Chapter Index

    ডায়েরী কার?

    ডাক্তার!
    ডাক্তার!

    সহসা যেন সলিল সেনের ডাকে ডাক্তারের সম্বিৎ ফিরে এল।

    তিনি বললেন, না, কিছু না। মাঝে মাঝে মনটা আমার কেন যে উতলা হয়ে
    ওঠে বুঝি না। একটু অপেক্ষা করুন আপনারা, এখনই আসছি। বলে দ্রুত পদবিক্ষেপে ডাক্তার
    ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

    বোঝা গেল ডাক্তার তাঁর ল্যাবরেটারী ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, কারণ সে ঘরের
    দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল।

    লোকটা এদিকে একেবারে চমৎকার। কিন্তু রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি
    যেন ওঁর ঘাড়ে চাপে—পাগলের মত যা-তা বকেন। অস্থির চঞ্চল হয়ে ওঠেন।…আশ্চর্য! মিঃ
    সেন বললেন।

    রাজু
    বললে, মাথায় কোন গণ্ডগোল আছে বোধ হয়। অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়।

    কি জানি! এত বড় জ্ঞানী ডাক্তার এ শহরে আর দুজন নেই। কিন্তু লোকটা
    এমন খামখেয়ালী যে সন্ধ্যার পরে লক্ষ টাকা দিয়েও ডেকে পাওয়া। যায় না! সন্ধ্যা হয়েছে
    কি সদর দরজা একেবারে পরের দিন সকালের মত বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু গভীর রাতে গিটারের করুণ সুর-মুর্ছনা
    শোনা যায়। আমার মনে হয় মাথা খারাপ-টারাপ কিছু নয়, হয়তো জীবনে বড় রকমের কোন আঘাত পেয়ে
    থাকবেন, তারই জন্য এইরকম মানসিক অবস্থা হয়েছে।

    রাত্রে কি সত্যি সত্যি ডাক্তার কোথাও বের হন না মিঃ সেন? কিরীটী শুধাল।

    না। আমার সঙ্গে ওঁর আজ সাত বছরের আলাপ। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একটি
    দিনের জন্যও শুনিনি যে রাত্রে বাড়ির বাইরে গেছেন। তবে একদিন জিজ্ঞাসা করায় উনি
    বলেছিলেন, রাত্রে উনি নিরিবিলিতে ল্যাবরেটারী ঘরে বসে নাকি ডাক্তার সম্বন্ধে
    রিসার্চ করেন।

    হ্যাঁ, সত্যি রিসার্চ করি।

    কথাটা শুনে সকলে চমকে ফিরে দেখল খোলা দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে সহাস্যমুখে ডাক্তার সান্যাল।

    ডাক্তার বলতে লাগলেন, আপনারা হয়ত জানেন টিউবারকল ব্যাসিলি বলে একরকম জীবাণু আছে, প্রতি বছর এই ভীষণ
    জীবাণুর প্রকোপে হাজার হাজার মানুষ
    মত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শুধু
    সভ্য সমাজই নয়, সমগ্র মানবজাতির এত বড় শত্রু
    আর দ্বিতীয়টি নেই। আপনাদের ঐ কালো ভ্রমরের হাতে পড়লে তবুও অনেক সময় নিস্তার পাওয়া যায় শুনেছি,
    কিন্তু এই ভীষণ দুশমনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সত্যই বড় দুরহ ব্যাপার। কালো ভ্রমর
    আসে রাতের আঁধারে লুকিয়ে চুপিচপি, কিন্তু এ শয়তান দিন-রাত্রি কিছু মানে না—এ তিল তিল করে
    মানুষের জীবন-শক্তি শুষে নেয়। আমি আজ দীর্ঘ এগারো বছর এই অদৃশ্য শত্রুর কবল থেকে রক্ষা পাবার
    পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার জীবনের সমস্ত শক্তি তিল তিল করে এর পায়ে ঢেলে দিতে
    প্রস্তুত আছি। দেখি এ আমার কাছে হার মানে কিনা!

    ডাক্তারের স্বরে উত্তেজনা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞার আভাস ঝরে পড়ল যেন। ভাবাতিশয্যে
    মাঝে মাঝে তাঁর সমস্ত দেহ যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।

    একটু
    থেমে ডাক্তার আবার বললেন, কিন্তু আর নয়, আজকের মত আপনাদের কাছ থেকে আমি বিদায় চাই।

    সকলে উঠে পড়লেন।

    ঘরের ওয়াল-ক্লকটা
    ঢং ঢং করে রাত্রি সাতটা ঘোষণা করলে।

    পথে নেমে কিছুদুর এগিয়ে একসময় সলিল সেনের মুখের কাছে মুখ এনে ঈষৎ
    চাপা গলায় কিরীটী ডাক দিল, মিঃ সেন!

