Chapter Index

    একদিন এক বুড়ো চাষী আর তার স্ত্রী তাদের ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে কাজের শেষে বসে ছিল। হঠাৎ চার কালো ঘোড়ায় টানা এক জমকালো গাড়ি তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো আর তার থেকে নামলেন খুব দামি পোশাক পরা এক ভদ্রলোক। চাষী উঠে দাঁড়িয়ে সেই বড়লোকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি কী চান, আর সে-ই বা তাঁর জন্যে কিছু করতে পারে কি না। বিদেশীটি হাত বাড়িয়ে বুড়ো চাষীকে অভিবাদন করে বললেন—আমি আর কিছুই চাই না। শুধু একবার কিছু চাষাড়ে খাবার খেতে চাই। আমার জন্যে কিছু আলু সেদ্ধ করুন যেমন করে আপনারা রাঁধেন ঠিক তেমনি। তারপর আপনাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে আমি আহ্লাদ করে খাব। চাষী হেসে বললে—আপনি নিশ্চয় কোন মস্ত জমিদার বা রাজপুত্র। বড়লোকেদের এইরকম ধরনের অদ্ভুত ইচ্ছা মাঝে মাঝে জাগে। যাই হোক, আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।

    চাষী-বৌ রান্নাঘরে গিয়ে আলুগুলি ঘষে ঘষে ধুতে লাগল। তারপর পাড়াগেঁয়ে লোকেরা যেমন খায় তেমনি আলুর ছোট ছোট গোলা তৈরি করল। যখন চাষী-বৌ এই কাজে ব্যস্ত, চাষী বিদেশীটিকে বললে—আসুন আমার সঙ্গে বাগানে একটু। ওখানে আমার কিছু কাজ আছে। চাষী বাগানে কতকগুলি গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল, তাতে সে কয়েকটি গাছ লাগাবে।

    বিদেশীটি জিজ্ঞেস করলেন—আপনার কি কোনো ছেলেপিলে নেই যে আপনার কাজে হাত লাগাতে পারে?

    চাষী জবাব দিলে—না। আমার একটি ছেলে ছিল সত্যি কিন্তু বহুকাল আগে সে দুনিয়া ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। ছেলেটার কোনো কাজে মন ছিল না। বুদ্ধি ছিল জ্ঞান ছিল, কিন্তু কোনো কাজ শেখেনি—শিখেছিল শুধু দুষ্টুমি। শেষটা সে বাড়ি ছেড়ে পালালো। তারপর থেকে তার আর কোনো খবর নেই।

    বুড়ো চাষী একটি কচি চারা নিয়ে গর্তে বসিয়ে তার পাশে একটি কাঠি পুঁতে দিলে। কোদালে করে কিছু মাটি তুলে গর্তে ভরে পায়ে করে চেপে মাটি সমান করে দিলে। তারপর চারার নিচে মাঝে একটা আর উপরে একটা দড়ি দিয়ে কাঠির সঙ্গে আঁট করে বেঁধে দিলে।

    বিদেশী বললেন—আচ্ছা বলুন তো, ঐ যে বাঁকাচোরা গাছটি ঐ কোণে প্রায় মাটি অবধি লুটিয়ে পড়ে রয়েছে, কই ওটিকে তো আপনি কাঠির সঙ্গে বেঁধে সমান করে দেবার চেষ্টা করছেন না?

    বুড়ো একটু হেসে বললে—মশায়, আপনি শহরের লোক, তাই, বোধহয় বাগান করা বোঝেন না। ওদিকের ঐ গাছ বাঁকাচোরা হয়েই বুড়ো হয়ে গেছে। ওকে আর কেউ সোজা করতে পারবে না। কচি চারা অবস্থাতেই গাছকে সোজা করতে হয়।

    বিদেশী বললেন—আপনার ছেলের বেলাতেও বোধহয় তাই হয়েছিল। তাকে যদি ছেলেবেলা থেকেই ভালো করে মানুষ করতেন, সে হয়ত পালিয়ে যেত না। এখন সে-ও নিশ্চয় বাঁকাচোরা হয়ে বেড়ে শক্ত হয়ে গেছে।

    বুড়ো বললে—সত্যি, বহুকাল হল সে চলে গেছে। নিশ্চয়ই আগের মত আর নেই। অনেক বদলে গেছে।

    বিদেশী বললেন—আপনার ছেলে আজ ফিরে এলে তাকে আপনি চিনতে পারবেন?

