নমি আমি,কবি-গুরু তব পদাম্বুজে,
    বাল্মীকি;হে ভারতের শিরঃচূড়ামণি,
    তব অনুগামী দাস,রাজেন্দ্র-সঙ্গমে
    দিন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে;
    তব পদ-চিহ্ন ধ্যান করি দিবানিশি,
    পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে,
    দমনিয়া ভব-দম দুরন্ত শমনে—
    অমর; শ্রীভর্ত্তৃহরি; সূরী ভবভূতি
    শ্রীকন্ঠ;ভারতে খ্যাত বরপুত্র যিনি
    ভারতীর, কালিদাস–সুমধুর-ভাষী;
    মুরারী-মূরলীধ্বনি-সদৃশ মুরারি
    মনোহর;কীর্ত্তিবাস,কীর্ত্তিবাস কবি,
    এ বঙ্গের অলঙকার;–হে পিতঃ, কেমনে,
    কবিতা-রসের সরে রাজহংস-কুলে
    মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি?
    গাঁথিব নূতন মালা ,তুলি সযতনে
    তব কাব্যদানে ফুল; ইচ্ছা সাজাইতে
    বিবিধ ভূষনে ভাষা; কিন্তু কোথা পাব
    ( দীন আমি; ) রত্নরাজী,তুমি নাহি দিলে,
    রত্নাকর ? কৃপা,প্রভু কর আকিন্চনে।
    একাকিনি শোকাকুলা, অশোক-কাননে
    কাঁদেন রাঘব-বান্ছা আঁধার কুটিরে
    নীরবে;দুরন্ত চেড়ী,সতীরে ছাড়িয়া,
    ফেরে দূরে মত্ত সবে উৎসব-কৌতুকে–
    হীন-প্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী
    নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে
    মলিন-বদনা দেবী,হায় রে যেমতি
    খনির তিমির গর্ভে ( না পারে পশিতে
    সৌর-কর-রাশি যথা ) সূর্য্যকান্ত-মণি;
    কিম্বা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশি-তলে;
    স্বনিছে পবন, দূরে রহিয়া রহিয়া
    উছ্বাসে বিলাপী যথা; লড়িছে বিষাদে
    মর্মরিয়া পাতাকুল; বসেছে অরবে
    শাখে পাখী; রাশি রাশি কুসুম পড়েছে
    তরুমূলে; যেন তরু, তাপি মনস্তাপে,
    ফেলিয়াছে খুলি সাজ; দূরে প্রবাহিণী,
    উচ্চ বিচী-রবে কাঁদি, চলিছে সাগরে,
    কহিতে বারীশে যেন এ দুঃখ-কাহিনী;
    না পশে সুধাংশু-অংশু সে ঘোর বিপিনে
    ফোটে কি কমল কভু সমল সলিলে ?
    তবুও উজ্বল বন ও অপূর্ব্ব রূপে;
    একাকিনী বসি দেবী, প্রভা আভাময়ী,
    তমোময় ধামে যেন ; হেন কালে তথা
    সরমা সুন্দরী আসি বসিলা কাঁদিয়া
    সতীর চরণ-তলে,সরমা সুন্দরী–
    রক্ষঃকুল-রাজলক্ষী রক্ষোবধূ-বেশে;
    কতক্ষনে চক্ষু-জল মুছি সুলোচনা
    কহিলা মধুর স্বরে; ” দুরন্ত চেড়ীরা,
    তোমারে ছাড়িয়া, দেবি ফিরিছে নগরে,
    মহোৎসবে রত সবে আজি নিশা-কালে;
    এই কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে
    পা-দুখানি। আনিয়াছি কৌটায় ভরিয়া
    সিন্দুর; করিলে আজ্ঞা,সুন্দর ললাটে
    দিব ফোঁটা। এয়ো তুমি, তোমার কি সাজে
    এ বেশ ? নিষ্ঠুর,হায়, দুষ্ট লঙ্কাপতি ;
    কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ ? কেমনে হরিল
    ও বরাঙ্গ-অলঙ্কার, বুঝিতে না পারি ?
