২০. নিত্যানন্দ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে
নীহাররঞ্জন গুপ্ত দ্বারানিত্যানন্দ
সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে বারান্দায় এসে উঠে দাঁড়ালেন।
সবি মা তুমি আছ, কিরীটীবাবু, আপনি আছেন—ব্যাপার বড় সাংঘাতিক হয়ে
দাঁড়িয়েছে। বসন্ত ভায়া থানায় ধরা না দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। দারোগাতো একেবারে
অগ্নিশর্মা। কাছারীতে কাজ করছিলাম, একেবারে মারমূর্তিতে গিয়ে হাজির
সংবাদ আমরাও পেয়েছি। ধীরকণ্ঠে কেবল কিরীটী কথাগুলো বলে।
পেয়েছেন? শুনেছেন সব?
হ্যাঁ, বসন্তবাবু
সবিতা দেবীকেও স্টেশন থেকে একটা চিঠি দিয়েছেন সব ব্যাপার জানিয়ে।
চিঠি?
হ্যাঁ, এই দেখুন। কিরীটী চিঠিটা সান্যালের হাতে তুলে দিল।
রুদ্ধ
নিঃশ্বাসে সান্যাল চিঠিটা পড়লেন।
কিন্তু বুঝতে পারছি না এরকম আহাম্মকের মত কাজ ওঁর মত একজন স্থির
বিবেচক লোক করতে গেলেন কেন?
পুলিশ তো এসব কথা বিশ্বাস করবে না, আর লক্ষ্মীকান্ত
দারোগা অত্যন্ত জঘন্য চরিত্রের লোক, সে তো কোনমতেই বিশ্বাস করবে না।
কেন?
এই সাধারণ
সহজ কথাটা বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়। পুলিশ বিশ্বাস করবেন না এ ব্যাপারে আমাদের কোন
হাত বা যোগসাজস নেই। তাদের ধারণা আমরাই বসন্ত ভায়াকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছি। সে কোথাও যায়নি।
কিন্তু বাবা, লক্ষ্মীকান্ত
দারোগাকেও নায়েবমশায় আলাদা চিঠি দিয়ে গিয়েছেন, লিখেছেন, কথাটা বললে কল্যাণী।
চিঠি লিখে রেখে গিয়েছে–
পুলিশের জাতও এমনি, ওসব চিঠির কথা বিশ্বাস করবে মনেও স্থান দিও না। সন্দিগ্ধ মন
ওদের সবেতেই ওরা সন্দেহ করে। স্টেশন পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। সেখানে স্টেশন মাস্টার
পর্যন্ত নাকি বলেছে কলকাতাগামী ঐ সময় একটা ট্রেন ছিল কিন্তু ট্রেনটার স্টেশনে
stoppage পর্যন্ত নেই, প্রথম শ্রেণীর প্যাসেঞ্জার এবং বিশেষ জরুরী প্রয়োজন বলিয়ে
স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে আগের জংশনে ফোন করিয়ে গাড়ি থামিয়ে সেই গাড়িতে নাকি বসন্ত
সেন চলে গেছেন। লক্ষ্মীকান্ত
সাহা স্টেশন মাস্টারের কথা পর্যন্ত বিশ্বাস করেনি, ছুটে ঐখান থেকেই কাছারীতে গিয়ে
হাজির হয়েছে। কাছারীতে সব ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, প্রত্যেকটি লোককে জিজ্ঞাসাবাদও
করেছে।
হুঁ।
তাহলে দারোগা সাহেবের ধারণা বসন্তবাবুর
কলকাতায় যাওয়ার জন্য ট্রেনে চাপাটাও
চোখে ধূলো দেবার জন্যই?
কথাটা যেন আবার বলে কল্যাণীই।
তা না হলে আর বলছি কি! এখানেও সে আসবে না ভাব! এলো বলে!
তা সেজন্য এত চিন্তারই বা কি আছে সান্যালমশাই। আসুন না তিনি।
স্বচক্ষে এসে দেখেই যান না হয়। মনের মধ্যে সন্দেহ একটা পুষে রাখার চাইতে সন্দেহটা
মিটিয়ে নেওয়াই তো ভাল। জবাব
দেয় কিরীটী মৃদু
হাস্যতরল কণ্ঠে।
এদিকে আরো একটা মুস্কিল
হয়ে গিয়েছে যে মা সবিতা! এবারে সান্যাল এতক্ষণ নির্বাক স্থাণুর মত দণ্ডায়মান সবিতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
কাছারীতে গিয়ে আমি সব কাজকর্ম দেখতে যাওয়ায় নানা প্রশ্ন সব শুরু হল। বাধ্য হয়েই কতকটা তাই আমাকে প্রকাশ
করতে হল, বসন্তকে থানায় গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছে। যেই না ওই কথা আমার মুখ থেকে
শোনা, সঙ্গে সঙ্গে অমনি চারিদিক থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুরু হয়ে গেল। কেন, কি বৃত্তান্ত, সাত-সতের। দয়াময় এ বৃদ্ধ বয়সে কি
যে ঝামেলার মধ্যে এনে আমাকে ফেললেন! জীবনে মিথ্যার আশ্রয় আজ পর্যন্ত নিইনি। মিথ্যা
বলি কি করে! বাধ্য হয়েই সব খুলে বলতে হল। আর কি বলবো, শুরু হয়ে গেল কর্মচারীদের মধ্যে যত কল্পনা আর
জল্পনা। নানা ধরনের প্রশ্ন, মিথ্যা কথা তো বলতে পারবো না, পালিয়ে এলাম। কি করি এখন
বল তো মা?
