Chapter Index

    ঘরের
    মধ্যে এখন দুজন।

    কিরীটী ও অতীনলাল সলিসিটার।

    কিরীটীবাবু! এতক্ষণে সর্বপ্রথম অতীনলাল কিরীটীর দিকে তাকিয়ে সম্বোধন
    করলেন ওকে। দুজনেরই পূর্ব-পরিচয়
    ছিল, কিন্তু এতক্ষণ কেউ সেটা প্রকাশ করেননি।

    গতকাল নায়েব বসন্ত সেনের মুখে অতীনলাল বোস সলিসিটারের নাম শোনা
    অবধিই কিরীটী ভাবছিল এ কোন অতীনলাল এবং আজ সলিসিটারের আসার সংবাদ পেয়ে এই ঘরে
    প্রবেশ করেই অতীনলালকে দেখে বুঝতে পেরেছিল ইনি তার পরিচিতই।

    বলুন?

    ব্যাপারটা যেন একটু ঘোরালই মনে হচ্ছে!

    একটু
    নয়, বেশই ঘোরাল মিঃ বোস। মৃদুকণ্ঠে
    কিরীটী জবাব
    দেয়।

    উইলটা পড়া সম্পর্কে কি করা যায় বলুন তো?

    উইলের বিষয়বস্তু আপনার জানা আছে তো?

    না।
    মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর এটা নতুন উইল। মাস দেড়েক আগে পূর্বের উইলটা বদলে তিনি এই নতুন উইলটা
    করেছিলেন। এ উইলটা যখন লেখা হয় আমি উপস্থিত ছিলাম না। ফেডারেল কোর্টে একটা মামলায়
    আমাকে দিল্লী যেতে হয়েছিল—আমার সিনিয়ার পার্টনার উইলটা করে দেন। হঠাৎ তিনি অসুস্থ
    হয়ে পড়ায় আমাকে উইলটা নিয়ে আসতে হয়েছে।

    হ। আচ্ছা একটু
    আগে যে বলছিলেন—মৃত্যুঞ্জয়বাবু
    নিহত হবার দিন আষ্টেক আগে যে জরুরী চিঠিটা লিখেছিলেন, সে চিঠিটা কি সঙ্গে এনেছেন?

    হ্যাঁ। দেখতে পারি কি চিঠিটা?

    এই যে, অতীনলাল তাঁর পোর্টফোলিওটা খুলে একটা লেফাপা বের করে তার
    ভিতর হতে একটা মুখ-কাটা রেজিস্ট্রী খাম বের করে দিলেন।

    কিরীটী চিঠিটা খাম থেকে টেনে বার করল। চিঠিটা বোসের সিনিয়র
    পার্টনারকেই লেখা। এবং তারিখ দেখেই বোঝা যায় নিহত হবার ঠিক নদিন পূর্বে চিঠিটা মৃত্যুঞ্জয়
    লিখেছিলেন।

    চিঠিটা অবশ্য সংক্ষিপ্ত। চিঠিতে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে, তিনি
    একটা শিলমোহর
    করে চিঠি তাঁর মেয়ের নামে লেফাপার মধ্যে রেখে গেলেন; সেই চিঠিটা তাঁর মেয়ে না পড়ার
    আগে যেন কোনমতেই উইল পড়ে শোনানো না হয় তাকে।

    যাই হোক মৃত্যুঞ্জয়
    চৌধুরী লিখিত এই চিঠি ও লেফাপার মধ্যে শিলমোহল করে যে গোপন চিঠি তিনি লিখে গিয়েছেন
    এবং মাত্র মাস দেড়েক আগে আবার নতুন করে উইল করার ব্যাপারে পূর্বের উইল বদল করে এ সব কিছু হতে একটা কথা
    কিরীটীর মনে স্বতই উদয় হয়, গত মাস-দুয়ের মধ্যে এমন কোন ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছিল যা
    মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে যথেষ্ট বিচলিত করেছিল।

    এবং যে কারণে তাঁকে উইল পর্যন্ত বদলাতে হয়েছিল। চিঠিটা পড়ে কিরীটী
    সেটা অতীনলালের হাতে আবার ফেরত দেয়।

    পূর্বের
    উইলে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী কিভাবে তাঁর সম্পত্তির ব্যবস্থা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছিলেন
    আপনার মনে আছে কি মিঃ বোস?

