Chapter Index

    উলটো কথা, কিন্তু সত্যি

    পরিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রথমে বলুন কী নাম আপনার?’

    ছাত্র বললেন, ‘আইজ্ঞা, বিপিনবিহারী সাঁপুই৷’

    পরিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘বয়স কত?’

    ছাত্র বললেন, ‘দু’কুড়ি দশ৷’

    পরিক্ষকের পাশে বসা অন্য একজন শিক্ষক বললেন, ‘দু’কুড়ি দশ? তার মানে পঞ্চাশ৷ দেখলে আরও বেশি মনে হয়৷ আপনি ঠিক জানেন?’

    বিপিনবিহারী বললেন, ‘গত বৈশাখের আগের বৈশাখে আমার বাবা মারা গেলেন৷ বাবা বলে দিয়েছিলেন, আমার বয়স দু’কুড়ি দশ৷’

    অতিকষ্টে হাসি চেপে পরিক্ষক বললেন, ‘তার মানে দু’ বছর আগে আপনার বয়স ছিল পঞ্চাশ৷ এখন বাহান্ন তো হবেই৷’

    অন্য শিক্ষক বললেন, ‘প্রত্যেক বৈশাখ মাসে আপনার এক বছর করে বয়স বাড়বে, এখন থেকে মনে রাখবেন৷ নিজের নামটা লিখতে পারেন?’

    ছাত্র ঘাড় হেলিয়ে জানালেন, পারি৷

    পরিক্ষক, শিক্ষক দু’জনের বয়স ছাত্রের চেয়ে কম৷ ছাত্রের পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া, মাথায় টাক৷ প্রথমে তাঁকে বসতে বললেও বসতে চাননি, এখন প্রায় জোর করেই বসানো হয়েছে টুলে৷ একটা খাতায় তিনি পেনসিল দিয়ে নিজের নাম লিখলেন৷ সেটা প্রায় পড়াই যায় না৷ একটা অক্ষর অনেক বড়, পাশেরটা অনেক ছোট৷

    পরিক্ষকের নাম মনোজ, আর অন্য শিক্ষকটির নাম রফিকুল৷ রফিকুল বললেন, ‘আর-একটু ভালো করে লিখতে হবে৷ যাই হোক, আপনার নামের মানে কী, জানেন?’

    বিপিনবিহারী ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে বললেন, ‘নামের মানে? সেটা কী?’

    মনোজ রফিকুলের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার! একজন মানুষ সারা জীবন ধরে একটা নাম বলে আসছে, অথচ তার মানেই জানে না!’

    রফিকুল বললেন, ‘তাতে আর কী হয়েছে? অনেক সাহেবের তো নামের কোনও মানেই থাকে না৷ শেক্সপিয়র নামের মানে কী?’

    মনোজ বললেন, ‘বাংলায় সব নামেরই মানে থাকে৷ শুনুন বিপিনবিহারীবাবু…৷’

    বিপিনবিহারী বাধা দিয়ে বললেন, ‘আমাকে ‘বাবু’ বলছেন কেন স্যার? আমি চাষাভুষো মানুষ, বাবু তো নই৷ আপনারা বাবু৷’

    মনোজ হেসে বললেন, ‘আমাদের সকলেই ‘বাবু’ বলে বটে, কিন্তু আমরাও বাবু নই৷ অনেক চাষির তুলনায় আমরা কম মাইনে পাই৷ আবার দেখুন, এই যে রফিকুলমাস্টার, ওঁকে কিন্তু কেউ ‘বাবু’ বলে না৷ বলে, ‘রফিকুলসাহেব’৷ আপনি বিপিনবিহারীসাহেব হতে রাজি আছেন?’

    বিপিনবিহারী এবার হে হে হে হে করে উঠলেন৷

    রফিকুল বললেন, ‘আপনার নামের মানেটা খুব সুন্দর৷ বিপিন মানে কানন, মানে জঙ্গল৷ আর বিপিনবিহারী মানে জঙ্গলে যে ঘুরে বেড়ায়৷ অর্থাৎ কৃষ্ণ৷ ছেলেবেলায় নিশ্চয়ই আপনার কেষ্টঠাকুরের মতো চেহারা ছিল৷ তাই আপনার বাবা ওই নাম রেখেছেন৷’

    বিপিনবিহারী বললেন, ‘আমার বাবাও ও নামের মানে জানত না৷’

    রফিকুল আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে, আপনি জানেন?’