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন সান্যাল সবিতার মুখের দিকে।
সবিতার কানে কিন্তু সান্যালের অত বড় দীর্ঘ বক্তৃতার কিছুই প্রবেশ করেনি।
সে তখন হতে বসন্ত সেনের পত্রটা পাওয়া অবধি পত্ৰমধ্যে বসন্ত সেন
লিখিত কথাগুলোই ভাবছিল। মনের মধ্যে তার তোলপাড় করে ফিরছিল চিঠির কথাগুলোই।
কিরীটীকে চলে যাবার জন্য অনুরোধ জানাতে বিশেষ করে লিখেছেন বসন্ত
কাকা। লিখেছেন তিনি, সেই মহাত্মার
প্রতি যদি তার এতটুকু সম্মান, শ্রদ্ধা বা কর্তব্য থাকে তাহলে যেন তাঁর পিতার
মৃত্যু-রহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপার হতে সে নিবৃত্ত হয়। কয়েকদিন ধরে তার মনের মধ্যে যে একটা
সন্দেহের বিশ্রী কাঁটা খচখচ করছে, তারপর
পারিবারিক ইতিহাসে কোথায় যেন একটা জটিলতা জড়িয়ে আছে সেটা স্বভাবতই একদিন সকলে ভুলে গিয়েছিল, অতীতের
অন্ধকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল, এইভাবে খোঁচাখুচি করতে গেলে হয়ত অতীতের সেই বিস্মৃতিপ্রায় জটিল কাহিনী
দিনের আলোয় প্রকাশ হয়ে পড়বে। কেচো খুড়তে গিয়ে হয়ত গোখরো সাপ ফণা তুলে বের হয়ে
আসবে—হানবে মৃত্যু ছোবল।
তবে কি সে কিরীটীকে বিদায় দেবে?
কিন্তু কেমন করে? কেমন করে এখন সে বলবে কিরীটীবাবুকে যে আপনি ফিরে
যান মিঃ রায়?
কিন্তু কিরীটীবাবু এখন ফিরে গেলেই কি সব চাপা যাবে? সবাই সব কথা যাবে ভুলে?
না, তা আর তো হবে না। কেউ কোনদিন ভুলবে না, ভুলতে পারে না। মুখে না বললেও ইঙ্গিতে
হাবেভাবে প্রকাশ করবে। প্রকাশ না হলেও আড়ালে মুখ টিপে হাসাহাসি করবে, তার
চাইতে সত্য যা প্রকাশ হোক। সংশয়ের এ পীড়ন থেকে মুক্তি হোক। সত্যিই যদি পারিবারিক
কোনও কলঙ্ক
তাদের থেকেই থাকে জানুক
সকলে।
ধনী জমিদারদের বংশে অমন কত কলঙ্ক থাকে। অপমানের ভয়ে লজ্জার ভয়ে আজ তাকে এড়িয়ে
গেলেই তা
থেকে মুক্তি মিলবে না। পাপের, অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত যে করতেই হবে পূর্বপুরুষদের পরবর্তী
বংশধরদের।
হ্যাঁ, যদি কোন পাপ থেকেই থাকে তার পিতার, কন্যা সে তার প্রায়শ্চিত্ত করবে। ভয়
পাবে না সে। সত্যকে সে অস্বীকার
করবে না। বংশের কোন অজ্ঞাত পাপ যদি তাকে স্পর্শ করেই থাকে, ফলভোগ তাকে করতে হবে
বৈকি। কিন্তু সত্যজিৎ, সত্যজিৎকে যদি হারাতে হয়? হারাতে হয় হারাবে। সত্যের জন্য কর্তব্যের
জন্য দিতে যদি হয়ই, যদি হয়ই আবশ্যক, দেবে সে তার প্রেমকে বলিদান। কঠিন প্রতিজ্ঞায়।
সবিতা নিজেকে দৃঢ়
করে তোলে। এবং এতক্ষণে কতকটা যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সান্যালের দিকে
তাকিয়ে প্রশান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কি বলছিলেন মামাবাবু?
