বাঘ নয়তো হ্যাংলা

    বনটা খুব গভীর। তেমনি গা-ছমছম। সেই বনে একটা বাঘ থাকত। বাঘটা এমন বুনো যে, বলবার কথা নয়। যেমন বুনো, তেমনি আবার হাঁদা। শুনলে হেসে মরি, বাঘটা কোনোদিন মানুষ দেখেনি। দেখা তো দূরের কথা, মানুষের নাম পর্যন্ত কানে শোনেনি। একদিন সেই বাঘটা করেছে কী, গাছে উঠেছে। পাখির ডিম খাবে। অত বড়ো একটা গাবদা-গাবুস বাঘ, শোনো কথা, সে ডিম খাবে। আরে বাবা, একটা ছুন্নিগুলির মতো ডিম! তুই খেলে তোর জালার মতো পেট ভরে কখনো! তবে, ডিম তাকে খেতে হল না। খাবার আগেই যার ডিম, সেই পুঁচকে পাখি তাকে দেখতে পেয়েছে। পাখি তো যাচ্ছেতাই করে বাঘকে কথা শুনিয়ে দিল। বলল, ‘ছি: ছি:, কী লজ্জা, কী লজ্জা! মানুষ খাবার মুরোদ নেই, বাঘ হয়ে তুই গাছে উঠে ডিম খাস! তাও আমার মতো একটা এইটুকুনি পাখির!’

    আর ডিম! ডিমের বদলে কে যেন বাঘের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলে! অপমানে বাঘের ল্যাজটা পর্যন্ত নেতিয়ে পড়ল। অপমানই তো! একটা হাতি যদি কথা শোনাত, সে তবু মানা যেত। শুনিয়ে দিল কিনা একটা পাখি! কেমন মুখ ঝামটিয়ে ট্যাঁক-ট্যাঁক করে উঠল! কী আস্পর্ধা। বাঘ তো রেগে কাঁই। ভেতরে ভেতরে এমন রাগান রাগল, মনে হল, একবার যদি পাখিটাকে ধরতে পারে! ধরলে যে পাখির কী দশা হবে, সে আর কে না জানে! কিন্তু অত সোজা! পাখি ধরবে! একবার থাবা তোলো! নাকের ডগায় টুসকি মেরে পাখি ফুড়ুৎ! একেবারে মগডালে।

    অবিশ্যি বাঘ রাগল বটে, কিন্তু রাগের ছিঁটেফোঁটাও তার মুখে দেখা গেল না। উলটে নোলা দিয়ে জল গড়াতে লাগল টসটস করে। কেন-না, মানুষের নাম শুনেই, তার খুব খিদে পেয়ে গেল। সে আর থাকতে পারল না। পাখিটা চোখের দৃষ্টি যেই একটু এদিক থেকে ওদিকে হেলিয়েছে, বাঘ গাঁক করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাখির ঘাড়ে। তাকেই খাবে। হায় কপাল! বুদ্ধি দেখো বাঘের! তুই জানিস না, ওই অমন গতরখানা নিয়ে এই ডাল থেকে ওই ডালে লাফ মারলে ডাল ভেঙে যাবে! হলও তাই। কোথায় পাখি! পাখি তো হুস! বাঘটা হুড়মুড় করে পড়ল একটা পলকা ডালের ওপর। সেটা মটাস করে ভাঙল। বাঘটা ধপাস করে পড়ল। মাথায় লাগল, না ঠ্যাং ভাঙল কে জানে! ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। উঠেই দে ছুট! ওই দেখো বাঘ ল্যাংচাচ্ছে। আর বলতে, বাঘের ল্যাংচানির খবর শুনে সারাবনে ঢিঢি পড়ে গেল। বাঁদর থেকে শুরু করে হায়েনা পর্যন্ত এমন হাসাহাসি করতে লাগল যে, লজ্জায় মাথা কাটা যায়! শেষমেশ বাঘের লুকিয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় থাকল না। তা বলো, এমন ভিতুর মতো বাঘ আর ক-দিন লুকিয়ে থাকতে পারে! দু-একদিন আড়ালে-আবডালে গা ঢাকা দিয়ে থাকা যায়। রোজ তো আর নয়! তা ছাড়া, বাঘের পক্ষে লুকিয়ে থাকাটাও কি খুব বড়াই করার মতো একটা কথা? তাই বাঘ একদিন গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বন ছাড়া সে আর যাবে কোথায়? যেই সে বেরোল তাকে দেখে আবার হাসাহাসি! আবার মুখে মুখে টিটকিরি! বাঁদর তো একটা ছড়াই বানিয়ে ফেলল। সে চেঁচাল :

    একটা ছিল বাঘ
    ধরতে গেল পাখি
    ধরতে গিয়ে ল্যাজ ছিঁড়েছে
    ভাঙল মালাইচাকি।
    দু-য়ো! দু-য়ো!