    সলিল সেন ফিরে বললেন, অ্যাঁ, আমায় ডাকলেন?

    হাাঁ মিয়াং এখান থেকে কত দূর হবে?

    মিয়াং! বলে বিস্মিত দৃষ্টি তুলে মিঃ সেন কিরীটীর মুখের দিকে
    তাকালেন।

    হ্যাঁ, মিয়াং। কিরীটী জবাব দিল।

    সে তো অনেক দূর হবে। টোয়ান্টে খাল ধরে কুড়ি মাইল উজানে গেলে পথে পড়ে
    মৌবিন, আরও এগলে ইয়ান্ডুন;
    তারপর পড়বে ডোনাবিয়ু—তারপর
    হেনজাদা শহর। হেনজাদার পরেই ইরাবতী নদী। যেখানে টোয়ান্টে খাল ইরাবতীর সঙ্গে মিশেছে
    সেইখানেই মিয়াং শহর।…কিন্তু হঠাৎ মিয়াং সম্বন্ধে প্রশ্ন কেন মিঃ রায়?

    আপনি কালো ভ্রমরকে ধরতে চান?

    কালো ভ্রমর! শুনেই একরাশ বিস্ময় যেন মিঃ সেনের কণ্ঠ দিয়ে ঝরে পড়ল।
    তিনি যেন বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। প্রথম দু-চার মিনিট মিঃ সেনের কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা
    বেরল না।

    কিরীটী চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে
    বললে, রাত্রি এখন সাতটা কুড়ি, হাতে আর মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা সময় আছে। যেমন করেই হোক
    আজ রাত্রি সাড়ে এগারোটার মধ্যে মিয়াং পৌঁছতে হবে আমাদের!

    কিন্তু–,
    মিঃ সেন কি যেন বলতে গেলেন। কিন্তু কিরীটী তাঁকে একরকম বাধা দিয়েই থামিয়ে বললে,
    আজকের রাত যদি হারান, তবে এ জীবনে আর কালো ভ্রমরকে ধরতে পারবেন না। সে চিরদিনের মত
    মুঠোর
    বাইরে চলে যাবে। তাকে হাতেনাতে যদি ধরতে চান তো আজকের রাত পোহাতে দেবেন না!

    আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না কিরীটীবাবু!

    বুঝবেন, সময় হলেই সব বুঝতে পারবেন। আপনাদের দ্রুতগামী পুলিসলঞ্চ আছে না?

    হ্যাঁ আছে।

    এখন সেটা পাওয়া যাবে?

    যাবে।

    তবে চলুন, আর একটি মুহূর্তও
    দেরি নয়।

    ***

    অন্ধকারে সার্চলাইট জ্বেলে
    পুলিস-লঞ্চখানা
    টোয়ান্টে খালের মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।

    লঞ্চে আরোহী আছে ছজন—সুব্রত, রাজু, কিরীটী, মিঃ সলিল সেন ও দুজন আর্মড বর্মী পুলিস।

    কিরীটী একটা লেদার বাঁধানো ডায়েরী হাতে করে নাড়তে নাড়তে বললে, মিঃ
    সেন, আপনি হয়তো সমগ্র ব্যাপারটার আকস্মিকতায় আশ্চর্য হয়ে গেছেন! এই ডায়েরী পড়লেই
    ব্যাপারটা সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুনুন
    পড়ছি—

    লঞ্চের কেবিনের আলোয় ডায়েরীখানা মেলে ধরে কিরীটী বললে, আমি
    অবিশ্যি ডায়েরীর সব কথা এখন আপনাদের পড়ে শোনাব না, কয়েকটা পাতা মাত্র পড়ব। শুনুন।

    কিরীটী ছোট একখানা ডায়েরী খুলে পড়তে শুরু করল–

    বাবা!—আমার স্নেহময় বাবা আর ইহজগতে নেই! বিলাত থেকে শেষ পরীক্ষা
    দিয়ে দেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ সংবাদে আমার বুকখানা একেবারে ভেঙে গড়িয়ে দিলে।