বলছিলাম বসন্তের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে কাছারী ও অফিসের
কর্মচারীদের মধ্যে বিশ্রী একটা সন্দেহ জেগেছে। মৃদুকণ্ঠে বললেন সান্যাল।
সেটা তো খুব স্বাভাবিক মামাবাবু। এ ধরনের ব্যাপারে ওরকম একটুআধটু গোলমাল
হৈচৈ হয়েই থাকে। এজন্য বিচলিত হলে তো আমাদের চলবে না। কালকে আপনার সঙ্গে আমিও
একবার কাছারী ও অফিসে
যাবো।
তুমি? তুমি যাবে? না, না—তার কোন প্রয়োজন হবে না। শক্ত হতে আমিও
জানি। আমি দেখছিলাম কেবল আজ ব্যাটাদের দৌড়। বিকেলের দিকে গিয়ে সব ঠিক করে দিচ্ছি। মুহূর্তে নিত্যানন্দের কথার ধাঁচ
পর্যন্ত পাটে গেল। কণ্ঠের সুর গেল বদলে।
ইতিমধ্যে সকলের
পশ্চাতে সন্তোষ
চৌধুরী যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে এবং ওদের সকল আলাপ-আলোচনাও শুনেছে ধৈর্যের সঙ্গে
নিঃশব্দে, ওরা কেউ টেরই পায় নি, এমন কি ওর উপস্থিতিটা পর্যন্ত। এতক্ষণে সন্তোষ চৌধুরী কথা বললে, সবিতা,
তোমার যদি আপত্তি না থাকে—তুমি যদি আমার সম্পর্কটা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা না করো—
উপস্থিত সকলেই
বক্তা সন্তোষ চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকাল। সন্তোষ চৌধুরীর কথা তখনও শেষ হয় নি, সে বলছিল, আমিও নায়েব
ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে গিয়ে উপস্থিত থেকে সব দেখাশোনা করতে পারি।
না, না—তোমার মানে আপনার এখন এসব ব্যাপারে না যাওয়াই ভাল সন্তোষবাবু। প্রতিবাদটা জানালেন
নিত্যানন্দ সান্যাল।
কেন? ক্ষতি কি তাতে? ভ্রূকুটি-কুটিল
দৃষ্টিতে
তাকায় সন্তোষ চৌধুরী সান্যালের দিকে।
বুঝলেন না এটা? এখনও তো এ বাড়ির সঙ্গে আপনার কোন সম্পর্কই
প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এতে করে আরো হয়ত ব্যাপারটা জটিল হয়েই উঠবে।
আমি এই বাড়িরই ছেলে। এখন আমিই বলতে গেলে সবিতার সব চাইতে নিকটতম
আত্মীয়-ঝামেলার কোন কথাই তো এতে উঠতে পারে না।
আহা, আপনি ঠিক বুঝছেন না! আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
বক্তব্যের শেষাংশটুকু সান্যাল পার্শ্বেই দণ্ডায়মান কিরীটীর দিকে
ফিরে তাকিয়ে শেষ করলেন।
আপনাদের ঘরোয়া পারিবারিক ব্যাপারের মধ্যে আমার মতামত দেওয়াটা ঠিক শোভন
হবে না সান্যাল মশাই। মৃদুকণ্ঠে
কিরীটী জবাব
দেয়।
কারোরই কিছু করতে হবে না মামাবাবু। নায়েব কাকা ফিরে না আসা পর্যন্ত—যতদিন
না সব গোলমাল মেটে, দেখাশোনা সব আমিই, হ্যাঁ-আমিই করবো। দৃঢ় সতেজ কণ্ঠে সবিতা বলে।
তুমি দেখবে! পাগলী! এসব ব্যবসা জমিদারীর ব্যাপার কি তুমি বুঝবে? কিছু তোমায়
ভাবতে হবে না মা। আমি যখন এসে উপস্থিত হয়েছিই
না মামাবাবু,
আপনাকে আর কষ্ট দেব না। বুড়ো
মানুষ আপনি কটা দিন এখানে থাকলেই
মনে বল-ভরসা পাব। যা দেখবার আজ থেকে আমি দেখবো। বলে উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিল,
বনমালী-বনমালী!
সবিতার ডাকে সাড়া দিয়ে বনমালী এসে হাজির হল, আমাকে ডাকছিলেন
দিদিমণি?