    বুড়ো বললে—মুখ দেখে চেনা শক্ত হবে। কিন্তু গায়ে একটা চিহ্ন আছে। জন্ম থেকে তার কাঁধে একট শিমের বিচির মতো দাগ ছিল।

    এই কথা বলতেই বিদেশী তাঁর কোট খুলে কাঁধ বার করে বুড়োকে দেখিয়ে বললেন—দেখুন তো, এটা কী?

    বুড়ো চেঁচিয়ে উঠে বললে—হা ভগবান। সত্যিই তুমি আমার সেই হারানো ছেলে? বুড়োর পুরনো ভালোবাসা উথলে উঠল। সে বললে—কিন্তু তোমার যখন এত টাকাকড়ি এত বড়লোকোমি, জমিদারের মতো হাবভাব—তুমি আমার ছেলে হবে কী করে? এত টাকা করলে কী করে?

    ছেলে বললে—বাবা, চারাগাছকে সোজা কাঠির গায়ে বেঁধে দেওয়া হয়নি। সে তেড়াবাঁকা হয়ে বেড়ে উঠেছে। এই বয়সে তার আর সোজা হবার উপায় নেই। কী করে আমি এত সব পেলুম? আমি চুরি-বিদ্যে শিখেছি। চোর হয়েছি। কিন্তু ভয় পেও না বাবা। আমি হচ্ছি চোর-চূড়ামণি। আমার কাছে তালাও কিছু নয়, ছিটকিনি হুড়কোও কিছু নয়। যা আমি চাই তাই আমি পাই। ভেবো না সাধারণ আর-সব চোরের মত আমি চুরি করি। আমি শুধু বড়লোকদের যা বাড়তি আছে তাই নিয়ে নি। গরিবদের আমি কিছু বলি না, বরঞ্চ তাদের কিছু দিই। তাদের কাছ থেকে কখনও নিই না। সহজে যা চট্‌ করে পাওয়া যায় তা আমি ছুঁই না। যাতে বুদ্ধি লাগে, তৎপরতা লাগে, হাত-সাফাই লাগে, যাতে ঝঞ্ঝাট আছে, শুধু সেই কাজেই আমি হাত লাগাই।

    বাবা বললেন—হায়, এসব শুনেও আমি খুশি হতে পারলুম না। চোর সে চোরই। এর ফল ভালো হবে না বলে দিলুম।

    বুড়ো ছেলেকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেল। বুড়ি যখন শুনলে তার ছেলে ফিরে এসেছে, সে আনন্দে কেঁদে ফেললে। কিন্তু তারপর বুড়ো যখন বুড়িকে বললে, ছেলে চোর-চূড়ামণি হয়ে ফিরে এসেছে, তখন তার দু-চোখ দিয়ে ধারা নামল। অনেক কেঁদে শেষে বুড়ি বললে—চোর হয়েছে হোক। তবু আমার ছেলে তো? আবার আমার চোখ তো ওকে দেখতে পেল!

    তারা টেবিলের ধারে বসে গেল খেতে। অনেক দিন পরে ছেলে তার বাপ-মার সঙ্গে একসঙ্গে বসে সেই পুরোনো দিনের চাষাড়ে খাবার খেতে লাগলো যা কতকাল সে খায়নি।

    বাবা বললেন—আমাদের জমিদারমশাই, যিনি ঐ প্রাসাদে থাকেন, যদি একবার শোনেন তুমি কে, আর তোমার পেশাটি কী, তাহলে তিনি ছেলেবেলায় তোমার নামকরণের দিনে যেমন তোমায় কোলে করে আদর করেছিলেন তেমন আর করবেন না বরং দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেবার কথা ভাববেন।