    কৌটা খুলি,রক্ষো বধূ যত্নে দিলা ফোঁটা ।
    সীমন্তে ; সিন্দুর বিন্দু শোভিল ললাটে ,
    গোধূলি-ললাটে, আহা; তারা-রত্ন-যথা ;
    দিয়া ফোঁটা, পদ-ধূলি লইলা সরমা ।
    ” ক্ষম লক্ষি, ছুইনু ও দেব-আকাঙ্খিত
    তনু;কিন্তু চির-দাসী দাসী ও চরণে;”
    এতেক কহিয়া পুনঃ বসিলা যুবতী
    পদতলে;আহা মরি সুবর্ণ-দেউটি
    তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি
    দশ দিশ; মৃদু-স্বরে কহিলা মৈথিলী;—
    ” বৃথা গন্জ দশাননে তুমি, বিধুমুখী ;
    আপনি খুলিয়া আমি ফেলাইনু দূরে
    আভরণ,যবে পাপী আমারে ধরিল
    বনাশ্রমে। ছড়াইনু পথে সে সকলে,
    চিহ্ন হেতু। সেই হেতু আনিয়াছে হেথা–
    এ কনক-লঙ্কাপুরে—-ধীর রঘুনাথে ;
    মণি,মুক্তা, রতন, কি আছে লো জগতে,
    যাহে নাহি অবহেলি লভিতে সে ধনে ?
    যথা গোমুখীর মুখ হইতে সুস্বনে
    ঝরে পূত বারি-ধারা, কহিলা জানকী,
    মধুর ভাষিণী সতী, আদরে সম্ভাষি
    সরমারে,—“হিতৈষিণী সীতার পরমা
    তুমি,সখি; পূর্ব্ব-কথা শুনিবারে যদি
    ইচ্ছা তব,কহি আমি, শুন মনঃ দিয়া ।—
    ছিনু মোরা, সুলোচনে, গোদাবরী-তীরে,
    কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে
    বাঁধি নীড়,থাকে সুখে;ছিনু ঘোর বনে,
    নাম পঞ্চবটী,মর্ত্ত্যে সুর-বন-সম।
    সদা করিতেন সেবা লক্ষণ সুমতি।
    দন্ডক ভান্ডার যার, ভাবি দেখ মনে,
    কিসের অভাব তার? যোগাতেন আনি
    নিত্য ফল-মূল বীর সৌমিত্রি; মৃগয়া
    করিতেন কভু প্রভু; কিন্তু জীব নাশে
    সতত বিরত,সখি রাঘবেন্দ্র বলী,—
    দয়ার সাগর নাথ ,বিদিত জগতে;
    “ভুলিনু পূর্ব্বের সুখ। রাজার নন্দিনী
    রঘু-কুল-বধু আমি; কিন্তু এ কাননে,
    পাইনু, সরমা সই,পরম পিরীতি ;
    কুটীরের চারিদিকে কত যে ফুটিত
    ফুলকুল নিত্য নিত্য,কহিব কেমনে?
    পঞ্চবটী-বন-চর মধু নিরবধি;
    জাগাত প্রভাতে মোরে কহরি সুস্বরে
    পিকরাজ;কোন রাণী,কহ; শশিুমুখি,
    হেন চিত্ত-বিনোদন বৈতালিক-গীতে
    খোলে আঁখি? শিখী সহ । শিখীনি সুখিনী
    নাচিত দুয়ারে মোর; নর্ত্তক,নর্ত্তকী,
    এ দোঁহার সম, রামা,আছে কি জগতে ?
    অতিথি আসিত নিত্য করভ,করভী,
    মৃগ- শিশু, বিহঙ্গম,স্বর্ণ-অঙ্গ কেহ,
    কেহ, শুভ্র,কেহ কাল,কেহ বা চিত্রিত,
    যথা বাসবের ধনুঃ ঘন-বন-শিরে;
    অহিংসক জীব যত। সেবিতাম সবে,
    মহাদরে; পালিতাম পরম যতনে,
    মরুভূমে স্রতোস্বতী তৃষাতুরে যথা,
    আপনি সুজলবতী বারিদ-প্রসাদে।
    সরসী আরসি মোর ; তুলি কুবলয়ে,
    ( অতুল রতন-সম ) পরিতাম কেশে ;
    সাজিতাম ফুল-সাজে ; হাসিতেন প্রভু,
    বনদেবী বলি মোরে সম্ভাষি কৌতুকে ;
    হায়, সখি, আর কি লো পাব প্রাণনাথে?
    আর কি এ পোড়া আঁখি এ ছার জনমে
    দেখিবে সে পা-দুখানি—আশার সরসে
    রাজীব ; নয়ন মণি? হে দারুণ বিধি,
    কি পাপে পাপী এ দাসী তোমার সমীপে?