হ্যাঁ, লছমনকে স্টেশনে পাঠিয়ে দে, টমটমটা নিয়ে আসুক। বিকেলে আমি
কাছারীতে যাবো–
বনমালী চলে গেল।
এবার সবিতা কিরীটীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, মিঃ রায়, দয়া করে যদি
আপনি এখন আমার ঘরে একবার আসেন উপরে। আপনার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা ছিল।
আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে অতঃপর দৃঢ় সংযত পদবিক্ষেপে রাজেন্দ্রণীর মতই অন্দরের
দিকে এগিয়ে গেল। সকলে
বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে অপলক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সবিতার গমনপথের দিকে।
আড়চোখে এবার তাকাল কিরীটী সান্যালের মুখের দিকে, প্রশান্ত
মুখমণ্ডল প্রসন্ন হাসিতে যেন ঝলমল
করছে।
কোথায়ও মুখের মধ্যে এতটুকু বিরাগ বা আক্রোশের চিহ্নমাত্রও নেই।
কিরীটী অগ্রসর হলো ভিতরে যাবার জন্য।
প্রভু! তোমার লীলা দয়াময়। মা কল্যাণী, উপাসনার একটু আয়োজন করে দেবে চল তো মা
জননী! নিরাকার পরম ব্রহ্ম কোন পথে যে কখন আমাদের চালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন তা তিনিই
জানেন। ব্রহ্ম কৃপাহি কেবলম।
নিত্যানন্দ ভিতরের দিকে পা বাড়ালেন। কল্যাণী অনুসরণ করল পিতাকে।
কেবল স্তব্ধ
নির্বাক সন্তোষ একাকী পাথরের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সবিতা তার নিজের ঘরে একটা আরামকেদারার উপরে হেলান দিয়ে। অর্ধশায়িত ভাবে চোখ বুজে
নিঃশব্দে পড়েছিল, কিরীটীর পদশব্দ দোরগোড়া পর্যন্ত এলেও তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ
করল না। টের পায় না সে।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে
ডাকল, সবিতা দেবী!
চোখ মেলে তাকাল সবিতা, ওঃ মিঃ রায়, আসুন ভিতরে আসুন— বলতে বলতে সবিতা কেদারাটা ছেড়ে
উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করতেই সবিতা ভিতর থেকে ঘরের দরজাটায় খিল তুলে বন্ধ করে
দিল।
বসুন
মিঃ রায়। দুজনেই উপবেশন
করে মুখোমুখি দুটো কেদারায়।
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা।
কিরীটী পকেট হতে একটা সিগার বের করে অগ্নিসংযোগ করল।
নায়েব কাকার চিঠিটা পড়লেন তো মিঃ রায়?
কিরীটী সবিতার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললে, হ্যাঁ। শুধু, চিঠিতেই আপনাকে বসন্তবাবু, আমাকে এ ব্যাপারে নিবৃত্ত করতে বলেননি, আজ সকালে
যাবার সময় নিজেও আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ফিরে যাবার জন্য।
হুঁ।
আপনি—আপনি তাতে কি জবাব
দিয়েছেন?
বলেছি আপনি আমাকে নিযুক্ত করেছেন, আপনি বললেই আমি চলে যেতে পারি।
এখন আমার থাকা না-থাকাটা অবশ্য আপনার উপরেই নির্ভর করছে। তা আপনি কি বলেন?
আমি!
হ্যাঁ।
শুনুন
মিঃ রায়, যত বড় দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপারই হোক না কেন, এর শেষ আমি দেখতে চাই। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বেশ।
কিন্তু একটা কথা মিঃ রায়—
বলুন?
সত্যিই কি আপনি মনে করেন এ রহস্য আপনি উঘাটন করতে পারবেন?
আমি আপনার এখানে এসেছি দিন পাঁচেক মাত্র। আর পাঁচটা দিন আমাকে সময়
দিন সবিতা দেবী।
আর পাঁচ দিনের মধ্যেই?
বিস্মিতা সবিতা তাকাল কিরীটীর মুখের প্রতি।
হ্যাঁ। পাঁচদিন বলছি, হয়ত তা নাও লাগতে পারে। তবে তার বেশী প্রয়োজন
হবে বলে মনে হয় না। ভাল কথা, সত্যজিৎবাবুকে দেখছি না যে?
সদরে
তিনি ম্যাজিস্টেটের
সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন।
আপনার একটু
আগেকার দৃঢ়তায় আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি সতি দেবী। এবং আপনি জানেন না, অজ্ঞাতেই
সম্পূর্ণভাবে
আপনি সমস্ত পরিস্থিতিরই একটা আকস্মিক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তারপর কতকটা যেন অস্ফুট আত্মগতভাবে বলে, I wanted
this! I wanted_now I am to see and wait!
কি বললেন?
না,
কিছু না। আচ্ছা আমি নিচে যাচ্ছি। কিরীটী ঘরের দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। এবং সিঁড়ি দিয়ে নামতে
নামতে অস্ফুটভাবেই
পূর্বের
মত বলতে থাকে, I hear the foot-steps! আসবে—এবারে সে আসবে।
স্বপ্লেখিতের মতই যেন অকস্মাৎ কিরীটীর সমস্ত চেতনা, অনুভূতি সজাগ
হয়ে উঠতে শুরু করেছে। চিন্তার ঘন কুজ্ঝটিকা-জাল
একটু একটু
করে মুক্তির আলোকসম্পাতে দূরীভূত হতে শুরু করেছে।
আর দেরি নেই।
রাত্রি কত হবে?