    —ভেবো না বাবা। উনি আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। পেশাদার মানুষ আমি, কেমন করে নিজেকে সামলাতে হয় জানি। আমি নিজেই আজ ওঁর কাছে যাব দেখা করতে।

    সন্ধে যখন হয়-হয় সেই সময় চোড়-চূড়ামণি তার গাড়িতে চড়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে প্রাসাদে গিয়ে হাজির হল।

    জমিদার তাকে মস্ত লোক ভেবে খুব খাতির করলেন। তারপর যখন তার আসল পরিচয় পেলেন জমিদারমশাইয়ের মুখ সাদা হয়ে গেল। অনেকক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন। শেষে তিনি বললেন—তোমার নামকরণের সময় তোমাকে আমার ধর্মপুত্তুর করেছিলুম। তাই বিচারের বদলে আমি তোমায় দয়াই দেখাবো। তোমায় কঠিন কোনো শাস্তি দেব না। তুমি যখন গর্ব করে বলছ তুমি চোর-চূড়ামণি, তোমার বিদ্যের আমি পরীক্ষা করব। যদি পরীক্ষায় তুমি উৎরে না যাও তাহলে তোমায় ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে।

    চোর-চূড়ামণি বললে—মাননীয় জমিদারমশাই! যত কঠিন হোক তিনটে কাজের কথা ভাবুন। যদি সেগুলি আমি করতে না পারি, আমাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারেন।

    জমিদার খানিকক্ষণ ভাবলেন। ভেবে বললেন—বেশ, তাহলে প্রথমে আমি নিজে যে ঘোড়ায় চড়ি সেই ঘোড়াটি তোমায় আস্তাবল থেকে চুরি করে নিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়, আমার শোবার ঘরে আমি আর আমার স্ত্রী যখন ঘুমোবো, তখন আমাদের নিচে থেকে বিছানার চাদরটি চুরি করে আর আমার স্ত্রীর হাত থেকে আমাদের বিয়ের আংটিটি নিয়ে পালাতে হবে। তৃতীয় কাজ, গির্জে থেকে বড় যাজক আর ছোট যাজককে চুরি করে নিয়ে যেতে হবে। তবে শুনে রাখো আমি যা বলছি—এরই উপর তোমার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।

    চোর-চূড়ামণি কাছের এক শহরে চলে গেল। সেখানে গিয়ে গ্রামের চাষানীরা যেমন পোশাক পরে তেমনি একটা পোশাক কিনে নিজে পরলে। মুখে তামাটে রঙ লাগিয়ে তাতে সরু সরু বলি-রেখা এঁকে দিল যাতে কেউ না তাকে চিনতে পারে। তারপর একটা ছোট পিপেতে পুরোনো হাঙ্গেরি দেশের সরাব ভরলে, তাতে একটা কড়া ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলে। পিপেটা একটা ঝুড়িতে বসিয়ে ঝুড়িটা পিঠে নিয়ে আস্তে আস্তে খোঁড়াতে খোঁড়াতে জমিদারের প্রাসাদের দিকে চলল। সেখানে এসে যখন পৌঁছল তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। উঠোনে একটা পাথরের উপর বসে সে হেঁপো রুগির মতো খক্‌-খক্‌ করে কাশতে লাগল আর দু-হাত ঘসতে লাগল, শীত করছে এই ভাব দেখিয়ে। আস্তাবলের দরজার সামনে কতকগুলি সৈন্য আগুনের ধারে শুয়ে ছিল। তাদের একজন বুড়িকে দেখে চেঁচিয়ে ডাকল—ও বুড়িমা, এখানে এসে একটু গরম হয়ে নাও না! তোমার তো দেখছি আর রাতে কোনো বিছানা জুটবে না। তাহলে যা পাও তাই নাও না!

