Chapter Index

    প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পরে ঘর্মাক্ত কলেবরে রুদ্ধ আক্রোশে ফুলতে ফুলতে লক্ষ্মীকান্ত থানায় এসে পৌঁছালেন। থানার দুজন চৌকিদার এসে তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরল।

    ঘন ঘন চাবুকের
    ঘায়ে জর্জরিত করে ও দুই পা দিয়ে পেটে ক্রমাগত লাথি মেরেও অশ্বের গতি তিনি বাড়াতে
    পারেননি। ঘোড়াটার মুখ দিয়ে ফেনী গড়াচ্ছিল। আশেপাশে চেয়ে দেখলেন লক্ষ্মীকান্ত, কিন্তু টমটম বা বসন্ত
    সেন কাউকেই নজরে পড়ল না। ঘোড়া হতে নেমে ঘর্মাক্ত কলেবরে থানার বারান্দায় এসে উঠলেন লক্ষ্মীকান্ত। সেখানেও বসন্ত সেন নেই।

    থানার বারান্দায় এ. এস. আই. পাণ্ডে দুজন চাষীর এজাহার নিচ্ছিলেন।
    চাষী দুটো সানুনাসিক কণ্ঠে পাণ্ডেকে কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিল, সহসা ওদের দিকে
    নজর পড়ায় যেন বোমার মতই ফেটে পড়লেন লক্ষ্মীকান্ত,
    হাজতঘরে নিয়ে শুয়েরিকা বাচ্চাদের বেশ করে ঘাতক দাও, তবেই সব স্বীকার করতে পথ পাবে।
    যেমন কুকুর তার তেমনি মগের চাই।

    অকস্মাৎ বড়বাবুকে আক্রোশে ফেটে পড়তে দেখে বিস্মিত পাণ্ডে মুখ তুলে
    তাকাল তার দিকে।

    চাষী দুজন অপরাধী নয়, একটা চুরির ব্যাপারে থানা থেকেই সাক্ষী হিসাবে ওদের
    এজাহার নেওয়া হচ্ছিল। অকারণে ওদের হাজতঘরে পরে ঠ্যাঙাবার তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে
    না।

    নায়েব বসত সেন এসেছিল পাণ্ডে? প্রশ্ন করলেন লক্ষ্মীকান্ত।

    কে, নায়েববাবু!
    হ্যাঁ, তিনি তো প্রায় মিনিট পনেরো আগে এসেছিলেন টমটমে করে। একখানা জরুরী চিঠি
    আপনার নামে লিখে রেখে গেছেন। বলে গেলেন আপনি এলেই আপনাকে দিতে।

    কি বললে? সে চিঠি লিখে রেখে চলে গেছে? কর্কশ
    কণ্ঠে শুধোলেন লক্ষ্মীকান্ত
    সহকারী পাণ্ডেকে।

    হ্যাঁ—এই যে চিঠি স্যার!

    বলতে বলতে একটা ভাঁজকরা চিঠি এগিয়ে দিলেন পাণ্ডে বড়বাবুর দিকে।

    চিঠি! কে চায় সে বদমায়েশের চিঠি! যেন একেবারে খেকিয়ে উঠলেন লক্ষ্মীকান্ত, সে বেটাকে আমি
    গ্রেপ্তার করেছিলাম। আর সে বেটা কিনা দিব্যি তোমাকে একটা চিঠি গছিয়ে দিয়ে ভেগে
    গেল! আহাম্মক! গদভ কোথাকার! কি করো? ঘাস খাও? যত সব অপদার্থ অকর্মার দল!

    ব্যাপারটা যেন এতটুকুও বোধগম্য হয়নি এমনি হাঁ করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে
    থাকে পাণ্ডে লক্ষ্মীকান্তর
    দিকে কিছুক্ষণ, তারপর ঢোক গিলে বলে, গ্রেপ্তার! নায়েবজীকে
    গ্রেপ্তার করেছেন স্যার?