    আছে, তবে details তো মনে নেই।

    তবু
    বলুন তো, শুনি?

    দুই ভাগে সম্পত্তি ভাগ করা হয়েছিল—এক অংশ তাঁর মেয়ে সবিতা দেবী
    পাবেন। বাকী অর্ধেকের অর্ধাংশ যদি তার জাঠতুত ভাই রামশঙ্কর চৌধুরীর ছেলে সন্তোষ চৌধুরী ফিরে আসেন তো তিনি
    পাবেন, এবং অবশিষ্ট পাবেন সৌদামিনী দেবী বা তস্য পুত্র ধনঞ্জয়।

    সৌদামিনী ও তস্য পুত্র ধনঞ্জয়—এরা কে?

    তা ঠিক বলতে পারি না।

    পূর্বের
    উইলে ওঁদের সম্পর্কে তাঁর কোন নির্দেশ বা পরিচিতি তো ছিল না?

    আপনাকে বা আপনার সিনিয়র পার্টনারকেও ওঁদের পরিচয় দেননি?

    আমি বা আমার পার্টনার কেউই জানি না, তবে বলেছিলেন মিঃ চৌধুরী যে
    সময়মত সে সব ব্যবস্থাই তিনি করে যাবেন।

    কিরীটী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কি যেন ভাবে এবং সহসা একটা কথা মনে পড়ায়
    আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ বোস
    বলতে পারেন মৃত্যুঞ্জয়
    চৌধুরী যে তাঁর পূর্বেকার
    উইল বদল করে আবার নতুন উইল তৈরী করেছিলেন, এ সংবাদ বসন্তবাবু জানতেন কিনা?

    মনে হয় জানতেন, কারণ
    প্রথমবারের উইলে বসন্তবাবু,
    একজন সাক্ষী ছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয়বারের উইলে শুনেছি আমার সিনিয়রের মুখেই, বসন্তবাবু, সাক্ষী হিসাবে নামসই
    করেননি। তবে মৃত্যুঞ্জয়বাবু
    যদি বসন্তবাবুকে বলে থাকেন পরে এক সময়ে সেটা অবশ্য বলতে পারি না।

    দ্বিতীয়বারের ঐ নতুন উইল সম্পর্কে আপনার কোন idea নেই তাহলে?

    না।

    ও সম্পর্কে কোন কথা আপনার সিনিয়রও কোন দিন আপনাকে বলেননি?

    না।

    কখনও সামান্য discussion-আলোচনাও হয়নি?

    না।

    ভৃত্য প্লেটে করে চা-জলখাবার নিয়ে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

    ঐদিনই দ্বিপ্রহরে কিরীটী তার ঘরে সবিতাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। প্রয়োজনীয়
    কিছু আলোচনা ছিল সবিতার সঙ্গে ওর।

    আজ রাত্রে আপনি যে ঘরে ও যে শয্যায় শোন, সে ঘরে ও সেই শয্যায়
    আপনার শোয়া চলবে না সবিতা দেবী। কিরীটী বলে।

    কেন?

    এখন কোন প্রশ্নই আপনি আমাকে অনুগ্রহ করে করবেন না সবিতা দেবী ও
    সম্পর্কে। সময়ে সবই আপনি জানতে পারবেন।

    কিন্তু

    এইটুকু শুধু বলতে পারি, যে ব্যবস্থা আমি করছি সব কিছু বিবেচনা
    করেই আমাকে করতে হচ্ছে, এবং এর চাইতে বেশী কিছু খুলে বলা বর্তমানে আমার পক্ষে
    সম্ভব নয় সবিতা দেবী।

    বেশ, তাই হবে। কিন্তু কোন ঘরে শোব রাত্রে?

    আপনার বাবার ঘরে। আর এ কথাটা যেন কেউ জানতে না পারে, এমন কি কল্যণী
    দেবী বা সত্যজিৎবাবুও
    না।

    কিন্তু বুঝতে পারছি না মিঃ রায়, একই বাড়িতে ওদের সকলের সঙ্গে থেকে সকলের অজ্ঞাতে অন্য ঘরে শোওয়া
    কেমন করে আমার পক্ষে সম্ভব হতে পারে!

