Chapter Index

    বুনো গোলাপের বেড়াল

    অনেকদিন আগে এক রাজা আর এক রানী ছিলেন। তাঁরা প্রতিদিন এই বলে বিলাপ করতেন— আহা, আমাদের যদি একটি সন্তান থাকত! কিন্তু বছরের পর বছর তাঁদের কোল পড়ে থাকত শূন্যই।

    তারপর হঠাৎ একদিন যখন রানী দিঘিতে স্নান করছেন, একটা ব্যাঙ জল থেকে ডাঙায় উঠে এসে বললে— তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে মহারানী। আজ থেকে এক বছরের মধ্যে তোমার একটি মেয়ে হবে।

    ব্যাঙের কথা ফলল। রানী একটি ছোট্ট মেয়েকে জন্ম দিলেন। সে এমনই সুন্দরী আর রাজা তাকে দেখে এমনই আত্মহারা হয়ে গেলেন যে তিনি মস্ত এক ভোজের আয়োজন করলেন। আত্মীয়দের, বন্ধুদের, চেনাশোনা যে যেখানে আছে সকলকে নিমন্ত্রণ করলেন। আর করলেন পরীদের, যাতে তারা তাঁর মেয়েকে আশীবাদ করে যায়। রাজ্যে তেরটি পরী ছিল কিন্তু রাজার ছিল বারোটি সোনার থালা। কাজেই একজন পরী নিমন্ত্রণ থেকে বাদ পড়ল।

    খুব জাঁকজমকে ভোজ হল। খাওয়ার পর্ব যখন শেষ হল, পরীরা প্রত্যেকে কন্যাটিকে একটি করে উপহার দিলে। একজন দিলে ধর্ম, একজন রূপ, একজন ঐশ্বর্য এমনি করে দুনিয়ার যা কিছু কাম্য সবই দিলে।

    এইভাবে এগারো জন বর দিতেই হঠাৎ সেই ত্রয়োদশ পরীটি কোথা থেকে এসে হাজির হল। নিমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে সে প্রতিশোধ নিতে এসেছে।

    নমস্কার করা নয়, কারুর দিকে তাকানো নয়, ঢুকেই চড়া গলায় চিৎকার করে সে বললে— রাজকুমারীর পনের বছর বয়স হলেই সে চরকার টেকো ফুটে মরে পড়ে যাবে। এই শাপ দিয়েই আর কোনো কথা না বলে পরী ঘর ছেড়ে চলে গেল।

    সকলেই ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু দ্বাদশ পরী তখনো কিছু বলেনি; সে এগিয়ে এল। শাপকে কাটান দিতে সে পারল না, শুধু একটু নরম করে দিলে। সে বললে— রাজকুমারী পড়ে যাবেন বটে, কিন্তু একেবারে মারা যাবেন না। তিনি অঘোর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়বেন। একশো বছর ধরে এমনি ঘুমোবেন তিনি।

    রাজা তাঁর কন্যাকে অমঙ্গলের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এমনই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন যে তিনি হুকুম দিলেন সারা রাজ্যে যত চরকার টেকো আছে সমস্ত পুড়িয়ে ফেলতে।

    যেমন সময় যেতে লাগল পরীদের বর একে একে ফলতে লাগল। রাজকন্যা এত সুন্দরী, নম্র, দয়ালু আর বুদ্ধিমতী হয়ে উঠলেন যে সবাই তাঁকে ভালবাসতে লাগল। এখন হল কি, যেদিন তার ঠিক পনের বছর পূর্ণ হল, রাজা রানী সেদিন দূরে গিয়েছিলেন। প্রাসাদের মধ্যে রাজকন্যা ছিলেন একা। তিনি প্রাসাদের মধ্যে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে ঘোরাঘুরি করছিলেন। এমনকি করতে করতে এক পুরোনো গম্বুজের ঘরে এসে হাজির। গোল ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিনি অবশেষে এক দরজার সামনে এসে উপস্থিত হলেন। দরজায় একটা মরচে-পড়া চাবি লাগানো। চাবি ঘোরাতেই দরজাটা খুলে গেল। একটি খুপরি ঘরে বসে এক থুত্থুড়ি বুড়ি চরকা ঘুরিয়ে এক মনে শনের সুতো কাটছে।।

    রাজকন্যা বললেন— প্রণাম হই দিদিমা। আপনি কী করছেন?

