Chapter Index

    ঘনীভূত

    নীল! নীল! নীল।

    পুরীর সাগর।

    কী একটা বিরাট অপূর্ব সীমাহীন অনন্ত বিস্ময়।

    বিশ্বপ্রকৃতি যেন বিরাট এক নীলাম্বরী গায়ে জড়িয়ে অসীমের মাঝে ড়ুব
    দিয়েছে।

    অকুল পারাপারহীন নীলাঞ্জনে দৃষ্টি মিগ্ধ হয়ে আসে।

    অসীম নীলাকাশ যেন স্নেহে আকুল অসীম বারিধির শান্ত শীতল বক্ষে
    নিঃস্ব করে আপনাকে আপনি উজাড় করে ফেলে দিয়েছেন।
    শুধু হেরি এক বিপুল মহান নীলিমা! যেদিকে চক্ষু ফিরাই! এ কি অপূর্ব! মহাবিস্ময়ে
    সমগ্র ইন্দ্রিয়কে মুগ্ধ করেছে!

    কিরীটী মুগ্ধ হয়ে গেল।

    একদিন মাত্র এখানে এসেছে সে, কিন্তু একটি দিনেই যেন তার সমগ্র
    মনখানি মুক্ত অবাধ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। কাজকর্ম চিন্ত সব কোথায় চলে গেছে।

    গতকাল রাত্রি প্রায় বারোটা পর্যন্ত এই সমুদ্রের ধারে বালুবেলার
    উপরে সে বসে বসে কাটিয়েছে।

    অনেক রাত্রে যখন শুতে যায়, দু-চোখের নিদ্রালু ভারী পাতার সঙ্গে
    যেন অদ্ভুত এক স্বপ্ন জড়িয়ে থাকে।

    স্বৰ্গৰ্বার হোটেল থেকে সাগরের বেলাভূমি মাত্র একরশি পথ দুরে।
    একতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়ালে সাগরের বিপুল রূপ দু-চোখের দৃষ্টি জুড়ে ভাসতে থাকে।

    সারাটা রাত এক অদ্ভুত চাপা গুম গুম গর্জন। যেন সাত-সাগরের অতলতলে
    কোন এক লৌহকারার অন্তরালে অনাদিকালের বন্দী দৈত্য মুক্তির লাগি লৌহকপাটের গায়ে
    মাতা খুঁড়ে খুঁড়ে গর্জন করছে।

    বিরামহীন ছেদহীন সে গর্জনধ্বনি।

    বিশেষ করে রাত্রির অন্ধকারে বিশ্বচরাচর যখন স্তব্ধ হয়ে যায়,
    সমুদ্রের কান্না যেন কী এক করুণ বেদনায় সাগরবেলায় কেঁদে কেঁদে ফেরে।

    ছোট মাঝারি বড় কালো কালো ঢেউগুলো শুভ্র ফেনার মুকুতা-কিরীট মাথায়
    পরে সাগরবেলার করুণ বেদনায় কেবলই আছড়ে আছড়ে পড়ে।

    মাটির কাছে বারিধির সেই চিরন্তন মিনতি, ওগো বন্ধু, ওগো আমার শান্ত
    মাটি, আমায় গ্রহণ কর! আমায় ধন্য কর! আমায় পূর্ণ কর।

    একজন পাগল সদাচঞ্চল খেয়াল খুশিতে উদ্দাম বাঁধনহারা, অন্যজন
    শান্ত-ধীর।

    ***

    স্বর্গদ্বার হোটেল।

    হোটেলটি একজন উড়িষ্যাবাসী বাঙালী ভদ্রলোকের। সাগরের প্রায় কোল
    থেকেই উঠেছে স্বর্গদ্বার হোটেলটি।

    আরাম ও পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে সত্যই প্রশংসনীয়। ঘরগুলি খোলামেলা,
    পরিপাটী সাজানো-গোছানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুপ্রশস্ত।

    হোটেলটি সর্বসমেত দোতলা।

    উপরে ও নীচে অনেকগুলি ঘর।

    সর্বদাই হোটেলটি নানাজাতীয় লোকের ভিড়ে ভর্তি থাকে। একতলা ও দোতলায়
    খোলা বারান্দা। সেখানে সোফা, আরাম-কেদারা প্রভৃতিতে বসবার বন্দোবস্ত আছে।

    উপরে ও নীচে দুটি খাবার ঘর।

    গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ভাইপোদের নিয়ে নীচেরই কয়েকখানি ঘরে বসবাস
    করছেন।

    কিরীটী ডাঃ অমিয়র সঙ্গে একই ঘরে থাকবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছে।

    গগনেন্দ্রনাথ সর্বসমেত পাঁচখানি ঘর নীচের তলায় ভাড়া নিয়েছিলেন।
    একখানিতে তিনি থাকেন। তাঁর ডান দিককার ঘরে রণধীর সস্ত্রীক, বাঁয়ের ঘরে কিশোর, তার
    পাশের ঘরে সমীর এবং তার পাশের ঘরে অধীর।

    কোন ঘরের সঙ্গে কোন ঘরের যোগাযোগ নেই, প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে আলাদা
    আলাদা সংলগ্ন ছোট্ট একটি বাথরুম আছে। তাছাড়াও একটি সকলের ব্যবহারের জন্য বড়
    স্নানঘর আছে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত করতে হলে বারান্দা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়।

    রেলিং দেওয়া প্রশস্ত বারান্দার সামনেই প্রশস্ত একটি বাঁধানো
    চত্বর, চত্বরের সীমানায় লোহার রেলিং, তারপরেই সদর রাস্তা, রাস্তার নীচে সাগরের
    বেলাভূমি।

    গগনেন্দ্রনাথের ফ্যামিলি ছাড়াও নীচের তলায় আরো তিনজন বাস করেন।

    কিরীটীদের পাশের ঘরেই থাকেন বারীন রায় নামে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক,
    ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয়। দীর্ঘ ছয় ফুট, বলিষ্ঠ গঠন। এত বয়স
    হয়েছে তবু শরীরের গাঁথুনি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। মাথায় সাদা চুল ব্যাক-ব্রাশ করা।
    দীর্ঘলম্বিত ধবধবে সাদা দাড়ি।

    চোখে সোনার ফ্রেমে কালো কাঁচের চশমা। চোখের গোলমাল আছে বলে তিনি
    রঙীন কাঁচের চশমা ব্যবহার করেন। অতি সৌম্য প্রশান্ত চেহারা, হাসিখুসী আমুদে লোক।
    অত্যন্ত রসিক।

    ভদ্রলোক অবিবাহিত, বাংলার বাইরে পাণ্ডববর্জিত মুলুকে কোথায় কোন্
    বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করে এতকাল কাটিয়েছেন। কার্য থেকে বিশ্রাম নিয়ে এখন দেশে
    দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

    বেশ সচ্ছল অবস্থা।

    তাছাড়া বারীনবাবুর পাশের ঘরে যতীন ঘোষ বলে এক ভদ্রলোক থাকেন।

    ভদ্রলোক চিররুগ্ন। অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে, স্বাস্থ্যকর জায়গায়
    কেবল ঘুরে ঘুরে বেড়ান।

    তাঁর পাশের ঘরে থাকেন তরুণী কুমারী ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী।

    মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করে বিলেত থেকেও ধাত্রীবিদ্যার
    ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন।

    লাহোর মেডিকেল কলেজে ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপনা করেন।

    বড়দিনের ছুটিতে পুরীতে বেড়াতে এসেছেন।

    বয়স প্রায় সাতাশ-আটাশ বৎসর হবে। রোগা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের বর্ণ
    উজ্জ্বল পরিষ্কার।

    টানা টানা দুটি স্বপ্নময় চোখ।

    সুশ্রী মুখখানি জুড়ে একটা কমনীয়তা যেন ঢল ঢল করে।

    ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে যথেষ্ট আলাপ।

    আমাদের নীচের তলার বাসিন্দাদের নিয়েই ঘটনা, তাই উপরের বাসিন্দাদের
    এখানে বৃথা বর্ণনা করে কারো বিরক্তিভাজন হতে চাই না। গগনেন্দ্রনাথের ভাইপোদেরও
    এখানে একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার।

    রণধীর মল্লিকের বয়স ত্রিশের মধ্যে আগেই বলেছি। বেশ মোটাসোটা
    নাদুসনুদুস চেহারা। গায়ের বর্ণ গৌর, নাক চোখ মুখে কোন বুদ্ধির প্রাধ্য নেই বটে,
    তবে শিশুর মত একটা সহজ সরলতা বিরাজ করে।

    অত্যন্ত শান্ত, গোবেচারী নিরীহ, আরামপ্রিয়। মিতভাষী চোখের
    দৃষ্টিতে একটা সদা-সশঙ্কিত ভাব। একান্ত নির্জনতাপ্রিয়। বেশীর ভাগ সময়ই বই পড়ে কাটায়।

    মেজো সমীরের বয়স প্রায় সাতাশের কাছাকাছি হবে।

    ভাইদের মধ্যে সমীরেরই গাত্রবর্ণ সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল। ভাইদের
    মধ্যে সব চাইতে বেশী লম্বা, রোগাটে গড়ন, ধীর শান্ত নমনীয়।

    চোখ দুটি টানা-টানা, গভীর আঁখিপল্লবের নীচে সমুদ্রে নীল জলের মত
    গভীর নীলাভ শান্ত উদাস দৃষ্টি। চোখের কোল দুটি সর্বদাই ছলছল করে। মাথার কোঁকড়া
    কোঁকড়া চুল। বিস্ত, এলোমেলো। উন্নত খড়গের মত বাঁকা নাসিকা যেন উদ্ধত বিস্ময়ে মুখের
    উপরে ভেসে আছে।

    পাতলা লাল দুটি ঠোঁট, মুক্তা-পংক্তির মত শুভ্র একসারি দাঁত।

    মুখখানি সদাই বিষণ্ণ, চিন্তাযুক্ত। যেন একখানি জলভরা মেঘ। বেশীর
    ভাগ সময়ই চুপচাপ একা একা বসে কী যেন ভাবে।