    তারপর বাবার ডায়েরী পড়ে বুঝতে পারলাম, বাবার অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী
    তিনটি লোক। দুজনের নাম তাঁর ডায়েরীতেই পেলাম। তারা দুজনেই বর্মায় এখন বিপুল
    সম্পত্তির অধিকারী—একজন মিঃ চৌধুরী, আর একজন বিখ্যাত তামাক ব্যবসায়ী বিপিন দত্ত।
    তৃতীয়জনের নাম কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বাবা, বিপিন দত্ত, মিঃ চৌধুরী ও আর একজন
    মিলে কাঠের ব্যবসা করেন।
    বিপিন দত্তের দুই ছেলে ও বৌ ছিল, মিঃ চৌধুরী অবিবাহিত। আমরা দুই ভাই-বোন ছাড়া
    বাবার আর কেউ ছিল না। বাবার ব্যবসায় উন্নতি হওয়ার আগেই মা মারা যান। বাবা ছিলেন
    যেমন সরল, তেমনি নিরীহপ্রকৃতির। এ জগতে কাউকেই তিনি অবিশ্বাস করতেন না। কিন্তু শেষ
    পর্যন্ত সেই বিশ্বাসই তাঁর কাল হল।

    মা মারা যাবার পর থেকে বাবা কেমন যেন উদাস প্রকৃতির হয়ে গিয়েছিলেন।
    এ দুনিয়ার কোন কিছুর ওপরই তাঁর আর তেমন কোন আকর্ষণই যেন ছিল না। ব্যবসা সংক্রান্ত সকল
    কিছুই দত্ত ও চৌধুরী তাঁর ব্যবসার অন্য দুই অংশীদার দেখাশুনা করতেন। বাবার কাছে
    কোন কিছুর সম্বন্ধে মত নিতে গেলে বলতেন, ওর মধ্যে আর আমায় টেনো না তোমরা, যা ভাল বোঝ
    তাই করগে।

    আমি ছিলাম তখন বিলেতে।

    দত্ত আর চৌধুরী বাবার এই উদাসীন ভাব ও একান্ত নিরপেক্ষতার ও সরল
    বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভিতরে ভিতরে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র করলেন।

    হঠাৎ একদিন শোনা গেল, ব্যবসার অবস্থা নাকি খুব খারাপ। বাবা শুনে
    সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। অডিটার এল, কমিটি বসল, শেষ পর্যন্ত সত্যিই দেখা গেল ব্যবসাতে
    প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপর ডিফিসিট পড়েছে। যে ব্যবসার মূলধন মাত্র সাড়ে
    তিন লক্ষ টাকা, সে ব্যবসায় এত বড় ডিফিসিট দিয়ে আর চলা একেবারেই অসম্ভব। অতএব
    ব্যবসা লালবাতি জ্বালতে
    বাধ্য হল।

    ভিতরে ভিতরে গভীর ষড়যন্ত্র করে দত্ত ও চৌধুরী নিজেদের কাজ গুছিয়ে
    নিয়ে বাবাকে একেবারে পথে বসাল।

    সরল-প্রাণ বাবা আমার। তাদের বন্ধু বলে আপনার জন বলে বিশ্বাস করেছিলেন। তাই
    তারা তাঁকে বন্ধুত্বের ও বিশ্বাসের চরম পুরস্কার দিয়ে গেল। এ আঘাত ও অপমান বাবা
    সহ্য করতে পারলেন না–অসুখে পড়লেন এবং আমি ফিরে আসবার আগেই চিরনিদ্রায় অভিভূত
    হলেন। যাবার সময় তিনি আমার নামে একটা চিঠি রেখে যান।

    সুরো বাবা আমার,

    এ জীবনের শেষক্ষণে তোমায় দেখে যেতে পারলাম না, এ যে আমার কত বড়
    দুঃখ তা
    একমাত্র ভগবানই জানেন। মনে মনে তোমার জন্য আমার শেষ আর্শীবাদ ভগবানের শ্রীচরণে
    দিয়ে গেলাম। যাবার আগে তোমায় দেবার মত আর আমার বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই, তোমার
    মার নামে জমানো হাজার পাঁচেক টাকা আর আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সঞ্চয় করা
    দুটি
    কথা রেখে যাচ্ছি।
            প্রথম কথা—এ দুনিয়ায় সরল
    বিশ্বাসের কোন দাম নেই।
            দ্বিতীয় কথা—যে
    বিশ্বাসহন্তা, তার একমাত্র ব্যবস্থা কঠোর মত্যুদণ্ড।…
            যারা তোমার বাবাকে এমনি
    করে পথে বসিয়ে গেল, তাদের তুমি ক্ষমা করো না।

