কুসুম-শয়নে যথা সুবর্ণ-মন্দিরে
    বিরাজে বীরেন্দ্র বলী ইন্দ্রজিত,তথা
    পশিল কূজন-ধ্বনি সে সুখ-সদনে।
    জাগিলা বীর-কুন্জর কুন্জবন-গীতে।
    প্রমীলার করপদ্ম করপদ্মে ধরি
    রথীন্দ্র, মধুর স্বরে, হায় রে, যেমতি
    নলিনীর কানে অলি কহে গুন্জরিয়া
    প্রেমের রহস্য কথা, কহিলা (আদরে
    চুম্বি নিমীলিত আঁখি )—“ডাকিছে কূজনে,
    হৈমবতী ঊষা তুমি,রূপসি, তোমারে
    পাখী-কুল; মিল, প্রিয়ে, কমল লোচন
    উঠ, চিরানন্দ মোর; সূর্য্যকান্তমণি-
    সম এ পরাণ,কান্তে, তুমি রবিচ্ছবি;—-
    তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ন;
    ভাগ্য-বৃক্ষে ফলোত্তম তুমি হে জগতে
    আমার; নয়ন-তারা; মহার্হ রতন;
    উঠি দেখ,শশিমুখি,কেমনে ফুটিছে,
    চুরি করি কান্তি তব মন্জু কুন্জবনে
    কুসুম ;” চমকি রামা উঠিলা সত্বরে;—
    গোপিনী কামিনী যথা বেনুর সুরবে;
    আবরিলা অবয়ব সুচারু-হাসিনী
    শরমে। কহিলা পুনঃ কুমার আদরে;—
    “পোহাইল এতক্ষনে তিমির-শর্বরী;
    তা না হলে ফুটিতে কি তুমি, কমলিনি,
    জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়? চল, প্রিয়ে, এবে
    বিদায় হইব নমি জননীর পদে;
    পরে যথাবিধি পূজি দেব বৈশ্বানরে,
    ভীষণ-অশনি-সম শর-বরিষণে
    রামের সংগ্রাম-সাধ মিটাব সংগ্রামে।”
    সাজিলা রাবণ-বধূ, রাবণ-নন্দন,
    অতুল জগতে দোঁহে; বামাকুলোত্তমা
    প্রমীলা, পুরুষোত্তম মেঘনাদ বলী ;
    শয়ন-মন্দির হতে বাহিরিলা দোঁহে—
    প্রভাতের তারা যথা অরুনের সাথে;
    বাজিল রাক্ষস-বাদ্য ; নমিল রক্ষক ;
    জয় মেঘনাদ উঠিল গগনে ;
    রতন-শিবিকাসনে বসিলা হরষে
    দম্পতী। বহিলা যান যানবাহ- দলে
    মন্দোদরী মহিষীর সুবর্ন-মন্দিরে।
    প্রবেশিলা অরিন্দম, ইন্দু-নিভাননা
    প্রমীলা সুন্দরী সহ,সে স্বর্ণ-মন্দিরে।
    ত্রিজটা নামে রাক্ষসী আইল ধাইয়া।
    কহিল বীর-কেশরী; ” শুন লো ত্রিজটে,
    নিকুম্ভিলা-যজ্ঞ সাঙ্গ করি আমি আজি
    যুঝিব রামের সঙ্গে পিতার আদেশে,
    নাশিব রাক্ষস-রিপু; তেঁই ইচ্ছা করি
    পূজিতে জননী পদ। যাও বার্তা লয়ে ;
    কহ,পুত্র, পুত্রবধু দাঁড়ায়ে দুয়ারে
    তোমার,হে লঙ্কেশ্বরী ;” সাষ্টাঙ্গে প্রণমি,
    কহিলা শূরে ত্রিজটা, ( বিকটা রাক্ষসী)—
    ” শিবের মন্দিরে এবে রাণী মন্দোদরী,
    যুবরাজ; তোমার মঙ্গল-হেতু তিনি
    অনিদ্রায়, অনাহারে পূজেন উমেশে ;
    তব সম পুত্র, শূর,কার এ জগতে ?