    সেজো বা তৃতীয় অধীর বেশ বলিষ্ঠ গঠন। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল-শ্যাম।
    চোখমুখে একটা উদ্ধত দৃষ্টি। কথা একটু যেন বেশীই বলে, কিন্তু ব্যবহারে একটা
    যুদ্ধ-ক্লান্ত সশঙ্কিত ভাব। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যে।

    সর্বকনিষ্ঠ কিশোর। রুগ্ন পাংশু চেহারা।

    মনে হয় চিরদিন শুধু রোগেই কেবল ভুগছে।

    চোখেমুখে একটা ভীত সশঙ্কিত ভাব। দেখলে করুণা হয়।

    এ বাড়ির বৌ বিনতা।

    এক কথায় যেন একখানি লক্ষ্মীর সচল প্রতিমা।

    চোখেমুখে একটা উদ্ধত বুদ্ধির প্রখ্য।

    বুড়ো গগনেন্দ্রনাথের সর্ববিধ সেবার কাজ হাসিমুখে সে-ই করে।
    দিবারাত্র ছায়ার মতই বুড়োর আশেপাশে ঘোরে।

    সমীর সব সময়ই বৌদিকে সাহায্য করে।

    প্রকাণ্ড এক রূদ্ধকারার মধ্যে বিনতা যেন আলোর একটুখানি আভাস। গভীর
    বেদনার মাঝে একফোঁটা আঁখিজল।

    এ বাড়ির সকলের মধ্যে যে শঙ্কার একটা কালো ভয়াবহ ছায়া থমথম করছে
    তার মাঝে যেন একটা আশার বিদ্যুৎ-শিখা এই বিনতা।

    বিনতা বড় গরীবের মেয়ে। মামার দয়ায় মামার বাড়িতেই চিরকাল অবহেলা
    অনাদরে মানুষ।

    জন্মাবধি তার ব্যথার সঙ্গেই পরিচয়। আশ্রয় তার চিরসাথী, হাসি তার
    কেউ নয়।

    কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে তীক্ষ্ণ মেধাবী।

    নিজের অক্লান্ত চেষ্টায় স্কলারশিপ নিয়ে বি. এ. পাস করে লাহোরে এক
    স্কুলে চাকরি নিয়ে যায়। মাঝখানে কিছুদিন নার্সিংও পড়েছিল। গগনেন্দ্রনাথ তখন লাহোর
    সেন্ট্রাল জেলে সুপারিনটেনডেন্ট। বিনতা থাকত গগনেন্দ্রনাথেরই পাশের একতলা ছোট্ট বাড়িটায়।
    কেমন করে যে রণধীরের সঙ্গে বিনতার আলাপ হল, কাকার দুর্জয় শাসনের গণ্ডি ডিঙিয়ে কেমন
    করে যে সেই আলাপ গভীর হতে গভীরতর হল এবং শেষটায় বিনতা স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে
    রণধীরের পিছু পিছু বধূবেশে গগনেন্দ্রনাথের পাষাণ-প্রাচীরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল
    সে আজও এক বিস্ময়।

    বাইরে থেকে এ বাড়ির যে ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিক আবহাওয়া, যেটা কোনদিনই
    বিনতার চোখে ধরা পড়েনি, আজ সেইটাই বিনতার
    সর্বাঙ্গে যেন সুকঠিন লৌহ-শৃঙ্খলের মতই তাকে জড়িয়ে ধরল এ বাড়ির মধ্যে পা দেওয়ার
    কিছুকালের মধ্যেই।

    শীঘ্রই চিরস্বাধীন বাধাহীন মন তাঁর হাঁপিয়ে উঠল।

    ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিক এ বাড়ির আবহাওয়া। যেন একটা দুর্জয় গোলকধাঁধা।
    এখানে সব কিছু একজনের বাঁধাধরা সুকঠিন নিয়মের মধ্যে চলে।

    যেন একটা প্রকাণ্ড অজগর সাপের বিষাক্ত দৃষ্টির তলায় সকলে সম্মোহিত
    পঙ্গু হয়ে আছে।

    এখানে জীবনের স্পন্দন নেই, আছে মৃত্যুর গভীর নীরবতা। এখানকার
    বাতাসে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। হাঁফ ধরে।

    পুরীতে এসে অবধি গগনেন্দ্রনাথ বেশীর ভাগ সময়ই তাঁর ঘরের সামনে
    বারান্দায় একটা আরামকেদারার উম্বরে দামী সাদা শাল গায়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকেন,
    তাঁর আশেপাশে বাড়ির আর সকলে বসে থাকে।

    মাঝে মাঝে গগনেন্দ্রনাথ সমুদ্রের তীরে বেড়াতে যান; সঙ্গে সবাই যায়।
    আবার সন্ধ্যার পরে একত্রে সবাই হোটেলে ফিরে আসে।

    দিনমণি একটু আগে সাগরজলে আবির গুলে অস্ত গেছেন। সাগর-কিনারে বালুর
    ওপরে সাগরজলের দিকে নিমেষহারা দৃষ্টি মেলে একাকী নীরবে বসে আছে প্রতিমা।

    কোলের উপরে পড়ে আছে রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতাখানা।

    মাথায় আজ সে সাবান দিয়েছিল, রুক্ষ বিস্ত চুলগুলি হাওয়ায় উড়ছে।
    পরিধানে তার আজ গেরুয়া রঙের একখানা খদ্দরের শাড়ি, গায়ে ডিপ আকাশ-নীল রঙের হাতকাটা
    ব্লাউজ।

    প্রতিমা দেখছিল, সন্ধ্যার ধূসর ম্লান ছায়া একটু একটু করে সারা
    পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে।

    সমুদ্রের নীল জল কালো হয়ে উঠছে।

    আজ যেন সমুদ্র বড় বেশী উতলা।

    আবছা আলোয় কালো কালো ঢেউগুলি শুভ্র ফেনার মালা গলায় দুলিয়ে দুহাত
    বাড়িয়ে ছুটে আসছে।

    প্রতিমা গান গাইছিলঃ

    ওগো কোন্ সুদূরের পার হতে আসে,
    কোন্ হাসি কান্নার ধন।
    ভেবে মরে মোর মন,
    ভেসে যেতে চায়
    এই কিনারার সব চাওয়া সব পাওয়া।

    বাঃ, চমৎকার গান তো আপনি! কী মিষ্টি আপনার গানটি।

    চমকে প্রতিমা ফিরে তাকাল।

    সন্ধ্যার ঘনায়মান আঁধারে তার ঠিক পশ্চাতে বালুবেলার উপরে যেন
    দীর্ঘ এক অস্পষ্ট ছায়ার মতই দাঁড়িয়ে আছে সমীর। যেন খাপ-খোলা একখানা বাঁকা তলোয়ার।

    কে, সমীরবাবু?

    সমীর প্রতিমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল, বললে, হাঁ। কিন্তু আমার
    নাম আপনি জানলেন কি করে? আপনার নাম তো আমি জানি না!

    প্রতিমা মৃদু হাসলে, তারপর স্মিতভাবে, বললে, আপনি আমার নাম জানেন
    না সমীরবাবু, কিন্তু আমি আপনার নাম জানি। আমার নাম প্রতিমা গাঙ্গুলী, পেশা
    ডাক্তারী। বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন যে?

    বসব? কণ্ঠে যেন একরাশ মিনতির বেদনা ঝরে পড়ল।

    কী অসহায়, করুণ!

    হ্যাঁ, বসুন না। আপনাকে এই হোটেলে প্রথম দিন থেকে দেখা অবধিই
    আপনার সঙ্গে আমার আলাপ করবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আপনারা কারো সঙ্গে কথাও
    বলেন না, মেশেনও না। খাবার ঘরে যান, চুপচাপ খেয়ে চলে আসেন।

    সমীর ততক্ষণে প্রতিমার অল্প একটু দূরে সাগরবেলার উপরে বসে পড়েছে।
    প্রতিমা বলছিল, কেন আপনারা কারো সঙ্গে মেশেন না, কথা বলেন না সমীরবাবু?

    সমীর চুপ করে বসে রইল।

    সমীরবাবু, এই চমৎকার জায়গায় এসেও আপনারা ঘরের মধ্যেই বসে থাকেন।
    কেমন করে থাকেন? ভাল লাগে? বাইরে আসতে কি ইচ্ছে হয় না? আমি তো এখানে আসা অবধি এক
    মুহূর্তও ঘরে থাকতে পারি না। সমস্ত মন যেন কেবলই বাইরে ছুটে আসে।

    হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে করে প্রতিমা দেবী, কিন্তু কই পারি না তো! কেন
    পারি না? কেন বাইরে আসতে পারি না আমি বুঝতে পারি না, একটা প্রবল নিষেধ যেন ঘরের
    মধ্যে আমায় পিছু টেনে রাখে, আমার সমস্ত গতিকে নষ্ট করে দেয়।

    চলে আসবেন বাইরে, যখন মন চাইবে।

    মন তো বাইরে ছুটে আসতে সব সময়ই চায় প্রতিমা দেবী। বলতে পারেন,
    কেমন করে ঘর ছেড়ে বাইরে আসতে হয়? সমীর বলল।

    কী সরল প্রশ্ন!

    প্রতিমা ডাঃ চক্রবর্তীর মুখে এদের সব কথাই শুনেছিল।

    শুনে সে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

    এও কি সম্ভব নাকি?

    সে বলেছিল ডাঃ চক্রবর্তীকে, কেন এরা সব ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয় না?
    কেন এরা বিদ্রোহী হয়ে বাইরে ছুটে আসে না?

    ডাঃ চক্রবর্তী জবাব দিয়েছিলেন, একদিন হয়তবা এরা বিদ্রোহী হতে
    পারত, কিন্তু আজ আর তারা পারবে না। মনের সে শক্তি আজ ওরা নিঃশেষে হারিয়েছে। আজ
    শুধু নিরুপায় বেদনায় ছটফট করবে, কিন্তু প্রতিকার তার করতে পারবে না। একদিন নয়,
    দুদিন নয়, দীর্ঘদিনের এই সম্মোহন—আজ আর এর থেকে তো ওদের নিস্তার নেই ডাঃ গাঙ্গুলী!

