এক
    আমাদের হৃদয়ের নদীর উপর দিয়ে ধীরে
    এখনো যেতেছে চ’লে কয়েকটি শাদা রাজহাঁস;
    সহধর্মিনীর সাথে ঢের দিন—আরো ঢের দিন
    করেছি শান্তিতে বসবাস;
    দেখেছি সন্তানদের ময়দানে আলোর ভিতরে
    স্বতই ছড়ায়ে আছে—যেমন গুনেছি টায়-টায়;
    অদ্ভুত ভিড়ের দিকে চেয়ে থেকে দেখে গেছি জনতার মাথা
    গৃহদেবতাকে দেখে শৃঙ্গ শিলায়।
    নগরীর পিতামহদের ছবি দেয়ালে টাঙায়ে-
    টাঙায়েছি নগরীর পিতাদের ছবি;
    পরিক্রমণে গিয়ে সর্বদাই আমাদের বড়ো নগরীতে
    যাহাতে অমৃত হয় সে-রকম অর্থ, বাচক্লবী,
    প্রকাশে প্রয়াস পেয়ে গেছি মনে হয়;
    আমাদের নেয় যাহা নিয়ে গেছি তুলে;
    নটে গাছ মুড়ে গেছে ব’লে মনে হয়
    আমাদের বক্তব্য ফুরুলে।
    আবার সবুজ হ’য়ে জুয়ায়ে গিয়েছে
    আমাদের সন্তানের সন্তানের প্রয়োজন মতো।
    এ-রকম চক্রাকারে ঘুরে গিয়ে কাল
    সহসা খি চড়ে উঠে উচ্চরের মতন ফলত
    অন্য-কোনো জ্যামিতিক রেখা হ’তে পারে;
    অন্য-কোনো দার্শনিক মত-বিপ্লব;
    জেনে তবু মুর্খ আর রূপসীর ভয়াবহ সংগম এড়ায়ে
    স্থির হ’য়ে রবে নাকি সন্ততিরা, সন্ততির সন্ততিরা সব?
    যদি তারা টেঁশে যায় করাল কালের স্রোতে ধরা প’ড়ে গিয়ে,
    যদি এই অন্ধকার প্রাসাদের ভগ্ন-অবশেষে
    শেয়া প্যাঁচার দিকে চেয়ে কেঁদে যা,-
    তখন স্বপ্নই সত্য; গিয়েছে বস্তুর থেকে ফেঁশে
    জীবনের বাস্তবতা সে-সময়।
    মানুষের শেষ বংশ লোপ পেলে কে ফিরায়ে দেবে
    জীবনের বাস্তবতা?—এমন অদ্ভুত স্বপ্ন নিয়ে
    মাঝে-মাঝে গিয়েছি নাগাঢ় কথা ভেবে।
    দুই
    সময় কীটের মতো কুরে খায় আমাদের দেশ।
    আমাদের সন্তানেরা একদিন জ্যেষ্ঠ হ’য়ে যাবে;
    স্বতসিদ্ধতায় গিয়ে জীবনের ভিতরে দাঁড়াবে;
    এ-রকম ভাবনার কিছু অবলেশ
    তাদের হৃদয়ে আছে হয়তো-বা;—মাঠে-ময়দানে
    কথা ব’লে জীবনের বিষ তারা ঝেড়ে ফেলে দিতে চায় আজ;
    অল্পায়ু হিমের দিন ততোধিক মিহিন কামিজে
    কাটাতেছে যেন অগণন গিরেবাজ।
    সমুদ্রের রৌদ্র থেকে আমাদের দেশে
    নীলাভ ঢেউয়ের মতো দীপ্তি নেমে আসে মনে হয়;
    আমাদের পিতামহ পিতারাও প্রবাদের মতো জেনে গেছে;
    আমাদেরও ততদূর ভাববিনিময়
    একদিন ছিলো,—তবু শোচনীয় কালের বিপাকে
    হারায়ে ফেলেছি সেই সান্দ্র বিশ্বাস।
    কারু সাথে অন্ধকার মাটিতে ঘুমায়ে,
    কারু সাথে ভোরবেলা জেগে—বারো মাস
    তাকেও স্মরণ ক’রে চিনে নিতে হয়