    হ্যাঁ। ঐ বেটা ঘুঘুই
    তো জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে হত্যা করেছে।

    বলেন কি!

    চিঠিটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন লক্ষ্মীকান্ত!

    সংক্ষিপ্ত চিঠি।

    লক্ষ্মীকান্ত,
    ভয় নেই আমি পালাচ্ছি না।
    দুচার দিনের মধ্যেই আমি আবার ফিরে আসছি, বিশ্বাস
    করতে পারো
    আমার কথায়। কতকগুলো জরুরী কাজ আছে আমার হাতে, সেগুলো শেষ না করা
    পর্যন্ত কিছুতেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আমার কথায় যদি বিশ্বাস করো
    তাহলে আমার
    জামিন আমি রইলাম। আর একটা কথা, এ নিয়ে আবার সবিতাদের উপর কোন হামলা করো না।
    কথাটা বলতে হলো এই জন্যে যে তোমার পক্ষে বিচিত্র কিছুই নেই। বুদ্ধিটা আবার তোমার একটু
    বেশী মাত্রায় প্রখর কিনা। সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, যেন প্রমোদভবনের
    কারো উপরে
    এতটুকুও কোন জুলুম
    না হয়, তাহলে ফিরে এসে তোমাকে জীবন্ত রাখবো না।

    নায়েব বসন্ত সেন।

    আক্রোশে হতাশায় অপমানে যেন লক্ষ্মীকান্তর সমস্ত অন্তরটা
    অগ্ন্যুৎপাতের মত দাউ দাউ করে জ্বলছে।
    পঠিত চিঠিটা আক্রোশে হাতের মুঠোর মধ্যে দুমড়াতে দমড়াতে রোষকষায়িত লোচনে পাণ্ডের
    দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন দিকে গেছে সে?

    মনে হল স্টেশনের দিকেই যেন গেলেন স্যার!

    এই মুহূর্তে
    সাইকেল নিয়ে বের হয়ে পড়ুন—যেমন
    করে হোক তাকে গ্রেপ্তার করে আনা চাই বা তার সংবাদ আনা চাই। যান।

    যাচ্ছি স্যার। তাড়াতাড়ি পাণ্ডে উঠে দাঁড়ালেন। লক্ষ্মীকান্ত চীৎকার করে উঠলেন,
    সমশের-ইসমাইল!

    থানার দুই
    জাঁদরেল
    ষণ্ডামাকা সেপাই। থানার যত অপকর্ম ওদের দিয়েই করানো হয়। হতদন্ত হয়ে তারা বড়বাবুর ডাক শুনে ছুটে এলো, হোজুর

    ছোটবাবু
    স্টেশনে যাচ্ছেন সাইকেল চেপে। তোমরাও যাও। নায়েব বসন্ত সেনকে ধরে আনতে হবে।

    সমশের আর ইসমাইল।

    লক্ষ্মীকান্তর
    দুটি যমদুত-সদৃশ সাকরেদ। এ সব ব্যাপারে
    এক পায়ে তো
    ওরা দাঁড়িয়েই আছে সর্বদা।

    সমশের ও ইসমাইল দুজনের আবার নায়েব বসন্ত সেনের উপরে রাগও ছিল।

    জমি সংক্রান্ত একটা ব্যাপারে মাস দুই আগে ওরা একটা চাষী জোতদারকে
    সায়েস্তা করতে গিয়েছিল, আচমকা পূর্বাহ্নেই সংবাদ পেয়ে তীরের মত ঘোড়া ছুটিয়ে নায়েব
    বসন্ত সেন অকুস্থানে এসে হাজির হয়।

    বসন্ত সেনের হাতে ঘোড়া হাঁকাবার সময় বিনুনী-কর চামড়ার একটা চাবুক
    ধরা থাকত। চাবুকটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরেই বসন্ত সেন ঘোড়া থেকে ঘর্মাক্ত কলেবরে লাফিয়ে ভূমিতে এসে দাঁড়াল,
    কি ব্যাপার সেপাই?