    কেন নেই ডাঃ চক্রবর্তী? প্রতিমা প্রশ্ন করেছিল।

    আমার ওদের সঙ্গে বেশ কিছুদিনের পরিচয়, অমিয় বলতে লাগল, কৌতূহলবশেই
    একটু একটু করে গগনেন্দ্রনাথের পূর্ব ইতিহাস আমি সংগ্রহ করেছি। প্রথম জীবনে
    গগনেন্দ্রনাথ লোকটা জেলের কয়েদীদের রক্ষী ছিলেন। দিনের পর দিন একদল অস্বাভাবিক অপরাধীদের
    সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ওঁর মনের সহজ প্রবৃত্তিগুলো একটু একটু করে বিকৃত হয়ে গেছে। হয়ত
    গগনেন্দ্রনাথ মনে মনে নিষ্ঠুরতা ভালবাসতেন না। কিন্তু যেহেতু তাকে জেলের কয়েদীদের
    রক্ষী হতে হয়েছিল, কর্তব্যের খাতিরেই হোক বা আইনের খাতিরেই হোক নিত্যনিয়মিত একদল
    অস্বাভাবিক লোকের সঙ্গে মিশে মিশে, ভেড়ার মত সর্বদা তাদের আইনের নাগপাশে বেঁধে রেখে চালনা করতে করতে হয়ত বা মনে মনে নিজের
    অজ্ঞাতেই একদিন অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিলেন। এক কথায় অন্যের উপরে ক্ষমতা প্রয়োগ
    করবার হয়ত একটা দুর্মদ উম্মাদ কামনা চিরদিনই ওঁর অবচেতন মনের মধ্যে সুপ্ত বস্তুর
    মত ঘুমিয়ে ছিল। একদিন হয়ত সেই অবচেতন মনের অলঙ্ঘ্য ইঙ্গিতেই জেলের কয়েদীদের রক্ষার
    কাজ বেছে নিয়েছিলেন প্রয়োজন হিসাবে, মনের অবচেতন লালসার তৃপ্তিসাধন করতে।

    মনোবিজ্ঞানে বলে, আমাদের অবচেতন মনে অনেক সময় অনেক অদ্ভুত বাসনাই গোপন
    থাকে। ক্ষমতা প্রয়োগের একটা দুর্বার বাসনা, একটা পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা, ধ্বংস করবার
    একটা বন্য বর্বর আদিম ইচ্ছা-ঐসব প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম মানব-প্রবৃত্তি-আজওঁ ওগুলো
    আমাদের সভ্যতার চাকচিক্যের অন্তরালে আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। আদিম
    বর্বর যুগের সেই বন্য নিষ্ঠুরতা, উন্মাদ প্রলোভন, পাশবিকতা—আজ আমরা সভ্যতার আবরণে
    সেটা ঢেকে রাখতে অনেক কায়দা-কানুন শিখেছি বটে, স্বীকার করি, কিন্তু তবু সেই আদিম
    বর্বর অবচেতন প্রবৃত্তিগুলি যখন আমাদের মনে প্রবল হয়ে ওঠে, তখন আমাদের একান্ত
    অজান্তেই আমরা নিরুপায় হয়ে ধরা দিতে বাধ্য হই সেই সব প্রকৃতির হাতে। কোথায় ভেসে যায়
    আমাদের সভ্যতা, এত কষ্টে অর্জিত শিক্ষার গিল্টির আবরণ। মনের সেই চিরন্তন আদিম
    বর্বরতা ক্ষুধার্ত লালসায় হুঙ্কার
    দিয়ে ওঠে।

    দুঃখের বিষয় আজ আমরা আমাদের জীবনের সব কিছুতেই যেন সেই আদিম বন্য
    বর্বর প্রবৃত্তির প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। জাতীয় জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে,
    সভ্যতায়। দয়া হতে, ভ্রাতৃত্ব হতে আজকের এই মনুষ্যত্বের এটা একটা রিঅ্যাকশন। আজকের
    এইসব চলিত নীতিগুলো দেখে অনেক সময় মনে হয় বুঝি খুব সঠিক চিন্তাপূর্ণ ও মঙ্গলজনক
    একটা গভর্মেন্ট গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে সে গভর্মেন্ট একদিন জোর করে
    চালু করা হয়েছিল, ভয় ও নিষ্ঠুরতার উপরে তার ভিত্তি উঠেছিল গড়ে। সেদিনকার সেই ভয় ও
    নিষ্ঠুরতার ভিত্তিতে গড়া গভর্মেন্টই আজ আমাদের মনের চিরন্তন আদিম ও ভয়ঙ্কর বর্বরতা
    ও নিষ্ঠুরতাকে মনের সভ্যতার গিল্টি-করা দরজাটা খুলে বাইরে বের করে দিয়েছে। তাই তো
    আজ জগতে জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে এত হানাহানি, এত রক্তারক্তি, এত যুদ্ধবিগ্রহ।

    ইঙ্গ-আমেরিকা আজ চিৎকার করছে বটে, জার্মানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যই
    তাদের জগতে এক শান্তিময় জীবনধারা নিয়ে আসা। জার্মানীই যেন এইসব যত দুঃখ ও অমঙ্গলের
    মূল। কিন্তু মনে মনে ব্রিটিশ, জার্মানী, জাপান সবাই একই দলের পথিক। শুধু বিভিন্ন
    কর্মধারা মাত্র। ভাল করে ভেবে দেখুন দিকি, প্রকৃতপক্ষে পশুর চাইতে বেশী কি? খুব
    delicately balanced- একমাত্র উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা। খুব দ্রুত এগিয়ে চলাও যেমন
    জাতি ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, পেছিয়ে থাকাও তাই। কেবল বেঁচে থাকতে হবে, দ্রুতও নয়,
    অতি শ্লথও নয়, মাঝামাঝি। দেশ বা জাতি সেও তো সমষ্টিগত মানবই।কথায় কথায় অনেক দূরে
    চলে এসেছি।

    ডাঃ চক্রবর্তী একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, আমার মনে হয়,
    গগনেন্দ্রনাথ বহুকাল ধরে বহু লোকের উপরে প্রভুত্ব করে করে, মানুষের উপরে অত্যাচার
    নিষ্ঠুরতা করে, বেদনা দিয়ে দিয়ে, আজ ওঁর মনের সহজ প্রবৃত্তিই গড়ে উঠেছে ঐ বেদনা
    দেওয়া ও অত্যাচার করার মধ্যে। সেই প্রাগৈতিহাসিক পাশবিক বর্বর আনন্দ, শুধু আগের মতো
    শারীরিক বেদনা দেওয়ার পরিবর্তে দিচ্ছে মানসিক বেদনা। এ ধরনের মনোবিকার খুব বড় একটা
    বেশী দেখা যায় না। আর এদের সঙ্গে যুদ্ধ করাও বড় কঠিন। সে চায় অন্যের উপরে তার
    প্রভুত্ব থাকবে। এবং সেই প্রভুত্বের দোহাই দিয়ে অন্যের উপরে করবে সে অত্যাচার।
    এতেই তার আনন্দ।

    প্রতিমা বলেছিল, এটা কি পাশবিক নয়, এইভাবে অত্যাচারের মধ্য দিয়ে
    আনন্দ ভোগ করা?

    নিশ্চয়ই। ডাঃ চক্রবর্তী বলেছিলেন, কিন্তু সবচাইতে মজা হচ্ছে,
    অত্যাচারী এখানে বুঝতেই পারছে না কী সে করছে, এখানে সে তার অবচেতন মনের দ্বারা
    চালিত হচ্ছে।

    প্রতিমা এরপর জিজ্ঞাসা করেছিল, কিন্তু কাকার এই অত্যাচার থেকে ভাইপোরা
    নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে না কেন আঃ চক্রবর্তী?

    ডাঃ চক্রবর্তী জবাব দিয়েছিলেন, ওইখানেই তো আপনার ভুল ডাঃ গাঙ্গুলী।
    তারা তা পারে না। একটা মুরগীকে একটা ঘরের মধ্যে সাদা চক দিয়ে মেঝের উপরে একটা লাইন
    টেনে, মুরগীর ঠোঁটটা সেই সাদা লাইনের উপরে রেখে দিলে যেমন তার মনে হবে সেই লাইনের
    সঙ্গেই সে বাঁধা পড়েছে, আর সে নড়তে পারবে না, গগনেন্দ্রনাথের ভাইপোদেরও মনের
    অবস্থা ঠিক তাই, তাদের সম্মোহিত করেছে যে সে ছাড়া আর তাদের উপায় নেই, মুক্তি নেই।

    আচ্ছা এই যে একটা পরিস্থিতি, এ তো অতগুলো লোকের পক্ষে ভয়ঙ্কর
    অমঙ্গলজনক। প্রতিমা বললে।

    নিশ্চয়ই, সেকথা একবার বলতে, হাজারবার!

    প্রতিমা রুদ্ধস্বরে বলেছিল, তবে তো এই শয়তান বুড়োকে খুন করাই
    উচিত। ওই শয়তানকে খুন করতে পারলে এখনও হয়ত ওদের বাঁচবার আশা আছে। এখনও হয়ত ওদের
    মনের সব কিছু মরে শুকিয়ে যায়নি। এখনও হয়ত ওদের মনের মাঝে আলো আসে, ফুল ফোটে।

    কী বলছেন আপনি প্রতিমা দেবী? বিস্মিত কণ্ঠে ডাঃ চক্রবর্তী
    জিজ্ঞাসা করলেন। ঠিকই বলছি, দশজনের মঙ্গলের কাছে একজনের মৃত্যু সে তো বড় বেশী কথা
    নয়, এর মধ্যে অন্যায় কী-ইবা আছে? একবার ঐ বেচারীদের কথা ভেবে দেখুন তো ডাঃ
    চক্রবর্তী। দিনের পর দিন দীর্ঘকাল ধরে কী যাতনাটাই না তারা সহ্য করছে!