    বুড়ি ঘাড় নেড়ে বললে— চরকা কাটছি।

    —ঐ যে বোঁ বোঁ করে ঘুরছে, ওটা কী? এই বলে রাজকন্যা চরকার টেকোর কাছে গিয়ে যেই না সেটাতে হাত দেওয়া অমনি তার শাপ ফলে গেল। টেকো ফুটে গেল হাতের আঙুলে। আর যেই না টেকো ফুটল সঙ্গে সঙ্গে রাজকন্যা পড়ে গেলেন তাঁর কাছেই যে বিছানা ছিল তার উপর। গভীর ঘুমে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘুম ছড়িয়ে পড়ল প্রাসাদের সব জায়গায়।

    রাজা রানী তখন সবে বাড়ি ফিরে হল-ঘরে প্রবেশ করেছেন। তাঁর আর সঙ্গের পারিষদেরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘোড়ারা ঘুমিয়ে পড়ল আস্তাবলে, কুকুররা উঠোনে, পায়রারা ছাদের ঘুলঘুলিতে আর মাছিরা দেয়ালের গায়েই। রান্নাঘরে উনুনের আগুনের গনগনানি পর্যন্ত থেমে স্তব্ধ হয়ে গেল। মাংস ফুটছিল, তার টগবগানি বন্ধ হয়ে গেল। বাসন-মাজা চাকর কি দোষ করেছিল বলে রাঁধুনি তাহার চুল ধরে টানছিল, সে চাকরের চুল ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। হাওয়া পড়ে গেল। প্রাসাদের সামনের গাছের পাতার নড়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল।

    সব কিছু থেমে গেল, কিন্তু প্রাসাদের চারিপাশ ঘিরে কাঁটাওয়ালা বুনো গোলাপের বেড়া বেড়েই চলল। তার বাড়া থামল না। প্রতি বছর উঁচু হতে থাকল সেই বেড়া। শেষে প্রাসাদের চারিপাশ ঘিরে এমন ঘন এমন উঁচু হয়ে পড়ল সেই কাঁটা-লতা যে বাইরে থেকে কিছুই আর দেখা যেত না। রাজপ্রাসাদের চুড়োর নিশেনটা পর্যন্ত নয়।

    কিন্তু সে দেশে লোকের মুখে-মুখে সুন্দরী রাজকন্যা বুনো গোলাপের নামে এক জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই শুনে সেই রাজকন্যা বুনো গোলাপের খোঁজে মাঝে মাঝে রাজপুত্রেরা আসতেন আর সেই বেড়া ভেঙে প্রাসাদে ঢোকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু পারতেন না। কাঁটার ঝোপ ভেঙে ঢোকা অসম্ভব হত। চারিদিক থেকে যেন নখওয়ালা হাত এসে তাঁদের জাপটে ধরত ; তাঁরা আর নিজেদের ছাড়াতে পারতেন না। সেইখানেই শুকিয়ে মরতেন।

    এরপর অনেক, অনেক বছর চলে গেল। সেই সময় একবার এক রাজপুত্র এলেন সেই দেশে। এসে এক বুড়োর মুখে গল্প শুনলেন যে, বুনো গোলাপ-বেড়ার পিছনে লুকোনো আছে এক রাজপ্রাসাদ। সেই প্রাসাদে বুনো গোলাপ নামে এক অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা একশো বছর ধরে ঘুমিয়ে আছেন। আর সেইসঙ্গে ঘুমিয়ে আছেন রাজা রানী সভাসদ পারিষদ সবাই। বুড়ো তার ঠাকুর্দার মুখে শুনেছে যে অনেক রাজকুমার বুনো গোলাপের বেড়া ভেদ করে ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করে শেষে কাঁটায় আটকা পড়ে ঐখানেই শুকিয়ে মরেছেন।