    বুড়ি খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাদের কাছে গিয়ে বললে—তোমাদের কেউ আমার পিঠ থেকে ঝুড়িটা একটু নামিয়ে দাও বাছা! তারপর সৈনিকদের পাশে আগুনের ধারে গিয়ে বুড়ি বসল।

    একজন জিজ্ঞেস করল—তোমার পিপেতে কী আছে বুড়িমা?

    বুড়ি. বললে—ভালো সরাব আছে। সরাব বেচে আমি খাই বাছা। যদি পয়সা দিয়ে কেনো তো এক পেয়ালা পেতে পারো।

    সৈনিক বললে—দেখি, তাহলে দাও।

    এক পেয়ালা সরাব খাবার পর সৈনিক বললে—সরাব ভালো হলে আমি এক পেয়ালার জায়গায় দু পেয়ালা খাই। বলে সে আর এক পেয়ালা সরাব ঢেলে নিয়ে খেল। আর সকলেও তার দেখাদেখি তাই করল। তাদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে আস্তাবলের ভিতরে যারা ছিল তাদের ডাকল—শুনছ ভাই-দোস্তরা! এখানে এক বুড়ি এসেছে, তার কাছে যা পুরোনো সরাব আছে, বুড়ির নিজের বয়সের মতো! একঢোক খেয়ে দেখো—আগুনে যা গরম হচ্ছ, তার চেয়ে গরম হয়ে যাবে। বুড়ি তার পিপে নিয়ে আস্তাবলে গিয়ে ঢুল। একজন সৈনিক জিন-পরা ঘোড়ার পিঠে বসেছিল—একজন তার লাগাম ধরে, আর একজন তার ল্যাজ। সরাবের গন্ধে তাদের মুখে জল এল। এক পাত্রের পর এক পাত্র। যত পায় তত চায়। শেষে বুড়ির পিপেই গেল খালি হয়ে। একটু পরে যে লাগাম ধরেছিল তার হাত থেকে লাগাম গেল খসে। নিজে সে মাটিতে পড়ে গিয়ে নাক ডাকাতে লাগল। অপরজন ল্যাজ ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে আরো জোরে নাক ডাকাতে লাগল। জিনের উপর যে বসে ছিল সে বসেই রইল বটে, কিন্তু তার মাথা ঝুলে পড়ল প্রায় ঘোড়ার গলা পর্যন্ত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার মুখ দিয়ে হাপরের মত শব্দ বার হতে লাগল। বাইরের সৈনিকরা সবাই ঘুমোচ্ছ মাটির উপর নিঃসাড়ে শুয়ে যেন মড়ার মতো। চোর-চূড়ামণি যখন দেখল যে ওষুধ ধরেছে, সে প্রথম সৈনিকের হাতে লাগামের বদলে একটুকরো দড়ি ধরিয়ে দিলে। যে লেজ ধরে ছিল তার হাতে একটুকরো খড় দিলে, কিন্তু যে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে আছে তাকে নিয়ে কী করা যায়? উপর থেকে ওকে গড়িয়ে ফেললে চলবে না—ঘায়ের চোটে জেগে উঠতে পারে, চেঁচামেচি করতে পারে। সে তখন করলে কী, জিনের বাঁধনগুলি ঘোড়ার গা থেকে খুলে দিলে। দেয়ালে আংটার সঙ্গে লাগানো একজোড়া দড়ি ঝুলছিল। সেই দড়ির অন্য মুখ জিনের সঙ্গে কষে বেঁধে দিলে, তারপর একটু টান দিতেই জিনশুদ্ধ ঘোড়সওয়ার শূন্যে ঝুলে রইলেন। সে তখন দড়ির আগা টান করে থামের সঙ্গে বেঁধে দিলে। তারপর ঘোড়াকে জিনের তলা থেকে বার করে আনল। পাছের পাথরের উপর চলতে গিয়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ হয় তাই খুর চারটি ছেঁড়া কম্বলে জড়িয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে তাকে বার করে নিয়ে গেল। বাইরে ঘোড়াকে এনেই তার পিঠে চড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে পালালো।