    প্রতিমা নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে গিয়েছিল, সমীরের কথা তার যেন
    এতক্ষণ মনেই ছিল না। সহসা সমীরের ভয়চকিত কণ্ঠস্বরে ও চমকে উঠল, আমি যাই, অনেক রাত
    হল।

    কাকা হয়ত খুজবেন।

    বসুনা না আর একটু! প্রতিমা বললে।

    না না, আমি যাই। একটা ভয়ঙ্কর অস্বস্তিতে যেন সমীরের কণ্ঠস্বর ভেঙে
    গুড়িয়ে যাচ্ছে, সহসা সে মাতালের মত অস্থির পদে টলতে টলতে চলে গেল।

    সেই অন্ধকারে বালুবেলার মধ্যে বসে সমীরের ক্রমঅপস্রিয়মাণ গতিপথের
    দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সহসা কেন জানি না প্রতিমার চোখের কোল দুটি জলে ভরে এল।

    সাগরে বুঝি জল উঠেছে, সহসা একটা ঢেউ এসে প্রতিমার পায়ের অনেকখানি
    ও লুণ্ঠিত শাড়ির আঁচলটা ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

    অল্প দূরেই কিরীটীর হাওয়াইন গিটারের মধুর সুর সমুদ্রে সাগরবেলায়
    তখন ছড়িয়ে পড়েছে।

    প্রতিমা আকাশের দিকে অশ্রুসজল দৃষ্টি তুলে তাকাল। কালো আকাশের
    বুকে হীরার কুচির মত নক্ষত্রগুলি জ্বলছে আর
    জ্বলছে।

    নীচে সাগর তেমনিই ঢেউয়ে ঢেউয়ে মাতামাতি করে চলেছে। উদ্দামতারও
    বিরাম নেই, গর্জনেরও বিরাম নেই।

    ***

    স্বর্গদ্বার হোটেলের নীচের তলায় বসবার ঘরে তখন অনেকেই জমায়েত হয়েছে।
    রাত্রি পৌনে আটটা।

    ঘরের এক কোণে গগনেন্দ্রনাথ একটা আরাম-কুরসীর উপরে গায়ে একটি দামী
    শাল জড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন। পাশেই আর একটা চেয়ারে বসে বিনতা উল বুনছে, তার
    অল্পদূরে বসে বই পড়ছে রণধীর, তার পাশে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে কিশোর চোখ বুজে
    পড়ে আছে। অধীর গগনেন্দ্রনাথ বাঁপাশে বসে একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন আনমনে।
    ঘরের অন্যদিকে যতীনবাবু ও বারীনবাবু মুখোমুখি বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন।
    অল্পদুরে একখানা সোফার উপরে বসে ডাঃ চক্রবর্তী কী একটা মোটা ডাক্তারী বই পড়ছেন।

    সমীর এখনও এল না? গগনেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন যেন কতকটা আপন মনেই।
    দিনদিনই সে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে। কপালে ওর অনেক দুখ আছে।

    এমন সময় ক্লান্তপদে সমীর এসে ঘরে প্রবেশ করল।

    গগনেন্দ্রনাথ একবার আড়চোখে সমীরের দিকে তাকিয়ে ধীর গভীর স্বরে
    প্রশ্ন করলেন, এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে সমীর?

    সমীর নীরবে মাথা নীচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রইল।

    কী, জবাব দিচ্ছ না কেন? একসঙ্গে সব বেড়িয়ে ফিরছিলাম, কোথায় তুমি
    হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলে?

    সমুদ্রের ধারে বেড়াচ্ছিলাম কাকা। মৃদুস্বরে সমীর জবাব দিল।

    বেড়াচ্ছিলে? অত্যন্ত অসংযমী ও উজ্জ্বল হয়ে উঠছ তুমি দিন দিন সমীর।
    কিছুদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করছি, গতিটা তোমার ক্রমে অবাধ হয়ে উঠছে। ধ্বংসের মুখে
    তুমি ছুটে যাচ্ছ সমীর।

    আমি–, সমীর যেন কী বলতে যাচ্ছিল প্রত্যুত্তরে।

    গগনেন্দ্রনাথ প্রবল বিরক্তির সুরে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, যাক, তর্ক
    করো না। দোষী হয়ে দোষ ঢাকবার মত পাপ বা অন্যায় আর নেই। কার হুকুমে তুমি এতক্ষণ বাইরে ছিলে?

    এমন সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী এসে ঘরে প্রবেশ করল, ঘরে ঢুকবার
    পথেই গগনেন্দ্রনাথের শেষের কথাগুলি তার কানে গিয়েছিল, সে সমীরের দিকে স্তব্ধ-বিস্ময়ে
    তাকিয়ে চেয়ে রইল।

    গগনেন্দ্রনাথ তীক্ষ্ণকণ্ঠে আবার প্রশ্ন করলেন, কী, চুপ করে আছ
    কেন, জবাব দাও? এত স্বাধীনতা তোমার কোথা থেকে এল? এত দুঃসাহস তোমার কেমন করে হয়?

    প্রতিমা আর সহ্য করতে পারল না। তার মনের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছিল,
    সে এবারে এগিয়ে এল, গগনবাবু, উনি আমার সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন, আমিই ওকে আটকে
    রেখেছিলাম; দোষ এতে যদি কিছু হয়ে থাকে তবে আমার, ওঁর নয়।

    গগনেন্দ্রনাথ তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিলেন, আপনি কে আমি জানি না।
    কিন্তু আপনি যেই হোন, আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে একজন তৃতীয় পক্ষের মাথা ঘামানোটা আমি
    আদপেই পছন্দ করি না। দয়া করে আর আপনি আমার ভাইপোদের
    সঙ্গে মিশে কুপরামর্শ দিয়ে উচ্ছন্ন দেবেন না।

    এসব আপনি কী যা খুশি তাই বলছেন গগনবাবু! তীব্র প্রতিবাদের সুরে
    প্রতিমা জবাব দিল।

    অসহ্য ক্রোধে ও অপরিসীম লজ্জায় তার সমগ্র মুখখানা তখন রক্তবর্ণ
    ধারণ করেছে।

    প্রতিমার কথার কোন জবাব না দিয়ে গম্ভীর স্বরে সমীরের দিকে তাকিয়ে
    গগনেন্দ্রনাথ বললেন, শোন সমীর, এভাবে উচ্ছন্নে যেতে তোমায় আমি দেব না। এ ধরনের
    অন্যায় যদি আবার কোনদিন তোমার দেখি তবে এমন ব্যবস্থা আমি করব যে, সারা জীবনের
    চোখের জলেও তোমার মুক্তি মিলবে না। এ অসহ্য! একেবারে অসহ্য এই অমার্জনীয় ঔদ্ধত্য।
    তারপরই উঠে দাঁড়িয়ে সকলকে লক্ষ্য করে আদেশের সুরে বললেন, চল সব ঘরে!

    একটা তীব্র কুটিল দৃষ্টি প্রতিমার দিকে হেনে গগনেন্দ্রনাথ ধীরপদে
    ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন, তার পিছু পিছু অন্য সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথা
    নীচু করে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল।

    প্রতিমাও একপ্রকার ছুটে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

    ঘরের অন্য সব প্রাণী স্তম্ভিত বিস্ময়ে স্থাণুর মতই যে যার জায়গায়
    নীরবে বসে রইল।

    ***

    সেই রাত্রে।

    রাত্রি বোধ করি দেড়টা হবে। কিরীটীর চোখে ঘুম নেই।

    অমিয় তার শয্যার উপরে শুয়ে অঘোরে নাক ডাকাচ্ছে।

    কিরীটী একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের পিছনদিকের জানালার সামনে এসে দাঁড়াল।

    বাইরে অন্ধকার প্রকৃতি কালো আকাশের ছায়ায় যেন চোখ বুজে পড়ে আছে।

    সমুদ্রের একটানা গুম গুম গর্জন রাত্রির স্তব্ধ অন্ধকারের দু-কূল
    ছাপিয়ে যেন কানের কাছে এসে আছড়ে পড়ছে।

    সহসা তার কানে এল কারা যেন পাশের ঘরেই চাপা উত্তেজিত স্বরে কী আলোচনা
    করছে।

    না না, এ অসম্ভব। এই পরাধীনতার নাগপাশ, দিনের পর দিন এই অকথ্য
    অত্যাচার সত্যি আর সহ্য হয় না। প্রাণ আমার হাঁপিয়ে উঠেছে। এভাবে আর বেশীদিন থাকলে
    বুঝি পাগল হয়ে যাব আমি! অধীর–

    মেজদা, এমনি করে অধীর হয়ো না ভাই। আর কটা দিনই বা বুড়ো—কতকাল আর
    বাঁচবে!

    না না, বুড়োর মৃত্যুর আশায় দিন গুনে গুনে আর পারি না। ইচ্ছে করে
    দুহতে সব ভেঙে মুচড়ে যেদিকে দু-চোখ যায় চলে যাই।

    কিন্তু যাবি কোথায়? পেট চলবে কী করে?

    পেটের ভাবনা ভাবছিস তুই অধীর! ভিক্ষে করে খাব, তবু এ আর সহ্য হয়
    না। ভেবে দেখ তুই, ওকে খুন করা ছাড়া আর আমাদের মুক্তির উপায় নেই। ওকে খুন করা
    উচিত—ও মরুক। ও মরুক। এখন ওর পক্ষে মরণই মঙ্গল।

    ছি ছি, এসব কী তুমি বলছো মেজদা?

    অনেক দুঃখে, অনেক কষ্টেই বলছি। শীঘ্র যদি ও না মরে, আমিই নিজে
    হাতে ওকে এই পৃথিবী থেকে সরাব। হ্যাঁ, আমিই সরাব। এবং তার উপায়ও ভেবে রেখেছি। কেউ
    জানবে, কেউ
    সন্দেহমাত্র করতে পারবে না। অথচ নিঃশব্দে কাজ হাসিল হবে। শোন্ কী উপায় আমি
    ভেবেছি……

    তারপর আর শোনা গেল না।

    কিরীটী গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

    পাশের ঘরেই অধীর থাকে।

    কিন্তু…

    ***

    দিন-দুই প্রতিমা কতকটা যেন ইচ্ছা করেই ওদের ধার দিয়ে গেল না। এড়িয়ে
    এড়িয়ে বেড়াল।

    কিন্তু আচমকা আবার সেদিন আবছা ভোরের আলোয় সমুদ্র-কিনারে সমীরের
    সঙ্গে প্রতিমার দেখা হয়ে গেল।

    সমুদ্রের বালুবেলায় একাকী সমীর দাঁড়িয়ে আছে।

    পরিধানে ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি।

    মাথার চুল এলোমেলো রুক্ষ, সাগর-হাওয়ায় আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

    যেন এক বিষাদের প্রতিমূর্তি।

    করুণায় প্রতিমার হৃদয় দ্রব হয়ে এল। আহা, কী অসহায়। প্রতিমা আর নিজেকে
    রোধ করে রাখতে পারলে না, এগিয়ে এল, নমস্কার সমীরবাবু।

    কে? চমকে সমীর ফিরে দাঁড়াল।

    সেই প্রভাতের প্রথম আলোয় প্রতিমার দিকে তাকিয়ে সমীরও মুগ্ধ হয়ে
    গেল।

    কী সুন্দর! কী স্নিগ্ধ!

