পৃথিবী এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম।
    সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে;
    যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে;
    যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় ক্ষেতের গোধূম
    চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুম
    গাঢ় করে দিয়ে যায়।-এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের।
    সমূদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ
    নদীর তরঙ্গে – ক্রমে তুষারের স্তুপে তার ঢেউ
    একবার টের পাবে, দ্বিতীয়বারের
    সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে ঢের।
    এইখানে সময়কে যতদুর দেখা যায় চোখে
    নির্জন ক্ষেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভুত চাষা;
    এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা
    সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে;
    অঘ্রানের বিকেলের কমলা আলোকে
    নিড়োনো ক্ষেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে;
    একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে।
    পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে
    নষ্ট হয়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে;
    সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে।
    ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হয়ে আসে।
    মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হল মানুষের বৃত্তি আদায়।
    যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে
    তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায়
    আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন।
    অভিভূত হয়ে আছে — চেয়ে দ্যাখো — বেদনার নিজের নিয়ম।
    নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়;
    জলপাই অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা;
    ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়;
    প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে
    আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে।
    সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ
    অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে
    এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়।
    পৃথিবীর রাজপথে-রক্তপথে-অন্ধকার অববাহিকায়
    এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়।
    তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মুক অপেক্ষায়;
    তাহার মাথার ‘পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়;
    এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হয়ে থেকে ক্রমে একদিন
    কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ?
    চেয়েছে মাটির দিকে — ভুগর্ভে তেলের দিকে
    সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা,
    মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার;
    দুরবীণে কিমাকার সিংহের সাড়া
    পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে।
    বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তারা।
    যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে,
    মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা
    দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে;
    চিরদিন এইসব হ্নদয় ও রুধিরের ধারা।
    মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে
    নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে;
    অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া।
    মোমের আলোয় আজ গ্রস্থের কাছে ব’সে – অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে
    আমরা যতটা দূর চ’লে যাই -চেয়ে দেখি আরো কিছু আছে তারপরে।
    অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে
    ছায়া ফ্যালে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে,
    কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে,
    অথবা যে সব থাম সমীচীন মিস্তিরির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে,
    তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ।
    হয়তো অনেক এগিয়ে তারা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ
    জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোলতার নেই অবলেশ।
    তাই তারা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরও জীবনের লিপ্ত অভিধানে
    বর্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে।
    সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয় — এই জ্ঞানে
    লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে
    নিজের বীজের তরে জোর করে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে।
    অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে।
    একটি আলোক নিয়ে বসে থাকা চিরদিন;
    নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে;
    সে সবের দিন শেষ হয়ে গেছে
    এখন সৃষ্টির মনে — অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে।
    সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে।
    একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে — বালুচরে,
    সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে।
    আমরা জটিল ঢের হয়ে গেছি — বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে।
    যদি কেউ বলে এসে : ‘এই সেই নারী,
    একে তুমি চেয়েছিলে এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ–
    তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কব্ে‌ ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ?
    আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর,
    যদিও অনেক মৃত্যুপরস্পরা ছিলো ইতিহাসে;
    বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অবলঙ ছবি;
    নানারুপ ক্ষতি ক্ষয় নানা দিকে মরে গেছি — মনে পড়ে বটে
    এইসব ছবি দেখি; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে
    নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থাণু।
    এক দরজায় ঢুকে বহিস্কৃত হয়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে
    অমেয় আলোয় হেঁটে তারা সব।
    (আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্‌ বাতাসের শব্দ শুনেছিল;
    তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?)
    আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
    কাচের গেলাসে জলে উজ্জুল শফরী;
    সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো;
    তারপর অন্য গ্রহ-নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে
    যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে।
    সৃষ্টির নাড়ীর ‘পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায়
    অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ;
    তবু তারা করে নাকো পরস্পরের ঋণশোধ।

    টীকা