হাত-ঘড়িটার দিকে একবার তাকাল কিরীটী, পৌনে এগারটা।
অত্যন্ত ক্ষিপ্তহস্তে কিরীটী সুইমিং কস্টিউমটা পরে নিয়ে তার উপরে ধুতিটা মালকোঁচা দিয়ে
পরিধান করে নিল।
মাথায় এঁটে
নিয়েছে সাঁতার দেবার একটা কালো রঙের রবারের তৈরি সুইমিং ক্যাপ। পায়ে রবার-সু।
ঘরের আলোটা কমিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে কক্ষ হতে বের হয়ে এলো কিরীটী দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে।
সত্যজিৎ সদর
হতে ফেরে নি। ঘরের মধ্যে সে তাই একাই ছিল।
এর মধ্যেই সমগ্র প্রমোদভবন যেন ঘুমের নিঃসীম অতলে তলিয়ে গিয়েছে।
পা টিপে টিপে সিঁড়ি-পথ অতিক্রম করে ভিতরের আঙ্গিনা পার হয়ে পূর্বদিনের ঘরের মধ্যেকার সেই পথ দিয়েই
নন্দনকাননে যাবার পথে এসে দাঁড়াল কিরীটী।
মাথার উপরে রাত্রির আকাশে শুক্লাত্রয়োদশীর চাঁদ। ক্ষীণ
চন্দ্রালোকে অদূরে
নন্দনকানন, দিগন্তপ্রসারী বৌরাণীর বিল কেমন যেন স্বপ্ন-বিহ্বল।
দ্রুতপদে কিরীটী নন্দনকাননে এসে পৌঁছল। পুবদিনের সেই স্থানটি চিনে
নিতে কিরীটীর কষ্ট হয় না। তারপর
ধীরে ধীরে জলের মধ্যে গিয়ে নামল।
গ্রীষ্মের রাত, বেশ গরম বোধ হচ্ছিল, বিলের শীতল জলে আকণ্ঠ ড়ুবিয়ে
শরীর যেন জড়িয়ে গেল। কিরীটী সন্মুখদিকে
দৃষ্টি রেখে দ্রুত হস্ত-সঞ্চালনে জল কেটে সাঁতরে চলল।
ক্ষীণ চন্দ্রকিরণস্নাত
বিলের জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কিরীটীর মনের মধ্যে কেমন যেন নেশা জাগে। মনে পড়ে
বঙ্কিমের চন্দ্রশেখরের প্রতাপ ও শৈবলিনীর চন্দ্রালোকিত রাত্রে গঙ্গার বুকে সাঁতার
দেবার কথা।
কিরীটী এগিয়ে চলে।
স্বপ্নের চাইতেও বর্তমানে যে চিন্তা তাকে এই রাত্রে বৌরাণীর বিলের
জলে এনে ফেলেছে, ঐ অস্পষ্ট দূরবর্তী অন্ধকার বৃক্ষ-সমাকুল তটরেখা—সেই
দিকে লক্ষ্য রেখে কিরীটী সাঁতরে চলে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে।
অনেকটা পথ চলে এসেছে কিরীটী।
সহসা তার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল অষ্পষ্ট ক্ষীণ সঙ্গীতের সুরে। উৎকর্ণ হয়ে ওঠে
কিরীটী সন্তরণ
দিতে দিতেই। জলের মধ্যে গানের সুর! হ্যাঁ, সত্যি কে যেন গান গাইছে অল্প দূরে
কোথাও। গানের সুরকে অনুসরণ
করে কিরীটী আরও খানিকটা দ্রুত নিঃশব্দে সাঁতরিয়ে এগিয়ে যায়।
ক্ৰমে স্পষ্ট—আরো
স্পষ্ট শোনা যায় এবার গানের সুরলহরী।
কি মধুর! কিবা অপরূপ
কন্ঠ!