    সত্যিই প্রতিমাকে সে-সময় বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল।

    সাগর-নীল রঙের একখানি ছাপা মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি পরিধানে। গায়ে
    সাদা রঙের জরির কাজ-করা ব্লাউজ। মাথার চুলগুলি এলোমেলো করে কাঁধের উপর হেলে রয়েছে।

    পায়ে শ্রীনিকেতনের চপ্পল।

    মুগ্ধবিস্ময়ে সে সমীরের দিকে তাকিয়ে। যেন সাগরলক্ষ্মী সাগর-শয্যা
    হতে এইমাত্র নিদ্রা ভেঙে বালুবেলার উপরে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যি কি সুন্দর আপনি,
    প্রতিমা দেবী! বড় ভাল লাগে আপনাকে আমার। মুগ্ধকণ্ঠে সমীর বললে।

    সহসা প্রতিমার মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। কিন্তু চকিতে সে
    আপনাকে সামলে নিল, সেদিনকার ঘটনার জন্য সত্যই আমি বড় দুঃখিত ও লজ্জিত সমীরবাবু।
    তারপরই স্বরটাকে গাঢ় করে বললে, কেন—কেন আপনি এ অত্যাচার সহ্য করছেন? ও শয়তানের
    খপ্পর থেকে বের হয়ে আসুন! পুরুষমানুষ আপনি, এ দুর্বলতা কেন?

    কিন্তু সমীর প্রতিমার কথায় যেন স্বপ্লেখিতের মত সজাগ হয়ে উঠল, না
    না, আপনি যান। আপনি এখান থেকে যান। আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমি আপনার সঙ্গে
    আর কথা বলতে চাই না। ভয়চকিত কণ্ঠস্বরে কথাগুলি বলতে বলতে একপ্রকার ছুটেই যেন কতকটা
    সমীর হোটেলের দিকে চলে গেল।

    স্তব্ধ-বিস্মিত প্রতিমার দু-চোখের কোলে জল উপচে উঠল। আহা,
    সমুদ্রের বুকে কে অদৃশ্য শিল্পী তুমি রক্তরাঙা আবির মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দিয়েছ।

    এ কি নয়নাভিরাম অপূর্ব দৃশ্য!

    হে অদৃশ্য শিল্পী, আমার প্রণাম গ্রহণ কর।

    ***

    সেই দিন সন্ধ্যায়।

    আজ আর গগনেন্দ্রনাথ সমুদ্রের ধারে সান্ধ্যভ্রমণে বের হননি। সকলেই
    যে যাঁর বসবার ঘরে বসে আছেন।

    কিরীটীও আজ সন্ধ্যায় বের হয়নি, কেননা মাথাটা তার সেই দুপুর থেকে
    বিশ্রীরকম ধরে আছে।

    ঠিক হয়েছে আগামী কাল সকালে সে কোণারক দেখতে যাবে।

    দু-চার দিন পরে ফিরবে।

    রণধীর সে-ঘরে নেই, নিজের ঘরে শুয়ে আছে।

    বিনতা সামনে বসে উল দিয়ে কী একটা বুনছিল, ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি
    আটটা ঘোষণা করল।

    বিনতা হঠাৎ যেন চমকে দাঁড়াল, কাকা, আপনার ওষুধ খাবার সময় হল,
    ওষুধটা নিয়ে আসি গে!

    গগনেন্দ্রনাথ চোখ বুজে ঝিমোচ্ছিলেন, মৃদুস্বরে বললেন, যাও। কিন্তু
    ওষুধ খাবার সময় আমার আধঘণ্টা আগেই হয়েছিল। তোমাদের কি আর সেদিকে খেয়াল আছে। তোমাদের
    সকলের যে আজকাল কী হয়েছে, তোমরাই তা জান। সময়মত ওষুধটাও দিতে যদি না পার, বললেই তো
    হয়, আমার নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করব। কারও সাহায্যেই আমার দরকার নেই।

    বিনতা বিনা বাক্যব্যয়ে ঔষধ আনতে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। রাগে
    অপমানে একটা নিষ্ফল বেদনায় তার সমগ্র অন্তরাত্মা তখন গর্জাচ্ছে।

    চোখ ফেটে জল আসতে চায়।

    বিনতার ঘরেই সাধারণত সব ঔষধপত্র থাকত।

    সে যখন ঘরে এসে প্রবেশ করল, রণধীর তখন একটা চেয়ারের উপরে শুয়ে আলোয়
    কী একখানা বই পড়ছে।

    ঔষধ কাঁচের গ্লাসে ঢেলে নিয়ে যেতে যেতে একবার আড়চোখে স্বামীর
    প্রতি চেয়ে বিনতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। গগনেন্দ্রনাথকে ঔষধ খাইয়ে বিনতা
    ঔষধের গ্লাসটা রাখতে ঘরে ফিরে এল।

    রণধীর তখন বইখাতা কোলের উপরে নামিয়ে রেখে কী যেন ভাবছিল।

    বিনতা তার সামনে এসে দাঁড়াল।

    কে, বিনতা? রণধীর প্রশ্ন করলে।

    হ্যাঁ, আমি। কিন্তু তুমি কি আজও এমনি করে নিশ্চিন্তই থাকবে?

    রণধীর চমকে সোজা হয়ে বসে বিনতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, কী হয়েছে
    বিনতা?

    কী হয়েছে? নতুন করে কী আর হবে? ওগো, আমি আর সহ্য করতে পারি না,
    যেখানে হোক চল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই—এখুনি, এই মুহূর্তে। কান্নায় বিনতার কণ্ঠস্বর
    রুদ্ধ হয়ে এল।

    রণধীর রীতিমত চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু কী সে জবাব দেবে এ প্রশ্নের?

    কী ভাবছ? আর কতকাল এমনি ভাবে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করব? ওগো, তুমি
    কি সত্যিই পাষাণ? এইভাবে কষ্ট দেবে বলে কি তুমি বিয়ে করেছিলে?

    বিনতা, স্থির হও। কোথায় যাব বল? এ আশ্রয় ছেড়ে গেলে পথে পথে আমাদের
    অনাহারে ঘুরে বেড়াতে হবে। এই যুদ্ধের দুর্মূল্যের বাজারে কেমন করে দিন চালাব?

    চলবে। কেন তুমি ভাবছ, আমি আবার চাকরি নেব।

    তোমার রোজগারে আমাকে জীবনধারণ করতে হবে? এর থেকে কি তাও ভাল নয়?

    না।

    বিনতা কিছুক্ষণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরে গম্ভীর স্বরে বললে, বেশ,
    তবে তুমি থাক তোমার ঐ অত্যাচারের ঐশ্বর্য নিয়ে, আমি চলে যাব। দু-মুঠো অন্নের আমার
    অভাব হবে না জেনো।

    বিনতা ধীর শান্তপদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

    রণধীর ব্যাকুল স্বরে ডাকলে, বিনতা, শোন-শোন!

    কিন্তু বিনতা ফিরে এল না।

    ***

    রাত্রি প্রায় পৌনে নটা।

    সকলে এবার খেতে যাবে।

    কিশোর একটা শোফার উপরে ক্লান্তভাবে শুয়ে ঝিমোচ্ছিল, সকলেই উঠে দাঁড়াল
    কিন্তু কিশোর উঠল না।

    কিশোরের দিকে তাকিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ডাকলেন, কিশোর, ওঠ। খেতে চল।

    আমি আজ আর খাব না কাকা। আবার বোধ হয় আমার জ্বর হয়েছে।

    গগনেন্দ্রনাথ কিশোরের সামনে এসে তার কপালে হাত দিয়ে বললেন, হ্যাঁ।
    তবে যাও, নিজের ঘরে শুয়ে থাক গিয়ে।

    কিশোর কী এক করুণ মিনতিভরা দৃষ্টিতে গগনেন্দ্রনাথের ভাবলেশহীন
    মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করল, একা একা আমার কোণের ঘরে শুতে বড় ভয় করে কাকা!

    ছেলেমানুষী করো না কিশোর, শুতে যাও।

    এখন একটু এখানেই থাকি, তোমরা খেয়ে এস, তারপর আমি যাবখন।

    তীব্রস্বরে গগনেন্দ্রনাথ এবারে ডাকলেন, কিশোর?

    সভয়ে ত্রস্ত কিশোর উঠে দাঁড়াল।

    বিনতা কিশোরের সামনে এগিয়ে এল, চল কিশোের, আমি তোমার সঙ্গে
    যাচ্ছি, তাহলে তো ভয় করবে না!

    গগনেন্দ্রনাথ গম্ভীর শান্ত স্বরে বলে উঠলেন, না। কেউ ওর সঙ্গে
    যাবে না। ও একাই যাবে। যাও কিশোর, শুতে যাও। ধীরপদে মাথা নীচু করে একপ্রকার টলতে
    টলতেই কিশোর ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

    নিজের ঘরে এসে কিশোর অন্ধকারেই শয্যার উপরে কোনমতে লুটিয়ে পড়ল।

    সত্যিই তার তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।

    বসবার ঘরে বারীনবাবু এক কোণায় বসেছিলেন, হঠাৎ তিনি গগনেন্দ্রনাথের
    দিকে তাকিয়ে, কিশোর চলে গেলে বললেন, সত্যি হয়ত ও ভয় পায় একা একা শুতে, গগনবাবু। হাজার হোক ছেলেমানুষ তো।

    গগনেন্দ্রনাথ তীব্রভাবে ফিরে দাঁড়ালেন, নিজের কাজ নিজে করুন মশাই,
    অন্যের কাজে মাথা ঘামাবার তো কোন দরকার নেই আপনার!