    বাঁদরের দুয়ো আর ছ্যা ছ্যা শুনে বাঘের মুখ দেখানো দায়। তবু বাঘ বলে কথা! বাঁদর তাকে দুয়ো দেবে, আর সে মুখ বুজে সহ্য করবে—এ কখনো হয়! বাঘ বাঁদরের দিকে মুখ ফিরিয়ে ‘গাঁক’ করে এমন একখানা ধমক মারল যে, মনে হল, সারাবনটা যেন ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল। কিন্তু বন কাঁপলে কী হবে! বনের সমস্ত পশুপক্ষী বাঘের হাঁক শুনে টপাটপ সব বেরিয়ে পড়েছে। বেরিয়ে পড়ে, বাঘকে ভেংচি কেটে এমন চেল্লাতে লাগল যে, বাঘ পালাবার পথ পেল না! বাব্বা, ওই ধুমসো বাঘের সঙ্গে একা কে পারবে? তাই সবাই একসঙ্গে ডাক ছাড়তেই বাঘও খোঁড়া ঠ্যাং-এ ঝপাং ঝপাং করে লাফ মারতে লাগল। আর বাঘের সঙ্গে বাঁদরটা গাছের ডাল টপকাতে টপকাতে চেঁচাতে লাগল :

    একটা ছিল বাঘ
    ধরতে গেল পাখি
    ধরতে গিয়ে ঠ্যাং ভাঙল
    বদ্যি কোথায় ডাকি!
    দু-য়ো! দু-য়ো!

    বন-ভরতি পশুপক্ষীর গঞ্জনা আর তাড়া খেয়ে বাঘ আর কোন মুখে বনে থাকে! বন থেকে পালাতে পারলেই সে যেন বাঁচে। তাড়ার চোটে বাঘ সত্যিই বন ছেড়ে ভাগলবা।

    ভাগ্যিস তখন সাঁঝ ঘনিয়ে রাত নেমে আসছিল! নইলে, বনের বাইরে এসে বাঘের যে দুর্দশার শেষ থাকত না, এ সবাই জানে। এ ভারি মজার ব্যাপার। কেমন দেখো, সূর্য উঠলেই আকাশটা আলোয় আলোয় ভরে যাচ্ছে, আবার রাত হলেই সূর্যটা কেমন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে! বন থেকে বেরিয়েই সেই অন্ধকারে বাঘ থমকে গেল। অন্ধকারটা যতই জমে জমে উঠছে, বাঘের বুকের ভেতরটাও তত শিরশির করে কাঁপছে। বন ছাড়া তো বাঘ এতদিন আর কিছু জানত না। তাই বনটা পেছনে ফেলে বাঘ যত সামনে এগোচ্ছে, ততই চোখদুটো ভ্যাবাচাকা খেয়ে এপাশ-ওপাশ চাইছে। চাইবেই তো। বনের ভেতর ইচ্ছে করলেই ঝুপঝাপ লুকিয়ে পড়ো, কেউ টেরও পাবে না। তবে হ্যাঁ, ঠাণ্ডা লাগিয়ে তুমি যদি আচমকা ফ্যাঁচ-চ-চ করে হেঁচে ফেলো, তবে অন্য কথা। সে তোমার কপালের দোষ। কিন্তু বনের বাইরে? হাঁচিরও কথা নেই, কাশিরও নেই। এখানে আর চোখকে ফাঁকি দিতে হচ্ছে না। কেউ দেখতে পেলে তোমার পালাবারও পথ নেই, লুকোবারও উপায় নেই। চোখে পড়বেই।

    ‘এই বাঘ!’

    এ কী রে! কে ডাকল এমন আচমকা! কে দেখতে পেল বাঘকে! গলাটা কেমন ফিনফিনে!

    ওই ফিনফিনে গলা শুনেই বোকারাম বাঘটা মারলে এক লাফ! লাফ মারতেই আর এক কান্ড, পা ফসকে চিৎপটাং। অমনি সেই ফিনফিনে গলায় খিলখিল করে হাসি। হাসতে হাসতে চেঁচাতে লাগল, ‘পড়ে গেছে! পড়ে গেছে!’

