Chapter Index

    নিশাচর ভূত

    চিনতে
    কষ্ট হয় না কিরীটীর ঐ মুহূর্তের
    দেখাতেই। লোকটা আর কেউ নয়, সেই চীনা আড্ডায় দেখা ভীষণ-দর্শন লোকটিই এই পৈশাচিক
    অনুষ্ঠানের হোতা।

    কিরীটী ভাবলে, তবে আমার হিসাব ভুল হয়নি। দলের নেতা ইনিই!
    স্বনামধন্য দস্যুরাজ
    কালো ভ্রমর! হ্যাঁ, লোকটার শক্তি আছে বটে। তাহলে দস্যুরাজ আমাদেরই সহযাত্রী!

    প্যাকিং করা বাক্সগুলোর আড়ালে কিরীটী স্তম্ভিত ভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল
    তা নিজেই বুঝতে পারেনি। যখন খেয়াল হল তখন সে আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে এল।

    রাতও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চোখ দুটো জালা করছে। বেশ ঘুমও পেয়েছে।

    কিরীটী ধীরে ধীরে এসে কেবিনে প্রবেশ করল এবং দরজাটা বন্ধ করে
    শয্যার ওপরে এসে গা এলিয়ে দিল। সাগরের দোলায় দোলায় অল্পক্ষণের মধ্যেই কিরীটী ঘুমিয়ে
    পড়ল একসময়।

    পরের দিন যখন কিরীটীর ঘুম ভাঙল, বেলা তখন প্রায় সাড়ে আটটা হবে,
    প্রভাতী চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

    সুব্রত
    ও রাজু
    তখন কেবিনে ছিল না—সম্ভবত ডেকে বেড়াতে গেছে।

    একটু পরেই জংলী কেবিনে ঢুকে বলল, চা বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বাবুজি!

    হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। আমি একেবারে স্নানটা সেরে আসি। বলে কিরীটী তোয়ালে
    ও একটা ঢোলা পায়জামা নিয়ে স্নানঘরের দিকে পা বাড়াল।

    স্নান
    সমাপ্ত করে আসতে আসতেই ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা শোনা গেল। ব্রেকফাস্ট সেরে আবার ওরা
    সকলে যখন ডেকের ওপর এল, তখন একে একে অনেক যাত্রীই ডেকের ওপর এসে জড় হতে শুরু
    করেছে।

    একটি বছর সাতেকের মেয়ে ডেকের ওপর স্কিপিং করছিল।

    ডাঃ সান্যালও ডেকেই ছিলেন। সুব্রত ও রাজু ডাঃ সান্যালের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ
    পরে কিরীটী যখন ওদের দলে এসে মিশল, ডাঃ সান্যাল, সুব্রত ও রাজু তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কিরীটী
    ওদের একপাশে এসে দাঁড়াল।

    সুপ্রভাত! কিরীটী জবাব দিল।

    একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে
    কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে একটু মৃদু
    হেসে ডাক্তার বললেন, কাল বুঝি রাতটকু আপনার না ঘুমিয়েই কেটে গেছে, মিঃ রায়?

    কিরীটী আনমনা ভাবে জবাব দিল, না, বেশ ঘুম হয়েছিল তো!

    আর বিশেষ কোন কথাবার্তা হল না। সবাই একমনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে
    রইল।

    চারিদিকে কেবল জল। জল আর জল। নীল জলরাশি গভীর উচ্ছাসে ঢেউয়ের তালে
    তালে নেচে ফিরছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন অস্ফুট সরে কি সব বলাবলি করছ।

    সুনীল আকাশ রুপালী
    রোদের আভায় ঝিলমিল করছে।

    ***

    সন্ধ্যায় ডাঃ সান্যালের কেবিনে সুব্রত, রাজু ও কিরীটী চা-পান করতে করতে ডাক্তারের সঙ্গে
    গল্প করছিল। কেবিনের মধ্যে স্টোভে চা তৈরী হয়েছে।

    ডাক্তার বলছিলেন, বিশ্বাস জিনিসটা মানুষের মনের সহজ প্রবৃত্তি। যুক্তি দিয়ে তাকে
    খাড়া করা যায় না। এই দেখুন
    না, আমি সকলকেই বিশ্বাস করি, আবার কাউকেই বিশ্বাস করি না। এক-এক সময় আমাদের এক-একটা
    ব্যাপারে বিশ্বাস না করা ছাড়া আর উপায়ই থাকে না। মন না মানলেও আমরা তাকে মেনে নিতে
    বাধ্য হই। তেমনি প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দুরকমের
    প্রবৃত্তি
    ঘুমিয়ে থাকে। অতি বড় শয়তান যে, তার বুকেও ভাল প্রবৃত্তি আছে। আবার সত্যসত্যই যে
    অতি নিরীহ ও একান্ত ধীরস্থির, তারও বুকে হয়তো শয়তানপ্রবৃত্তি ঘুমিয়ে থাকে। গাছের গোড়ায়
    জল ঢালতে ঢালতে যেমন সেটা ক্ৰমশঃ বড় হতে হতে শেষটায় শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে
    চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের মনের ভিতরেও যে প্রবৃত্তিটা নিয়ে আমরা বেশী নাড়াচাড়া
    করি যেটাকে
    আমরা বেশী প্রশ্রয় দিই, সেইটাই শেষ পর্যন্ত আমাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।
    যে চোর, যে ডাকাত, তার অন্তরেও হয়তো একটা নিরীহ প্রবৃত্তি ঘুমিয়ে আছে।

    কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, কিতু দুষ্কর্ম করতে করতে দুজনের এমন
    একটা স্বভাব হয়ে দাঁড়ায় যে, কিছুতেই সে আর ভাল পথে চলতে চায় না। পেচা যেমন আলো পরিহার করে চলে, দুর্জনেরাও তেমনি ভাল যা কিছ,
    তা এড়িয়ে চলে।

    আগের দিন সন্ধ্যার মত সেদিনও ডাঃ সান্যাল ক্রমশ যেন কেমন একটু চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন। সেটা
    লক্ষ্য করে সুব্রত
    শুধাল, আপনার কি শরীর খারাপ হয়েছে, ডাঃ সান্যাল?

    ডাক্তার কেমন একপ্রকার অন্যমনস্কের মত যেন জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন,
    সন্ধ্যার দিকে মরফিয়া ইনজেকশন নেওয়া আমার একটা বদ অভ্যাস, আপনারা যদি কিছু মনে না
    করেন তবে… বলে ডাক্তার উঠে গিয়ে সুটকেস থেকে সিরিঞ্জ বের করে ইনজেকশন নেবার জন্য
    প্রস্তুত হতে লাগলেন।

    সিরিঞ্জের মধ্যে ঔষধ ভরে ডান হাতটা বৈদ্যুতিক আলোর কাছে তুলে ধরে তিনি ঔষধটা শরীরের
    মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।

    সিরিঞ্জটা যথাস্থানে রেখে ডাক্তার যেন অনেকটা হৃষ্টচিত্তেই নিজের
    আসনে এসে উপবেশন করলেন।

    ডাক্তারের সেই অস্থির-অস্থির
    ভাবটা ক্ৰমশঃ ঠিক হয়ে পূর্বের
    প্রফুল্লতা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগল।

    এই দেখুন। বলতে বলতে ডাক্তার বাঁ হাতের আস্তিনটা গুটিয়ে সেটা আলোর
    নীচে সকলের চোখের সামনে প্রসারিত করে ধরলেন—হাতে অসংখ্য কালো কালো দাগ। একটু পরে
    তিনি আবার বলতে লাগলেন, দেখুন, মরফিয়া নিয়ে নিয়ে হাতটা একেবারে ভরে গেছে। কিন্তু
    কি করব বলুন, শরীরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করি সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই,
    আর সেই যন্ত্রণায় আমার সমগ্র শরীরটা যেন বিষের মত জ্বলতে থাকে। তাই মরফিয়া নিতে হয়।

    সুব্রত প্রশ্ন করল, আচ্ছা এতে কি শরীরের কোন ক্ষতি হয় না, ডাঃ
    সান্যাল?

    ডাক্তার হেসে বললেন, ক্ষতি হয় বৈকি। আমাদের মস্তিষ্কে যন্ত্রণাবোধের
    যে স্নায়ুকেন্দ্র
    আছে, সেখানকার স্নায়ুকোষে যন্ত্রণা-বোধ-বাহী স্নায়ু যন্ত্রণা বোধকে বহন করে নিয়ে যায় এবং তাতেই
    আমরা দেহের কোন না কোন স্থানে যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝতে পারি। এ মরফিয়া সেই যন্ত্রণা-বোধ-বাহী স্নায়ুকে অবশ করে দেয়। তার ফলে
    যন্ত্রণা-বোধ-স্নায়ু দিয়ে যন্ত্রণাটা
    প্রবাহিত হয়ে মস্তিকে আর উপস্থিত হতে পারে না বলেই যন্ত্রণার উপশম হয়।

    কিন্তু এইভাবে মরফিয়া নেওয়াটা কি একটা নেশা নয়?

