Chapter Index

    বাঃ, চা-টা চমৎকার হয়েছে তো! কে তৈরী করল?

    কিরীটী সুশান্ত চ্যাটার্জির দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে।

    মৃদু হেসে সুশান্ত বলে, আমি।

    বুঝতে পেরেছি। কিরীটী আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,
    সত্যিই দেখছি আপনি রীতিমত কুশলী লোক।

    আজ্ঞে—

    চমকে যেন সুশান্ত কিরীটীর দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তির মত কথাটা
    উচ্চারণ করে।

    বলছিলাম সত্যিই আপনি গুণী লোক। কি বলেন অবনীবাবু?

    অবনী সাহার মুখের দিকে তাকাল কিরীটী।

    অবনী সাহা কোন জবাব দেন না।

    কিন্তু সুশাবাবু, আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না।

    সুশান্ত চ্যাটার্জি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

    আচ্ছা সুশাবাবু! কিরীটী প্রশ্ন করে।

    বলুন!

    মিত্ৰাণী দেবী—মানে আপনার শ্যালিকা—ওঁর তো সংসারে কেউ নেই?

    না।
    সত্যি ভাগ্যটাই ওর খারাপ।

    হ্যাঁ, অবনীবাবুর কাছে তাই শুনছিলাম বটে। আচ্ছা উনি তো বেশ
    কিছুদিন আপনাদের এখানে আছেন?

    হ্যাঁ।

    Dont mind-একটা কথা delicate হলেও জিজ্ঞাসা করছি—

    বলুন?

    মেয়েটিকে আপনার কি রকম বলে মনে হয়?

    মানে?

    মানে বলছিলাম—মেয়েটির স্বভাব-চরিত্র–

    না,
    না-সে রকম কিছু নেই—অত্যন্ত innocent type-এর।

    আচ্ছা মালদহে যখন উনি ছিলেন?

    না,
    কোন কিছু ওর সম্পর্কে শুনিনি। কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন বলুন তো?

    মানে বলছিলাম এইজন্য যে, সেখানে মানে মালদহে তার কোন ভালবাসার জন তো
    থাকতেও পারে!

    সুশান্ত যেন হঠাৎ কেমন চমকে ওঠে। বলে, কী বলছেন মিঃ রায়?

    না,
    বলছিলাম থাকতেও পারে। হয়ত আপনি জানেন না।

    না,
    না, সে রকম কিছু হলে—

    কিরীটী সুশান্ত চ্যাটার্জির মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে
    থাকে।

    দুচোখের পাতা যেন পড়ছে না।

    সুশান্ত বলতে থাকে, আমি নিশ্চয়ই জানতে পারতাম।

    সুশান্তর গলায় যেন একটা কঠিন আত্মপ্রত্যয়ের সুর।

    না মশাই, তিনি তার গোপন মনের খবর আপনাকে বলতে যাবে কেন? আপনি তো
    আর তার বন্ধু নন-জামাইবাবু-গার্জিয়ান–

    না,
    না, আপনি জানেন না—

    কী জানি না?

    সুশান্ত ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বলে, হ্যাঁ, আমি জানতে
    পারতাম সেরকম কিছু থাকলে।

    কিরীটী আর কোন কথা বলল না।

    হঠাৎ অতঃপর উঠে দাঁড়ায় এবং অবনী সাহার দিকে তাকিয়ে বলে, চলুন
    অবনীবাবু, অনেক রাত হয়ে গেছে।

    অবনী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান।

    আচ্ছা মিঃ চ্যাটার্জী, আমরা তাহলে চলি।

    কিরীটী অবনী সাহাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

    গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎ একসময় কিরীটী বলে, আচ্ছা অবনীবাবু—

    বলুন?

    যে দাওয়াই দিয়ে এলাম, সেটা ঠিক কাজ করবে বলে মনে হয়?

    কী বলছেন!

    না,
    কিছু না। আচ্ছা-কিরীটী প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়, মিত্ৰাণী দেবী তার জামাইবাবুকে
    ভালবাসে বলে আপনার মনে হয়?

    অসম্ভব নয় কিছু।

    তা বটে, আচ্ছা আপনি সন্দেহের বিষে কখনো জর্জরিত হয়েছেন?

    সন্দেহের বিষে!