    বিপিনবিহারী একটু ভেবে বললেন, ‘শিব ঠাকুর, কার্তিক আর গণেশ, আর- একজন ঠাকুর, তাই বটে?’

    মনোজ এবার একটা বই এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি বাংলা পড়তে পারেন তো? এই জায়গাটা জোরে-জোরে পড়ুন৷’

    বিপিনবিহারী পড়তে লাগলেন, ‘পু পু পু নি মার চা চা চা চাঁদ এখন মাঝ গ গ গ গনে৷ রা বর্গীয় জ, বাড়ির ন ন ন হ বতে মা ঝ রা তে র দন্তের সয়ে হ্রস্ব উ, সু আর র-এ এ-কার…৷’

    মনোজ বললেন, ‘হয়েছে, হয়েছে৷ আর থাক৷’

    রফিকুল জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার বাড়ির হাঁস ডিম পেড়েছে?’

    বিপিনবিহারী বললেন, ‘আমাগো বাড়িতে হাঁস নাই, সার৷’

    রফিকুল বললেন, ‘মনে করুন আছে৷ ডিম পেড়েছে ন’টা৷ একজন সব ডিম কিনতে চায়৷ বাজারে এখন হাঁসের ডিমের দাম এক-একটা আড়াই টাকা৷ তা হলে ন’টা ডিমের জন্যে কত দাম চাইবেন?’

    মাথা চুলকে, অনেক হিসেবটিসেব করে বিপিনবিহারী বললেন, ‘পনেরো টাকা৷’

    মনোজ বললেন, ‘এত সস্তা? আপনার বাড়িতে আমি রোজ ডিম কিনতে যাব৷’

    রফিকুল বললেন, ‘এরকম হিসেবে ভুল করলে আপনি পদে-পদে ঠকবেন৷ একটু-একটু অঙ্ক না শিখলে কি চলে?’

    বিপিনবিহারী বললেন, ‘আমার ছেলে ভালো হিসেব বোঝে৷ তাকে কেউ ঠকাতে পারবে না৷’

    রফিকুল বললেন, ‘আপনার ছেলে কি সব সময় আপনার পাশে থাকবে? আপনি যখন হাট-বাজারে যাবেন?’

    মনোজ বললেন, ‘ঠিক আছে৷ আপনার হয়ে গিয়েছে৷ নমস্কার৷ আপনি এবার আসুন৷’

    বিপিন বেরিয়ে এলেন৷

    বাইরে আরও অনেকে অপেক্ষা করছেন৷ তাঁদেরও পরিক্ষা দিতে হবে৷ সকলেই বিপিনের বয়সি৷ কয়েকজন মহিলাও আছেন তাঁদের মধ্যে৷ পরিক্ষা চলল প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে৷

    তারপরই ঘোষণা করা হল ফলাফল৷

    একজন মাস্টারমশাই চেঁচিয়ে এক-একটা নাম ডেকে তারপর বলছেন পাশ কিংবা ফেল৷

    ‘বিপিনবিহারী সাঁপুই, ফেল৷’

    পাশ বা ফেলের যে কী মূল্য, তা বিপিন বুঝতেই পারলেন না৷ অন্য কয়েকজনের সঙ্গে বসে-বসে গল্প করছিলেন৷ পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বলল রে? আমার নামে কী বলল? ফেল? হে হে হে হে!’

    তারপর তিনি বাড়ির পথ ধরলেন৷

    বেলা প্রায় দুটো বাজে৷ খিদে পেয়ে গিয়েছে বেশ৷ বাড়িতে ঢোকার একটু আগে ভাগ্যের পুকুর৷ বেশ বড়, দু’দিকে দুটো ঘাট৷ পুকুর আবার ভাগ্যের কী করে হয়? আসলে এটা ভাগের পুকুর, পাঁচটা পরিবার এর মাছ ভাগ করে নেয়৷ এরা কথায় বলে ‘ভাগ্যের পুকুর’৷

    ফতুয়াটা খুলে রেখে বিপিন সেই পুকুরে নেমে পড়লেন৷ জল দাপিয়ে স্নান করলেন ভালোভাবে৷

    ভিজে গায়ে বাড়ির মধ্যে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে বউকে বললেন, ‘একটা গামছা দাও৷ আর তাড়াতাড়ি ভাত দাও, পেট জ্বলছে৷’

    রান্নাঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর স্ত্রী চপলা৷ তিনি গামছাও দিলেন না, ভাত বাড়ার জন্য ব্যস্তও হলেন না৷ চোখ গোল-গোল করে তাকিয়ে রইলেন৷

    বিপিন আবার বললেন, ‘কই গো, একটা গামছা দাও৷ দেখছ না, ভিজে গা!’