    চাষী জোতবার পরাণ
    মণ্ডল নায়েবকে দেখে কেদে পড়ল, দেখেন কত্তা, সেপাইদের অত্যাচারটা একবার দেখেন।
    মিথ্যে মিথ্যে ওরা আমায় থানায় নিয়ে যেতে
    চায়।

    বসন্ত সেন বললেন, সেপাই, তোমরা থানায় যাও। আমি দারোগা সাহেবের
    সঙ্গে দেখা করে যাবোখন। বলো সাহেবকে ওর জামিন আমি রইলাম।

    সমশের আর ইসমাইল দুজনেই খিঁচিয়ে উঠেছিল কটুকণ্ঠে, সরে যান নায়েব মশাই! এ সব
    থানা-পুলিসের ব্যাপারে আপনি মোড়লি করতে এসেছেন কেন?

    বাঘের মতই অকস্মাৎ গর্জে উঠেছিলেন বসন্ত সেন, এই শুয়ারকি বাচ্চা! জানিস কার
    সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস?
    চাবকে একেবারে পিঠের চামড়া তোদের তুলে নেবো।

    ইতিমধ্যে গোলমাল ও চেঁচামেচিতে
    প্রায় শখানেক চাষী সেখানে চারপাশে এসে ভিড় করেছে। লোহার মত কঠিন শক্ত দেহের বাঁধনি
    তাদের।

    রাগে
    গর্জাতে
    গর্জাতে
    সমশের আর ইসমাইলকে থানায় ফিরে আসতে হয়েছিল।

    সেযাত্রায় অবশ্য থানার দারোগাকে বসন্ত সেন শপাঁচেক টাকার নোট গুজে
    দিয়ে তার রোষবহ্নি
    হতে পরাণ
    মণ্ডলকে বাঁচিয়েছিল।

    সমশের আর ইসমাইলকে দারোগা সাহেব চোখ রাঙিয়েই বলেছিল, জমিদারের
    এলাকায় বাস করতে হলে একটু
    সাবধান হয়ে বুঝে-সুঝে
    কাজ করতে হয়।

    কিন্তু রৌপ্য চাকতির একটি ভগ্নাংশও তাদের পকেটে যায়নি, অতএব তাদের
    রাগটা বসন্ত সেনের উপরে প্রশমিত হবার সুযোগ পায়নি। তারা এতদিন সুযোগের অন্বেষণেই ফিরছে।
    আজ মিলেছে সুযোগ।
    মহা উল্লাসে তারা বসন্ত সেনের উদ্দেশ্যে অগ্রগামী সাইকেলবাহী পাণ্ডের পশ্চাতে
    পশ্চাতেই বের হয়ে পড়তে দেরি করে না এতটুকুও।

    আর ঠিক ঐ সময়ে প্রমোদভবনের মধ্যে কোথাও একটা সাইকেল পাওয়া যায়
    কিনা অনুসন্ধান করে ফিরছিল কিরীটী।

    বনমালী বললে, কাছারীর পাইক রামশুরণের একটা ভাঙা সাইকেল আছে। বেচারা ঘোড়ায় চড়তে
    জানে না বলে কর্তাবাবু
    তাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, জরুরী সংবাদ কখনো দেওয়া-নেওয়া করতে হলে রামশরণকে দ্রুত যাওয়া-আসার
    জন্য। মাস দুই
    হলো রামশরণ
    ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। নিচের যে ঘরে সে থাকত সে ঘরেই সাইকেলটা আছে। আনবো সেটা?