    প্রশ্নটা করে কেমন যেন অসহায় ভাবে, একটু যেন নির্বোধের মতই অবনী
    সাহা পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটীর মুখের দিকে তাকান।

    কিরীটী তার কথাটার পুনরাবৃত্তি করে, বলে, হ্যাঁ-সন্দেহের বিষে!

    কেন বলুন তো?

    না,
    তাই জিজ্ঞাসা করছি।

    হঠাৎ ঐ প্রশ্ন?

    বললাম তো এমনিই। কিন্তু আমি জানি—

    কি?

    ও বিষ বড় সাংঘাতিক বিষ!

    মিঃ রায়!

    কিছু বলছিলেন?

    হ্যাঁ। মিত্ৰাণী দেবীকে আপনি কি সত্যিই সন্দেহ করছেন?

    কিরীটী হেসে ফেলে। বলে, মিত্ৰাণী দেবীকে দেখছি আপনি কিছুতেই ভুলতে
    পারছেন! যাই বলুন, একটা অদ্ভুত আকর্ষণ সত্যিই আছে ভদ্রমহিলার মধ্যে। কিন্তু আকাশে
    কি রকম মেঘ করেছে দেখছেন।

    সত্যিই আকাশে মেঘ করেছিল। একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল।

    অবনীবাবু! কিরীটী আবার ডাকে।

    বলুন?

    একটা অনুরোধ কিন্তু আছে আপনার কাছে—

    অনুরোধ!

    হ্যাঁ।

    কী, বলুন?

    আপাততঃ কিছুদিনের জন্য ঐ সুশান্ত ও মিত্ৰাণীকে আপনার ভুলে যেতে
    হবে।

    ভুলে যেতে হবে?

    হ্যাঁ। Completely! একেবারে মনের পাতা থেকে মুছে ফেলতে হবে।

    কিন্তু–

    সাপ ধরার আগে—আমি কালনাগিনীর কথা বলছি-ধরতে হলে প্রথমদিকে কিছুটা
    তাকে তার ইচ্ছামত চলতে দিতে হয়। শেষে যখন ফণা তুলবে তখন ধরবেন। কিন্তু বৃষ্টি বোধ
    হয় সত্যিই নামল!

    কিরীটীর সে-রাত্রে গৃহে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়।

    এবং গৃহে যখন সে পৌঁছল তখন বেশ ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। কলিংবেল
    টিপতেই জংলী এসে দরজাটা খুলে দিল। কিরীটী সোজা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির
    দু-চার ধাপ অতিক্রম করতেই সেতারে মল্লারের আলাপ তার কানে আসে। বুঝতে পারে, কৃষ্ণা এখনও
    ঘুমোয়নি। সেতার বাজাচ্ছে কৃষ্ণাই।

    কিরীটী ধীরে ধীরে সোপান অতিক্রম করতে থাকে। বসবার ঘরে মেঝেতে
    কার্পেটের উপর বসে কৃষ্ণা সেতার বাজাচ্ছিল।

    জানালা খোলা। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। এলোমেলো হওয়ায় জানালার
    পর্দা উড়ছে।

    কিরীটী নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একটা সোফার উপর বসল। কৃষ্ণা টেরও পায়
    না। সেতার বাজানোর মধ্যেই নিমগ্ন হয়ে থাকে।

    অনেকক্ষণ বাজাবার পর থামতেই, এতক্ষণে নজর পড়ে কৃষ্ণার কিরীটী বসে
    আছে সোফার উপরে।

    তুমি কতক্ষণ? কৃষ্ণা সেতারটা নামিয়ে রেখে শুধায়।

    অনেকক্ষণ।

    বস তুমি, খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। কৃষ্ণা উঠে পড়ে।

    আরে শোন শোন প্রিয়ে–কিরীটী পিছন থেকে কৃষ্ণাকে ডাকে।

    কী হল আবার? ফিরে দাঁড়ায় কৃষ্ণা।

    আচ্ছা কৃষ্ণা–

    কী?

    ভালবাসা কি অপরাধ?

    কেন? বুড়ো বয়সে কারো আবার প্রেমে পড়লে নাকি?

    বাঁকা চোখে তাকিয়ে স্মিত হাস্যে প্রশ্ন করে কৃষ্ণা।

    খুব যে দুঃসাহস দেখছি!

    তা একটু আছে বৈকি।

    এত বিশ্বাস!

    হুঁ।

    কথাটা বলে কৃষ্ণা আর দাঁড়ায় না। একটা গভীর কটাক্ষ স্বামীর প্রতি
    নিক্ষেপ করে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

    টীকা