১৯. ডাঃ সান্যালের গৃহে
নীহাররঞ্জন গুপ্ত দ্বারাডাঃ সান্যালের গৃহে
রাস্তায়
নেমে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কিরীটী যেন কি ভাবে, তারপর আবার সে বাড়ির
গেটের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে, স্বল্প আলো-আঁধারে সে গাড়ির নম্বরটা দেখবার চেষ্টা
করলে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখল যে গাড়ির নাম্বার প্লেটই নেই—সেটা খুলে রাখা হয়েছে।
গাড়িবারান্দায় যেখানে গাড়িটা দাঁড় করানো ছিল সেখানে কাঁকর বিছানো। কিরীটী একটা
কাঁকর তুলে নিয়ে গাড়ির বডির উপর ঘষে ঘষে ইংরাজীতে লিখল K। তারপর আবার বের হয়ে
রাস্তায় এসে নামল।
রাত্রি প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। চারিদিকে অল্প অল্প আলো ফুঁটে উঠেছে। সবেমাত্র
দু-একজন করে লোক রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে।
কিরীটী নিশ্চিন্ত মনে হাঁটতে শুরু করল। আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে
ভুলপথে এসে পড়েছে তা সে নিজেও টের পয়নি। যখন খেয়াল হল তখন বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। লোকজন
গাড়িঘোড়া চলতে শর করেছে।
কিরীটী সামনেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে কিছু জলখাবার ও চা খেয়ে
নিল। তারপর রাস্তায় এসে নামতেই হঠাৎ ওর কানে এসে বাজল, মিঃ রায়!
কিরীটী চমকে উঠে ফিরে দেখলে সামনেই দাঁড়িয়ে ডাঃ সান্যাল ও মিঃ
সলিল সেন।
সুপ্রভাত! কোথায় চলেছেন?
ডাক্তারই প্রথমে প্রশ্ন করলেন।
এই…মানে সকালবেলা বেড়াতে বেড়াতে…। কিরীটী আমতা আমতা করে জবাব
দিল।
ডাক্তার মৃদু
মৃদু হাসতে লাগলেন, তারপর বললেন, একেবারে রাত্রিবাস চাপিয়েই বেড়াতে
বেরিয়েছেন দেখছি যে!
কিরীটী নিজের বেশভূষার দিকে সহসা এতক্ষণে তাকিয়ে লজ্জিত হল, একটু অপ্রস্তুতও হল। সত্যি, এ
খেয়াল তো তার মোটেই হয়নি। তাড়াতাড়ি সে কথাটা ঢাকবার জন্য কিরীটী হাসতে হাসতে
প্রশ্ন করলে, আপনিও মর্নিংওয়াকে বুঝি?
হ্যাঁ, না মানে, ভোরবেলা গেছলাম আমার এই বন্ধুর বাড়ি। এর পায়ে
হেটে বেড়ানোর শখ। তাই বেড়াতে বেরিয়েছি। আমার এ বন্ধুটিকে বোধ হয় চিনতে পারছেন না!