    এতেক কহিয়া দেবী কাঁদিলা নীরবে ।
    কাঁদিলা সরমা সতী তিতি অশ্রু-নীরে।
    কতক্ষনে চক্ষু-জল মুছি রক্ষোবধূ
    সরমা, কহিলা সতী সীতার চরণে;—
    ” স্মরিলে পূর্ব্বের কথা ব্যাথা মনে যদি
    পাও, দেবী, থাক তবে ; কি কাজ স্মরিয়া ?—
    হেরি তব অশ্রু-বারি ইচ্ছি মরিবারে ; ”
    উত্তরিলা প্রিয়ম্বদা ( কাদম্বা যেমতি
    মধু-স্বরা ) ;–“এ অভাগী,হায়, লো সুভগে,
    যদি না কাঁদিবে, তবে কে আর কাঁদিবে
    এ জগতে ? কহি, শুন পূর্ব্বের কাহিনী।
    বরিষার কালে,সখি,প্লাবন-পীড়নে
    কাতর,প্রবাহ,ঢালে,তীর অতিক্রমি,
    বারি-রাশি দুই পাশে; তেমতি যে মনঃ
    দুঃখিত,দুঃখের কথা কহে সে অপরে।
    তেঁই আমি কহি,তুমি শুন,লো সরমে ;
    কে আছে সীতার আর এ অবরু-পুরে?
    ” পঞ্চবটী-বনে মোরা গোদাবরী-তটে
    ছিনু সুখে। হায়, সখি,কেমনে বর্ণিব
    সে কান্তার-কান্তি আমি ? সতত স্বপনে
    শুনিতাম মন-বীণা বন-দেবী-করে;
    সরসীর তীরে বসি, দেখিতাম কভু
    সৌর-কর-রাশি-বেশে সুরবালা-কেলি
    পদ্মবনে; কভু সাধ্ধী ঋষিবংশ-বধূ
    সুহাসিনী আসিতেন দাসীর কুটীরে,
    সুধাংশুর অংশু যেন অন্ধকার ধামে;
    অজিন ( রন্জিত, আহা, কত শত রঙে; )
    পাতি বসিতাম কভু দীর্ঘ তরুমূলে,
    সখী-ভাবে সম্ভাষিয়া ছায়ায়,কভু বা
    কুরঙ্গিনী-সঙ্গে রঙ্গে নাচিতাম বনে,
    গাইতাম গীত শুনি কোকিলের ধ্বনি;
    নব-লতিকার,সতি দিতাম বিবাহ
    তরু-সহ; চুম্বিতাম মন্জরিত যবে
    দম্পতী, মন্জরীবৃন্দে আনন্দে সম্ভাষি
    নাতিনী বলিয়া সবে; গুন্জরিলে অলি,
    নাতিনী-জামাই বলি বরিতাম তারে;
    কভু বা প্রভুরর সহ ভ্রমিতাম সুখে
    নদী-তটে; দেখিতাম তরল সলিলে
    নূতন গগন যেন,নব তারাবলী,
    নব নিশাকান্ত-কান্তি ; কভু বা উঠিয়া
    পর্ব্বত-উপরে ,সখি বসিতাম আমি
    নাথের চরণ-তলে, ব্রততী যেমতি
    বিশাল রসাল-মূলে; কত যে আদরে
    তুষিতেন প্রভু মোরে, বরষি বচন-
    সুধা, হায়, কব কারে ? কব বা কেমনে ?
    শুনেছি কৈলাস-পুরে কৈলাস-নিবাসী
    ব্যোমকেশ,স্বর্ণাসনে বসি গৌরী-সনে,
    আগম,পুরাণ, বেদ, পঞ্চতন্ত্র-কথা
    পঞ্চমুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে;
    শুনিতাম সেইরূপে আমিও,রূপি,
    নানাকথা ; এখনও, এ বিজন বনে,
    ভাবি আমি শুনি যেন সে মধুর বাণী ;—
    সাঙ্গ কি দাসীর পক্ষে, হে নিষ্ঠুর বিধি,
    সে সঙ্গীত ?”—নীরবিলা আয়ত-লোচনা
    বিষাদে। কহিলা তবে সরমা সুন্দরী ;—
    “শুনিলে তোমার কথা, রাঘব-রমণি,
    ঘৃণা জন্মে রাজ-ভোগে ; ইচ্ছা করে,ত্যজি
    রাজ্য-সুখ, যাই চলি হেন বনবাসে ;
    কিন্তু ভেবে দেখি যদি,ভয় হয় মনে।
    রবিকর যবে, দেবি, পশে বনস্থলে
    তমোময়,নিজগুনে আলো করে বনে
    সে কিরণ; নিশি যবে যায় কোন দেশে,
    মলিন-বদন সবে তার সমাগমে;
    যথা পদার্পণ তুমি কর, মধুমতি,
    কেন না হইবে সুখী সর্ব্ব জন তথা,
    জগৎ-আনন্দ তুমি, ভুবন-মোহিনী ;
    কহ, দেবি, কি কৌশলে হরিল তোমারে
    রক্ষঃপতি? শুনিয়াছে বীণা-ধ্বনি দাসী,
    পিকবর-রব নব পল্লব-মাঝারে
    সরষ মধুর মাসে ; কিন্তু নাহি শুনি
    হেন মধুমাখা কথা কভু এ জগতে;”

    টীকা