প্রাঙ্গণে নামল অকালসন্ধ্যার ছায়াসূর্যগ্রহণের কালিমার মতো।উঠল ধ্বনি : খোলো দ্বার!প্রাণপুরুষ ছিল ঘরের মধ্যে,      সে কেঁপে উঠল চমক খেয়ে।দরজা ধরল চেপে,আগলের উপর আগল লাগল।কম্পিতকণ্ঠে বললে, কে তুমি।মেঘমন্দ্র-ধ্বনি এল : আমি মাটি-রাজত্বের দূত,সময় হয়েছে, এসেছি মাটির দেনা আদায় করতে।ঝন্‌ঝন্‌ বেজে উঠল দ্বারের শিকল,থরথর কাঁপল প্রাচীর,হায়-হায় করে ঘরের হাওয়া।নিশাচরের ডানার ঝাপট আকাশে আকাশেনিশীথিনীর হৃৎকম্পনের মতো।ধক্‌ধক্‌ ধক্‌ধক্‌ আঘাতেখান্‌খান্‌ হল দ্বারের আগল, কপাট পড়ল ভেঙে। কম্পমান কণ্ঠে প্রাণ বললে, হে মাটি, হে নিষ্ঠুর, কী চাও তুমি?দূত বললে, আমি চাই দেহ।দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে প্রাণ; বললে :এতকাল আমার লীলা এই দেহে,এর অণুতে অণুতে আমার নৃত্য,নাড়ীতে নাড়ীতে ঝংকার,মুহূর্তেই কি উৎসব দেবে ভেঙে–দীর্ণ হয়ে যাবে বাঁশি,চূর্ণ হয়ে যাবে মৃদঙ্গ,ডুবে যাবে এর দিনগুলিঅতল রাত্রির অন্ধকারে?দূত বললে, ঋণে বোঝাই তোমার এই দেহ,শোধ করবার দিন এল–মাটির ভাণ্ডারে ফিরবে তোমার দেহের মাটি।প্রাণ বললে, মাটির ঋণ শোধ করে নিতে চাও, নাও–কিন্তু তার চেয়ে বেশি চাও কেন?দূত বিদ্রূপ করে বললে, এই তো তোমার নিঃস্ব দেহ,কৃশ ক্লান্ত কৃষ্ণচতুর্দশীর চাঁদ–এর মধ্যে বাহুল্য আছে কোথায়?প্রাণ বললে, মাটিই তোমার, রূপ তো তোমার নয়।অট্টহাস্যে হেসে উঠল দূত; বললে,যদি পার দেহ থেকে রূপ নাও ছাড়িয়ে।প্রাণ বললে, পারবই, এই পণ আমার। প্রাণের মিতা মন। সে গেল আলোক-উৎসের তীর্থে।বললে জোড়হাত করে :হে মহাজ্যোতি, হে চিরপ্রকাশ, হে রূপের কল্পনির্ঝর,স্থূল মাটির কাছে ঘটিয়ো না তোমার সত্যের অপলাপ–তোমার সৃষ্টির অপমান।তোমার রূপকে লুপ্ত করে সে কোন্‌ অধিকারে।আমাকে কাঁদায় কার অভিশাপে।মন বসল তপস্যায়।কেটে গেল হাজার বছর, লক্ষ বছর– প্রাণের কান্না থামে না।পথে পথে বাটপাড়ি,রূপ চুরি যায় নিমেষে নিমেষে।সমস্ত জীবলোক থেকে প্রার্থনা ওঠে দিনরাত :হে রূপকার, হে রূপরসিক,যে দান করেছ নিজহাতে জড় দানব তাকে কেড়ে নিয়ে যায় যে।ফিরিয়ে আনো তোমার আপন ধন। যুগের পর যুগ গেল, নেমে এল আকাশবাণী :মাটির জিনিস ফিরে যায় মাটিতে,ধ্যানের রূপ রয়ে যায় আমার ধ্যানে।বর দিলেম হারা রূপ ধরা দেবে,কায়ামুক্ত ছায়া আসবে আলোর বাহু ধরেতোমার দৃষ্টির উৎসবে।রূপ এল ফিরে দেহহীন ছবিতে, উঠল শঙ্খধ্বনি।ছুটে এল চারি দিক থেকে রূপের প্রেমিক। আবার দিন যায়, বৎসর যায়। প্রাণের কান্না থামে না।আরো কী চাই।প্রাণ জোড়হাত করে বলে :মাটির দূত আসে, নির্মম হাতে কণ্ঠযন্ত্রে কুলুপ লাগায়–বলে “কণ্ঠনালী আমার’।শুনে আমি বলি, মাটির বাঁশিখানি তোমার বটে,কিন্তু বাণী তো তোমার নয়।উপেক্ষা করে সে হাসে।শোনো আমার ক্রন্দন, হে বিশ্ববাণী,জয়ী হবে কি জড়মাটির অহংকার–সেই অন্ধ সেই মূক তোমার বাণীর উপর কি চাপা দেবে চিরমূকত্ব,যে বাণী অমৃতের বাহন তার বুকের উপর স্থাপন করবে জড়ের জয়স্তম্ভ? শোনা গেল আকাশ থেকে :ভয় নেই।বায়ুসমুদ্রে ঘুরে ঘুরে চলে অশ্রুতবাণীর চক্রলহরী,কিছুই হারায় না।আশীর্বাদ এই আমার, সার্থক হবে মনের সাধনা;জীর্ণকণ্ঠ মিশবে মাটিতে, চিরজীবী কণ্ঠস্বর বহন করবে বাণী।মাটির দানব মাটির রথে যাকে হরণ করে চলেছিলমনের রথ সেই নিরুদ্দেশ বাণীকে আনলে ফিরিয়ে কণ্ঠহীন গানে।জয়ধ্বনি উঠল মর্তলোকে।দেহমুক্ত রূপের সঙ্গে যুগলমিলন হল দেহমুক্ত বাণীরপ্রাণতরঙ্গিণীর তীরে, দেহনিকেতনের প্রাঙ্গণে।

    টীকা