    কোন কৌশলে বুদ্ধি খাটিয়ে সামান্য কাজ সম্পন্ন করতে আপনি পারবেন না
    সবিতা দেবী?

    সবিতার মুখের দিকে তাকিয়েই কিরীটী বুঝতে পারে, সবিতা ওর প্রস্তাবে
    সত্যিই একটু
    বিহ্বল
    হয়ে পড়েছে।

    শুনুন সবিতা দেবী, যেমন usual আপনি ঘরে শুতে যান শুতে যাবেন নিজের
    ঘরে, তারপর
    রাত্রে কোন এক সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে ছাদের দরজা খুলে ছাদ দিয়েই পাশের আপনার বাবার ঘরে গিয়ে
    শোবেন। বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলতে চাই?

    হ্যাঁ। মৃদু
    নিরুৎসুক কণ্ঠে জবাব
    দেয় সবিতা।

    আর একটা কথা সবিতা দেবী

    বলুন।

    সৌদামিনী ও তাঁর পুত্র ধনঞ্জয়—এদের আপনি চেনেন?

    কই, ও নাম দুটো কখনও শুনেছি বলেও তো আমার মনে পড়ছে না!

    মনে করে দেখুন তো! আপনার কোন দূর-সম্পর্কীয়
    আত্মীয় বা

    না,
    ও নাম দুটো জীবনে কখনও শুনিনি।

    কখনও আপনার বাবার মুখে কোন আলোচনার মধ্যে?

    না।

    ভাল করে আর একবার ভেবে দেখুন সবিতা দেবী!

    না,
    কখনও ও দুটো নাম শুনিনি কারো মুখেই।

    কানাইয়ের মার মুখেও নয়?

    না।
    কিন্তু কেন বলুন তো?

    ওই দুটি নামের পরিচয় আমার জানা একান্ত আবশ্যক সবিতা দেবী। আচ্ছা
    এবারে আপনি
    যেতে পারেন সবিতা দেবী। হ্যাঁ ভাল কথা, দুটো দিন অন্তত আপনি বাড়ি থেকে
    কোথাও বের হবেন না। এটিও আমার একটা বিশেষ অনুরোধ।

    বেশ।

    সবিতাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী চটপট প্রস্তুত হয়ে নিল, এখনি একবার
    থানায় যেতে হবে। লক্ষ্মীকান্তর
    সঙ্গে কথা আছে।

    কিরীটী থানায় গিয়ে পৌঁছাল
    যখন, বেলা তখন প্রায় তিনটে।

    লক্ষ্মীকান্ত
    বাইরে অফিস ঘরেই ছিলেন, কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে আহ্বান জানালেন, আসুন কিরীটীবাবু,
    বসুন।

    কিরীটী নিঃশব্দে উপবেশন
    করল। বললে, বসন্তবাবুর কোন খোঁজ পেলেন মিঃ সাহা?

    না। তবে কলকাতায় ঘটনার বিবরণী ও বসন্ত সেনের full description দিয়ে
    special branch-এ জরুরী
    তার করে দিয়েছি। যে কোন মুহূর্তেই
    সংবাদ একটা কিছু আশা করছি।

    আমার মনে হয় দু-চার দিনের মধ্যে হয়ত বসন্তবাবু, নিজেই ফিরে এসে ধরা দেবেন মিঃ সাহা!

    হুঁ!
    আপনি তাই মনে করেন কিরীটীবাবু?
    আপনি জানেন না তাহলে ঐসব চরিত্রের লোকদের they are dangerous! প্রথম হতেই
    ব্যাপারটা আমি লঘু করে নিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি এত জটিলতা আছে ভিতরে। আফসোস হয়
    আমার—প্রথমেই ও লোকটাকে সন্দেহ করিনি কেন? প্রথমেই ওকে গ্রেপ্তার করলে হয়ত এতদিনে
    সব সুরাহা একটা হয়ে যেত

    ভাববেন না, সে যাবে কোথায় পালিয়ে, ধরা পড়বেই!

    সে আমিও জানি। তবে

    আপনি পরশু
    বলছিলেন, সন্তোষ চৌধুরীর নিকট অনেক কিছুই নাকি জানতে পেরেছেন!