    কিরীটীর আদেশে রামশুরণের
    সাইকেলটা এনে দিল বনমালী। কিরীটী সাইকেলটা চেপে বের হয়ে পড়ল।

    বৌরাণীর বিলটার ধার দিয়ে যতদূত বাঁধানো সড়ক ছিল চালিয়ে শেষে কাঁচা রাস্তায়
    এসে পড়ল কিরীটী। কাঁচা সড়কে গত দুদিনের বৃষ্টির ফলে কাদা জমে আছে। কোনমতে তার
    মধ্যে দিয়েই সাইকেল চালিয়ে সন্তর্পণে
    এগুতে লাগল কিরীটী।

    বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ দিক ওটা। জনহীন, মানুষের বসতি বড় একটা নেই
    এদিকে। বেশীর ভাগই জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে কেবল দুএকটা চালাঘর এদিকটায় চোখে পড়ে।

    এই জঙ্গলই অস্পষ্ট রেখায় গত সন্ধ্যায় নন্দনকানন হতে দেখা গিয়েছিল।
    মাথার উপরে বৈশাখের জলন্ত সূর্য।
    পিপাসায় কণ্ঠতালু
    কাঠ হয়ে উঠেছে। কোথাও একটু
    তৃষ্ণার জল পাওয়া যায় কিনা এদিক ওদিক তাকাতে লাগল কিরীটী।

    সহসা নজরে পড়ে ছোট একটা বাড়ি। চালাঘর বললে ভুলই হবে। মেঝে ও দেওয়ালের
    পাকা গাঁথুনির উপরে খড়ের ছাউনি। আশেপাশের খানিকটা স্থানও পরিচ্ছন্ন। তবে সংস্কারের
    অভাবে ও অযত্নে জঙ্গলাকীর্ণই হয়ে আছে।

    এমন নির্জনে একেবারে জঙ্গলের প্রান্তে এমন একটা বাড়ি দেখে একটু আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল
    সে।

    বাড়িটায় কোন লোকজন আছে বলেও মনে হয় না। কোথাও কোন পত্রান্তরালে
    বসে একটা ঘুঘু কূজন
    করছিল।

    কিরীটী সাইকেল হতে নেমে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল। সহসা এমন সময় বাড়ির
    পশ্চাৎ দিক হতে একটি প্রৌঢ় বাড়ির সামনে এসে কিরীটীকে অদূরে সাইকেলটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল।

    লোকটার সাজ-পোশাকে ও চেহারায় এ দেশীয় বলে মনে হয় না।

    উঁচু
    লম্বা চেহারা। মুখে সাদা-পাকা চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি রঙিন কাপড়ের। পরিধানে
    রাজপুতদের ধরনের পায়জামা, গায়ে একটা রঙিন পাতলা পাঞ্জাবি, পায়ে নাগরা।

    মনে হয় লোকটা কোন রাজপুত-বংশীয়ই হবে। কিরীটী হাতের ইশারায় লোকটিকে
    ডাকল।

    প্রৌঢ় ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করে বোধ হয় কি ভাবলে, তারপর ধীরে মন্থর পায়ে নাগরা জুতোর মচমচ শব্দ তুলে কিরীটীর
    সামনে এগিয়ে এল এবং অত্যন্ত রুক্ষ
    দৃষ্টিতে
    তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, কেয়া? কেয়া মাংতেছে আপ ইধার?

    নমস্তে জী, অপিকো দেখনেসে মালুম হোতা হ্যায় কি আপ ইধার বাঙ্গলকা আদমী নেহি
    হো।

    বেশখ বাবাজী, ম্যায় রাজপুত হু। বৃদ্ধের
    কণ্ঠস্বর মোলায়েম হয়ে আসে।

    রাজপুত! বিস্মিত কিরীটী প্রশ্ন করে, আপ রাজপুতনাকে রহনেওয়ালে?

    হ্যাঁ। রাজপুতনার এক গাঁয়ে আমার বাড়ি।

    এখানে কতদিন আপনি আছেন? আপনার নাম কি?

    আমার নাম সূরযমল সিং, জাতিতে আমরা
    রাজপুত চৌহান। মাস দেড়েক হলো এখানে এসেছি। কিন্তু কেন বলুন তো?

