হিরণমাসির প্রধান প্রয়োজন রান্নাঘরে।      দুটি ঘড়া জল আনতে হয় দিঘি থেকে–         তার দিঘিটা ওই দুই ঘড়ারই মাপে                 রান্নাঘরের পিছনে বাঁধা দরকারের বাঁধনে। এ দিকে তার মা-মরা বোনপো,    গায়ে যে রাখে না কাপড়,        মনে যে রাখে না সদুপদেশ,           প্রয়োজন যার নেই কোনো কিছুতেই,সমস্ত দিঘির মালেক সেই লক্ষ্মীছাড়াটা।        যখন খুশি ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে,    মুখে জল নিয়ে আকাশে ছিটোতে ছিটোতে সাঁতার কাটে,ছিনিমিনি খেলে ঘাটে দাঁড়িয়ে,      কঞ্চি নিয়ে করে মাছ-ধরা খেলা,         ডাঙায় গাছে উঠে পাড়ে জামরুল–             খায় যত ছড়ায় তার বেশি।       দশ-আনির টাক-পড়া মোটা জমিদার,         লোকে বলে দিঘির স্বত্ব তারই–বেলা দশটায় সে চাপড়ে চাপড়ে তেল মাখে বুকে পিঠে,             ঝপ্‌ করে দুটো ডুব দিয়ে নেয়,বাঁশবনের তলা দিয়ে দুর্গা নাম করতে করতে চলে ঘরে–             সময় নেই, জরুরি মকর্দমা।         দিঘিটা আছে তার দলিলে, নেই তার জগতে।আর ছেলেটার দরকার নেই কিছুতেই,             তাই সমস্ত বন-বাদাড় খাল-বিল তারই–      নদীর ধার, পোড়ো জমি, ডুবো নৌকা, ভাঙা মন্দির,             তেঁতুল গাছের সবার উঁচু ডালটা।জামবাগানের তলায় চরে ধোবাদের গাধা,         ছেলেটা তার পিঠে চড়ে–             ছড়ি হাতে জমায় ঘোড়দৌড়।      ধোবাদের গাধাটা আছে কাজের গরজে–             ছেলেটার নেই কোনো দরকার,      তাই জন্তুটা তার চার পা নিয়ে সমস্তটা তারই,             যাই বলুন-না জজসাহেব।      বাপ মা চায় পড়ে শুনে হবে সে সদর-আলা;সর্দার পোড়ো ওকে টেনে নামায় গাধার থেকে,         হেঁচড়ে আনে বাঁশবন দিয়ে,             হাজির করে পাঠশালায়।মাঠে ঘাটে হাটে বাটে জলে স্থলে তার স্বরাজ–         হঠাৎ দেহটাকে ঘিরলে চার দেয়ালে,             মনটাকে আঠা দিয়ে এঁটে দিলে                 পুঁথির পাতার গায়ে। আমিও ছিলেম একদিন ছেলেমানুষ।         আমার জন্যেও বিধাতা রেখেছিলেন গড়ে             অকর্মণ্যের অপ্রয়োজনের জল স্থল আকাশ।তবু ছেলেদের সেই মস্ত বড়ো জগতে         মিলল না আমার জায়গা।আমার বাসা অনেক কালের পুরোনো বাড়ির             কোণের ঘরে–                 বাইরে যাওয়া মানা।  সেখানে চাকর পান সাজে, দেয়ালে মোছে হাত,             গুন গুন ক’রে গায় মধুকানের গান;    শান-বাঁধানো মেজে, খড়্‌খড়ে-দেওয়া জানলা।নীচে ঘাট-বাঁধানো পুকুর, পাঁচিল ঘেঁষে নারকেল গাছ।    জটাধারী বুড়ো বট মোটা মোটা শিকড়ে               আঁকড়ে ধরেছে পুব ধারটা।        সকাল থেকে নাইতে আসে পাড়ার লোকে,           বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঝিকিমিকি জলে               ভেসে বেড়ায় পাতিহাঁসগুলো,                   পাখা সাফ করে ঠোঁট দিয়ে মেজে।প্রহরের পর কাটে প্রহর।        আকাশে ওড়ে চিল,    থালা বাজিয়ে যায় পুরোনো কাপড়ওয়ালা,        বাঁধানো নালা দিয়ে গঙ্গার জল এসে পড়ে পুকুরে।     পৃথিবীতে ছেলেরা যে খোলা জগতের যুবরাজ               আমি সেখানে জন্মেছি গরিব হয়ে।                       শুধু কেবল    আমার খেলা ছিল মনের ক্ষুধায়, চোখের দেখায়,           পুকুরের জলে, বটের শিকড়-জড়ানো ছায়ায়,নারকেলের দোদুল ডালে, দূর বাড়ির রোদ-পোহানো ছাদে।               