    বারীনবাবুও তীব্রস্বরে জবাব দিলেন, সত্যি, আপনার মত অভদ্র আমি
    দেখিনি।

    তীব্র ব্যঙ্গের স্বরে গগনেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, তাই নাকি!

    তারপরই কিছুক্ষণ বারীনবাবুর চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে
    থেকে ঘর হতে বের হয়ে যাবার জন্য ফিরে দাঁড়ালেন এবং চলতে চলতে কতকটা আত্মগতভাবে
    বলেন, আমি কখনও কিছু ভুলি না। মনে রেখো এ কথা। আমি আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘ ষাট
    বছরের জীবনের কোন কথাই ভুলিনি। সবই আমার মনে আছে। কোন মুখ আমি ভুলিনি।

    ***

    প্রতিমা এতক্ষণ স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল ও শুনছিল।

    ওঁরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই সে চুপিসাড়ে পায়ে পায়ে গিয়ে কিশোরের
    ঘরে প্রবেশ করল।

    পায়ের শব্দে কিশোর চমকে প্রশ্ন করলে, কে? কে?

    চুপ, চেঁচিও না। আমি প্রতিমা। প্রতিমা কিশোরের শয্যার পাশটিতে এসে
    দাঁড়াল।

    কিশোর মৃদুস্বরে বললে, ডাঃ গাঙ্গুলী?

    কিশোরের শয্যার পাশটিতে বসে, কিশোরের রোগতপ্ত কপালে হাত বুলোতে বুলোতে
    গভীর স্নেহের সঙ্গে প্রতিমা বললে, আমাকে তুমি প্রতিমাদি বলেই ডেকো কিশোর। আমার কোন
    ছোট ভাই নেই, তুমিই আমার ছোট ভাইটি। কেমন, তুমি আমার ভাই হতে তো?

    হব।

    তুমি বলছিলে একা একা নাকি তোমার এ ঘরে শুতে ভয় করে, কেন তোমার ভয়
    করে ভাই? প্রতিমা প্রশ্ন করলে।

    কি জানি প্রতিমাদি, সত্যি আমার বড় ভয় করে। মনে হয় এই ঘরের আশপাশে
    অন্ধকারে কারা যেন সব লুকিয়ে আছে। যত রাত্রি বাড়তে থাকে তারা সব আমার বিছানার
    চারপাশে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়। অন্ধকার থেকে চাপা গলায় ফিসফিস করে কারা যেন আমাকে
    ডাকে। আমি শুনতে পাই, দিনের বেলাতেও তারা আমাকে ডাকে। তারা গান গায়, তারা হাসে,
    তারা কাদে।

    পাগল ছেলে! ও তোমার মনের ভুল। ওসব কিছু না।

    বললে তুমি বিশ্বাস করবে না প্রতিমাদি, তাদের আমি খুব ভাল করে
    দেখতে পাই না বটে, কিন্তু তারা আমার চারপাশে সর্বদা ঘোরে, আমাকে চাপা গলায় কেবলই
    ডাকে, তা টের পাই।

    এবারে আর দেখো ডাকবে না। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা ওষুধ এনে দিচ্ছি।
    প্রতিমা নিজের ঘরে গিয়ে একটা ভেরনল ট্যাবলেট নিয়ে এসে কিশোরকে খাইয়ে দিল। শীঘ্রই
    কিশোরের চোখের পাতায় ঘুম নেমে এল।

    ঘুম আসছে প্রতিমাদি, ঘুমোই। কতদিন আমি ভাল করে ঘুমোই না।

    সস্নেহে প্রতিমা জবাব দিল, হ্যাঁ, ঘুমোও।

    অনেকদিন পরে সেরাত্রে কিশোর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল।

    ***

    পরের দিন খুব প্রত্যুষে কিরীটী কোণারক দেখতে চলে গেল, এখানকার
    আবহাওয়ায় মনটা তার সত্যিই বড় বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রতিমা নিজের ঘরে বসে কি একখানা
    মনোবিজ্ঞানের বই পড়ছিল, ডাঃ চক্রবর্তী এসে ঘরে ঢুকল, চলুন প্রতিমা দেবী, সমুদ্রের
    ধারে বেড়িয়ে আসি।

    প্রতিমা বই রেখে উঠে দাঁড়াল, চলুন।

    বেরুবার পথে হঠাৎ প্রতিমার সমীরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল, সমীর
    যেন প্রতিমাকে দেখে কি বলবার জন্য একটু এগিয়ে এল, কিন্তু প্রতিমা সেদিকে লক্ষ্য না
    করে হনহন করে এগিয়ে গেল। আজ দুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথের শরীরটা অসুস্থ। বসবার ঘরে
    কাল থেকে আর আসেন না। সর্বদাই তাঁর ঘরের সামনে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে গায়ে
    কমলালেবু রঙের একটা শাল জড়িয়ে বসে থাকেন। মেজাজটা আরও খিটখিটে হয়ে উঠেছে। হোটেলের
    চাকর-খানসামাদের পর্যন্ত নানা কাজের খুঁত ধরে চেঁচামেচি করেন। খাবার ঘরে যান বটে,
    কিন্তু এক গ্লাস দুধ ও কিছু ফল খেয়ে উঠে আসেন।

    কিশোরের সকালের দিকে জ্বর থাকে না বটে, কিন্তু সন্ধ্যার পরেই একটু
    ঘুষঘুষে জ্বর। আসে। চোখ মুখ গা হাত পা জ্বালা করে। অমিয় ও প্রতিমা কিশোরকে ভাল করে
    পরীক্ষা করে গোপনে গোপনে কি ঔষধপত্র দিচ্ছে। গগনেন্দ্রনাথ জানতে পারলে আর রক্ষা
    থাকবে না তা ওরা ভাল করেই জানে। ঠিক বলবেন, অনধিকার চর্চা!

    ***

    আজ দুদিন থেকে গগনেন্দ্রনাথও যেমন বিকেলে কোথাও বেড়াতে বের হন না,
    ভাইপোদেরও যেতে দেন না বাইরে। সর্বদাই তারা ছায়ার মত গগনেন্দ্রনাথের চারপাশে ভিড়
    করে থাকে। প্রত্যেকের মুখের উপরে যেন একটা বিষাদের কালো মেঘ থমথম করে।

    ***

    সেদিন সকাল থেকেই আকাশের বুকে একটা পাতলা কালো মেঘের যবনিকা
    দুলছে।

    সাগর হয়েছে যেন একটু বিশেষ চঞ্চল।

    সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া বইছে বাঁধনহারা।

    সাগরের বুকে ঢেউয়ের সে কি মাতামাতি!

    বড় বড় উঁচু কালো ঢেউগুলি যেন সাদা দাঁতের পংক্তি বের করে সমগ্র
    বিশ্বদুনিয়াকে গিলবার জন্য ক্ষুধিত লালসায় শত বাহু বাড়িয়ে বহুঙ্কারে ছুটে এসে
    বালবেলার উপরে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। দ্বিপ্রহরের দিকে হোটেলের উপরতলায় সকলেই প্রায়
    সেদিনকার সমুদ্রের সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে সাগরকিনারে চলে গেলেন।

    গগনেন্দ্রনাথ তাঁর ঘরের সামনে আরামকেদারায় চুপটি করে বসে আছেন।

    কিশোর তার ঘরে শুয়ে, বাকি সবাই গগনেন্দ্রনাথের চারপাশে বসে। হঠাৎ
    একসময়ে গগনেন্দ্রনাথ ভাইপোদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, তোমরাও আজ সব সমুদ্র দেখে
    এস। দুদিন তোমরা ঘরের মধ্যে আটকা আছ। যাও, সবাই ইচ্ছামত বেড়িয়ে এস। কিন্তু দেখো,
    সন্ধ্যা পর্যন্ত যেন বাইরে থেকো না।

    কাকার কথা শুনে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
    এ শুধু আশ্চর্যই নয়, অভাবনীয়ও বটে।

    এমনি করে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আজ পর্যন্ত জ্ঞানত এর আগে কোনদিন
    তাদের মিলেছে কিনা তারা মনে করতে পারে না।

    বদ্ধ ঘরের বদ্ধ হওয়ায় তীব্র অনুশাসনের গণ্ডির মধ্যেই তারা আবদ্ধ।

    সকলেই একে একে উঠে দাঁড়াল। কেননা অসম্ভব অভাবনীয় হলেও কাকার আদেশ
    বা অনুমতিকে অবহেলা করার মত তাদের কারো দুঃসাহস নেই।

    সমীরই সবার আগে গায়ে পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। কয়েকদিন
    হল সমর রায় নামে একজন কবি ও আটিস্ট এসে বারীনবাবুর পাশের ঘরখানি অধিকার করেছে।

    সমরবাবুর বয়েস ছাব্বিশ-সাতাশের বেশী হবে না। রোগা লিকলিকে দেহের
    গঠন। মাথাভর্তি এলোমেলো ঝাকড়া ঝাকড়া বাবরী চুল কাধের উপরে লুটিয়ে আছে। গায়ের রং কালো।
    চোখমুখ বেশ তীক্ষ্ণ তবে একটা মেয়েলী ঢং আছে। চোখে পানে, একটা সরু সিল্কের কারের
    সঙ্গে গলদেশে দোদুল্যমান।

    সমরবাবু অতি-আধুনিক কবি। রবীন্দ্র-শেষ যুগে যেসব কবি আপনাতে আপনি
    দ্যুতিমান, নক্ষত্রনিচয় রবি-প্রতিভাকে স্নান করে দেবার দুর্বার বাসনায় উচ্চকণ্ঠে
    সগৌরবে আপনাদের বিজয়-দুন্দুভি পিটছেন, সমর রায় তাঁদেরই একজন।

    রবীন্দ্রনাথ নাকি কোন একজন অতি আধুনিক কবির কবিতা পড়ে বলেছিলেন,
    অমুকের কবিতা যদি কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তবে সত্যিই তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ
    থাকবো।

    জানি না কেউ বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন কিনা তাঁকে।

    সমীর চিরদিনই কবিতার ভক্ত। সমরবাবু একজন কবি শুনে তার মনটা সহজেই
    সমরবাবুর দিকে একটু ঝুঁকেছিল।

    দূর থেকে সমরবাবুর উদাস বধূ কৈ বধূ কৈ ভাব সমীরের মনে একটা বিস্ময়ের
    উদ্রেক করেছিল সন্দেহ নেই।

    সে সমরবাবুর সঙ্গে আলাপ করবার জন্য সুযোগ খুঁজছিল।

    সমীর যখন কাকার আদেশে হোটেল থেকে সাগরের দিকে বেড়াতে যাবার জন্য
    বেরুচ্ছে, হঠাৎ দরজায় সমরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

    সমরবাবুও তার খাতা ও ঝরনা কলম নিয়ে তখন সমুদ্রের দিকে চলেছেন।

    দুজনের দরজার গোড়ায় দেখা হতেই সমীর হাত তুলে সমরবাবুকে নমস্কার
    জানাল। সাগরের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সহজেই দুজনের আলাপ-পরিচয় জমে উঠল।

    সমীর বলছিল, আপনি যে একজন কবি তা আমি শুনেছি সমরবাবু, কোন্ কোন্
    কাগজে আপনি কবিতা লেখেন?