    না, এমনি জিজ্ঞাসা করলাম।

    সূরযমল অতঃপর চুপ করেই থাকে।

    এখানে কোন কাজ ছিল বুঝি আপনার সিংজী? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

    কিরীটীর প্রশ্নে সুরযমল
    একটু
    যেন থমকে গিয়ে ইতস্ততঃ করে, তারপর মৃদু
    হাস্যের সঙ্গে মোলায়েম কণ্ঠে জবাব
    দেয়, কাজ না থাকলে
    কি সাধ করে নিজের মুলক ছেড়ে এত দূর
    দেশে কেউ আসে বাবাজী! তা বাবাজী, আপনাকে তো এদিকে কখনও দেখিনি!

    না,
    আমিও মাত্র কয়েকদিন হল এদিকে এসেছি, এখানকার লোক আমি নই। জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। বড় পিপাসা পেয়ে গেল, হঠাৎ এই
    বাড়িটা চোখে পড়ায়—

    পিপাসা লেগেছে বাবুজী
    আপনার, দাঁড়ান, পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সূরযমল চীৎকার করে ডাকল, আরে
    এ চন্দ্রা, চন্দ্রা বিটিয়া হো?

    মিহি মেয়েলী কণ্ঠে জবাব
    এল, যাইলোটামে থোড়া পানি আউর থোড়ি মিঠাই তো লাও বিটিয়া

    না, মিঠাই নয় সূরযমলজী, শুধু পানি। কিরীটী
    প্রতিবাদ জানায়।

    এ কি কোন একটা বাত হলো বাবাজী। মেহমান, আপনি আমার কুটীরে। প্রৌঢ়
    হাসতে হাসতে জবাব
    দেয়।

    অপূর্ব!

    মুহূর্তে
    যেন কিরীটীর দুটি চোখের তারা বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।

    কিরীটী সম্মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

    কোন একটি শান্ত রাগিণী যেন মূর্তিময়ী হয়ে নিঃশব্দে সঙ্গীতের মত চারিদিক মর্মায়িত
    করে এগিয়ে আসছে। কি অপুর্ব সুঠাম দেহবল্লরী। চপলা চঞ্চলা।

    একটু
    লম্বাটে ধরনের মুখখানি।

    হাতের মুঠির মধ্যে যেন ধরা যায় সরু কটিদেশ। পেলব সুকোমল দুটি বাহু।

    পরিধানে যদিও রক্তিম পশমের ঘাঘরা ও আঁটসাট কাঁচলি, তথাপি যেন
    প্রস্ফুটিত কমলের মতই সৌন্দর্য ঢলঢল করছে কমনীয়তায় মাধুর্যে। এক হাতে লৈটা ও আর এক
    হাতে রেকাবিতে দুটো নাড়ু
    নিয়ে এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল তরুণী।

    হরিণের মত সরল দুটি চোখের চাউনি তুলে তাকাল তরুণী।

    চোখের নিচে কাজলের সক্ষম কালো রেখা। মাথার চুলে বেণী সংবদ্ধ।

    খালি পা দুটিতে অলক্তরাগ
    চিহ্ন।

    এই আমার নাতনী চন্দ্রলেখা বাবাজী। আমার ভাইয়ের বিটির বিটি।

    ওর মা?

    ওর মা! আমাদের বিটি প্রৌঢ়ের চোখের কোল দুটি ছলছল করে এল।

    অনুমানেই বুঝতে পারে কিরীটী, প্রৌঢ়ের মেয়েটি আর ইহজগতে নেই।

    কিরীটী চন্দ্রলেখার প্রসারিত হাত হতে মিষ্টির পাত্র ও লোটাটা নিল। নাড়ু ঠিক নয়, লাড্ডু। এবং ওদের দেশীয় প্রথায়ই
    তৈরী। কোনমতে একটা লাড্ডু
    গলাধঃকরুণ
    করে কিরীটী এক লোটা পানিই ঢকঢক করে পান করে নিল।