    হ্যাঁ সন্তোষ চৌধুরী দুখানা
    চিঠি দেখাল মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর লেখা রামশঙ্করের কাছে।

    সে চিঠি দুটোতে কি লেখা ছিল আপনার মনে আছে কি মিঃ সাহা।

    সংসারের নানা কথা।

    সে চিঠির মধ্যে টাকা বা সম্পত্তির কোন কথা ছিল কি?

    না,
    সে ধরনের কোন কথাই ছিল বলে তো মনে পড়ছে না!

    কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

    আবার প্রশ্ন করে, কানাইয়ের মার কোন সংবাদ পেলেন মিঃ সাহা?

    না।
    চারিদিকে লোক তো পাঠিয়েছিলাম, কেউই কোন সংবাদ আনতে পারেনি।

    আপনার লোকদের বিলের চৌহদ্দিটা একবার ভাল করে খুঁজে দেখতে বলবেন তো!

    কেন বলুন তো?

    দেখুন না খোঁজ করে, কানাইয়ের মার সন্ধান না পেলেও, আর কারো সংবাদও
    তো পেতে পারেন!

    বেশ তো, এখনি লোক পাঠাচ্ছি। কিন্তু আপনার অনুসন্ধান কতদূর এগলো?

    কিরীটী তখন নিচুকণ্ঠে
    কতকগুলো কথা লক্ষ্মীকান্তকে
    বললে। কিরীটীর কথা শুনতে শুনতে লক্ষ্মীকান্ত
    বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং বলেন, আশ্চর্য! তাহলে তো আমার মনে হয়

    সন্তর্পণে এবারে আমাদের এগুতে হবে। He is desperate now! মরীয়া হয়ে
    এবারে হত্যাকারী তার শেষ attempt নেবেই—এবং সেই চরম মুহূর্তে আমরা red-hand ধরবো তাকে। আপনি প্রস্তুত
    থাকবেন। বিশেষ করে এই কথা বলবার জন্যই আমার এখানে আসা।

    ধন্যবাদ। আমি প্রস্তুত থাকবো।

    প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ কিরীটী সাইকেলে চেপেই আবার প্রমোদভবনে ফিরে এলো।

    সন্ধ্যা একসময় উত্তীর্ণ হয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার রাত্রি চারিদিকে ঘন
    কালো পক্ষ বিস্তার করে।

    ক্রমে রাত্রি বেড়ে চলে, নিস্তব্ধ হয়ে আসে চারিদিক।

    প্রমোদভবনের সকলের
    চোখে নেমে আসে ঘুমের ঢুলুনি।
    একটা কিছু ঘটনার প্রতীক্ষায়
    রাত্রির নিস্তব্ধ প্রহরগুলো কেটে যেতে থাকে কিরীটীর। কিন্তু কোন কিছুই ঘটলো না,
    ব্যর্থ প্রতীক্ষার
    ব্যাকুলতায় নিশি প্রভাত হলো।

    একটা অস্বাভাবিক গুমোট ভাব যেন সমস্ত প্রমোদভবনকে গ্রাস করেছে।
    চলাফেরা করে সব নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। কারো মুখেই কোন কথা নেই।

    এমনি করেই কেটে গেল সমস্ত দিন সূর্য গেল অস্তাচলে, সন্ধ্যার তরল
    ছায়া নেমে এল চারিদিকে, রাত্রিও আসন্ন।

    রাত্রি!

    রহস্যময়ী রাত্রি আসে তার কালো ওড়না মেলে ধরণীর বুকে শ্লথ মন্থর
    পদসঞ্চারে। রহস্যঘন আশঙ্কার পূর্বাভাস
    যেন রাত্রির ঘনিয়ে ওঠা স্তব্দতায়।

    গেটের পাশে ঝাউগাছগুলো বাস টানছে যেন থেকে থেকে কোন ক্লান্ত
    প্রেতাত্মার মতই। বৌরাণীর বিলের অথৈ কালো জল অন্ধকারে যেন ঘন জমাট বেধে আছে। কালো
    রহস্যঘন আকাশে তারাগুলো মিটিমিটি তাকাচ্ছে ভয়ে ভয়ে বুঝি।

    ঢং..ঢং…ঢং। রাত্রি তিনটে ঘোষিত হলো দেওয়াল-ঘড়িটায়।

    একটা চাপা পদশব্দ অন্ধকারে যেন মর্মরিত হয়ে উঠলো। কিরীটী
    প্রস্তুতই ছিল সত্যজিৎকে নিয়ে। চকিতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল।