চন্দ্রালোকিত এই নিশীথ রাত্রি যেন বীণাবাদন করছে। গানের সুর-মুর্ছনায় যেন আকাশ বাতাস দিগন্ত প্লাবিত হয়ে
যাচ্ছে।
আরো কিছুটা অগ্রসর হবার পর সহসা এতক্ষণে কিরীটীর নজরে পড়ে তীরের
সন্নিকটে একটি ছোট ভাসমান নৌকা জলের মধ্যে। ভাসমান সেই নৌকার উপরে বসেই ধীরে ধীরে
বৈঠা দিয়ে জল কাটতে কাটতে আপন মনে সম্বিৎহারা হয়ে কে যেন গান গেয়ে চলেছে।
আরো একটু
এগিয়ে গেল কিরীটী সন্তর্পণে।
চন্দ্রালোকে এবারে গায়িকা নৌকার উপরে উপবিষ্টা চন্দ্রলেখাকে চিনতে
কিরীটীর কষ্ট হয় না।
গায়ে একটা পাতলা জরির ওড়না চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। বৃক্ষের দুপাশ দিয়ে ঝুলছে পাকানো মত দুটি বেণী।
আশ্চর্যই হয়ে যায় কিরীটী এত রাত্রে নৌকায় বসে চন্দ্রলেখাকে গান
গাইতে শুনে।
কে জানে ওর দাদু
হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে! সেই ফাঁকে চন্দ্রা নৌকা নিয়ে বিলের জলে ভেসে পড়েছে এই রাত্রে।
কি একটা উর্দু
গান গাইছে চন্দ্রা। গানের ভাষা না বুঝলেও ভারি মিষ্টি কিন্তু লাগে কিরীটীর গানের
ভাব।
কিরীটী এবারে একটু
অন্ধকার দেখে তীরের এক অংশে সাঁতরে গিয়ে ওঠে এবং উঠে ভিজে কষ্টিউমটা গা হতে খুলে ধুতিটা পরে নিল।
চন্দ্রা তখনও আপন মনে গান গাইছে। কিরীটী আলোছায়া-খচিত পথ দিয়ে বাড়িটার
দিকে এগিয়ে চলল।
দিনের বেলায় আজ যখন প্রৌঢ় সূরযমলের সঙ্গে এই দিকে
এসেছিল তখনি বেশ ভাল করে চারিদিক দেখে রেখেছিল। বাড়ির পশ্চাৎভাগে পৌছাতে তার কষ্ট
হয় না।
এদিককার দরজাটা
ভেজানো ছিল মাত্র। বোধ হয় চন্দ্রলেখাই ভেজিয়ে রেখে গিয়েছে।
সন্তর্পণে ভেজানো দরজাটা
ঠেলে ফাঁক করে কিরীটী ভিতরে প্রবেশ করল, সামনেই অপ্রশস্ত একটি আঙ্গিনা।
অস্তগামী চন্দ্রালোকে চারিদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার দেখে নেয়
কিরীটী।
ঘরের প্লিন্ত মাটি হতে প্রায় হাতখানেক উঁচু। তারপরেই
একটা বারান্দা মত। বারান্দার উপরে এসে উঠলো কিরীটী।
পর পর তিনটি ঘর। দুটি ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। একখানা ঘরের ঈষদুন্মক্ত দ্বারপথে আসছে মৃদু আলোর একটুখানি আভাস।
পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল কিরীটী প্রথমেই সেই কক্ষের দিকে।
আলগোছে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের
উপরে ভর করে দরজার
সামান্য ফাঁক দিয়েই ঘরের মধ্যে উঁকি দিল। ঘরের এক কোণে দেওয়াল ঘেষে মাটির
প্রদীপাধারের উপরে একটি মৃৎপ্রদীপ
জ্বলছে
মিটমিট করে।
প্রদীপের সেই ক্ষীণালোকেই তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে কিরীটী
কক্ষের চতুঃপার্শ্ব দেখে নিল। শুন্য কক্ষ।
এক কোণে একটা খাটিয়ার উপরে শুন্য শয্যা। তারই পাশে একটা মাটির
কলসী, একটা গ্লাস। দেওয়ালে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টাঙিয়ে খানকতক শাড়িকাপড় ঝোলানো।
কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না এই ঘরেই শোয় চন্দ্রলেখা। এটা তারই শয়নকক্ষ
নিশ্চয়ই।
এইটা যদি চন্দ্রলেখার শয়নকক্ষ হয় তো ওর দাদু সুরযমলের
ঘর কোনটা? কোন ঘরে তাহলে সূরযমল থাকে?
বাকী দুটো ঘর তো দেখছে ও তালাবদ্ধ। তবে কি সুরযমল এই দুটো ঘরেরই কোন
একটাতে থাকে। এখন নেই, কোথায় গিয়েছে! কিন্তু এত রাত্রে সে কোথায়ই বা যাবে বা যেতে
পারে তার বয়সের তরুণী নাতনীকে একাকিনী এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যে একা বাড়িতে রেখে?
