Chapter Index

    অবনী সাহা বলছিল কিরীটীকে।

    ব্যাপারটা যদিও প্লেন ও সিম্পল সুইসাইড কেস বলেই সকলের ধারণা হয়েছে,
    তবু কেন যেন অবনী মনে মনে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করতে পারেনি।

    অথচ মনের কথাটা কাউকে খুলেও বলতে পারে না।

    হঠাৎ মনে পড়েছিল থানায় বসে কেসটার ডাইরী লিখতে লিখতে কিরীটীর কথা।

    সন্ধ্যাবেলা তাই সোজা চলে এসেছিল কিরীটীর ওখানে।

    কিরীটী তার বসবার ঘরে নিত্যকার মত দাবার ছক সাজিয়ে নিয়ে কৃষ্ণার
    সঙ্গেই খেলছিল।

    আগে আগে কৃষ্ণার ঐ দাবা খেলাটা আদৌ ভাল লাগত না, কিন্তু ইদানীং বোধ
    হয় দাবা খেলায় রস পেতে শুরু করেছিল সে।

    কিরীটী ডাকলেই বসে পড়ত টুলটা টেনে।

    কিরীটীর অবিশ্যি তাতে করে সুবিধাই হয়েছে।

    সে বলে, যাক, দাবাটা তাহলে নেহাত তোমার কাছে এখন একেবারে নিরস
    ব্যাপার বলে মনে হয় না কৃষ্ণা?

    না।

    কিন্তু কি করে এই অঘটন সম্ভবপর হল বল তো?

    কি করে আবার? সঙ্গদোষে?

    কৃষ্ণা হাসতে হাসতে বলেছে।

    যা বলেছ। সঙ্গদোষে সাধুও চোর হয়ে যায়।

    তা যায়, আবার চোরও সাধু হয়।

    কিন্তু এবারে তোমার মন্ত্রী সামলাও, বোড়ের চাল দিতে দিতে কিরীটী
    বলে।

    তার আগে এই নাও কিস্তি।

    আর ঠিক সেই মুহূর্তে শ্রীমান জংলীর আবির্ভাব, বাবু।

    কিরীটী বিহ্বলভাবে
    তখন কিস্তি সামলাতে ব্যস্ত।

    মুখ না তুলেই বললে, আজ্ঞা করুন—

    আজ্ঞে, অবনীবাবু এসেছেন।

    কিরীটী পূর্ববৎ খেলার দিকে নজর রেখে বলে, কোন্ অবনী—সেন,
    চাটুয্যে, বাঁড়ুজ্যে, মিত্তির, না সাহা–

    জিজ্ঞাসা করিনি তো!

    জিজাসা করে এস তা হলে।

    বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন আজ্ঞে।

    জবাব দিল এবারে কৃষ্ণা, বললে, হ্যাঁ। ঘরে নিয়ে আয়।

    জংলী বের হয়ে গেল।

     বেলেঘাটা থানার ইন্ডার্জ
    অবনী সাহা প্রবেশ করল একটু পরেই ঘরে।

    কি ব্যাপার? কিরীটী শুধায় এবং বলে, বসুন।

    একটু দরকার ছিল।

    কৃষ্ণা ততক্ষণে উঠে পড়েছে।

    কৃষ্ণা, দু কাপ চা–অবনীবাবু
    চলবে তো?

    আপত্তি নেই।

    কৃষ্ণা অন্দরে অদৃশ্য হল।

    পাইপটা ইতিমধ্যে নিভে গিয়েছিল। নতুন করে পাইপের গহ্বরে টোবাকো
    ঠাসতে ঠাসতে কিরীটী তাকাল অবনীর মুখের দিকে, মনে হচ্ছে যেন মিঃ সাহা, কোন জটিল
    সমস্যায় পড়েছেন?

    না,
    সেরকম কিছু না, তবে—

    তবে?

    আমার এলাকায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। অবিশ্যি কাল রাত্রে কোন এক সময়।
    ডিটেকটেড হয়েছে আজ ভোর পাঁচটায়।

    কি ব্যাপার–খুনটুন
    নাকি?

    কিরীটী পাইপটায় লাইটারের সাহায্যে অগ্নিসংযোগ করল।

    আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্যি মনে হচ্ছে আত্মহত্যাই—এ কেস অফ সুইসাইড। তবে—

    আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার মনটা যেন একটু খুঁতখুঁত করছে।

    তাই।

    স্ত্রী না পুরুষ?