    সকাল হতেই টগ-বগ করে ঘোড়া হাঁকিয়ে চোর-চূড়ামণি প্রাসাদে এসে হাজির। জমিদারমশাই তখন সবে ঘুম থেকে উঠে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখছেন।

    —নমস্কার জমিদার প্রভু! এই নিন আপনার ঘোড়া। আপনারই আস্তাবল থেকে নিয়ে গিয়েছিলুম। বিশেষ কষ্ট হয়নি। দেখুন একবার আপনার সৈনিকরা কেমন সুন্দর ঘুমোচ্ছে আর আস্তাবলের ভিতরে যদি একবার উঁকি দেন, দেখবেন আপনার পাহারাদাররা কত আয়েসে আছে।

    জমিদার হেসে বললেন—বেশ, প্রথমবার তুমি সফল হলে। কিন্তু দ্বিতীয়বার অতটা সহজ হবে না। আর আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি, আমার সামনে তুমি যদি চোর হিসেবে আসো তাহলে চোরের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করা দরকার তেমনই করব।

    সেদিন রাত্রে জমিদার-গিন্নি যখন শুতে গেলেন, যেহাতে তাঁর বিয়ের আংটি সে হাত মুঠো করে রইলেন। জমিদার বললেন—সব দরজায় তালা দেওয়া, ছিটকিনি দেওয়া। আমি জেগে চোরের জন্যে অপেক্ষা করব। চোর যদি জানলা দিয়ে ঢেকে তো তাকে গুলি করব।

    অন্ধকার হতে চোর-চূড়ামণি ফাঁসিকাঠের কাছে গেল। গিয়ে ফাঁসিকাঠ থেকে একটা মড়া নামিয়ে তাকে পিঠে করে প্রাসাদে নিয়ে গেল। তারপর জমিদারের শোবার ঘর পর্যন্ত সে একটা মই লাগালো। মড়াটাকে কাঁধে ফেলে উঠতে লাগল মই বেয়ে। জানলার কাছ পর্যন্ত উঠে মরা মানুষের মাথাটা সে জানলার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিলে। জমিদার তাঁর বিছানায় শুয়ে শুয়ে লক্ষ রাখছিলেন। তিনি যেই দেখলেন জানলায় মানুষের মাথা, অমনি গুলি চালালেন। সঙ্গে সঙ্গে চোর-চূড়ামণি কাঁধ থেকে মড়াটাকে ফেলে দিলে আর নিজে এক ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে রইল। সেইখান থেকে চোর-চূড়ামণি চাঁদের আলোয় দেখল জমিদারমশাই জানলা দিয়ে বেরিয়ে মই বেয়ে নেমে এলেন। নিচে এসে মড়াটাকে তুলে বাগানে নিয়ে এলেন। এনে তাকে পুঁতে ফেলবার জন্যে মাটি খুঁড়তে লাগলেন।

    চোর-চূড়ামণি ভাবল—এইবার সুযোগ। ভেবে আস্তে আস্তে তার লুকোনো কোণ থেকে বেরিয়ে মই বেয়ে উঠে সোজা ঢুকল গিয়ে জমিদারনীর ঘরে।

    জমিদারের মত গলা করে সে বললে—গিন্নি, চোরটা মরেই গেল। হাজার হোক, আমার ধর্মপুত্র ছিল তো! কষ্ট হয়। ঘটনাচক্রে পড়ে আজ এমন হয়েছে, নইলে সত্যিই ও অত খারাপ নয়। তাই ভাবছি ব্যাপারটা বেশি জানাজানি না হওয়া ভালো। তা ছাড়া ওর বাপ-মার কথাটাও ভাবতে হবে। আলো হবার আগে আমি ওকে বাগানে গোর দিয়ে ফেলব যাতে কেউ না জানতে পারে। বিছানার চাদরটা দাও, ঐতে জড়িয়ে ওকে গোর দিয়ে দিই।