    সমরবাবু জবাব দিলেন, সব কাগজেই প্রায় লিখি।

    তবু?

    যেমন ধরুন, পথহারা পাখী, কবরখানা, কসাইঘর, কারা-প্রাচীর-সব
    পত্রিকাতেই আমি লিখি।

    ভারতবর্ষ প্রবাসীর সঙ্গে সমীরের পরিচয় আছে বটে কিন্তু সমরবাবু বর্ণিত
    কাগজগুলোর নাম দু-একবার শুনলেও চোখে দেখার সৌভাগ্য তার কোনদিনও হয়নি, অতএব সে চুপ
    করেই পথ চলতে লাগল।

    সহসা একসময় আবার সে প্রশ্ন করলে, এখানে এসে অবধি নতুন কোন কবিতা
    আপনি লেখেননি সমরবাবু?

    হ্যাঁ,
    একটা লিখছি, শুনবেন? এখনও কিন্তু শেষ হয়নি।

    হ্যাঁ, বলুন না?

    তবে শুনুন, সমর চলতে চলতেই কবিতা আওড়াতে শুরু করলেন। কবিতার নাম :

    পুরীর
    সমুদ্র

    হে সমুদ্র? তুমি কি একটা পাখী,
    পশু না হংসডিম্ব?
    কিংবা রেলের লাইন, কাঁটা তারের বেড়া
    জেলের কয়েদীদের চোখের জল।
    তুমি কার বেদনা দীর্ঘশ্বাস;
    কার ছেঁড়া চটিজুততা!
    কিংবা কোন কেরানীর হেঁড়া পাতলুন!
    পথিকের ক্ষয়ে যাওয়া শুক্‌তলা,
    যুদ্ধের ধূসর তাঁবু
    তোমার গর্জনে শুনি সৈনিকের মার্চ,
    যেন পায়ে অ্যামুনিশন বুট।
    কিংবা রাইফেল মেসিনগান
    বোমারু হাওয়াই জাহাজ!
    আমি হতবাক!

    সমরবাবু হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, এই পর্যন্তই লিখেছি, বাকি এখনও
    লেখা হয়নি, ভাব তো সব সময় মাথায় আসে না। ভাব বা প্রেরণা মনের একটা অস্বাভাবিক
    ক্ষণমুহূর্ত। কিন্তু কেমন লাগল কবিতাটা আপনার সমীরবাবু?

    সমীর বোকার মতই যেন হঠাৎ বলে ফেললে, বেশ। কিন্তু বুঝলাম না তো!

    সমরবাবু সোল্লাসে বলে উঠলেন, বোঝেননি তো? ঐখানেই আমাদের অতি
    আধুনিক কৃতিত্ব। আমাদের কবিতা ভাবীকালের জন্য। এই যে প্রতীক্ষিত বেদনা, এর একটা
    বিপুল রূপ—এ তো সকলের চোখে ধরা পড়বার নয়!

    ***

    ঘরের মধ্যে খাটের উপরে শুয়ে ডাঃ চক্রবর্তী সমগ্র দেহখানি একটা
    কম্বলে ঢেকে কি একখানা বই পড়ছিল।

    ভিতরে আসতে পারি কি? বাইরে থেকে প্রতিমার গলা শোনা গেল।

    ডাঃ চক্রবর্তী শশব্যন্তে উঠে বসল শয্যার উপর, আসুন প্রতিমা দেবী।

    প্রতিমা হাসতে হাসতে এসে ঘরে প্রবেশ করল। তারপরই ডাঃ চক্রবর্তীর
    দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বললে, এ কি, অসময়ে বিছানায় শুয়ে যে?

    শরীরটা সকাল থেকেই যেন কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, আবার ম্যালেরিয়া
    জ্বর আসছে কিনা বুঝতে পারছি না। অমিয় বললে।

    প্রতিমা হাসতে হাসতে বললে, ডাক্তার মানুষের অসুখ, এ তো ভাল নয়! কই
    দেখি। আপনার নাড়ীটা?

    নাড়ী দেখে প্রতিমা বললে, না, জ্বর নেই, তবে pulseটা একটু rapid,
    চলুন সমুদ্রের ধারে একটু হাওয়ায় বেড়িয়ে আসবেন, হয়ত ভাল লাগতে পারে।

    অমিয় জামাটা গায়ে দিতে দিতে উঠে দাঁড়াল, চলুন।

    হোটেল থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দুজনে সমুদ্রের কিনারে কিনারে
    বালুবেলার উপর দিয়ে হেঁটে চলল।

    অনেকটা দূর গিয়ে অমিয় বললে, আসুন প্রতিমা দেবী, এখানে একটু বসা
    যাক।

    ***

    রণধীর ও অধীর দুজনে হোটেল থেকে বের হয়ে গেল। পিছু পিছু বিনতাও বের
    হয়ে গেল।

    একমাত্র কিশোর শুধু গেল না, নিজের ঘরে শুয়ে রইল।

    ***

    ধীরে ধীরে দিনের আলো নিভে আসছে।

    দিনের শেষের রক্তিমাভ শেষ সূর্যরশ্মি সমুদ্রের নীল জল লাল করে
    তুলেছে।

    অমিয় প্রতিমার দিকে ফিরে বললে, জুর বোধ হয় এসে গেল প্রতিমা দেবী,
    বড্ড শীতশীত করছে। আমি ফিরে যাই।

    প্রতিমা শশব্যন্তে উঠে দাঁড়ালেন, আমিও সঙ্গে যাচ্ছি চলুন।

    না না, অমিয় প্রতিবাদ করে উঠল, আমি একাই যেতে পারব, আপনার মিথ্যে
    কষ্ট করতে হবে না।

    কষ্ট! এতে আবার কষ্ট কি বলুন তো?

    না না, আমি একাই ফিরে যাচ্ছি।

    অমিয় চলে গেল। প্রতিমা সাগরের দিকে চেয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগল।

    আমার
    দিন ফুরাল, ব্যাকুল বাদল সাঁঝে,
    বনের ছায়ায় জল ছল ছল সুরে
    হৃদয় আমার কানায় কানায় পুরে
    ক্ষণে ক্ষণে ঐ গুরু গুরু তালে
    গগনে গগনে গভীর মৃদঙ্গ বাজে।
    কোন দুরের মানুষ কেন এলো কাছে
    মনের আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে,
    বুকে দোলে তার বিরহ-ব্যথার মালা,
    গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা
    মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি
    হার মানি তার অজানা মনের মাঝে।

    প্রতিমা
    দেবী?

    কে?
    প্রতিমা চমকে ফিরে তাকাল, ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে সমীর।

    সমীরবাবু!
    আসুন, বসুন। বলে প্রতিমা আবার অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

    আমি আমার সেদিনকার ব্যবহারের জন্য সত্যই অনুতপ্ত প্রতিমা দেবী।
    আমাকে ক্ষমা করুন। কুণ্ঠিত স্বরে সমীর বললে।

    ক্ষমা! কী বলছেন আপনি সমীরবাবু? আপনি তো কোন অন্যায়ই করেন নি।
    সত্যিই আপনার কাকা যখন আপনাদের অন্যের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না…

    সত্যি প্রতিমা দেবী, মাঝে মাঝে যে আমার কী হয়, কেমন যেন সব গোলমাল
    হয়ে যায় মাথার মধ্যে। সত্যি এ বাঁধন আমার অসহ্য হয়ে
    উঠছে। কিন্তু আমি নিরুপায়, মুক্তির

    কোন পথই খুঁজে পাই না..কী আমি করব বলতে পারেন?

    চলে আসুন সমীরবাবু, ঘরের বাঁধন ছিড়ে চলে আসুন। আমি তো ভেবে পাই
    না, কী করে দিনের পর দিন এই শাসন সহ্য করে আসছেন। আমি হলে এতদিন পাগল হয়ে যেতাম,
    না হয় আত্মহত্যা করতাম।

    হয়ত শেষ পর্যন্ত আর কিছুদিন এভাবে থাকতে হলে আত্মহত্যাই আমাকে
    করতে হবে। আমি বড় ক্লান্ত।

    পুরুষমানুষ আপনি, আত্মহত্যা করবেন কেন? ছিঃ ছিঃ, ওসব কথা কল্পনায়ও
    মনে স্থান দেবেন না। এ অত্যাচারকে আপনার জয় করতে হবে। মনে সাহস আনুন।

    সত্যি এ বাঁধন আমি ছিড়ে ফেলব। এমনি করে কেউ কোনদিনই আমাকে বলেনি।
    কিন্তু …, সহসা সমীর গভীর আগ্রহে প্রতিমার একখানা হাত চেপে ধরে বললে, আমি পারব,
    তুমি যদি আমার সহায় হও প্রতিমা! তুমি যদি আমার পাশে এসে দাঁড়াও! বলবল প্রতিমা,
    তুমি আমার সহায় হবে! আজই আমি এর একটা মীমাংসা করব।

    ধীরে ধীরে প্রতিমা তার ধৃত হাতখানা ছাড়িয়ে নিল, সমীর! বললে
    প্রতিমা, আমি তোমার সহায় হলেই কী তুমি জয়ী হতে পারবে?