ইনি সি. আই. ডি ইনস্পেকটার মিঃ সলিল সেন।
বিলক্ষণ! আগেই এর সঙ্গে পরিচয় লাভের সৌভাগ্য হয়েছে, সুপ্রভাত মিঃ
সেন। বলে কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানাল।
মিঃ সেনও প্রতি-নমস্কার দিলেন মৃদু হেসে।
ডাঃ সান্যাল সলিল সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
ও তাই নাকি, বেশ বেশ।…কিন্তু মিঃ সেন, ধূর্জটিবাবুর আসল পরিচয়টুকু পেয়েছেন তো? ভদ্রলোক
চমৎকার গান গাইতে পারেন। আসছেন তো আজ আমার ওখানে, শুনবেন এর গান…এবার জাহাজে ওঁর
সঙ্গে আলাপ হল।
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, শুনবেন না মিঃ সেন ডাক্তার সান্যালের
কথা, বিনয় করে বড্ড বেশী বাড়িয়ে বলছেন। বরং ওঁরই বাজনার সুর এখনও আমার দু কান ভরে আছে।
যা বলেছেন মিঃ রায়। সত্যি অতি অদ্ভুত ওঁর বাজনার হাত যেন
সুধাবর্ষণ করে। মিঃ সেন বললেন।
মিঃ সেন, আপনি তো এদিকেই চলেছেন, চলুন আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে
যাব। বলে যেন একপ্রকার জোর করেই কিরীটী মিঃ সেনকে সঙ্গে করে এগিয়ে যায়।
পথে যেতে যেতে কিরীটী সংক্ষেপে ডাঃ সান্যালের কাছে যে কেন পরিচয়টা
তার গোপন করেছে সবই বলে।
***
দ্বিপ্রহরে ডাঃ সান্যালের গৃহে
সকলেই এসে হাজির হয়েছে—কিরীটী, সুব্রত, রাজু
ও মিঃ সলিল সেন।
কমিশনার রোডে ডাক্তার সান্যালের বাড়ি। মস্ত বড় দোতলা বাড়ি, বাড়ির
পিছনে ফলের বাগান ও গ্যারেজ। দোতলায় একটি ল্যাবরেটরী। তার পাশেই লাইব্রেরি ঘর।
দশ-বারোটা আলমারিতে ঠাসা ইংরাজী, বাংলা, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষার সব ডাক্তারীর বই।
শয়নঘরে একটা ছোট ক্যাম্পখাটে সামান্য একটা কম্বল বিছানো। তার ওপরে একটা কাশ্মীরী
চাদর পাতা। ঝালর-দেওয়া পরিষ্কার দুটি মাথার বালিশ। মাথার কাছে টী-পয়ের ওপরে একটা
টেবিলল্যাম্প ও তার পাশে ধ্যানস্থ বুদ্ধের ছোট্ট একটি পিতল-মুর্তি।…
ঘরে তিনটি ফটো—একটি ডাক্তারের মার এবং অন্য দুটি তাঁর বাবার ও বোনের।
ডাক্তার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের সবাইকে সর বাড়ি-ঘর দেখালেন।
খেতে বসে নানা গল্প করতে করতে ডাঃ সান্যাল একসময়ে প্রশ্ন করলেন,
মিঃ অমর বসুর
মৃত্যুর কোন কিনারা হল মিঃ সেন?
না,
এখনও তো কোন সন্ধান পাইনি।
ডাক্তার গম্ভীরভাবে
বললেন, কিন্তু খবরের কাগজওয়ালারা তো খুব বলছিল যে, এর মধ্যে কালো ভ্রমরেরও নাকি
হাত আছে!
কালো ভ্রমরের নাম শুনেই মিঃ সেন সহসা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন,
চাপা কণ্ঠে বলতে লাগলেন, কালো ভ্রমর! উঃ, একটিবার যদি সেই শয়তানকে–সেই দুশমনকে হাতের কাছে
পেতাম, তবে তার কাঁচা মাথাটাই চিবিয়ে খেতাম বোধ হয়।
মিঃ সেনের ভাব দেখে ডাক্তার সান্যাল হেসে বললেন, কালো ভ্রমরের
ওপরে আপনার যে ভয়ানক রাগ দেখছি মিঃ সেন!
রাগ কি আর সাধে হয় ডাক্তার! সভ্য সমাজের মধ্যে সে একটা গলিত কুষ্ঠ। সর্বত্র এমন বিভীষিকা সে জাগিয়ে তুলেছে যে
আঁতকে শিউরে উঠতে হয়।…শয়তান!
ডাক্তার এবারে যেন একটু গম্ভীর হলেন, বললেন, সত্যি সে বেটা বড় বাড়িয়ে
তুলেছে। আর আশ্চর্য লোকটার ক্ষমতা! ভয়ডর বলে কি কিছু ওর শরীরে নেই আপনাদের ডিপার্টমেন্টটাই বা
কেমন? সামান্য একটা ডাকাতের দলের আজ পর্যন্ত কিনারা করে উঠতে পারল না! দিনের পর
দিন সে
তার অত্যাচার চালিয়ে চলেছে!
পাপের ভরা তার পূর্ণ
হয়েছে। এবার তার সকল কিছুর হিসাবনিকাশ হবে দেখুন না, বললে রাজু।
এ কথাই হতে পারে না। একটা ডাকাতের দলকে খুঁজে বের করা যায়!