    জমিদারনী তাকে বিছানার চাদরটা দিলেন।

    চোর-চূড়ামণি জমিদারের মত গলায় আবার বললে—শোনো গিন্নি। বেচারা সামান্য একটা চাদর আর আংটির জন্যে প্রাণ দিল। চাদরটাই যখন ওকে দিলুম আংটিটাও দিই। নিয়ে যাক সঙ্গে। আমি অন্তত ভাবব ঐটুকু উপকার ওর করলুম। জমিদারনী কখনও জমিদারের কথা অমান্য করতেন না। তাই খুব ইচ্ছে না থাকলেও তিনি আঙুল থেকে আংটিটা খুলে তার হাতে তুলে দিলেন। চোর জিনিসটি নিয়ে নির্বিঘ্নে নিজের বাড়ি পৌঁছল জমিদার বাগানে মড়াটাকে পুঁতে ফেলবার আগেই।

    পরের দিন সকালবেলা চোর-চূড়ামণি যখন বিছানার চাদর আর আংটি নিয়ে হাজির হল, জমিদারের মুখ হয়ে গেল এত বড়। বললেন—তুমি কি ভেল্কিবাজি জানো নাকি হে? আমি নিজে হাতে তোমায় কাল মাটির নিচে গোর দিয়ে এলুম, সেখান থেকে তোমায় তুলে জ্যান্ত করে দিলে কে?

    চার বললে—আমাকে আপনি পোঁতেননি, পুঁতেছেন ফাঁসির মড়াকে। বলে যা যা হয়েছিল সব সে খুঁটিয়ে বলে গেল। জমিদার বলতে বাধ্য হলেন যে তার প্রখর বুদ্ধি, অসীম ধূর্ততা।

    —কিন্তু এখনও তো শেষ হয়নি। তৃতীয় কাজ এখনও বাকি। সেটা যদি না করতে পারো তাহলে সবই বৃথা।

    চোর-চূড়ামণি শুধু একটু হাসল। কোনো জবাব দিল না। রাত হলে সে পিঠে একটা লম্বা থলি ফেলে বগলে একটা পুঁটলি নিয়ে আর হাতে একটা লণ্ঠন ঝুলিয়ে গ্রামের গির্জেয় গিয়ে উপস্থিত হল। থলির ভিতর নিল কতকগুলি কাঁকড়া আর পুঁটলির মধ্যে ছোট ছোট মোমবাতি। গোরস্থানে গিয়ে বসে একটা কাঁকড়া বার করে তার পিঠে একটা মোমবাতি বসিয়ে দিলে। তারপর মোমবাতির পলতে জ্বেলে দিয়ে কাঁকড়াটাকে মাটিতে ছেড়ে দিলে যাতে সে চারিদিকে হেঁটে বেড়াতে পাবে। তারপর থলি থেকে আর-একটা কাঁকড়া বার করে তারও পিঠে মোমবাতি বসিয়ে জ্বালিয়ে ছেড়ে দিলে। এমনি করে সবগুলো কাঁকড়া। তারপর সে নিজে একটা লম্বা কালো আলখাল্লা পরল আর মুখে পরল একটা পাকা দাড়ি। সেই চেহারা করে সে থলিটা নিয়ে গির্জেয় ঢুকে বেদীর উপরে উঠে দাঁড়ালো। গির্জের চুড়োর ঘড়িতে তখন ঠিক বারোটা বাজছে। ঘড়ির শেষ ঘন্টা যেই না পড়া অমনি সে কান-ফাটানো শব্দে চিৎকার করে উঠল—শোনো পাপীর দল! প্রলয় উপস্থিত! সব কিছু শেষ হতে চলল! যে যে আমার সঙ্গে স্বর্গে যেতে চায় এই থলির মধ্যে এসে ঢুকুক। আমি মহর্ষি পিটার—স্বর্গের দরজা আমিই খুলি আর বন্ধ করি। ঐ দেখ যারা মারা গেছে তারা কবরস্থানে ঘুরে ঘুরে তাদের অস্থি সংগ্রহ করছে। এসো এসো, থলির মধ্যে ঢোকো। পৃথিবী এখনই ধ্বংস হয়ে যাবে!

