আকাশের থেকে আলো নিভে যায় ব’লে মনে হয়।
    আবার একটি দিন আমাদের মৃগতৃষ্ণার মতো পৃথিবীতে
    শেষ হয়ে গেল তবে;— শহরের ট্রাম
    উত্তেজিত হয়ে উঠে সহজেই ভবিতব্যতার
    যাত্রীদের বুকে নিয়ে কোন্‌ এক নিরুদ্দেশ কুড়োতে চলেছে।
    এই দিকে পায়দলদের ভিড়—অই দিকে টর্চের মশালে বার—বার
    যে যার নিজের নামে সকলের চেরে আগে নিজের নিকটে
    পরিচিত;— ব্যক্তির মতন নিঃসহায়;
    জনতাকে অবিকল অমঙ্গল সমুদ্রের মতো মনে ক’রে
    যে যার নিজের কাছে নিবারিত দ্বীপের মতন
    হয়ে পড়ে অভিমানে—ক্ষমাহীন কঠিন আবেগে।
    সে মুহূর্ত কেটে যায়; ভালোবাসা চায় না কি মানুষ নিজের
    পৃথিবীর মানুষের? শহরে রাত্রির পথে হেঁটে যেতে যেতে
    কোথাও ট্রাফিক থেকে উৎসারিত অবিরল ফাঁস
    নাগপাশ খুলে ফেলে কিছুক্ষণ থেমে থেমে এ রকম কথা
    মনে হয় অনেকেরই;—
    আত্মসমাহিতিকূট ঘুমায়ে গিয়েছে হৃদয়ের!
    তবু কোনো পথ নেই এখনো অনেক দিন, নেই।
    একটি বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে নিভে গেছে প্রায়।
    আমাদের আধো-চেনা কোনো-এক পুরোনো পৃথিবী
    নেই আর। আমাদের মনে চোখে প্রচারিত নতুন পৃথিবী
    আসে নি তো।
    এই দুই দিগন্তের থেকে সময়ের
    তাড়া খেয়ে পলাতক অনেক পুরুষ—নারী পথে
    ফুটপাতে মাঠে জীপে ব্যারাকে হোটেলে অলিগলির উত্তেজে
    কমিটি-মিটিঙে ক্লাবে অন্ধকারে অনর্গল ইচ্ছার ঔরসে
    সঞ্চারিত উৎসবের খোঁজে আজো সূর্যের বদলে
    দ্বিতীয় সূর্যকে বুঝি শুধু অন্ন, শক্তি, অর্থ, শুধু মানবীর
    মাংসের নিকটে এসে ভিক্ষা করে। সারাদিন— অনেক গভীর
    রাতের নক্ষত্র ক্লান্ত হয়ে থাকে তাদের বিলোল কাকলীতে।
    সকল নেশন আজ এই এক বিলোড়িত মহা-নেশনের
    কুয়াশায় মুখ ঢেকে যে যার দ্বীপের কাছে তবু
    সত্য থেকে— শতাব্দীর রাক্ষসী বেলায়
    দ্বৈপ-আত্মা-অন্ধকার এক-একটি বিমুখ নেশন।
    শীত আর বীতশোক পৃথিবীর মাঝখানে আজ
    দাঁড়ায়ে এ জীবনের কতগুলো পরিচিত সত্ত্বশূন্য কথা—
    যেমন নারীর প্রেম, নদীর জলের বীথি, সারসের আশ্চর্য ক্রেঙ্কার
    নীলিমায়, দীনতায় যেই জ্ঞান, জ্ঞানের ভিতর থেকে যেই
    ভালোবাসা; মানুষের কাছে মানুষের স্বাভাবিক
    দাবীর আশ্চর্য বিশুদ্ধতা; যুগের নিকটে ঋণ, মনবিনিময়,
    এবং নতুন জননীতিকের কথা— আরো স্মরণীয় কাজ
    সকলের সুস্থতার— হৃদয়ের কিরিণের দাবী করে; আর অদূরের
    বিজ্ঞানের আলাদা সজীব গভীরতা;
    তেমন বিজ্ঞান যাহা নিজের প্রতিভা দিয়ে জেনে সেবকের
    হাত দিব্য আলোকিত ক’রে দেয়— সকল সাধের
    কারণ-কর্দম-ফেণা প্রিয়তর অভিষেকে স্নিগ্ধ ক’রে দিতে;—
    এই সব অনুভব ক’রে নিয়ে সপ্রতিভ হতে হবে না কি।
    রাত্রির চলার পথে এক তিল অধিক নবীন
    সম্মুখীন— অবহিত আলোকবর্ষের নক্ষত্রেরা
    জেগে আছে। কথা ভেবে আমাদের বহিরাশ্রয়িতা
    মানবস্বভাবস্পর্শে আরো ঋত— অন্তর্দীপ্ত হয়।

    টীকা