আপনাদেরও সে রকম চেষ্টা নেই মিঃ সেন। নইলে–
বললেন ডাক্তার মৃদু মৃদু
হাসতে হাসতে।
আহারাদির পর সলিল সেন বললেন, আমি এখন ঘণ্টা-দুয়েকের জন্য বিদায়
নেব। আবার চারটে সাড়ে চারটার মধ্যে ফিরব, জরুরী একটা কাজ আছে।
মিঃ সেন উঠে পড়লেন।
কিরীটী বললে, আমারও একটু
কাজ আছে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরব। সুব্রত, তোমরা এখানেই থেকো।
কিরীটীও মিঃ সেনের সঙ্গে উঠে গেল।
ছোট টু-সীটার
গাড়িখানি মিঃ সেনের। একজন ভৃত্য গাড়ির মধ্যে বসেছিল। সে গিয়ে ভিতরের সীটে বসল, মিঃ
সেন গিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসলেন।
মিঃ সেন কিরীটীর দিকে ফিরে গুডবাই বলে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। গাড়ি
চলতে শুরু করল। এমন সময় গাড়ির বডির পিছনদিকটায় নজর পড়তেই কিরীটী চমকে উঠল। কারণ সে
দেখলে গাড়ির গায়ে ঘষে ঘষে K অক্ষরটি তখনও স্পষ্ট রয়েছে।
বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটবার আগেই গাড়িটা সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে
খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে স্থানটা ধূমায়িত
ও পেট্রলের গন্ধে ভরিয়ে দিয়ে গেটের বাইরে চলে গেছে।
সহসা কিরীটীর চমক ভাঙল ডাক্তারের কণ্ঠস্বরে। ইতিমধ্যে কখন যে একসময়
ডাঃ সান্যাল নীচে নেমে একেবারে ওর পাশটিতে দাঁড়িয়েছেন সে টেরই পায়নি। ডাক্তার
বললেন, মিঃ রায়, আপনি যাবেন না বলছিলেন?
কিরীটী ততক্ষণে আপনাকে সামলে নিয়েছে, বললে, হ্যাঁ, এই যে যাই! বলে
সে গিয়ে রাস্তায় নামল।
***
সন্ধ্যার তখন আর খুব বেশী দেরি নেই।
দিনের আলোর বিলীয়মনি রশ্মিগুলো আকাশের মেঘের গায়ে গায়ে ইন্দ্রধনু রচনা করছে।
ঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিলের চারপাশে হেলানো বেতের চেয়ারে বসে
সুব্রত, কিরীটী, ডাক্তার সান্যাল, রাজু
ও মিঃ সলিল সেন।
কিরীটী গাইছিল—
দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ঐ ছায়া ভুলাল রে ভুলাল মোর প্রাণ! ওপারের ঐ সোনার কলে আঁধার মূলে কোন মায়াগেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান।…
কিরীটীর উদাত্ত কণ্ঠস্বর সান্ধ্য-প্রকৃতির গায়ে যেন মায়াজাল রচনা
করে চলেছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে সকলে শুনছে।
কিরীটী তখন গাইছে—
ফুলের বাহার নেইকো যাহারফসল যাহার ফলল না,অশ্রু যাহার ফেলতে হাসি পায়। দিনের আলো যার ফুরালোসাঁঝের আলো জ্বললো নাসেই বসেছে ঘাটের কিনারায়– ওরে আয়। আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনের শেষে শেষ খেয়ায়—
ধীরে ধীরে কিরীটী গানটা শেষ করল।
ইতিমধ্যে ডাক্তারের ভৃত্য ভোলা এসে ঘরের বৈদ্যুতিক আলো জালিয়ে দিয়ে
গেছে।
ওরা সবিস্ময়ে দেখল, ডাক্তারের দুচোখের কোলে দু ফোঁটা জল টলমল
করছে।
ডাক্তার মৃদুস্বরে
যেন কি বলছেন আত্মগতভাবে। তাঁর মনের মাঝে যেন বিষম ঝড় উঠেছে।
হঠাৎ একসময় ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে অশান্ত অস্থির পদে ঘরের মধ্যে
পায়চারি শুরু করেন।