    ঘরের মধ্যেও অন্ধকার। আলোটা আগেই নিবিয়ে রাখা হয়েছে।

    পা টিপে টিপে কিরীটী এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজার ঈষৎ ফাঁক দিয়ে কিরীটী বাইরের মৃদু আলোকিত
    বারান্দার দিকে দৃষ্টিপাত করল।

    শুনতে সে ভুল করে নি।

    কালো আংরাখায় আবৃত
    সেই দীর্ঘ মূর্তি,
    মুখের নিম্নাংশে কালো একটা রুমাল বাঁধা। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ঘরের দিকেই।

    কিরীটী আর মুহূর্তও
    বিলম্ব করে না। ক্ষিপ্র ত্বরিৎপদে ছাদের দরজা
    দিয়ে বের হয়ে ছাদ দিয়েই সবিতার শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করল। সবিতার ঘর ও মৃত্যুঞ্জয়
    চৌধুরীর ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা
    খুলে যেমন সে হাতের টর্চের
    আলো ফেলেছে ঘরের মধ্যে এবং চাপা দৃঢ়কণ্ঠে
    বলেছে, হাত তোল বন্ধু your
    game is up. আংরাখা-আবৃত মূর্তি
    শয্যাটার উপরে সবে ঘুমন্ত সবিতার উপরে দুই হাত প্রসারিত করে ঝুঁকেছিল, চকিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একলাফে দক্ষিণ
    দিকে সরে গেল এবং বিদ্যুৎগতিতেই যেন পরমুহূর্তে
    আর এক লাফে ছাদের দরজা
    দিয়ে বাইরে অদৃশ্য
    হলো।

    কিরীটী ও সত্যজিৎও লাফ দিয়ে মূর্তিকে অনুসরণ করে ছাদের দরজার দিকে ছুটে যায়। ছাদে এসে কিরীটী দেখলে মূর্তি ছাদের প্রাচীরের উপরে
    উঠে দাঁড়িয়েছে এবং চক্ষের পলকে নীচে লাফিয়ে পড়ল।

    দুজনেই ছুটে প্রাচীরের কাছে এল এবং প্রাচীরের উপরে উঠে নীচে ঝুঁকে দেখতে পেল, আবছা ছায়ার
    মত মূর্তিটা
    তখন নন্দনকাননের পথ ধরে ছুটছে।

    কিরীটী ও সত্যজিৎ কালবিলম্ব না করে পর পর দুজনেই নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
    আশ্চর্য, পায়ে তাদের এতটুকু লাগলো না, যেখানে তারা লাফিয়ে পড়েছে সেখানকার মাটি
    ঝরঝরে নরম ধুলোর
    মত।

    এ ব্যবস্থা তাহলে প্রয়োজনের খাতিরে পূর্বাহ্নেই করা ছিল।

    কিরীটী আগে আগে এবং পশ্চাতে ছুটলো সত্যজিৎ নন্দনকাননের দিকে। হঠাৎ
    মনে হলো যেন ঝপ করে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বার অস্পষ্ট একটা শব্দ পাওয়া গেল। শব্দটা
    কিরীটীর সতর্ক শ্রবণেন্দ্রিয়কে এড়াল না।

    কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ল। পশ্চাতে সত্যজিৎও।

    কেউ যেন জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো বলে মনে হল না? সত্যজিৎই প্রশ্ন করে।

    হ্যাঁ। কিন্তু চুপ! আস্তে! কিরীটী সত্যজিৎকে সতর্ক করে দেয় চাপা
    কণ্ঠে, চেয়ে দেখুন ঐ

    সত্যি! সত্যজিৎ কিরীটীর চাপাকণ্ঠের
    সতর্ক নির্দেশে সামনের অন্ধকারে জলের দিকে তাকিয়ে দেখল, নিঃশব্দ সাঁতারে কেউ একটা
    কালো সর্পিল
    রেখার মত এগিয়ে চলেছে প্রমোদভবনের প্রাচীরের দিকে।

    ওদিকে যাচ্ছে যে নিশ্চয়ই
    ওদিকে কোন গুপ্ত দ্বারপথ
    আছে—wait and see!

