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়কাকের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সেদিন তার ক্লান্তি আরও বেশি। শুতেই একটা কাঠের কুঁদোর মত ঘুমিয়ে পড়ল।

    দুটোর সময় দাঁড়কাক এল চার কালো ঘোড়ার গাড়ি করে। গাড়িও কালো, দাঁড়কাকও কালো। দাঁড়কাক মনের দুঃখে বললে—আমি জানি ও ঘুমিয়ে পড়েছে। যতই ঝাঁকাক, যতই ডাকুক, সে উঠল না।

    যখন দেখলে কিছুতেই কিছু হল না তখন দাঁড়কাক তার পাশে এক টুকরো রুটি রাখল, এক টুকরো মাংস রাখল আর এক বোতল সরাব রাখল। তারপর তার নিজের নাম লেখা একটি সোনার আংটি নিয়ে লোকটির আঙুলে পরিয়ে দিল। শেষে একটি চিঠি লিখল—এই রুটি এই মাংস, এই সরাব কোনোদিন ফুরোবে না। এখানে তো তুমি আমায় উদ্ধার করতে পারলে না। কিন্তু যদি আমায় উদ্ধার করতে চাও তাহলে স্ট্রমবার্গের সোনার প্রাসাদে এসো।

    চিঠিটা রেখে দিয়ে সে গাড়িতে গিয়ে বসল। গাড়ি ছুটল স্ট্রমবার্গের সোনার প্রাসাদে।

    লোকটি ঘুম থেকে উঠে যখন বুঝল যে সে ঠিক সময়টিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তার মনের উপর এক ভার নেমে এল। সে বললে—রাজকন্যা নিশ্চয়ই এসেছিলেন। আমি তাঁকে উদ্ধার কতে পারলাম না।

    তারপর যে-সব জিনিস রাজকন্যা রেখে গিয়েছিলেন তার উপর তার চোখ পড়ল। চিঠি পড়ে সে জানল কী হয়েছে। তখন সে উঠে বেরিয়ে পড়ল স্ট্রমবার্গের সোনার প্রাসাদের খোঁজে। কিন্তু কোথায় সে সোনার প্রাসাদ তার কিছুই সে জানত না।

    অনেক দিন নানা জায়গায় ঘুরে অবশেষে এক অন্ধকার বনের মধ্যে ঢুকে তার পথ হারিয়ে গেল। পনের দিন তার মধ্যে ঘুরে একদিন ভারি ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমাবার জন্যে এক ঝোপের নিচে শুয়েছে, সেই সময় হঠাৎ দেখল দূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। চলল তখন সেইদিকে। সেখানে পৌঁছে দেখল একটা বাড়ির মধ্যে থেকে আলো আসছে। কিন্তু বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রকাণ্ড দৈত্য, তাই বাড়িটাকে মনে হচ্ছে নেহাত ছোট। সে ভাবলে—এখন যদি আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকি আর দৈত্য আমায় দেখতে পায়, তাহলে আমায় প্রাণ রেখে আসতে হবে। এটা ভেবেও সে কিন্তু এগিয়ে গেল।

    দৈত্য তাকে দেখে বললে—ভালই হল তুমি এলে। অনেক কাল আমি কিছু খেতে পাইনি। তুমি আজকে আমার রাতের খোরাক হবে।

    লোকটি বললে—আমাকে না খাওয়াই বরং ভাল। কেউ আমায় খাক এটা আমি চাই না। আর তোমার যদি খিদেই পেয়ে থাকে, তোমার পেট ভরাবার মতো আমার কাছে যথেষ্ট খাবার আছে।

    দৈত্য বললে—তুমি যদি সত্যি কথা বলে থাকো তাহলে নিশ্চিন্ত থাকো। আর কিছু খাবার আমার নেই বলেই তোমায় খেতে চাইছিলুম।

    তখন তারা বাড়িতে ঢুকে টেবিলের ধারে বসল। লোকটি তার রুটি, মাংস আর সরাব বার করে টেবিলে রেখে বললে—এ খাবার কোনদিন ফুরোবে না।

    দৈত্য বললে—ঠিক এমনি জিনিসই আমার দরকার। বলে পেট ভরে সে খেল।

    লোকটি জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, স্ট্রমবার্গের সোনার প্রাসাদ কোথায় বলতে পারো?

    দৈত্য বললে—আমার ম্যাপ দেখে বলে দিতে পারি। ম্যাপে সব শহর গ্রাম বাড়ি দেখানো আছে।

    ম্যাপ এনে কিন্তু দেখা গেল তাতে সোনার প্রাসাদের কোন চিহ্ন নেই।

    দৈত্য তখন বললে—আরো বড় ম্যাপ আমার আছে—দাঁড়াও আনছি।

    শেষে খুব পুরোনো এক ম্যাপে স্ট্রমবার্গের সোনার প্রাসাদ পাওয়া গেল। কিন্তু তা হাজার হাজার মাইল দূরে।

    লোকটি বললে—ওখানে পৌঁছবার উপায় কী?