    সে কি কাল? সে জীবন? জ্ঞাতিভ্রতা? গণিকা? গৃহিণী?
    মানুষের বংশ এসে সময়ের কিনারে থেমেছে,
    একদিন চেনা ছিলো ব’লে আজ ইহাদের চিনি
    অন্ধকার সংস্কার হাৎড়ায়ে, মৃদুভাবে হেসে;
    তীর্থে—তীর্থে বারবার পরীক্ষিত হ’য়ে পরিচয়
    বিবর্ণ জ্ঞানের রাজ়্যে কাগজের ডাঁইয়ে প’ড়ে আছে;
    আমাদের সন্ততিও আমাদের হৃদয়ের নয়।
    আমরা মধ্যম পথে বিকালের ছায়ায় রয়েছি
    একটি পৃথিবী নষ্ট হ’য়ে গেছে আমাদের আগে,
    আরেকটি পৃথিবীর দাবি
    স্থির ক’রে নিতে হ’লে লাগে
    সকালের আকাশের মতন বয়স;
    সে-সকাল কখনো আসে না ঘোর,স্বধর্মনিষ্ঠ রাত্রি বিনে।
    পশ্চিমে অস্তের সূর্য ধূলিকণা, জীবাণুর উতরোল মহিমা রটায়ে
    পৃথিবীকে রেখে যায় মানবের কাছে জনমানবের ঋণে।
    তিন
    সারাদিন ধানের বা কাস্তের শব্দ শোনা যায়।
    ধীর পদক্ষেপে কৃষকেরা হাঁটে।
    তাদের ছায়ার মতো শরীরের ফুঁয়ে
    শতাব্দীর ঘোর কাটে-কাটে।
    মাঝে-মাঝে দু’-চারটে প্লেন চ’লে যায়।
    একভিড় হরিয়াল পাখি
    উড়ে গেল মনে হয়, দুই পায়ে হেঁটে
    কত দূর যতে পারে মানুষ একাকী।
    এ-সব ধারণা তবু মনের লঘুতা।
    আকাশে রক্তিম হ’য়ে গেছে;
    কামানের থেকে ম্ময়, আজো এইখানে
    প্রকৃতি রয়েছে।
    রাত্রি তার অন্ধকার ঘুমাবার পথে
    আবার কুড়ায়ে পায় এক পৃথিবীর মেয়ে, ছেলে;
    মানুষ ও মনীষীর রৌদ্রের দিন
    হৃদয়বিহীনভাবে শূন্য হ’য়ে গেলে।
    সেই রাত্রি এসে গেছে; সন্ততিরা জড়ায়ে গিয়েছে
    জ্ঞাতকুলশীল আর অজ্ঞাত ঋণে।
    পারাবত-পক্ষ-ধ্বনি সায়াহ্নের, সকালের নয়,
    মাঝে এই বেহুলা ও কালরাত্রি বিনে।
    চার
    এখন অনেক দূরে ইতিহাস-স্বভাবের গতি চলে গেছে।
    পশ্চিম সূর্যের দিকে শত্রু ও সুহৃদ তাকায়েছে।
    কে তার পাগড়ি খুলে পুব দিকে ফসলের, সূর্যের তরে
    অপেক্ষায় অন্ধকার রাত্রির ভিতরে
    ডুবে যেতে চেয়েছিলো বলে চ’লে গেছে।

    আমরা সকলে তবু সময়ের একান্ত সৈকতে
    নিজেদের অপরের সবায়ের জনমতামতে
    অনেক ডোডের ভিড়ে ডোডেদের মতো
    নেই—তুব র’য়ে গেছি স্বভাববশত।
    এই ক্রান্তি জীবন বা মরণের ব’লে মনে হয়।

    আকাশের ফিকে রঙ ভোরের, কি সন্ধ্যার আঁধার?
    এই দূরত্যয় সিন্ধু কি পার হবার?
    আমরা অনেক লোক মিলে তবু এখন একাকী;
    বংশ লুপ্ত ক’রে দিয়ে শেষ অবশিষ্ট ডোডো পাখি,
    হ’তে গিয়ে পারাবত-পক্ষ-ধ্বনি শুনি,
    না কি ডোডোমির অতল ক্রেংকার।

    টীকা