    চপলা এবার বললেন, ‘ওগো, তুমি নাকি ফেল করেছ?’

    বিপিন একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ৷ তাই তো শুনলাম৷ ফেল করেছি তো কী হয়েছে? তাতে কি আমার হাত-পা ক্ষয়ে গিয়েছে?’

    চপলা বললেন, ‘তোমার কী আক্কেল, তুমি পাশ-ফেলও বোঝো না!’

    বিপিন বললেন, ‘কী করে বুঝব? আমার বাপ-চোদ্দো পুরুষ কেউ কখনও পাশও করেনি, ফেলও করেনি৷ আমরা মাঠের কাজ করি, ওসব আমাদের পোষায় না৷ তবে কী জানো চপলা, মাস্টারবাবুরা আমাকে খুব খাতির করে ‘আপনি, আজ্ঞে’ করে কথা বলছিল৷ একবার বলেছিল ‘বিপিনবাবু’, হে হে হে হে৷’

    এই সময় দৌড়তে-দৌড়তে এসে ঢুকল ওঁদের ছেলে নন্দলাল, ডাকনাম নন্দু৷ বারো-তেরো বছর বয়স৷ হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরা৷ সে এসেই হতাশভাবে বলল, ‘বাবা, তুমি ফেল করেছ? অ্যাঁ?’

    বিপিন এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন৷ এরা ‘ফেল’ কথাটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন? তাতে কি কিছু বদলে যায়?

    নন্দু আবার বলল, ‘জানো মা, সইফুলের চাচা মুজিবরসাহেব পাশ! সুশান্তর বাবা অনন্তহরি দাস পাশ৷ বাতাসির মা-ও পাশ৷ আর আমার বাবা কিছু পারেনি৷’

    চপলা স্বামীকে বললেন, ‘তুমি কী গো? তোমাকে এত করে পড়ানো হল! তুমি তবু পারলে না?’

    বিপিন বললেন, ‘পারব না কেন? যা যা জিজ্ঞেস করল, গড়গড় করে বলে দিলাম৷ কোনটায় পাশ আর কোনটায় ফেল, তা আমি কী করে জানব? ঠিকঠিকই তো বলেছি, এখন বাবুদের যদি পছন্দ না হয়…৷’

    নন্দু বলল, ‘মোটেই কিছু ঠিক বলোনি৷ নিজের নামটা লিখতে পারোনি ঠিক করে৷ অঙ্কে ভুল করেছ৷ বাংলা পড়া পারোনি৷’

    বিপিন এবার একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘অঙ্ক ভুল মানে? বাবুরা বলে কী, আমাদের বাড়ির হাঁস নাকি ন’টা ডিম পেড়েছে৷ হাঁসই নেই, তা ডিম পাড়বে কী করে? যত্তসব অদ্ভুত কথা৷ এ আবার অঙ্ক হয় নাকি!’

    চপলা বললেন, ‘হাঁসের ডিম আর আলু-পটলের দাম, সবই অঙ্ক৷ তুমি কিছু জানো না, তাই তোমাকে সবাই ঠকায়৷ গামছা দিচ্ছি, মাথা মুছে নাও, খাওয়াদাওয়া সেরে আবার পড়তে বসো৷’

    বিপিন এবার এ পরিবারের প্রধান হিসেবে খানিকটা গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, ‘কী, আমি আবার পড়তে বসব? মোটেই না৷ ওসব আমার পোষাবে না৷ খেয়েদেয়ে আমি একটা ঘুম দেব৷ তারপর বিকেলবেলা মুনসিগঞ্জের হাটে যাব৷’

    নন্দু বলল, ‘না বাবা, তোমাকে আবার পড়তে বসতেই হবে৷ পনেরো দিন পর আর-একবার পরিক্ষা৷’

    বিপিন বললেন, ‘মারব এক থাবড়া৷ তোর কথা শুনে আমাকে পড়তে হবে? ওসব পরিক্ষামরিক্ষার মধ্যে আমি আর যাচ্ছি না৷’

    চপলা বললেন, ‘শোনো, তোমাকে এ পরিক্ষায় পাশ করতেই হবে৷ নইলে ছেলেটার যে ক্ষতি হয়ে যাবে!’