    বাঘের তো দফা রফা। উঠে পড়! উঠে পড়! বাঘ উঠেই দেখে, তার চোখের সামনে একটা বাক্স। বাক্সের ওপর ঠোক্কর লেগেই যে তার পা ফসকেছে, তা আর বুঝতে বাকি রইল না বাঘের। সে ভীষণ রেগে গেল! বাক্সটার পেটে মারলে ক্যাঁত করে এক লাথি। সাঁই-ই-ই করে ছিটকে গিয়ে বাক্সটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘মেরো না, মেরো না!’ বলতে-না-বলতেই বাক্সের ঢাকনাটা ফটাস করে খুলে গেল। খুলে যেতেই, তার ভেতর থেকে এইটুকুনি একটা মানুষ-মানুষ পুতুল বেরিয়ে এল। ফিকফিক করে হেসে বাঘকে দেখতে লাগল।

    বাঘের তো চক্ষু ছানাবড়া। এটা কে রে! অত বড়ো বাঘটা তাকে দেখে একেবারে ভয়ে চুপসে গেল। যতটা চুপসে গেল, ভয়টাকে লুকোবার জন্যে ঠিক ততটা সে ফোঁস-ফোঁস করতে লাগল। ফোঁস-ফাঁস করতে করতে হঠাৎ সে হেঁড়ে গলায় হুংকার দিল, ‘আহা! আবার হাসি হচ্ছে!’

    কোথাও কিছু নেই এ আবার কী কথা! অচেনা কারো সঙ্গে দেখা হলে কোথায় ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করবে, ‘হাই, আপনি কেমন আছেন!’ ‘তা নয়, গলার স্বর কী, যেন কুম্ভকর্ণ নাক ডাকাচ্ছে!’ তো বলব কী, তার কথা শুনে এবার আর ফিকফিক করে নয়, খিলখিল করে হেসে উঠল পুতুলটা। হাসতে হাসতে হাততালি দিতে লাগল। দিতে দিতে বলল :

    ঘোড়া দেখিনি, হাতি দেখিনি
    ছাগল, ভেড়া, শুয়োর,
    সাপ দেখিনি, নেংটি, ছুঁচো,
    ব্যাং দেখিনি কুয়োর।
    লাল দেখিনি, নীল দেখিনি,
    শরৎ মেঘের সাদা,
    আমার সামনে দাঁড়িয়ে যিনি,
    হয়তো তিনি গাধা।

    এবার আর বাঘের না-রেগে উপায় আছে! শেষে কিনা এই পুঁচকেটা তাকে গাধা ঠাওরাল! বাঘ গর্জে উঠল, ‘এই বেঁটে, তুই আমাকে গাধা বললি কেন রে?’

    পুতুল বলল, ‘তুমি কেন বেঁটে বললে শুনি?’

    ‘বেঁটে নয়তো তুই কে?’ বাঘের গলায় তেমনি হুংকার।

    ‘আমি মানুষ। আমি পুতুল।’

    পুতুল বলতে বাঘ কিছু বুঝল কি না কে জানে। কিন্তু মানুষের নাম শুনেই তার নোলায় জল গড়িয়ে পড়ল। বাঘের অত বড়ো মুখখানা এত বড়ো হাঁ হয়ে, খাইখাই করে উঠল। বাঘ পুতুলের ঘাড়ে মারলে লাফ! পুতুল তো এইটুকুনি। পুতুল টুপ করে বসে পড়ল। তাক ফসকে বাঘ পা পিছলে সড়াৎ! তাই না দেখে, মানুষ-মানুষ ছোট্ট পুতুল হেসে লুটোপুটি। বাঘ এদিকে রেগে বোম-পটকা। ঝটকা মেরে ঘুরে দাঁড়িয়ে গাঁক-গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘শোনরে বেঁটে, বাঘের খপ্পর থেকে কেউ নিস্তার পায় না। একবার যখন আমার নজরে পড়েছিস, তখন তোকে খাবই। এখন যত হাসছিস, আমার পেটের ভেতর ততই কাঁদবি।’

    ‘ও, এবার বুঝতে পেরেছি, তুমি তাহলে গাধা নও, বাঘ!’ বলে, পুতুলটা আরও জোরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল :

    গাধা তবু গাধার মতো
    আর কিছু নয় অন্য,
    তুমি দেখি বাঘের নামে
    বিচ্ছিরি জঘন্য!