    স্ত্রী।

    বয়স কত?

    ওর স্বামীর স্টেটমেন্ট অনুযায়ী এই সাতাশ-আটাশ হবে।

    তাহলে বিবাহিত?

    হ্যাঁ।

    জংলী দু কাপ চা নিয়ে এল ট্রেতে করে ঐ সময়।

    একটা কাপ কিরীটী নিজে তুলে নিল, অন্যটা অবনীর দিকে এগিয়ে দিল,
    নিন।

    চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বলে, স্বামীটী কেমন? তার সঙ্গে
    কথাবার্তা হয়েছে?

    হয়েছে। সুশান্ত চ্যাটার্জি। ক্রিশ্চান, রেলের গার্ড, বেলেঘাটার কোয়ার্টারে
    থাকে। বাড়িতে কে কে আছে আর?

    স্ত্রী শকুন্তলা আজ বছর দুই থেকে নানা রোগে ভুগছিল, বেশীর ভাগ সময়ই
    শয্যাগত থাকত এবং ইদানীং মাস-তিনেক একেবারেই শয্যাশায়িনী হয়ে পড়েছিল। হাঁপানী রোগী
    বুড়ো বাপ, একটি বছর আষ্টেকের ছেলে, আর–

    আর?

    আর আছে মিত্ৰাণী বলে একটি মেয়ে।

    মেয়ে?

    হ্যাঁ–মানে
    তরুণী, এই বছর কুড়ি-একুশ হবে বয়েস। ঐ শকুন্তলারই দূর-সম্পৰ্কীয় বোন। ওঁকে আবার
    শকুন্তলা নিজের সুবিধার জন্যই সংসারে নিয়ে এসেছিল। তারও সংসারে কেউ নেই, কাকার
    গৃহে আশ্রিতের মত একধারে পড়েছিল।

    হুঁ। তাহলে দুর্ঘটনার মধ্যে এক তরুণীও আছে! তা দেখতে কেমন
    মহিলাটি?

    মহিলাটি?

    হুঁ।

    মিত্ৰাণীর চেহারার একটা মোটামুটি বর্ণনা দেন অবনী সাহা।

    কালো, রোগা, ছিপছিপে…কিন্তু কালোর উপর একটা অপূর্ব আলগা শ্ৰী
    আছে যেন মুখে ও চেহারায় মেয়েটির। অবনী বলে।

    আর কিছু? কিরীটী শুধায়।

    মেয়েটির আর একটি গুণ আছে-চমৎকার সেতার বাজায়।

    আর? স্ব

    ভাব শান্ত। মুখে বড় একটা কথাই নেই কখনও।

    কিরীটী একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে, বল তাহলে, যাকে বলে
    নিঃশব্দচারিণী!

    কতকটা তাই।

    হুঁ,
    তা ঐ সুশান্তর সঙ্গে তার শ্যালিকার সম্পর্কটি কেমন?

    ঐখানেই তো আমার সন্দেহ!

    কি রকম?

    যদিও শকুন্তলাই বলে-কয়ে এনেছিল মিত্ৰাণীকে তার গৃহে-তারপর সে-ই হয়ে
    উঠেছিল ইদানীং একান্ত বিরূপ যেন ঐ মেয়েটির উপরে।

    খুব স্বাভাবিক। নারীচরিত্র তো! সন্দেহ-তাই না?

    হুঁ।
    স্বামীকে সে সন্দেহ করতে শুরু করল, তাতেই অশান্তি ক্রমশঃ বেড়ে ওঠে।

    অবশেষে ঐ দুর্ঘটনায় ঐ পরিস্থিতি তো? কিরীটী বলে।

    হ্যাঁ–কিন্তু কথা হচ্ছে এখন ব্যাপারটা বাইরে থেকে সুইসাইড মনে
    হলেও আমার কিন্তু কিরীটীবাবু মনে হচ্ছে কেন যেন কোথায় একটা গোলমাল আছে।

    তা কি অসুখে ভুগছিলেন শকুন্তলা?

    সুরেন ডাক্তারের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম, তিনি বললেন-প্রথম দিকে
    ক্ষুতে ভুগছিলেন, পরে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ নিউরটিক–

    কি রকম?