    চন্দ্রলেখা কিরীটীর হাত হতে লোটা আর পাত্রটি নেবার জন্য এবার এগিয়ে
    আসতেই কিরীটীর স্মৃতির পৃষ্ঠায় একটা বিদ্যুৎচমক খেলে যায় যেন।

    অবিকল ঠিক এমনি না হলেও এই মুখখানিরই আদলটা যেন ওর চেনা চেনা।

    তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে একবার তাকাল কিরীটী চন্দ্রলেখার
    মুখের প্রতি।

    কোথায় কবে যেন অমনি একখানি মুখে সে দেখেছে। কিন্তু কোথায়!

    মিষ্টির পাত্র ও লোটাটা কিরীটীর হাত থেকে নিয়ে চলে গেল চন্দ্রলেখা
    অন্দরের দিকে।

    কিরীটী তাকিয়ে থাকে মেয়েটির ক্রমঅপস্রিয়মাণ দেহের দিকে। কি দেখছেন
    বাবাজী?

    কিরীটী মৃদু
    হেসে প্রৌঢ় সূরযমলের দিকে ফিরে তাকিয়ে
    বলে, আপনার নাতনীর ঠিক রাজরাণীর মতই রূপ
    সিংজী!

    রাজরাণী! সবই ওর কপালের লিখন, প্রৌঢ় সূরযমলের
    বুকখানা
    কাঁপিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন বের হয়ে আসে।

    কথাগুলো অস্পষ্ট আত্মগতভাবে উচ্চারণ করেছিল সূরযমল।
    কিরীটী সঠিক বুঝতে পারে না।

    কিন্তু বললে না তো সিংজী, এ দেশে কেন তুমি এসেছো?

    ঐ যে বল্লাম বাবুজী,
    ভাগ্যের লিখন! ভাগ্যই টেনে এনেছেন আমাদের এই দেশে-নইলে, কথাটা সরযমল আর শেষ করে
    না। হঠাৎ যেন কথার মোড়টা ফিরিয়ে দিয়ে সূরযমল বলে, এই ধূপের মধ্যে
    দাঁড়িয়ে কেন বাবাজী, চল ওপাশের আমবাগানের বিলের ধারে চমৎকার একটা জায়গা আছে।

    চল।

    সত্যিই অপূর্ব
    জায়গাটা।

    নিবিড় আম্রকানন। সম্মুখেই দিগন্তপ্রসারী বিলের জল। বৌরাণীর বিল।

    দ্বিপ্রহরের খর সূর্যালোকে
    বিলের বুকে মন্থর বায়ুর তাড়নে জেগে-ওঠা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউগুলো যেন হীরার কুচির
    মতই জলজল করছে।

    পত্রান্তরাল হতে একটা হরিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে এবং মধ্যে মধ্যে
    শিস দিয়ে উঠছে একটা বুলবুলি।

    কিরীটী ভাবছিল এমন নিরিবিলি জায়গাটিতে এমন একখানা বাড়ি কে তৈরী
    করল!

    প্রশ্নটা সরযমলকে
    জিজ্ঞাসা না করে পারে না সে।

    লোকালয়ের বাইরে এই নির্জন জায়গায় এই বাড়িটার খোঁজ তোমাকে কে দিল
    সিংজী?

    যে বাবুজী
    আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন তিনি এই বাড়িতে এনে তুলেছেন আমাদের।

    বাবুজী!
    কি নাম তার?