    দৈত্য বললে—আমার হাতে ঘণ্টা-দুই সময় আছে, আমি তোমাকে প্রাসাদের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি। তার চেয়ে দূরে নিয়ে যেতে পারব না, কারণ আমায় আবার ফিরতে হবে।

    দৈত্য তাকে নিয়ে প্রাসাদ থেকে একশো মাইল দূরে পৌঁছে দিল। বললে—এবার তুমি নিজেই যেতে পারবে। দৈত্য চলে যেতে লোকটি হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে একদিন সোনার প্রাসাদের কাছে এসে পৌঁছল।

    এক কাঁচের পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সেই প্রাসাদ। জাদু-করা রাজকন্যা তাঁর ঘোড়ার গাড়ি করে রোজ তার চারিদিকে ঘুরতেন। রাজকন্যাকে দেখে লোকটির এত আনন্দ হল যে সে ভাবলে এখনই রাজকন্যার কাছে যাই। কিন্তু পাহাড়ে চড়তে গিয়ে দেখল, এত পিছল যে পা দিলেই পিছলে পড়ে যেতে হয়।

    যখন সে দেখল রাজকন্যার কাছে পৌঁছতে পারবে না, সে মনের দুঃখে বললে—আমি এখানেই চিরদিন বসে থাকব রাজকন্যার অপেক্ষায়।

    সেখানে ছোট একটি কুটির বানিয়ে সে এক বছর কাটিয়ে দিলে। প্রত্যেক দিন দেখত উপরে রাজকন্যা প্রাসাদের চারিদিকে ঘোড়ার গাড়ি করে ঘুরছেন তো ঘুরছেন। কিন্তু সে সেখানে পৌঁছতে পারত না।

    তারপর একদিন সে দেখল তিনজন ডাকাত নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। সে চেঁচিয়ে বললে—ভগবান তোমাদের সহায় হোন।

    তারা থেমে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার লড়াই শুরু করল।

    তিন বারের বার আবার সে বললে—ভগবান তোমাদের সহায় হোন।

    তারা আবার লড়াই থামিয়ে চারিদিকে দেখল। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে বাঘের মত লড়তে থাকল এবার।

    সে তখন মনে মনে বললে—দেখে আসি ব্যাপারটা কী!

    ডাকাতদের কাছে এগিয়ে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল—কেন তোমরা লড়ছ? একজন বললে সে একটা লাঠি খুঁজে পেয়েছে সেটা দিয়ে ছুঁলেই যেকোন বন্ধ দরজা আপনি খুলে যায়। দ্বিতীয় জন বললে সে একটা গা-ঢাকা পেয়েছে যেটা গায়ে পরলেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায়। তৃতীয় ব্যক্তি বললে সে একটা ঘোড়া ধরেছে যে সব জায়গায় চরতে পারে, এমনকি কাঁচের পাহাড়েও। তাদের মধ্যে এমন ঝগড়া; সম্পত্তিগুলো সকলের একসঙ্গে থাকবে, না আলাদা আলাদা ভাগ হবে?

    লোকটি বললে—তোমরা যদি চাও, জিনিসগুলির বদলে আমি অন্য কিছু দিতে পারি। আমার কাছে টাকাকড়ি নেই, কিন্তু টাকার চেয়েও দামি কিছু আছে। কিন্তু তার আগে তোমাদের জিনিসগুলি আমার একবার পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার তোমরা সত্যি কথা বলছ কি না।

    ডাকাতরা রাজি হতে সে ঘোড়ায় চড়ে লাঠি হাতে নিয়ে গা-ঢাকা গায়ে দিল। সব জিনিস যেই সে পেল অমনি তাকে আর কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না।

    তারপর সে প্রত্যেক ডাকাতকে কয়েক ঘা কষিয়ে বললে—এই তোদের প্রাপ্য, হতভাগারা! এই নিয়েই খুশি থাক্!

    বলে সে কাঁচের পাহাড়ে গিয়ে উঠল। উপরে উঠে প্রাসাদে পৌঁছে দেখল প্রাসাদের দরজা বন্ধ। তার লাঠি দিয়ে ছুঁতেই দরজা খুলে গেল।

    সে তখন প্রাসাদে ঢুকে সোজা সভাঘরে গিয়ে দেখল, রাজকন্যা বসে আছেন। সামনে এক সোনার পেয়ালায় একপেয়ালা সরাব। গা-ঢাকা গায়ে ছিল বলে রাজকন্যা তাকে দেখতে পেলেন না। সে তখন রাজকন্যার দেওয়া আংটিটি আঙুল থেকে খুলে সরাবের পেয়ালায় টুং করে ফেলে দিল।

    রাজকন্যা বললেন—এই তো আমার আংটি। আমার উদ্ধারকর্তা তাহলে এখানেই আছেন।

    অনুচরেরা সারা প্রাসাদে তাকে খুঁজল, কিন্তু কোথাও পেলে না। সে বাইরে গিয়ে গা-ঢাকা খুলে ঘোড়ায় চড়ে বসল। অনুচরেরা তাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল।

    সে তখন ঘোড়া থেকে নেমে রাজকন্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। রাজকন্যা বললেন—এতদিনে তুমি আমায় উদ্ধার করলে। কাল আমাদের বিয়ের উৎসব হবে।

    টীকা