    চোখের জলের মধ্যে দিয়ে বাবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করে মনে মনে
    প্রতিজ্ঞা করলাম, যেমন করেই হোক, যারা বাবাকে আমার এমনি করে লাঞ্ছিত করেছে তাদের
    আমি উপযুক্ত দণ্ড দেব।

    ভাল করে খোঁজ নিয়ে শুনলাম, দত্ত আর চৌধুরী এখন দুজনেই শহরের মধ্যে
    বিশেষ গণ্যমান্য লোক। একজন কাঠের ব্যবসা ফেদে লক্ষপতি, অন্যজন তামাকের ব্যবসায়ে
    প্রায় তাই।

    এই পর্যন্ত পড়ে কিরীটী থামল। তারপর আবার পাতা ওল্টাতে লাগল।

    তারপর শুনুন।
    বলে কিরীটী আবার পড়তে শুরু
    করে : দত্তর চরম শাস্তি মিলেছে, প্রাণে মারিনি। সমস্ত ব্যবসা তছনছ করে দিয়েছি। আজ
    লক্ষপতি তামাকের ব্যবসায়ী বিপিন দত্ত পথের ভিক্ষারী। পয়সার শোকে আজ সে পাগল,
    রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।

    এক নম্বর হল। এবার চৌধুরী তোমার পালা।

    চৌধুরীর ভাগ্নে সনৎকে লোক দিয়ে দলে ভিড়িয়েছি। ভাগ্নে বুড়োর খুব
    আদরের। উঃ, বুড়ো
    একেবারে জলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন সনৎ অধঃপাতের পথে নেমে চলেছে।
    অর্থাৎ সে জানে না, এর মধ্যে আছে এক হতভাগ্যের প্রতিহিংসার চক্রান্ত। কিন্তু
    দিনকে-দিন এ কি হচ্ছে আমার?
    দুশ্চিন্তা সর্বদা যেন আমায় ভূতের মত পিছু
    পিছু
    তাড়া করে চলেছে। এ কি হল?…

    ডায়েরীর আর এক জায়গায় লেখা আছে—

    আরও কিছুদিন যাক। সনৎকে একেবারে পথের ধুলোয় টেনে এনে বসাই, তারপর
    বুড়ো চৌধুরীকে ধরব। ওকে শেষ করতে তো আমার এক মাসও লাগবে না। কিন্তু আর একজন কে? কি তার নাম, কে আমাকে
    বলে দেবে?

    কিন্তু আমার এ কি হল?
    এ কি যন্ত্রণা? রাত্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শয়তানটা যেন আমায় শত বাহু মেলে শয়তানির পথে টেনে
    নিয়ে চলে, কোনমতেই যেন আমি তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি না।

    আর এক জায়গায় লেখা–

    ডাঃ চৌধুরী হঠাৎ মরে আমায় বড় ফাঁকিটাই দিয়ে গেল। আমার স্বপ্ন ধুলোয়
    মিশে গেল। কি করি?
    এখন কি করি?…কিন্তু এ কি! দুষ্কর্ম কি আমার জীবনের সাথী হয়ে দাঁড়াল নাকি? আমি কি পাগল হয়ে যাব?

    ডায়েরীর আর এক পাতায় লেখা–

    হ্যাঁ, সেই ঠিক হবে; যেমন করে হোক বুড়ো চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি
    নষ্ট করে দিতে হবে। ওর ভাগ্নেদের পথে বসাতে হবে।

    মিলেছে, সুযোগ মিলেছে। সনৎ লোক পাঠিয়েছিল আমার কাছে, উইলের অন্যতম
    উত্তরাধিকারীকে যদি কোনমতে প্রতিরোধ করতে পারি, তবে সে আমায় দশ হাজার টাকা
    দেবে।…

    আরও এক পাতায় লেখা—

    অমর বসু সব ভেস্তে দিল! শেষ পর্যন্ত কূলে এসে তরী ডোবাল, কিন্তু আমার যে সব গোলমাল
    হয়ে যায়! ভেবেছিলাম সনৎকে মুঠোর মধ্যে এনে ধীরে ধীরে তাকে পথের ভিখারী করে পিপড়ের
    মত পিষে মেরে ফেলে দেব একদিন। তা তো হল না। সব ভেস্তে গেল! এখন উপায়? মিলেছে—উপায়
    মিলেছে। আজ রাত্রেই সনৎকে শেষ করব।