অশোকবনে এসেছিল হনুমান,    সেদিন সীতা পেয়েছিলেন নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের খবর।আমার হনুমান আসত বছরে বছরে আষাঢ় মাসে           আকাশ কালো করে                   সজল নবনীল মেঘে।        আনত তার মেদুর কণ্ঠে দূরের বার্তা,               যে দূরের অধিকার থেকে আমি নির্বাসিত।        ইমারত-ঘেরা ক্লিষ্ট যে আকাশটুকু               তাকিয়ে থাকত একদৃষ্টে আমার মুখে,        বাদলের দিনে গুরুগুরু ক’রে তার বুক উঠত দুলে।বট গাছের মাথা পেরিয়ে কেশর ফুলিয়ে দলে দলে               মেঘ জুটত ডানাওয়ালা কালো সিংহের মতো।    নারকেল-ডালের সবুজ হত নিবিড়,               পুকুরের জল উঠত শিউরে শিউরে।        যে চাঞ্চল্য শিশুর জীবনে রুদ্ধ ছিল               সেই চাঞ্চল্য বাতাসে বাতাসে, বনে বনে।পুব দিকের ও পার থেকে বিরাট এক ছেলেমানুষ ছাড়া পেয়েছে আকাশে,               আমার সঙ্গে সে সাথি পাতালে।         বৃষ্টি পড়ে ঝমাঝম। একে একেপুকুরের পৈঁঠা যায় জলে ডুবে।        আরো বৃষ্টি, আরো বৃষ্টি, আরো বৃষ্টি।রাত্তির হয়ে আসে, শুতে যাই বিছানায়,        খোলা জানলা দিয়ে গন্ধ পাই ভিজে জঙ্গলের।               উঠোনে একহাঁটু জল,ছাদের নালার মুখ থেকে জলে পড়ছে জল মোটা ধারায়।           ভোরবেলায় ছুটেছি দক্ষিণের জানলায়,                   পুকুর গেছে ভেসে;        জল বেরিয়ে চলেছে কল্‌কল্‌ করে বাগানের উপর দিয়ে,    জলের উপর বেলগাছগুলোর ঝাঁকড়া মাথা জেগে থাকে।পাড়ার লোকে হৈ হৈ করে এসেছে        গামছা দিয়ে ধুতির কোঁচা দিয়ে মাছ ধরতে।           কাল পর্যন্ত পুকুরটা ছিল আমারি মতো বাঁধা,    এ বেলা ও বেলা তার উপরে পড়ত গাছের ছায়া,           উড়ো মেঘ জলে বুলিয়ে যেত ক্ষণিকের ছায়াতুলি,    বটের ডালের ভিতর দিয়ে যেন সোনার পিচকারিতে           ছিটকে পড়ত তার উপরে আলো–    পুকুরটা চেয়ে থাকত আকাশে ছল্‌ছলে দৃষ্টিতে।           আজ তার ছুটি, কোথায় সে চলল খ্যাপা                   গেরুয়া-পরা বাউল যেন। পুকুরের কোণে নৌকোটি    দাদারা চড়ে বসল ভাসিয়ে দিয়ে,        গেল পুকুর থেকে গলির মধ্যে,           গলির থেকে সদর রাস্তায়–তার পরে কোথায় জানি নে। বসে বসে ভাবি।           বেলা বাড়ে।    দিনান্তের ছায়া মেশে মেঘের ছায়ায়,           তার সঙ্গে মেশে পুকুরের জলে বটের ছায়ার কালিমা।                   সন্ধে হয়ে এল।    বাতি জ্বলল ঝাপসা আলোয় রাস্তার ধারে ধারে,           ঘরে জ্বলেছে কাঁচের সেজে মিট্‌মিটে শিখা,ঘোর অন্ধকারে একটু একটু দেখা যায়           দুলছে নারকেলের ডাল,                   ভূতের ইশারা যেন।গলির পারে বড়ো বাড়িতে সব দরজা বন্ধ,        আলো মিট্‌ মিট্‌ করে দুই-একটা জানলা দিয়ে           চেয়ে-থাকা ঘুমন্ত চোখের মতো।        তার পরে কখন আসে ঘুম।    রাত দুটোর সময় স্বরূপ সর্দার নিষুত রাতে           বারান্দায় বারান্দায় হাঁক দিয়ে যায় চলে। বাদলের দিনগুলো বছরে বছরে তোলপাড় করেছে আমার মন;        আজ তারা বছরে বছরে নাড়া দেয় আমার গানের সুরকে।    শালের পাতায় পাতায় কোলাহল,        তালের ডালে ডালে করতালি,               বাঁশের দোলাদুলি বনে বনে–    ছাতিম গাছের থেকে মালতীলতা               ঝরিয়ে দেয় ফুল।আর সেদিনকার আমারি মতো অনেক ছেলে আছে ঘরে ঘরে,        লাঠাইয়ের সুতোয় মাখাচ্ছে আঠা,               তাদের মনের কথা তারাই জানে।

    টীকা