    চিৎকারের শব্দ সমস্ত গ্রামে প্রতিধ্বনিত হল। বড় যাজক আর ছোট যাজক গির্জের সবচেয়ে কাছে থাকেন বলে তাঁরা সবার আগে শুনলেন। যখন তাঁরা দেখলেন গোরস্থানে ছোট ছোট আলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাঁরা ভাবলেন নিশ্চয়ই অসাধারণ কিছু একটা ঘটছে। তাঁরা গির্জের দিকে চললেন। কিছুক্ষণ সেই বক্তৃতা শোনবার পর ছোট যাজক বড় যাজককে বললেন—আমাদের দু-জনের এ সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না। প্রলয়ের আগেই স্বর্গে পৌঁছনো চাই। এই সহজ পথ হাতছাড়া করা ঠিক নয়।

    বড় যাজক বললেন—সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেই ঐ কথা ভাবছিলুম। তুমিও যখন রাজি তাহলে চল।

    ছোট যাজক বললেন—রাজি। কিন্তু আপনি বড়, আপনি আগে যান। আমি পিছনে যাচ্ছি।

    বড় যাজক প্রথমে গিয়ে বেদীতে উঠতেই চোর-চূড়ামণি থলি খুলে ধরল। বড় যাজক প্রথমে ঢুকলেন, তাঁর পিছনে ছোট। চোর-চূড়ামণি সঙ্গে সঙ্গে থলির মুখে শক্ত করে দড়ি বেঁধে দিল আর তার মাঝখানটা ধরে বেদীর সিঁড়ি দিয়ে টেনে নামাতে লাগল। যখনই দুই বোকার মাথা সিঁড়ির গায়ে ধাক্কা খেতে লাগল চোর-চূড়ামণি বলতে লাগল—আমরা পাহাড়ের উপর দিয়ে যাচ্ছি। তারপর চলল গ্রামের রাস্তা দিয়ে। যেই তারা রাস্তায় জমা জলের উপর দিয়ে যাচ্ছে, চোর চেঁচিয়ে বলছে—আমরা ভিজে মেঘের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। শেষে যখন সে তাদের নিয়ে প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল সে চেঁচিয়ে বললে—এবার আমরা স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। এখনই স্বর্গের উঠোনে এসে পৌঁছব। উপরে উঠে সে থলিটাকে পায়রাদের ঘরে ঠেলে গুঁজে দিলে। যখন চারিদিকে পায়রা উড়তে লাগল সে বললে—দেখ স্বর্গের দেবদূতরা কেমন ডানা ঝাপটাচ্ছেন। বলে দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে, হুড়কো টেনে দিয়ে চলে গেল।

    পরদিন সকালবেলা সে জমিদারের কাছে গিয়ে হাজির হয়ে বললে—সে তৃতীয় কাজটিও করেছে। বড় যাজক ছোট যাজক দুজনেই গির্জের বাইরে।

    জমিদার ব্যস্ত হয়ে বললেন—কোথায় তাঁরা?

    —তাঁর উপরে পায়রার ঘরে একটি থলির মধ্যে আছেন। তাঁরা ভাবছেন তাঁরা স্বর্গে এসেছেন।

    জমিদার নিজেই উপরে গেলেন। গিয়ে দেখলেন চোর-চূড়ামণি সত্যি কথাই বলেছে। বড় যাজক আর ছোট যাজককে মুক্ত করে দিয়ে জমিদার বললেন—তুমি সত্যিই ওস্তাদ চোর! চোর-চক্রবর্তী! বাজি জিতেছ। যাক, এবার তোমার গোটা চামড়াটাই বাঁচল। কিন্তু দেখ বাপু, তুমি আমার জমিদারি ছেড়ে যাও। এদিকে আর কখনও এসো না। এদিকে এলে এরপর তোমায় ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।

    চোর-চূড়ামণি তার বাপ-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল দুনিয়া টহল দিতে। সেই থেকে আর তাকে দেখা যায়নি।

    টীকা