    উঃ, কী সর্বনাশ! সংবাদ পেলাম অমর বসুই নাকি বাবার ব্যবসায় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে
    তৃতীয় ব্যক্তি ছিল, চৌধুরীর সহকারী হিসাবে। দাঁড়াও বসু এবারে তোমার পালা।

    তারপর অনেক পাতার পরে
    লেখা আছে–

    দলের লোকেরা আমায় জানবার জন্য কী ব্যাকুল—কী ইচ্ছুক! অমর বসুর
    মৃত্যুর ঘটনা খুব চাঞ্চল্য জাগিয়েছে যাহোক!

    কলকাতায় যেতে হবে।

    সনৎ আর সুব্রত ওদের মধ্যে যে কোন একজনকেও যদি কোনমতে এখানে এনে
    ফেলতে পারি তবেই কিস্তিমাত। একজন ধরা পড়লেই ওরা সব কজনই ছুটে আসবে। ধরে সব কটাকে
    রেঙ্গুনেই আনতে হবে—আমার মুঠোর
    মধ্যে।

    আর এক জায়গায় লেখা–

    নাঃ, কিরীটী বড় বাড়িয়ে তুলেছে! কিন্তু ভদ্রলোকের দেখছি বুদ্ধি
    আছে। হ্যাঁ, বলতেই হবে বুদ্ধি আছে। ঠিক আঁচ করেছে তো!

    বুদ্ধির লড়াই আমার বড় ভাল লাগে। দেখি না এক চাল খেলে!

    আবার এক জায়গায় লেখা–

    দেখছি ধনাগারের চার্টটা
    চুরি গেছে।…তা যাক, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। ও তো আমি জানিই। ওটা আবার
    কিরীটীটাই হাত করেছে। ওটা চুরি
    করে আনতে হবে। রেঙ্গুনে গিয়ে চুরি করলেই হবে। ব্যস্ততার কিছু নেই।

    ডায়েরীর শেষ পাতায় লেখা আছে–

    টাকাকড়ি সঞ্চয় করে আমার আর কি হবে?…আমি আমার ধনাগারের সমস্ত অর্থ তাকে দিয়ে
    যাব—মরবার আগে যে আমার কাছে সবচাইতে বিশ্বাসী বলে মনে হবে। ও তো পাপের অর্থ, পাপের
    নেশায় অর্জন করা অর্থ। আমার চাই না।

    ডায়েরীর সব শেষ পাতায় লেখা—

    মত্যুগুহায়
    সনৎ ও অমরকে আটকে রেখেছি। কাল যাব মৃত্যুগুহায়
    রাত্রি বারোটায়। তপ্ত শলা দিয়ে অমরের চোখ কানা করব। আর সনৎকে চিরজীবনের জন্য আমার
    ধনাগারে বন্দী করে রেখে আসব। অর্থ-পিশাচ! দেখি আমার আজীবনের সঞ্চিত অর্থে ওর সাধ
    মেটে কিনা! যে সামান্য অর্থের জন্য ভাইকে মেরে ফেলতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত নয়, তার প্রায়শ্চিত্ত
    হওয়া দরকার। তাছাড়া আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারও শাস্তি হোক। থাকুক ও ওই রুদ্ধ ধনাগারে—যুগ যুগ ধরে
    অর্থের প্রাচুর্যের
    মধ্যে বন্দী হয়ে যখের মত।

    এই পর্যন্ত পড়ে কিরীটী ডায়েরী বন্ধ করল এবং সকলের মুখের দিকে চেয়ে
    বলল, আজ সেই ভীষণ রাত্রি অর্থাৎ এগারোই, এবং আজ বারোটায় হবে সেই ভীষণ পাপানুষ্ঠান।

    সকলে এতক্ষণ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে কিরীটীর পড়া শুনছিল, এবার বলে
    উঠল, উঃ, কী ভয়ঙ্কর!

    অন্ধকারে মোটর লঞ্চ ঝরঝর শব্দে জল কেটে চলেছে তখন।

    কিরীটী ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, তখন রাত্রি সাড়ে দশটা।…এখনও দেড়
    ঘণ্টা বাকি।

    টীকা