    রাজপুত্র বললেন— আমার ভয় নেই। আমি যাবই। গিয়ে সুন্দরী রাজকন্যা বুনো গোলাপকে খুঁজে বার করব।

    বুড়ো তাঁকে অনেক বুঝিয়ে ক্ষান্ত করবার চেষ্টা করল, কিন্তু রাজপুত্র তার কথায় কান দিলেন না।

    হয়েছিল কি, একশো বছর তখন সবে শেষ হচ্ছে। বুনো গোলাপের জেগে ওঠবার সময় এসেছে। রাজপুত্র যখন বেড়ার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন তখন বড় বড় গোলাপ ফুলে ভরে গেছে সেই বেড়া। সেইসব ফুল সরে গিয়ে রাজকুমারের জন্যে বেড়ার মধ্যে একটি পথ করে দিলে। রাজপুত্র সেই পথ দিয়ে ঢুকতেই ফুলেরা সরে এসে আবার বন্ধ করে দিল সেই পথ।

    উঠোনে গিয়ে তিনি দেখলেন ঘোড়া ঘুমোচ্ছ, গায়ে-ছোপ হাউণ্ড কুকুর ঘুমোচ্ছে। ছাদের ঘুলঘুলিতে পায়রারা ডানার মধ্যে মুখ গুঁজে ঘুম দিচ্ছে। প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে দেখেন দেয়ালে মাছি ঘুমোচ্ছে। সিংহাসনের কাছে রাজা আর রানী। রান্নাঘরে রাঁধুনি বাসন-মাজা চাকরকে মারবে বলে হাত তুলেই ঘুমিয়ে পড়েছে আর রান্নাঘরের ঝি কাটা-মুর্গিটা কোলে নিয়েই ঘুম দিচ্ছে।

    আরো এগিয়ে চললেন রাজার কুমার। চারিদিক এত নিস্তব্ধ যে নিজের নিশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। অবশেষে রাজপুত্র সেই গম্বুজের ঘরে যেখানে বুনো গোলাপ ঘুমিয়ে ছিলেন সেখানে এসে পৌঁছলেন। ফুলের মত শুয়ে আছেন সুন্দরী এক মেয়ে। রাজপুত্র সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। তিনি নিচু হয়ে রাজকন্যার মুখে একটি চুমু দিলেন।

    রাজপুত্রের ছোঁয়া পেতেই রাজকন্যা চোখ মেলে তাকালেন রাজপুত্রের দিকে। তারপর তাঁরা দুজনে নেমে এলেন গম্বুজের ঘর থেকে। রাজা জেগে উঠলেন, রানী জেগে উঠলেন, সভাসদ পারিষদ সবাই জেগে উঠলেন। উঠে সবাই সবার দিকে অবাক চোখে তাকাতে থাকলেন। আস্তাবলের ঘোড়ারা জেগে উঠে গা-ঝাড়া দিতে থাকল। কুকুরেরা লাফিয়ে উঠে ল্যাজ নাড়তে থাকল, পায়রারা ডানার মধ্যে থেকে মুখ বার করে নিয়ে চারিদিকে একবার তাকিয়ে উড়ে চলে গেল মাঠের দিকে। মাছিরা দেয়ালের গায়ে আবার হাঁটতে লাগল। উনুনের আগুন আবার গনগনে হয়ে উঠল। রান্না হতে থাকল। মাংস ফুটতে থাকল আর রাঁধুনি বাসন-মাজা চাকরের গালে এমন এক থাপ্পড় লাগালো যে সে চেঁচিয়ে উঠল। ঝি কাটা-মুরগির পালক ছাড়াতে শুরু করে দিলে।

    তারপর রাজপুত্রের সঙ্গে খুব ধুমধামে বুনো গোলাপের বিয়ে হয়ে গেল আর তারা জীবন কাটাতে থাকল সুখে।

    টীকা