    উহ; বাবু,
    শুধাবেন না দয়া করে। ঐ কথাটি বললে বেইমানি করা হবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি—

    হ্যাঁ

    কিরীটী মনের মধ্যে একটা জাল বুনে চলে।

    একটা কাহিনীর ছিন্নসূত্র।
    কিছুতেই এ কয়দিন ধরে যার কোন হদিসই সে মনের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিল না, সেই ছিন্ন
    সূত্রটিই যেন সহসা মনের মধ্যে এসে উকিঝুকি দিচ্ছে।

    চিন্তার জাল নীহারিকার মত এখনও দ্রুত ঘুর্ণমান আকারহীন। অস্পষ্ট ধোঁয়াটে।

    তাছাড়া বাবাজীর বোধ হয় ইচ্ছাও ছিল না কারো সঙ্গে এ দেশে আমি
    আলাপ-পরিচয় করি বা কথা বলি। কিন্তু দেড় মাস একটা লোকের মুখে দেখি না। এই প্রথম
    এখানে বাইরের লোক তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি

    তোমার খাওয়াদাওয়া, বাজার-হাট করতে হয় না?

    না।
    বাবুজীর
    লোক হপ্তায় দিন করে সব পৌঁছে দিয়ে যায়।

    প্রৌঢ় সূরযমল ও তার অপূর্ব সুন্দরী তরুণী নাতনীর এখানে বাস করা
    হতে সব কিছুই যেন একটা ঘন রহস্যের জালে ঘেরা।

    কিন্তু অদৃশ্য
    পরিচয় দানে অনিচ্ছুক সব ব্যাপারে সদা সতক প্রৌঢ়বর্ণিত বাবু-জীটি কে?

    কি সম্পর্ক সেই বাবুজীর
    এই প্রৌঢ় রাজপুত ও তার তরুণী
    সুন্দরী নাতনীটির সঙ্গে? কেনই
    বা সে এদের সদর
    রাজপুতানা হতে এই নির্জন স্থানটিতে
    এনে লুকিয়ে রেখেছে?
    কি উদ্দেশ্যে?

    কথায় বোঝা গেল, প্রৌঢ়ের নিকট হতে তার বাবুজীর কোন সংবাদই পাওয়া যাবে না। কিন্তু সংগ্রহ করতে হবে
    সংবাদটি।

    কেন হঠাৎ দেড় মাস যাবৎকাল রাজপুতানা হতে ঐ প্রৌঢ় সরমল সিং ও তার তরুণী নাতনী চন্দ্রলেখা
    বৌরাণীর বিলের দক্ষিণ প্রান্তে এই নির্জন কুটিরে বাসা বেধেছে?

    বিলের অপর প্রান্তে প্রমোদভবনের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই তো?

    এ বাড়িটা কার জানো সিংজী?
    কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

    না বাবুজী।

    কিরীটী যখন প্রমোদভবনে এসে পৌঁছল সূর্য তখন ঠিক মধ্যগগনে। তাম্রপাত্রের মত সমস্ত
    আকাশটা প্রখর তাপে যেন গনগন করছে। প্রচণ্ডঅগ্ন্যুত্তাপ যেন মাথার উপরে আকাশ হতে
    ঝরে পড়ছে।

    বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবিতা ও কল্যাণী। কল্যাণীর হাতের মধ্যে
    ধরা একটা চিঠির কাগজ। ওদের সামনে দাঁড়িয়ে নীল কোর্তা গায়ে কুলী শ্রেণীর একটা লোক। লোকটা বোধ হয়
    স্টেশনের কুলীই হবে।

    সাইকেলটা বারান্দার এক পাশে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বারান্দার
    উপরে উঠে এলো কিরীটী।

    সবিতার সমস্ত মুখখানা যেন উদ্বেগে থমথম করছে। কল্যাণীর চোখমুখেও
    চিন্তার ছায়া।

    ব্যাপার কি মিস
    সান্যাল?
    কিরীটীই ওদের দিকে অগ্রসর হতে হতে প্রশ্ন করে সর্বপ্রথমে।

    এই দেখুন, কল্যাণী হাতের কাগজটা কিরীটীর সামনে এগিয়ে দেয়।

    কি এটা? কাগজটা কিরীটী তার কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে তুলে ধরল। চিঠি।
    সংক্ষিপ্ত চিঠি একখানা। লিখেছেন নায়েব বসন্ত সেন। কৌতুহলভরেই চিঠিটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে কিরীটী।

