এই সব দিনরাত্রি
    মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ড়ুবে যাওয়া ভালো।
    এইখানে
    পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারা দেশে
    এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।
    তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই;
    তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই;
    শরীর বিবশ হলে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের
    কংগ্রেসের মতো কোনো আশা-হতাশার
    কোলাহল নেই।
    অনেক শ্রমিক আছে। এইখানে।
    আরো ঢের লোক আছে
    সঠিক শ্রমিক নয় তারা।
    স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝ’রে
    এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃত্যুবৎ ঘোরে।
    নামগুলো কুশ্ৰী নয়, পৃথিবীর চেনা-জানা নাম এই সব।
    আমরা অনেক দিন এ-সব নামের সাথে পরিচিত; তবু,
    গৃহ নীড় নির্দেশ সকলই হারায়ে ফেলে ওরা
    জানে না কোথায় গেলে মানুষের সমাজের পারিশ্রমিকের
    মতন নির্দিষ্ট কোনো শ্রমের বিধান পাওয়া যাবে;
    জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে;
    অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছে।
    মেডিকেল ক্যাম্বেলের বেলগাছিয়ার
    যাদবপুরের বেড কাঁচড়াপাড়ার বেড সব মিলে কতগুলো সব?
    ওরা নয়—সহসা ওদের হয়ে আমি
    কাউকে শুধায়ে কোনো ঠিকমতো জবাব পাই নি।
    বেড আছে, বেশি নেই—সকলের প্রয়োজনে নেই।
    যাদের আস্তানা ঘর তল্পিতল্পা নেই
    হাসপাতালের বেড হয়তো তাদের তরে নয়।
    বটতলা মুচিপাড়া তালতলা জোড়াসাঁকো—আরো ঢের ব্যর্থ অন্ধকারে
    যারা ফুটপাত ধ’রে অথবা ট্রামের লাইন মাড়িয়ে চলছে
    তাদের আকাশ কোন দিকে?
    জানু ভেঙে পড়ে গেলে হাত কিছুক্ষণ আশাশীল
    হয়ে কিছু চায়–কিছু খোঁজে;
    এ ছাড়া আকাশ আর নেই।
    তাদের আকাশ
    সর্বদাই ফুটপাতে;
    মাঝে মাঝে এম্বুলেনস্‌ গাড়ির ভিতরে
    রণক্লান্ত নাবিকেরা ঘরে
    ফিরে আসে
    যেন এক অসীম আকাশে।
    এ-রকম ভাবে চ’লে দিন যদি রাত হয়, রাত যদি হয়ে যায় দিন,
    পদচিহ্নময় পথ হয় যদি দিকচিহ্নহীন,
    কেবলই পাথুরেঘাটা নিমতলা চিৎপুর—
    খালের এপার-ওপার রাজাবাজারের অস্পষ্ট নির্দেশে
    হাঘরে হাভাতেদের তবে
    অনেক বেডের প্রয়োজন;
    বিশ্রামের প্রয়োজন আছে;
    বিচিত্র মৃত্যুর আগে শাস্তির কিছুটা প্রয়োজন।
    হাসপাতালের জন্যে যাহাদের অমূল্য দাদন,
    কিংবা যারা মরণের আগে মৃতদের
    জাতিধর্ম নির্বিচারে সকলকে–সব তুচ্ছতম আর্তকেও
    শরীরের সান্ত্বনা এনে দিতে চায়,
    কিংবা যারা এইসব মৃত্যু রোধ করে এক সাহসী পৃথিবী
    সুবাতাস সমুজ্জ্বল সমাজ চেয়েছে—
    তাদের ও তাদের প্রতিভা প্রেম সংকল্পকে ধন্যবাদ দিয়ে
    মানুষকে ধন্যবাদ দিয়ে যেতে হয়।
    মানুষের অনিঃশেষ কাজ চিন্তা কথা
    রক্তের নদীর মতো ভেসে গেলে, তারপর, তবু, এক অমূল্য মুগ্ধতা
    অধিকার করে নিয়ে ক্রমেই নির্মল হতে পারে।
    ইতিহাস অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন এখনো কালের কিনারায়;
    তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে; মানুষের মন
    জানে জীবনের মানে : সকলের ভালো ক’রে জীবনযাপন।
    কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ।
    চারি দিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়–অলীক প্ৰয়াণ।
    মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নব মন্বন্তর;
    যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;
    মানুষের লালসার শেষ নেই;
    উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ
    অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ
    অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ
    নেই।
    কেবলই আসন থেকে বড়ো, নবতর
    সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো।
    মানুষের দুঃখ কষ্ট মিথ্যা নিস্ফলতা বেড়ে যায়।
    মনে পড়ে কবে এক রাত্রির স্বপ্নের ভিতরে
    শুনেছি একটি কুণ্ঠকলঙ্কিত নারী
    কেমন আশ্চর্য গান গায়;
    বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়;
    গানের ঝংকারে যেন সে এক একান্ত শ্যাম দেবদারু গাছে
    রাত্রির বর্ণের মতো কালো কালো শিকারী বেড়াল
    প্ৰেম নিবেদন করে আলোর রঙের মতো অগণন পাখিদের কাছে;
    ঝর্‌ ঝর্‌ ঝর্‌
    সারারাত শ্রাবণের নির্গলিত ক্লেদরক্ত বৃষ্টির ভিতর
    এ পৃথিবী ঘুম স্বপ্ন রুদ্ধশ্বাস
    শঠতা রিরংসা মৃত্যু নিয়ে
    কেমন প্রদত্ত কালো গণিকার উল্লোল সংগীতে
    মুখের ব্যাদান সাধ দুৰ্দান্ত গণিকালয়—নরক শ্মশান হল সব।
    জেগে উঠে আমাদের আজকের পৃথিবীকে এ-রকম ভাবে অনুভব
    আমিও করেছি রোজ সকালের আলোর ভিতরে বিকেলে— রাত্রির পথে হেঁটে;
    আমরা অঙ্গার রক্ত; শতাব্দীর অন্তহীন আগুনের ভিতরে দাঁড়িয়ে।
    এ আগুন এত রক্ত মধ্যযুগ দেখেছে কখনও?
    তবুও সকল কাল শতাব্দীকে হিসেব নিকেশ করে আজ
    শুভ কাজ সূচনার আগে এই পৃথিবীর মানবহৃদয়
    স্নিগ্ধ হয়—বীতশোক হয়?
    মানুষের সব গুণ শান্ত নীলিমার মতো ভালো?
    দীনতা : অন্তিম গুণ, অন্তহীন নক্ষত্রের আলো।
    চতুরঙ্গ। কার্তিক-পৌষ ১৩৫৬

    টীকা