তবে রাজপুত এরা, এদেশের লোকদের মত ভীতু তো নয়। তাছাড়া রাজপুতের মেয়ে আত্মরক্ষা করতেও
হয়ত জানে।
সহসা এমন সময় অস্ফুটকাতর
একটা শব্দে ও যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই থমকে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে উৎকীর্ণ হয়ে
ওঠে। শিকারী বিড়ালের মতই সজাগ হয়ে ওঠে।
অস্ফুট কাতরোক্তি। স্পষ্ট ও শুনেছে।
উৎকর্ণ হয়ে আছে কিরীটী, অসম্ভব কিছুর একটা প্রতীক্ষায় ওর সমস্ত দেহটা যেন কঠিন
ঋজু
হয়ে উঠেছে।
আঙ্গিনার উপরে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। কোথায় অন্ধকারে একটা
তক্ষক টক টক করে শব্দ করে উঠলো, নিস্তব্ধ রজনী যেন ককিয়ে উঠলো। কুৎসিত শব্দটা যেন
নিস্তব্ধ রজনীর বুকে একটা ভয়াবহু
ইঙ্গিত দিয়ে গেল কোন আশু
অশুভ অমঙ্গলের। আবার শোনা গেল অস্পষ্ট কাতরোক্তি। ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠের
যন্ত্রণাকাতর শব্দ যেন। মনে হয় বুঝি একটা বুকচাপা
দীর্ঘশ্বাস নিশতি রাতের স্তব্ধতায় মর্মায়িত হয়ে উঠেছে।
কাতর শব্দটা আবার কানে ভেসে এলো। এবারে কিরীটীর মনে হলো যেন
পাশেরই কোন ঘর থেকে শব্দটা অস্পষ্টভাবেই ভেসে আসছে।
সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী আধো আলো আধো ছায়া ঘেরা বারান্দার
চারদিকে।
কোথা হতে আসছে শব্দটা শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ করে বোঝবার চেষ্টা
করে।
ঐ তালাবন্ধ দুটো ঘরের একটা ঘর হতে কি? পায়ে পায়ে সন্তর্পণে এগিয়ে যায় কিরীটী প্রথম
ঘরটার দিকে।
আবার সেই অস্পষ্ট কাতরোক্তি।
সহসা আবার কিরীটী থমকে দাঁড়াল। বহুদূর হতে যেন ভেসে আসছে দ্রুত ধাবমান অশ্বক্ষুরধ্বনি।
খট খটখট খটখট– ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোন অশ্বারোহী হয়ত এই
দিকেই আসছে।
ঘরের দিকে আর যাওয়া হল না। অষ্পষ্ট কাতরোক্তি ক্ষণপূর্বে কোথা হতে আসছে তার আর
সন্ধান করা হল না কিরীটীর। মুহর্তে সে নিজের সংকটময় পরিস্থিতিটা সম্যক উপলব্ধি করে
কর্মপন্থা স্থির করে ফেলে। অত্যন্ত দ্রুত ক্ষিপ্রপদে কিরীটী আঙ্গিনাটা অতিক্রম করে
বাড়িটার সম্মুখভাগে এসে দাঁড়াল। সকালবেলাতেই ঐদিন কিরীটী লক্ষ্য করেছিল একটা বড়
শিমুল গাছ ও তেতুল গাছ পাশাপাশি একটা জায়গায় বাড়িটার সামনে দক্ষিণ দিকে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে
আছে ছায়া বিস্তার করে।
কিরীটী দ্রুতপদে
সেই দুটি বৃক্ষের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করে দাঁড়াল।
অশ্বক্ষুরধ্বনি এখন আরো স্পষ্ট শোনা
যাচ্ছে। অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে এই দিকেই অশ্ব ছুটিয়ে আসছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অশ্বারোহী বাড়ির সামনে এসে বেগবান অশ্বের রাশ টেনে অশ্বের গতি রোধ
করল। অষ্পষ্ট চাঁদের আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিরীটী দেখল দীর্ঘকায় এক
ব্যক্তি অশ্ব হতে অবতরণ করল।
কিন্তু অশ্বারোহীকে চিনবার উপায় নেই। সর্বাঙ্গ একটা কালো মুখমলের আংরাখায় আবৃত। মুখাবয়বেরও প্রায় সবটাই
কালো একটা রুমালে টাকা।
অশ্বারোহী ধীর মন্থর
পদে চাবুকটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরেই এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে।
দৃঢ়
বলিষ্ঠ পদবিক্ষেপ। চলার মধ্যে কোন সঙ্কোচ বা দ্বিধামাত্রও যেন নেই।
স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো
দ্রুত কিরীটী উল্টে যায়, মনে করবার চেষ্টা করে আগন্তুকের চলার ভঙ্গীটা—কোন
পরিচিতজনের চলার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে কিনা।
কিরীটী কিন্তু বৃক্ষের
আড়াল হতে বের হয়ে আসে না বা আগন্তুককে অনুসরণ