    সুচরিতাসু
    মা সবিতা,
    কয়েকটা বিষয়ে জরুরী কাজে
    একান্ত বাধ্য হইয়াই আমাকে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাইতে হইতেছে। এবং সেই কারণেই
    আপাততঃ লক্ষ্মীকান্ত
    দারোগার কথা অগ্রাহ্য করিয়া যাইতে হইল। তুমি কোনরুপ চিন্তা করিও না। পার তো এবং
    সর্বদিকে মঙ্গল চাও তো কিরীটীবাবুকে বিদায় দিও তাহার যথাযোগ্য
    প্রাপ্য মিটাইয়া। বৃদ্ধ
    চিরমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী তোমার কাকাবাবুর
    এই অনুরোধটি রাখিও মা। এটা আমার একান্ত অনুরোধ। তোমার পিতাঠাকুর আজ মৃত। সেই মহাত্মার প্রতি যদি তোমার
    এতটুকুও সম্মান, শ্রদ্ধা বা কর্তব্য
    থাকে তাহা হইলে তাহার মৃত্যুরহস্যের
    অনুসন্ধানের ব্যাপার হইতে নিবৃত্ত হও। লক্ষ্মীকান্ত
    দারোগাকেও পৃথক
    পত্ৰ দিয়া গেলাম। টমটমটা স্টেশন-মাস্টারমশাইয়ের জিম্মায় রহিল, সেটা লইয়া যাইবার
    ব্যবস্থা করিবে।

    চিরআশীর্বাদক তোমার নায়েব কাকা

    বসন্ত সেন।

    কিরীটীই কুলীটার দিকে চেয়ে বললে, তুই যা। মাস্টারবাবুকে বলিস গাড়িটা বিকেলে লোক গিয়ে নিয়ে আসবে।
    বলতে বলতে পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে কিরীটী লোকটাকে বকশিশ দিল।

    কুলীটা হাসিমুখে সেলাম জানিয়ে চলে গেল।

    বসন্তবাবু
    এভাবে চলে গেলেন, এটা কি ভাল হলো মিঃ রায়?
    কথাটা বললে কল্যাণী।

    বিশেষ কোন কারণেই তাঁকে যেতে হয়েছে, চিঠিতেই তো তিনি জানিয়েছেন
    কল্যাণী। এ ব্যাপারে এত চিন্তার কি আছে?

    কিতু লক্ষ্মীকান্ত
    দারোগা!

    কল্যাণীর মুখের কথা শেষ হল না দেখা গেল ঝড়ের বেগে ধুলো উড়িয়ে এক
    অশ্বারোহী প্রমোদভ্রমণের দিকে আসছে।

    দ্রুতধাবমান
    অশ্বের লৌহক্ষুরের
    খট খট শব্দ ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে।

    কিরীটী সবিতা ও কল্যাণী তিনজনেই সোৎসুক অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে অশ্বারোহীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

    কে অশ্বারোহী! বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ক্ৰমে অশ্বারোহী
    স্পষ্ট হয়ে উঠলো এবং তাকে চেনাও গেল।

    ঝড়ের গতিতেই অশ্বারোহী
    সোজা একেবারে প্রমোদভবনের গেটের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে অভ্যস্ত দক্ষ অশ্বচালকের
    মতই মুহূর্তে
    অশ্বের বল্গা
    টেনে এক লহমায় যেন অশ্বের সমস্ত গতিকে রোধ করে জিনের পা-দানে পা দিয়ে নিচে নেমে
    দাঁড়ালেন।

    অশ্বের সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত ও মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে।

    অশ্বারোহীও ঘর্মাক্তকলেবর।
    বৃদ্ধ
    বয়সে পরিশ্রমে তখনও তিনি হাঁপাচ্ছেন। নিত্যানন্দ সান্যাল।

    টীকা