শক্তিপরীক্ষা

    রামরিখ পালোয়ান রাজবাড়ি চলেছে। সেখানে আজ বিরাট শক্তিপরীক্ষা। নানা দেশ থেকে বহু পালোয়ান জড়ো হবে। তারপর কার কত শক্তি তার পরীক্ষা দিতে হবে। কুস্তি—টুস্তি নয়, শুধু যে যতটা পারে নিজের শক্তি দেখাবে, তা যে যেভাবে পারে। রামরিখ ভেবেচিন্তে একটা পাঁচ মন ওজনের লোহার গদা নিয়েছে। এইটে সে বাঁই বাঁই করে ঘুরিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। গদাটা একটা গোরুর গাড়িতে করে পেছনে আসছে।

    রামরিখ আজ ধুতি পরেছে। গায়ে রঙিন জামা, মাথায় পাপড়ি। মাঝে মাঝে গোঁফে তা দিতে দিতে নাগরা জুতোর শব্দ তুলে হাঁটছে। মনে একটু স্ফূর্তি। তার ধারণা, আজকের পরীক্ষায় সে—ই আসর মাত করে আসবে। ওস্তাদকে একশো মোহর পুরস্কার দেওয়া হবে।

    রাজবাড়ি আর বেশি দূর নয়। দু—খানা গ্রাম পেরোলেই শহর। শহরের মাঝখানে মস্ত রাজবাড়ি। চারদিকে বিশাল অঙ্গন। আজ হাজার হাজার মানুষ পালোয়ানদের দেখতে আসবে।

    সামনেই একটা গোরুর গাড়ি যাচ্ছে। গোরুর গাড়িতে একটা বড়োসড়ো চেহারার লোক বসে বসে ঢুলছে। রামরিখ দেখতে পেল গোরুর গাড়িটা রাস্তায় একটা খাদে পড়ে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে আটকে গেছে। বলদ দুটো টেনে তুলতে পারছে না। যে লোকটা ঢুলছিল সে একটু বিরক্ত হয়ে নেমে পড়ল। মালকোঁচা মারছে। রামরিখ কাঁধ দিয়ে একটা চাড় মেরে গোরুর গাড়িটা খাদ থেকে তুলে দিয়ে বলল, ‘সামান্য কাজ।’ মোটাসোটা লোকটা তার দিকে চেয়ে একটু আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘পালোয়ান নাকি তুমি?’

    ‘ওই সামান্য কিছু চর্চা করি আর কী।’

    ‘বেশ, বেশ।’ বলে লোকটা একটু হাসল, ‘তা তোমার জিনিসপত্র কই?’

    ‘ওই যে, গোরুর গাড়িতে। পাঁচ মন ওজনের গদা।’

    লোকটা অবাক হয়ে বলে, ‘পাঁচ মন? যাঃ।’

    কথা কইতে কইতে পিছনের গোরুর গাড়িটা কাছে চলে এল। রামরিখ গদাটা দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে।’

    লোকটা গদাটা দেখে বলল, ‘এটা ফাঁপা জিনিস নয় তো!’

    রামরিখ হেসে বলল, ‘আরে না, নিরেট লোহার গদা।’

    ‘হতেই পারে না।’ বলে লোকটা গদাটা তুলে নিয়ে হাতে নাচিয়ে একটু দেখে নিয়ে হঠাৎ নিজের হাঁটুটা তুলে তার ওপর রেখে দু—হাতের চাড় দিয়ে মচাৎ করে সেটা দু—আধখানা করে ভেঙে ফেলল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘নাঃ, নিরেট জিনিসই বটে হে।’

    রামরিখ হাঁ করে চেয়ে রইল। লোহার গদা কেউ ভাঙতে পারে এ তার জানা ছিল না।

    লোকটা মুখে একটু দুঃখ প্রকাশ করে বলল, ‘সামনের গাঁয়েই কামারশালা আছে, জুড়ে নিয়ো ভাই। অসাবধানে তোমার খেলনাটা ভেঙে ফেলেছি।’ বলে লোকটা চলে গেল।’

    রামরিখ গদাটা কামারশালায় জুড়ে নিতে গাঁয়ে ঢুকল। একটু চিন্তিত। মনে আর তত স্ফূর্তি নেই। কামার ভীষণ ব্যস্ত। বলল, ‘আমার যে গদা জোড়া দেওয়ার সময় নেই।’

    রামরিখ করুণ গলায় বলল, ‘ভাই, আমি যে রাজবাড়ির শক্তিপরীক্ষায় যাচ্ছি। সময় নেই, একটু করে দাও ভাই।’

    কামার খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কোথায় তোমার গদা?’

    ‘এই যে!’

    কামার গদার টুকরো দুটো দু—হাতে তুলে বলল, ‘এইটুকু গদা!’ বলে কামারশালার আর এক কোণে অন্তত একশো হাত দূরে যেখানে তার ছোটোছেলেটি কাজ করছিল সেদিকে ছুড়ে দিতে দিতে বলল, ‘ওরে বিশে, এ দুটো টুকরো জুড়ে দে তো!’

    বিশে একটা টুকরো বাঁ হাতে, অন্যটা ডান হাতে লুফে নিয়ে বলল, ‘দিই বাবা।’

    রামরিখ অধোবদন হয়ে বসে রইল। গদা জুড়ে নিয়ে রামরিখ ফের যখন রওনা হল তখন তার পা চলছে না। মনটা বড়োই খারাপ।

    আর একটা গাঁ পেরোলেই শহর। রাস্তার পাশে কতকগুলো ছেলে ডাংগুলি খেলছিল। কী কারণে তাদের মধ্যে একটু বিবাদ হয়েছে। হঠাৎ একটা ছেলে ছুটে এসে বলল, ‘মশাই, আপনার ডান্ডাটা একটু ধার দেবেন? আমরা এই পার্টিটা খেলেই দিয়ে দেব। আমাদের ডান্ডাটা ভেঙে গেল কিনা এইমাত্র।’

    বলেই ছেলেটা গদাটা গোরুর গাড়ির ওপর থেকে তুলে নিয়েই ছুট। রামরিখ দাঁড়িয়ে দেখল, ছেলেটা তার গদা দিয়ে গুটি তুলল, তারপর সেই গুটি সত্তর হাত দূরে পাঠাল। গদা দিয়ে এক হাতে দূরত্বটা মাপল। তারপর দৌড়ে এসে ফের গোরুর গাড়িতে গদাটা রেখে ছুটে চলে গেল।

    রামরিখ আর এগোল না। গোরুর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফেরত যেতে লাগল।

    টীকা