    কার বা এ হেন মাতা ?”—এতেক কহিয়া
    সৌদামিনী-গতি দূতী ধাইল সত্বরে।
    বাহিরিলা লঙ্কেশ্বরী শিবালয় হতে
    প্রণমে দম্পতী পদে। হরষে দুজনে
    কোলে করি, শিরঃ চুম্বি, কাঁদিলা মহিষী।
    কহিলা বীরেন্দ্র; ” দেবি আশীষ দাসেরে।
    নিকুম্ভিলা-যজ্ঞ সাঙ্গ করি যথাবিধি,
    পশিব সমরে আজি, নাশিব রাঘবে;
    শিশু ভাই বীরবাহু; বধিয়াছে তারে
    পামর। দেখিব মোরে নিবারে কি বলে ?
    দেহ পদ-ধূলি, মাতঃ ;তোমার প্রসাদে
    নির্ব্বিঘ্ন করিব আজি তীক্ষ্ন শর-জালে
    লঙ্কা; বাঁধি দিব আনি তাত বিভীষণে
    রাজদ্রোহী ; খেদাইব সুগ্রীব অঙ্গদে
    সাগর অতল জলে;” উত্তরিলা রাণী,
    মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে;—
    “কেমনে বিদায় তোরে করি রে বাছনি ;
    আঁধারি হৃদয়াকাশ,তুই পূর্ণ শশী
    আমার। দুরন্ত রণে সীতাকান্ত বলী;
    দুরন্ত লক্ষণ শূর; কাল-সর্প-সম
    দয়া-শূন্য বিভীষণ; মত্ত লোভ-মদে,
    স্ববন্ধু-বান্ধবে মূঢ় নাশে অনায়াসে,
    ক্ষুধায় কাতর ব্যাঘ্র গ্রাসয়ে যেমতি
    স্বশিশু; কুক্ষনে,বাছা, নিকষা শাশুড়ী
    ধরেছিলা গর্ভে দুষ্টে, কহিনু রে তোরে;
    এ কনক-লঙ্কা মোর মজালে দুর্ম্মতি;”
    হাসিয়া মায়ের পদে উত্তরিলা রথী;—
    কেন, মা ডরাও তুমি রাঘবে লক্ষণে,
    রক্ষোবৈরী ? দুইবার পিতার আদেশে
    তুমুল সংগ্রামে আমি বিমুখিনু দোঁহে
    অগ্নিময় শর-জালে ; ও পদ-প্রসাদে
    চির-জয়ী দেব-দৈত্য-নরের সমরে
    এ দাস ; জানেন তাত বিভীষণ, দেবি,
    তব পুত্র-পরাক্রম ; দম্ভোলি-নিক্ষেপী
    সহস্রাক্ষ সহ যত দেব-কুল-রথী ;
    পাতালে নাগেন্দ্র, মর্ত্তে নগেন্দ্র ; কি হেতু
    সভয় হইলা আজি,কহ, মা, আমারে ?
    কি ছার সে রাম, তারে ডরাও আপনি ?
    মুছিয়া নয়ন-জল রতন-আঁচলে,
    উত্তরিলা লঙ্কেশ্বরী; ” যাইবি রে যদি;—
    রাক্ষস-কুল-রক্ষণ বিরূপাক্ষ তোরে
    রক্ষুন এ কাল-রণে ; এই ভিক্ষা করি
    তার পদ যুগে আমি। কি আর কহিব ?
    নয়নের তারা হারা করি রে থুইলি
    আমায় এ ঘরে তুই;” কাঁদিয়া মহিষী
    কহিলা,চাহিয়া তবে প্রমীলার পানে ;—
    “থাক,মা,আমার সঙ্গে তুমি; জুড়াইব,
    ও বিধুবদন হেরি এ পোড়া পরাণ ;
    বহুলে তারার করে উজ্জ্বল ধরণী।”
    বন্দি জননীর পদ বিদায় হইলা
    ভীমবাহু কাঁদি রাণী, পুত্র-বধূ সহ,
    প্রবেশিলা পুনঃ গৃহে। শিবিকা ত্যজিয়া,
    পদ-ব্রজে যুবরাজ চলিলা কাননে—
    ধীরে ধীরে রথীবর চলিলা একাকী,
    কুসুম-বিব্রিত পথে যজ্ঞশালা মুখে।

    টীকা