    বাঘ এবার সত্যি-সত্যি ভীষণ রেগে গেল। বাঘকে গাধা বললে, যেমন সহ্য করা যায় না, তেমনই জঘন্য বললে আরও সহ্য করা যায় না। বুঝতে পারছ, এখন বাঘ তাই আরও রেগে, আরও টং! তার নখের যুগ্যি নয় একটা বেঁটে, তাকে এমন করে ডেঁটে দিল! বাঘ ভেতরে ভেতরে গজরাতে লাগল। তার ল্যাজ রাগে ওলট-পালট খেয়ে ছটফট করতে লাগল। তার চোখের চাউনি লাল-টকটকে হয়ে গেল। এবার বোধহয় সে আবার পুতুলটার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে। তাক কষছে। এই পড়ল বলে!

    এই দেখো, ওদিকে আবার কী কান্ড হয়েছে! সেই যে-বাক্সটার ভেতর থেকে এই পুতুলটা বেরিয়েছে, তার ভেতর থেকে কেমন একটি একটি করে আরও ক-টি পুতুল বেরিয়ে এল! বেরিয়ে এল চুপিচুপি। বেরিয়ে এসে বাঘের পেছনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইল। বাঘ যেই-না লাফাতে যাবে, অমনি চারটে, না, পাঁচটা, পাঁচটা না, দশটা, দশটা না, বিশটা পুতুল তিড়িং তিড়িং করে বাঘের ল্যাজে উঠে পড়ল। বাঘ তো থতোমতো খেয়ে গেছে। ল্যাজটা সাঁইসাঁই করে ঝাপটা মারতে লাগল। ঝাপটা মারলে কী হবে, ততক্ষণে তারা তরতর করে কেউ বাঘের পিঠে উঠে পড়েছে, কেউ বাঘের লোম খামচে পেটে ঝুলে পড়েছে। কেউ কানে ঢুকে পড়েছে। ঠিক যেমন করে পিঁপড়ে টুপটুপ পানতুয়া ছেঁকে ধরে, তেমনি করে ছেঁকে ধরল। ধরে, কেউ বাঘের ল্যাজে চিমটি কাটে। কেউ পিঠ খামচে লোম টানে। কেউ পেটের নীচে দোল খায়। কানের ভেতর কু-উ ডাকে। নাকের ডগায় ঘুসি মারে। গলার তলায় সুড়সুড়ি দেয়! বাঘ লাফ মারবে কী, লাফ মারতে গিয়ে হেসে মরে। হাসতে-হাসতে নেচে মরে। নাচতে-নাচতে কেঁদে মরে। কাঁদতে-কাঁদতে গড়গড় গড়াত, পা ফসকে পড়াত! তারপর গাঁক-গাঁক গাঁকাচ্ছে। চার-পা তুলে কোঁকাচ্ছে। কোঁকাতে-কোঁকাতে বাঘ হাঁপিয়ে উঠল। হাঁপাতে হাঁপাতে শেষকালে বাঘের দফারফা। যেখানে গড়াচ্ছিল, সেইখানে গড়াতে গড়াতে বাঘের দাঁতে দাঁতকপাটি। বাঘ আর হাসেও না, নাচেও না। কাঁদেও না, কোঁকায়ও না। ঠাণ্ডা মেরে জ্ঞান হারাল। ঠ্যাং উলটে পড়ে রইল সেইখানে।

    তারপর?

    তারপর আর কী! যখন জ্ঞান ফিরল, বাঘ তখন আধমরা হয়ে আছে। কোনোরকমে পা ছড়িয়ে উঠে বসল। জুলুক-জুলুক এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। ভোঁ-ভাঁ! কেউ কোত্থাও নেই। সেই পুতুলগুলোও নেই। পুতুলের বাক্সটাও নেই। আশ্চর্য, গেল কোথায়?

    তাদের দেখতে না পেয়ে বাঘ স্বস্তির নিশ্বেস ফেলল। মনে মনে ভাবল, যাক বাবা, গেছে, ভালোই হয়েছে। এই নাকখত, আর এই কানমলা। আর যদি কোনোদিন এমুখো হই! পুতুল নামের এই বেঁটে মানুষগুলোই যখন এমন ঠ্যাঁটা, তখন না জানি মানুষ নামের লম্বাগুলো কী দজ্জাল! ঢের হয়েছে। আর দরকার নেই মানুষ খেয়ে। মানে-মানে নিজের ডেরায় ফিরে যাওয়াই ভালো! বলে, অনেক আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে আবার বাঘ বনে ফিরে এল।

    টীকা