    পারব। সত্যি তোমার মুখের দিকে চাইলে যেন আমার মনে সাহস আসে,
    নিজেকে যেন খুঁজে পাই। তারপর হঠাৎ উঠে পড়ে সমীর বললে, এখুনি আমি চললাম প্রতিমা।
    মনে হঠাৎ যা উঠেছে, এখনি যদি এর সংশোধন না করি, আবার আমি সাহস হারিয়ে ফেলব। আমি
    যাই। সমীর দ্রুতপদে স্থানত্যাগ করে চলে গেল।

    সমীরের ক্রম অপস্রিয়মাণ গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহসা
    গভীর স্নেহে প্রতিমার চোখের কোল দুটি জলে ভরে উঠল।

    ***

    যতীনবাবু নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে কি একটা মাসিকের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন।
    সহসা ওপাশের বারান্দা থেকে কি একটা গোলমালের আওয়াজ কানে এল। উনি মুখ তুলে দেখলেন,
    একটা খানসামা দ্রুতপদে বারান্দা অতিক্রম করে কিশোরের ঘরের দিকে চলে গেল। যতীনবাবু
    বুঝলেন, কোন কারণে আবার গগনেন্দ্রনাথ খানসামার উপরে চটে গেছেন। তিনিই বোধ হয় তাকে
    গালাগাল দিচ্ছিলেন। চেয়ে দেখলেন, গগনেন্দ্রনাথ একটা শাল গায়ে দিয়ে নিত্যকারের মত
    ইজিচেয়ারটার উপর হেলান দিয়ে বসে আছেন। আচ্ছা মাথা খারাপ যাহোক! যতীনবাবু আবার পড়ায়
    মনোনিবেশ করলেন; কেননা এ ধরনের ব্যাপার রোজই প্রায় দুচারবার হয়।

    ***

    বারীনবাবু বেড়াতে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যতীনবাবুর ঘরের সামনে
    দাঁড়ালেন, যতীনবাবু!

    কে, বারীনবাবু? আসুন।

    চলুন না সাগরের ধার থেকে একটু বেড়িয়ে আসা যাক।

    এখুনি যাবেন? আর একটু বেলা পড়লে গেলে ভাল হত না?

    হাতঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে বারীনবাবু বললেন, বেলা আর আছে
    কই, সোয়া চারটে বাজে। শীতকালের বেলা, তারপর আবার মেঘে মেঘে সন্ধ্যা হতে বেশী দেরিও
    হবে না।

    বেশ চলুন।

    যতীনবাবু উঠে জামাটা গায়ে চাপিয়ে বারীনবাবুর সঙ্গে ঘর থেকে বের
    হলেন।

    গগনেন্দ্রনাথ তখনও একই ভাবে চেয়ারটার উপরে চুপটি করে শাল গায়ে জড়িয়ে
    বসে আছেন।

    বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বারীনবাবু উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন, আজ
    কেমন আছেন গগনবাবু?

    গগনেন্দ্রনাথ জবাবে ঠিক কি যে বললেন তা শোনা বা বোঝা গেল না বটে,
    তবে বারীনবাবু মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকিয়ে বললেন, দেখলেন যতীনবাবু, লোকটা সত্যিই কি
    অভদ্র! শরীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, ঝাজাল স্বরে জবাব দিলেন, বেশ আছি। সত্যি, এত
    অভদ্র আমি, জীবনে কখনও
    দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

    যতীনবাবু চলতে চলতেই মৃদুস্বরে জবাব দিলেন, একে ভদ্রলোকের বেশ
    খিটখিটে মেজাজ, তারপর আবার অসুস্থ। গভর্নমেন্টে যাঁরা চাকরি করেন তাঁরা বুড়ো হয়ে
    পেনশন নেবার পর এইরকম খিটখিটে বদমেজাজী হন।

    তার কারণ কি জানেন? বেশীর ভাগ বুড়োরাই আমাদের দেশে activelife ছেড়ে
    দেবার পর dispeptic হয়ে পড়েন। ফলে ভাল করে রাত্রে ঘুম হয় না, খিটখিটে হয়ে ওঠেন।
    বারীনবাবু জবাব দিলেন।

    কিন্তু আপনিও তো বুড়ো হয়েছেন বারীনবাবু! আপনি তো কই খিটখিটে
    মেজাজের হননি? যতীনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ও থিওরিটা কিন্তু আমি মানতে
    পারলাম না বারীনবাবু।

    কিন্তু এক-আধজনকে নিয়েই তো আর সকলকে বিচার করা চলে না যতীনবাবু!
    হাসতে হাসতে বারীনবাবু জবাব দিলেন।

    ওঁদের সঙ্গে পথেই হোটেলের কিছু আগে ডাঃ অমিয় চক্রবর্তীর দেখা হয়ে
    গেল।

    চক্রবর্তী তখন জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলের দিকে ফিরে আসছে।

    অমিয়র মুখের দিকে তাকিয়ে বারীনবাবু প্রশ্ন করলেন, ডাক্তার, অসুস্থ
    নাকি?

    অমিয় কোনমতে জবাব দিলে, হ্যাঁ, জ্বর হয়েছে।

    অমিয় দ্রুতপদে হোটেলে গিয়ে প্রবেশ করল।

    পথে সমীরবাবুর সঙ্গেও ওঁদের দুজনের দেখা হল। সমীর তখন দ্রুতপদে
    হনহন করে হোটেলের দিকে ফিরছে।

    ডাক্তার ডাকলেন, কিন্তু সমীর কোন জবাব দিল না ওদের ডাকে। সমীরের
    মাথার মধ্যে তখন উত্তেজনার আগুন জ্বলছে।

    বারীনবাবু সমীরের অপস্রিয়মাণ দেহের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বললেন,
    পাগল! গুষ্টিসুদ্ধই পাগল!

    ***

    বেলা প্রায় চারটে-পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় রণধীর একা একা হোটেলে ফিরে
    এল।

    কাকার সঙ্গে দেখা করে সে দ্রুতপদে নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল এবং
    জামা কাপড় সমেতই নিজের শয্যার উপরে গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে রইল।

    মাথার মধ্যে তখন তার দপদপ করছে।

    মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রণধীরের স্ত্রী বিনতা ফিরে এল, এবং খুড়শ্বশুরের
    সঙ্গে কী খানিকটা কথাবার্তা বলে রণধীরের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।

    ***

    সমীর কিন্তু হোটলের দোরগোড়া পর্যন্ত এসে আর হোটেলে প্রবেশ করল না।
    সাগরের কিনারে গিয়ে বসে রইল।

    সে যখন হোটেলে ফিরে এল তখন প্রায় সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
    সমীরের ফিরে আসবার কিছু আগেই বারীনবাবু ও যতীনবাবু হোটেলে ফিরে আসেন।

    ***

    সন্ধ্যা প্রায় ছটার সময় ডাঃ প্রতিমা গাঙ্গুলী ফিরে এল এবং হোটেলে
    ফিরে সটান নিজের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।

    ***

    সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছটার সময় সকলে এসে খাবার ঘরে ঢুকলেন চা খাবার
    জন্য।

    চা খেতে বসে হঠাৎ বিনতা বললে, কাকা তো চা খেতে এলেন না!

    সকলেই একবার মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলো, কেননা চিরন্তন নিয়মের এ একটা
    ব্যতিক্রম।

    রণধীর একজন হোটেল-ভৃত্যকে গগনেন্দ্রনাথকে চা পান করতে আসবার জন্য
    ডাকতে পাঠালে।

    অল্পক্ষণ বাদেই চাকরটা দ্রতপদে ফিরে এল, তার সারা মুখে একটা
    ভীতত্রস্ত ভাব।

    বিনতা জিজ্ঞাসা করলে, কিরে, বাবুকে ডেকেছিস?

    মু কিছি বুঝি পারিলি নাহি। মু ডাকিলি, বাবু কড়কিছি কহিলে নাহি।
    আপন আসি দেখন্তু।

    সে কি রে! সকলে উঠে দাঁড়াল এবং একসঙ্গে ঘর ত্যাগ করে সকলেই চলে
    গেল।

    একটু পরেই একটা গোলমালের শব্দ শুনে প্রতিমা সেখানে গিয়ে হাজির হল।

    সকলে স্তম্ভিত বিস্ময়ে গগনেন্দ্রনাথকে ঘিরে চারপাশে হতবুদ্ধির মত
    দাঁড়িয়ে আছে।

    সকলের মুখেই একটা ভীত্যন্ত ভাব।

    ব্যাপার কি, রণধীরবাবু? প্রতিমা ব্যগ্র-ব্যাকুল কণ্ঠে শুধাল।

    কী জানি, বুঝতে পারছি না কিছু, দেখুন তো-ডাকছি সাড়া দিচ্ছেন না।

    প্রতিমা শশব্যন্তে ভাল করে পরীক্ষা করতেই তার মুখখানা কালো হয়ে
    গেল, ধীর মৃদুস্বরে বললে, উনি আর বেঁচে নেই, মারা গেছেন।

    সকলেই সমস্বরে বললে, সে কি!

    কি করে যে এমনি ভাবে হঠাৎ গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু হল কেউ ভেবে পেল
    না।

    প্রতিমা বললে, শুধু হর্টফেল করে মারা গেছেন। আগে থেকেই তো হার্টের
    অসুখে ভুগছিলেন।

    কিন্তু আশ্চর্য, গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুকে কেউ এক ফোটা চোখের জলও
    ফেললে না।

    সকলেই যেন ভয়ানক নিশ্চিন্ত হয়েছে।

    একটা যেন ভূতের বোঝা এতদিন তারা বয়ে বেড়াচ্ছিল, তার থেকে যেন সকলে
    মুক্তি পেয়েছে।

    অমিয় যখন ব্যাপারটা শুনল, রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে দশটা হবে, সে-ও
    এল দেখতে। মৃতদেহ ভাল করে পরীক্ষা করেও তার মনটা যেন খুতখুত করতে লাগল।

    ***

    দিন-দুই বাদে কিরীটী কোণারক থেকে ফিরে এল।

    গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ শুনে সে-ও স্তম্ভিত হয়ে গেল।

    কয়েকদিনের ঘটনাগুলি তার মনের মাঝে এসে নানা চিন্তার জট পাকাতে
    লাগল।

    টীকা