    অনুমান মিথ্যা নয়। দেখা গেল কে একজন প্রাচীর ঘেষে উঠে দাঁড়িয়েছে
    অন্ধকারেই ছায়ার মত জল থেকে।

    পরমুহর্তেই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল যেন প্রাচীরের মধ্যে আশ্চর্য
    মন্ত্রবলে!

    Now quick, follow me! বলেই কিরীটী জলে নামল।

    কয়েক মিনিটের মধ্যে দুজনে সাঁতরিয়ে প্রাচীরের সামনে এসে পৌঁছল।
    এবং ঐখানে জলের গভীরতা বুঝবার জন্য নিচে পা দিতেই জলের নিচে মাটি পায়ে অনুভব করে।
    এক কোমরও জল নয় ওখানে।

    সামনেই একটা ছোট দ্বারপথ-কপাটটা
    এখনও উন্মুক্ত আছে।

    সিক্ত অবস্থাতেই আগে আগে কিরীটী ও পশ্চাতে সত্যজিৎ সেই ছোট দ্বারপথ দিয়ে নিচু হয়ে কতকটা হামাগুড়ি
    দেবার মত করেই ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলে সরু
    একটি অপ্রশস্ত গলিপথ সামনে—অন্ধকার।

    বদ্ধ বায়ুর ভ্যাপসা গরমে গলি-পথটা যেন কালো মুখব্যাদান করে আছে।

    কোথায় গেছে এই গুপ্ত
    গলি-পথ! প্রমোদভবনের কোন অংশের সঙ্গে নিশ্চিত যোগাযোগ আছে এই গোপন গলি-পথের!

    সতর্ক পদসঞ্চারে দুজনে অগ্রসর হয়।

    কিছুটা অগ্রসর হবার পরই ক্ষীণ একটা আলোর শিখা অন্ধকারে যেন
    অনিশ্চিতের মধ্যে আশার হাতছানি জানায়।

    আরো অধিক সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলে কিরীটী।

    অগ্রসর হয় দুজনে। একটা কটু
    অ্যামোনিয়ার তীব্র গন্ধ যেন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে আসছে। নাক জালা করে।

    অশ্বের হ্রেষাধনি শোনা গেল। তবে কি ওরা আস্তাবলের দিকেই এগিয়ে
    চলেছে?

    হ্যাঁ, কয়েক পদ আর অগ্রসর হতেই দুজনে—প্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে
    সত্যজিৎ প্রমোদভবনের আস্তাবলের মধ্যে এসেই প্রবেশ করল।

    সামনেই পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অদূরে সেই মূর্তি। এক কোণে একটা আলো জ্বলছে। মূর্তি
    তার গা হতে ভিজে জামা-কাপড়গুলো খুলতে ব্যস্ত।

    চোখের ইশারায় কিরীটী সত্যজিৎকে বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে যাবার নির্দেশ
    দিয়ে নিজে ডান দিকে এগিয়ে যায়।

    হঠাৎ অসতর্ক সত্যজিতের পায়ের নিচে ঘরের মেঝেতে ইতস্তত ছড়ানো ঘোড়ার
    আহার্য চানার দানা পিষ্ট হবার মচমচ শব্দে চকিতে মূর্তি ফিরে ঘুরে দাঁড়ায়।

    গায়ের জামাটা খুলেছে মাত্র, মুখের রুমালটা এখনো খোলা হয়নি।

    ধকধক করে হিংস্র বাঘদের
    মতই লোকটার চোখের তারা দুটো জলে ওঠে একটা নিষ্ঠুর
    ক্রোধে।– আকস্মিক পরিস্থিতিটা কিরীটী মুহূর্তে
    উপলব্ধি করে নেয় এবং আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হবার পূর্বেই লোকটা চকিতে পা বাড়িয়ে ঠিক তার পায়ের
    নাগালের মধ্যেই অশ্বটায়
    প্রচণ্ড একটা লাথি মারে। ঝনঝন করে আলোর চিমনিটা ভেঙে গড়িয়ে যায়, মুহূর্তে ঘরটা নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে
    অবলুপ্ত হয়ে যায়।

    কিরীটী মুহূর্তের
    জন্য যেন বিহবল হয়ে পড়ে, কিন্তু পরক্ষণেই অন্ধকারে আন্দাজ করে সম্মুখের দিকে লাফিয়ে
    পড়ে।

    অন্ধকারেও কিরীটীর লক্ষ্য ব্যর্থ হয় না। লোকটাকে জাপটে ধরে।

    জড়াজড়ি করেই কিরীটী লোকটাকে নিয়ে মেঝেতে পড়েই চেচিয়ে ওঠে, সত্যজিৎবাবু, টর্চটা জালান!