করবার চেষ্টা করে না। নিশ্চেষ্ট হয়েই অপেক্ষা করে।
সে স্পষ্ট দেখতে পেল এক সময় আগন্তুক বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বৃক্ষের
আড়াল থেকে বের হয়ে আবার বাড়ির দিকে অগ্রসর হবে কিনা ভাবছে এমন সময় অতর্কিতেই কিরীটী যেন চমকে ওঠে
আবার পদশব্দে।
শুকনো ঝড়া পাতা গড়িয়ে যাচ্ছে মচমচ করে, কে যেন ধীর মন্থর পদে পশ্চাতের গাছপালার
দিক থেকে হেঁটে
আসছে।
চকিতে কিরীটী আধো আলো আধো অন্ধকারে পশ্চাতের দিকে তাকিয়ে এক পাশে
সরে দাঁড়াল। একটা অস্পষ্ট আবছা মূর্তি
এগিয়ে আসছে। পদভারে
তার শুকনো ঝরা পাতাগুলো মচমচ শব্দে গড়িয়ে যাচ্ছে।
মূর্তি
ক্রমে আরো এগিয়ে আসে। অষ্পষ্ট আলোছায়াতেও কিরীটীর এবারে চিনতে কিন্তু কষ্ট হয় না।
সূরযমল সিং
সূরযমল এগিয়ে বাড়ির মধ্যেই গিয়ে
প্রবেশ করল। কিরীটী তথাপি নিশ্চুপ
হয়ে দাঁড়িয়ে।
অপেক্ষাই করবে সে।
বোধ হয় মিনিট পনের বাদে আকাশে চাঁদের সামান্য অবশিষ্ট আলোকটুকুও
যেন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
চাঁদ অস্তমিত।
চারিদিক একটা অস্পষ্ট ধূসর
আবহাওয়ায় যেন রহস্যঘন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ কিরীটী সচকিত হয়ে উঠল। পূর্বের সেই আগন্তুক ও সূরযমল
প্রায় পাশাপাশি দুজনে হাঁটতে বাড়ির ভিতর হতে বের হয়ে এলো।
নিম্নকণ্ঠে দুজনে তখনও যেন কি কথা বলছে পরস্পরের মধ্যে হিন্দী ভাষাতেই।
প্রথমটায় ওদের কারো কোন কথাই কিরীটী বুঝতে পারে না। ক্রমে হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে
যখন কিরীটী যেখানে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল আত্মগোপন করে তার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে,
ওদের দুএকটা শব্দ খাপছাড়া অসংলগ্ন ভাবে ওর কানে এলেও সঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
এগিয়ে যেতে যেতে একসময় দুজনেই কিরীটী যে গাছ দুটোর আড়ালে দাঁড়িয়ে
ছিল তার হাত দেড়েক তফাতে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
এবারে ওদের কথাও স্পষ্ট শুনতে পেল কিরীটী।
সূরযমল বলছিল, তোমাকে তো বললাম
বাবুজী,
আর এভাবে এখানে আমি দেশ মুলক ছেড়ে থাকতে পারব না।
চাপা ভারী কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এলো, শোন সূরযমল,
তোমারই ভালর জন্য এ ব্যবস্থা করেছি আমি।
কিন্তু
আর বেশীদিন থাকতে হবে না। কাজ শেষ হয়ে এসেছে প্রায়।
ঝুটমুট তুমি এখানে আমাকে ধরে
রেখেছ বাবুজী।
এতদিন তো হয়ে গেল তোমার কথায় কথায়—
সুরযমল,
ছেলেমানুষী করো না।
বাবুজী,
অর নয়। সামনের শনিবারই চলে যাবো।
পাগলা, তা হতে পারে না।
আমি যাবোই। মিথ্যেই তুমি আমাকে অনুরোধ করছে।
সুরযমল
শোন, আমার বিনা হকুমে এখান হতে যদি এক পা-ও নড়, তাহলে
বাবুজী,
ভুলে যাচ্ছো সূরযমল রাজপুতের বাচ্ছা। ও
চোখরাঙানিকে থোড়াই কেয়ার করে।
দ্বিতীয় বক্তার কণ্ঠস্বর সহসা এর পর যেন একেবারে খাদে নেমে এলো,
এতদূর
এগিয়ে এসে এভাবে সব নষ্ট করো না সূরযমল।
তোমারই ভালর জন্য বলছি আমি। আর একটা সপ্তাহ তুমি অপেক্ষা কর। এতদিনই তো অপেক্ষা
করলে।
সুরযমল
কোন প্রত্যুত্তর দেয় না। চুপ করেই থাকে।
কাল আবার দেখা হবে। আর মনে থাকে যেন যা বলে গেলাম। বলতে বলতে হঠাৎ
থেমে গিয়ে কি যেন মনে পড়ে গিয়েছে এইভাবে জামার ভিতর হাত চালিয়ে একমুঠো নোট বের করে
সূরযমলের দিকে এগিয়ে দিল, এই
নাও, এই টাকাগুলো
রাখো। আমি চললাম।
সূরযমল হাত বাড়িয়ে নোটগুলো
নিল।
অতঃপর আগন্তুক এগিয়ে অশ্বের
পৃষ্ঠে
আরোহী হয়ে নিমেষে অশ্বকে ছুটিয়ে
দৃষ্টির
বাইরে চলে গেল। দুর হতে বিলীয়মান অশ্বক্ষুরধ্বনি ভেসে আসে খট খট খট।
ক্রমে মিলিয়ে যায়। সূরযমল আরো কিছুক্ষণ স্থাণর
মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে একসময় বাড়ির দিকে পা বাড়াল।