    আসলে তাঁর মানে ডাক্তারের মতে কোন রোগই ছিল না, অথচ শকুন্তলা
    দেবীর ধারণা হয়ে গিয়েছিল, পা দুটো তার প্যারালিসিস হয়ে গিয়েছে। কোন শক্তি নেই পায়ে।
    হাঁটাচলা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সম্পূর্ণভাবে শয্যাশায়িনী হয়ে পড়েছিল।

    তারপর?

    সুরেন ডাক্তার তাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শকুন্তলা
    দেবীকে কিছুতেই বোঝাতে পারেননি যে তাঁর পায়ে কোন রোগ নেই। ইচ্ছা করলেই তিনি হাঁটতে
    পারবেন।

    মানসিক রোগ এক এক সময় এমনিই কঠিন হয় বটে। আচ্ছা অবনীবাবু—

    বলুন?

    সুশান্ত ও মিত্ৰাণীর মধ্যে রিলেশানটা কেমন?

    যতদূর জানতে পেরেছি খুব প্রীতির এবং স্নেহের। শ্যালিকা ও
    ভগ্নীপতির যেমন হয়।

    হুঁ।
    তা মিত্ৰাণীর জবানবন্দি থেকে কিছু জানা গেল না?

    অবনী প্রশ্ন করেছিলেন নানাভাবে মিত্ৰাণীকে।

    আপনি তার সেবা-শুশ্রূষা
    করতেন?

    হ্যাঁ।

    যদিও ইদানীং মিত্ৰাণীকে একেবারে সহ্য করতে পারত না শকুন্তলা,
    তথাপি একমুহূর্ত মিত্ৰাণীকে না হলে চলতও না শকুন্তলার।

    কেবলই থেকে থেকে ডেকে উঠত,-মিতা-মিতা—

    মিত্ৰাণী ছুটে ছুটে আসত, ডাকছিলে দিদি?

    কি করা হচ্ছিল মহারাণীর? গলা চিরে গেল ডেকে ডেকে–সাড়া নেই—

    দুধ এনে দেবো, খাবে?

    দুধ! এক বাটি বিষ এনে দাও। তাই তো মনে মনে চাইছ তোমরা
    সর্বক্ষণ—কখন এ আপদ মরবে!

    মিত্ৰাণী মৃদু মৃদু হেসেছে।

    গায়ে মাখেনি কোন তিরষ্কার মিত্ৰাণী তবু।

    দুধ এনে বলেছে, খেয়ে নাও দিদি দুধটা।

    আগে ঐ বিড়ালকে একটু দে ঐ দুধ থেকে, তারপর খাব। কই, দে!

    ভয় নেই তোমার, এতে বিষ নেই।

    যা বলছি তাই শোন।

    শেষ পর্যন্ত বিড়ালকে দুধ খাওয়াবার পর তবে সেই দুধ খেয়েছে
    শকুন্তলা।

    কখনও আবার জিজ্ঞাসা করেছে, কাল সারারাত ধরে অত ফুসুরফুসুর কার
    সঙ্গে করছিলি?

    কার সঙ্গে আবার করব? মিত্ৰাণী বলেছে।

    ঢাকবার চেষ্টা করিস না মিতা, তোর জামাইবাবুর সঙ্গে আমি জানি
    সারারাত কথা বলেছিস!

    জামাইবাবুর তো কাল নাইট-ডিউটি ছিল।

    দেখ, মিথ্যা বলিস না। আমি জানি ও কাল ডিউটিতেই যায়নি।

    মিত্ৰাণী আর কি বলবে, চুপ করে থেকেছে।

    চুপ না করে থাকা ছাড়া আর উপায়ই বা কি!

    তারপর? কিরীটী শুধায়।

    অবনী বলল, এ ধরনের টচারের একটা সীমা আছে। তাই আমার মনে হয়—হয়ত ঐ
    সুশান্ত, শকুন্তলার স্বামী, শেষ পর্যন্ত ডেসপারেট হয়ে–

    নিজের স্ত্রীকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে।

    অসম্ভব কি কিছু?

    না,
    তা নয়। তবে—

    কি?

    অবনী কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

    আচ্ছা এখন সুশান্তবাবুর ওখানে গেলে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে?

    পারে। কারণ আমি তাকে দুদিন বাড়িতেই সর্বক্ষণ থাকতে বলে এসেছি।

    তবে চলুন না একবার সুশান্তবাবুর ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক।

    বেশ তো চলুন।

    টীকা