    বিপিন বললেন, ‘আমি পরিক্ষামরিক্ষা না দিলে ছেলের কেন ক্ষতি হবে? আমি তো ওর বই কেনার জন্য টাকা দিইছি!’

    চপলা বললেন, ‘শোনো, ইশকুলের ছেলেমেয়েদের তো পরিক্ষা পাশ করতেই হয়৷ এক ক্লাস থেকে উপরের ক্লাসে ওঠে৷ ওদের ইশকুলে শুধু পড়াশোনা করলেই হয় না, হাতের কাজ শিখতে হয়৷ অন্য কাজও শিখতে হয়৷ তাকে বলে ‘ওয়ার্ক এডুকেশন’৷ নন্দুদের ইশকুলে নিয়ম করেছে, বাবা-মা যদি কিছুই লেখাপড়া না জানে, তা হলে তাদের একজনকে শিখিয়ে পরিক্ষায় পাশ করাতে হবে৷ এ জন্য তোদের কত নম্বর রে নন্দু?’

    নন্দু বলল, ‘এর জন্য পঞ্চাশ নম্বর৷ আর-একটা চান্স দেবে বলেছে৷’

    বিপিন বললেন, ‘বাপ-মায়ের যে-কোনও একজন? তা হলে নন্দু তুই তোর মাকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে পরিক্ষা দেওয়া না বাপু! আমার দ্বারা ওসব হবে না৷’

    চপলা বললেন, ‘আমি তো তোমাদের মতো ক অক্ষর গোমাংস নই গো! আমি ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি৷ বাবা-মা সাততাড়াতাড়ি বিয়ে না দিলে আরও পড়তাম৷ তোমাদের বাড়িতে তো লেখাপড়ার চলই ছিল না৷ ভাগ্যিস ছেলেমেয়েরা ইশকুলে যাচ্ছে৷ ওদের বই আমিও পড়ি সময় পেলে৷’

    বিপিন এবার উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘তা হলে তো ভালোই হল৷ নন্দু, তোর মাকে পরিক্ষার মাস্টারদের কাছে নিয়ে যা৷ টপটপ সব ঠিকঠাক বলে দেবে৷ আমাকে আর টানাটানি করিস না৷’

    নন্দু বলল, ‘কিন্তু মা তো লেখাপড়া জানেই!’

    বিপিন বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? মাস্টারবাবুদের বলবি না৷ মেয়েছেলে দেখলেই ভাববে, পড়তে-টড়তে জানে না৷’

    চপলা বললেন, ‘তার মানে কি তুমি তোমার ছেলেকে মিথ্যে কথা বলতে শেখাচ্ছ?’

    এর উত্তর না দিয়ে বিপিন মাথা নীচু করে চলে গেলেন ভিতরে৷

    এরপর কয়েক দিন ধরে চলল টানাপোড়েন৷

    বিপিন আর কিছুতেই পড়তে বসতে চান না৷ চপলা আর নন্দু তাঁকে পড়তে বসাবেনই বসাবেন৷

    সারাদিন মাঠে খেটেখুটে আসেন বিপিন৷ সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে একটু চা আর বিড়ি খেতে না-খেতেই নন্দু বলে, ‘বাবা, এবার পড়তে বসো৷’

    চপলা বলেন, ‘অন্তত ছ’ পাতা হাতের লেখা না করলে আমি ভাত বেড়ে দেব না৷’

    সারাদিনের পরিশ্রমের পর বইখাতা নিয়ে বসতেই বিপিনের চোখ ঢুলে আসে ঘুমে৷

    বউ তার পেটে খোঁচা মেরে খিলখিল করে হাসে৷ আর ছেলে বলে, ‘বাবা, একটু চোখে জল দাও!’

     এটা গ্রামের কথা৷ শহরের বাড়িতে-বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়েরা সন্ধের পর পড়তে বসে, তারা একটু অমনোযোগী হলেই বাবা-মায়েরা বলেন, ‘এই পড়, পড়, তোকে ফার্স্ট হতেই হবে!’