    হতভম্ব সত্যজিৎ বিমূঢ়ের
    মত দাঁড়িয়েছিল অন্ধকারে।

    কিরীটীর আদেশে যেন সব্বিৎ ফিরে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই কোমরে ঝোলানো
    টর্চটার বোতাম টিপে আলো জলে।

    কিরীটীর বুঝতে বিলম্ব হয় না, যাকে আক্রমণ করেছে তার গায়ে শক্তি
    প্রচুর।
    যত করে মাটিতে চেপে ধরে তার বুকের ওপর উঠে বসবার চেষ্টা করে কিরীটী, কিন্তু সুবিধা
    করে উঠতে পারে না প্রতিপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী বলে।

    সহসা সত্যজিতের নজরে পড়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে একটা মোটা মত হাত দেড়েক
    কাঠের টুকরো। এগিয়ে গিয়ে কাঠটা তুলে নিয়ে সত্যজিৎ

    সুযোগ বুঝে লোকটার মাথায় একটা সজোর আঘাত হানে।

    একটা অস্পষ্ট যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে এবারে প্রতিপক্ষ এলিয়ে পড়ে
    নিস্তেজ হয়ে। হাত-পা এলিয়ে দেয়।

    বুঝতে পারে কিরীটী, মাথায় আঘাত পেয়ে ক্ষণেকের জন্য সংজ্ঞালোপ হয়েছে
    প্রতিপক্ষের।

    ঘরের কোণ হতে একটা মোটা দড়ি এনে অতঃপর ভূতলশায়ী সংজ্ঞাহীন লোকটার
    হাত বেধে তাকে বন্দী করতে ওদের বেগ পেতে হয় না।

    প্রতিপক্ষকে বন্দী করে কিরীটী যখন উঠে দাঁড়াল, গুরু পরিশ্রমে তখন সে
    হাঁপাচ্ছে।

    কে লোকটা!

    রহস্যের মেঘনাদ—মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যাকারী ক্লিষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয় কিরীটী সত্যজিতের
    প্রশ্নের।

    সত্যজিৎ বলে, সত্যি?

    হ্যাঁ।

    কৌতুহলভরে
    সত্যজিৎ এগিয়ে গিয়ে বন্দী সংজ্ঞাহীন ভূপতিত ব্যক্তির মুখ হতে কালো রুমালটা খুলে নিয়ে
    যেন ভূত দেখবার মত চমকে উঠে, এ কি,

    এ যে সহিস লছমন!

    হ্যাঁ, লছমনই বটে। তবে আসলে ও লছমন নামধারী মাত্র–ছদ্মনাম ওর ওটা।

    ছদ্মনাম?

    হ্যাঁ। কিন্তু লোকটাকে তো মনে হতো বড়ো অকর্মণ্য!

    সে-ও ওর ভেক ধারণ
    করা মাত্র। দেখতেই তো পেলেন ওর শক্তির বহর।
    কিন্তু এখানে আর নয়, চলুন বাইরে যাওয়া যাক। বাগানে দলবল নিয়ে লক্ষ্মীকান্ত
    অপেক্ষা করছেন। এ নাটকের শেষ দৃশ্যের এখনও বাকী।

    কিরীটী ও সত্যজিৎ বাগান অতিক্রম করে বারান্দার দিকেই অগ্রসর হতেই
    অন্ধকার হতে লক্ষ্মীকান্ত
    সামনে এসে দাঁড়ালেন, কিরীটীবাবু?

    মিঃ সাহা! কি ব্যাপার?

    চুপ,
    আস্তে, কানাইয়ের মা

    কানাইয়ের মা! এসেছে তাহলে?
    কিন্তু কোথায়?

    সন্তোষ চৌধুরীর ঘরে ঢুকেছে।

    টীকা