    এখানে দৃশ্যটি উলটো৷

    মনোজ আর রফিকুলমাস্টার ওয়ার্ক এডুকেশনের জন্য নানারকম হাতের কাজ আগেই চালু করেছিলেন, এ বছরই শুরু করেছেন বয়স্ক শিক্ষা অভিযান৷ এমনিতে অনেক চেষ্টা করেও বয়স্কদের স্কুলে আনা যায় না, কিন্তু বাড়িতে ছেলেমেয়েদের চেষ্টায় হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে৷

    যেসব ছাত্র বা ছাত্রী অনেক দিন স্কুলে আসে না, এই দু’জন শিক্ষক তাদের খবর নিতে যান৷ এককালে কোনও ছাত্রের অসুখবিসুখ হলে ডেভিড হেয়ারসাহেব তাদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিতেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন৷ একালেই বা তা হবে না কেন?

    নন্দলাল নামে ছেলেটির বাবা ডাহা ফেল করার পর সে আর স্কুলে আসে না৷ বাবার জন্য লজ্জা পেয়েছে৷ সে কি তা হলে পড়াই ছেড়ে দিল?

    দুই শিক্ষক তাই এলেন একদিন খোঁজ নিতে৷ গ্রামের একপ্রান্তে নন্দুদের বাড়িতে পৌঁছতে-পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল৷ এ গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি, ঘরে-ঘরে জ্বলছে হারিকেন৷

    অন্যদের কাছে খোঁজ নিতে-নিতে দুই শিক্ষক পৌঁছে গেলেন বিপিনবিহারী সাঁপুইয়ের বাড়িতে৷

    বাইরে দাঁড়িয়েই তাঁরা শুনতে পেলেন, ভিতরের একটা ঘরে চলছে পড়াশুনো৷

    ছেলে জিজ্ঞেস করছে, ‘বলো বাবা, ‘সূর্যোদয়’ বানান কী? প্রথমে বলো ‘সূর্য’৷’

    বিপিন বললেন, ‘দন্তের সয়ে দীর্ঘ-ঊ৷ অন্তস্থ য-এ- য-ফলা সূর্য৷’

    নন্দু বলল, ‘ঠিক৷ কিন্তু ‘সূর্যোদয়’ হলে অন্তস্থ য-এ ও-কার হবে৷ তারপর ‘‘দয়’, ‘সূর্যোদয়’, বলো!’

    তারপরেই নন্দুকে ডেকে ভিতরে এসে বসলেন দুই মাস্টার৷ রফিকুল-মাস্টার বললেন, ‘নন্দলাল, তুমি খুব ভালো কাজ করেছ৷ তুমি ফুল মার্ক পাবে৷’

    নন্দু বলল, ‘স্যার, এই দেখুন আমার বাবার হাতের লেখা অনেক পরিষ্কার হয়েছে৷ আর অঙ্ক, বাবা বলো তো, এক কিলো আলুর দাম সাড়ে চার টাকা হলে পাঁচ কিলোর দাম কত?’

    বিপিন বললেন, সাড়ে বাইশ৷ একুশ পেলেই ছেড়ে দেব৷’

    মনোজ বললেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে৷ নন্দু, তোমার বাবাকে আর পরিক্ষা দিতে যেতে হবে না৷ এখানেই তো জেনে গেলাম৷ চমৎকার উন্নতি হয়েছে৷ এটা তোমারই কৃতিত্ব!’

    বিপিন বললেন, ‘স্যার, আপনি সেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন৷ এখন আমি বুঝেছি, তিনি কোনও সাধারণ ঠাকুর-দেবতা নন৷ তিনি এই সব বইপত্তর লেখালেখির মহারাজ, তাই না? তিনি লিখেছেন:

    আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে,

    বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে৷

    পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি৷

    দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি৷

    চিক চিক করে বালি, কোথা নাই কাদা,

    এক ধারে কাশবন ফুলেফুলে সাদা…’

    থেমে গিয়ে বিপিন দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘এ তো আমাদের গেরামেরই কথা৷ ঠাকুরবাবু কী করে লিখলেন বলুন তো! তিনি কি আমাদের এখানে এসেছিলেন?’

    রফিকুল বললেন, ‘নন্দু, তোমার বাবা শুধু পাশ নন, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট৷’

    চপলা এবার লাজুক মুখে বললেন, ‘আশীর্বাদ করুন স্যার, উনি যেন এই পড়ার অভ্যেসটা চালিয়ে যেতে পারেন!’

    টীকা