    ডাক্তার একটু হাসলেন, তারপর বললেন, নিশ্চয়ই নেশা বৈকি! নেশা…বদ
    অভ্যাস। বুঝতে কি আমি পারি না, পারি বুঝতে পারি সব, কেননা আমি একজন ডাক্তার। তবু নিজেকে সংযত করতে পারি
    না। কোন এক অদৃশ্য
    শক্তি যেন আমার সমস্ত দেহমনকে অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ সিরিঞ্জ ও মরফিয়ার দিকে
    ঠেলতে থাকে। আমি পারি না, কিছুতেই নিজেকে রোধ করে রাখতে পারি না।

    ডাক্তারের মুখে একটা করুণ অসহায় ভাব ফুটে ওঠে।

    রাত্রি বৃদ্ধি
    হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর দেহ ও মন কি জানি কেন সেই প্যাকিং-করা বাক্সগুলোর দিকে
    টেনে নিয়ে যেতে চায়। আকর্ষণটা কিছুতেই রোধ করতে পারে না কিরীটী, তাই গায়ে একটা
    ধুসর বর্ণের নিদ্রাবস্ত্র চাপিয়ে, মাথায় একটা নাইট-ক্যাপ এটে সেটাকে টেনে একেবারে
    কপালের নীচ পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে, কিরীটী কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। রেডিয়াম দেওয়া
    হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত্রি তখন দেড়টা।

    অতি সন্তর্পণে নীচে দোতলায় ডেকের দিকে চলল কিরীটী।

    প্যাকিং-করা বাক্সগুলো যেখানে একটার ওপর একটা সাজানো আছে, তার আড়ালে
    এসে কিরীটী থমকে দাঁড়াল। আর ঠিক ঐ সময়ে কতকগুলো ফিস ফিস আওয়াজ তার কানে এল। মনে
    হল, দুজন লোক যেন নিম্নকণ্ঠে কথাবার্তা বলছে।

    কেউ কিছু টের পেয়েছে?

    না।

    ঠিক জান?

    হ্যাঁ।

    এই ঔষধটা আজও আবার শেষরাত্রে লোকটার শরীরে ইনজেকশন করে দেবে। আর
    যেমন বলে রেখেছি ঠিক তেমনি ব্যবস্থা করবে। কোন গণ্ডগোল হবে না; ক্যাপ্টেনের সঙ্গে
    আমার কথা হয়েছে। সে বাধা দেবে না।

    এর পরে আর কোন কথা শোনা গেল না। লোক দুটো তখন চলে গেছে বোধ হয়। মাঝে মাঝে শুধু সাগরের একটানা গর্জন
    আঁধারের বুকে ভেসে আসে।

    তারপর সহসা একসময় একটা অস্পষ্ট গোঁ গোঁ শব্দ শুনে কিরীটী চমকে
    উঠল। ঐ পাশে সিঁড়ির নিচেটা যেখানে এসে শেষ হয়েছে, সেদিক থেকে আওয়াজটা আসছে বলে মনে
    হল। কিরীটী দ্রুতপদে এগিয়ে গেল।

    সিঁড়ির নীচে সে জায়গাটায় তত আলো নেই। সিঁড়ির গায়ে যে বৈদ্যুতিক আলোটা জ্বলছে, তার ক্ষমতাও খুব
    বেশী নয়। সেই অস্পষ্ট আলোতে দেখা গেল সিঁড়ির নীচে একটা লোক পড়ে গোঁ গোঁ করছে।

    কিরীটী লোকটার মুখের ওপর ঝুকে পড়ে দেখল, লোকটা কোন কারণে অজ্ঞান হয়ে
    গেছে। সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির ধারে যে কলিং বেল ছিল, সেটা টিপে দিলে।

    দেখতে দেখতে জাহাজের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হতে আরম্ভ করে খালাসীরা
    পর্যন্ত অনেকেই এসে হাজির হল।

    সকলের মুখেই শঙ্কিত ভাব।

    একজন খালাসী ক্যাপ্টেনের আদেশে লোকটির চোখ-মুখে জল দিতে শুর করলে।
    জাহাজের ডাক্তার খবর পেয়ে ছুটে এলেন এবং নাড়ি দেখে বললেন, ও কিছু নয়, কোন কারণে হয়তো
    অজ্ঞান হয়ে গেছে।

    লোকটি অল্পক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসল। চোখ-মুখে তার তখনও
    একটা ভয়াত ভাব। চারিদিক চকিত দৃষ্টিতে দেখে লোকটা অস্ফুট ঘরে কেবল বললে, ভূত ভূত!

    জাহাজের মেট শুধায়, ভূত! কি বলছিস রে?

    হ্যাঁ কর্তা, ভূত! আমি দেখেছি, স্বচক্ষে দেখেছি। এই দেখুন আমার গলা টিপে ধরেছিল।
    উঃ, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বলে লোকটি আবার হাঁপাতে লাগল।

    লোকটার কথা শুনেই সকলে যেন একটু ভয় পেয়ে গেছে। বুড়োগোছের একজন খালাসী এগিয়ে
    এসে বলল, আমিও কাল রাত্রে এমনি সময় ওই বাক্সগুলোর পিছনে কি একটা দেখেছিলাম। উঃ, কী
    ভীষণ মুখ
    তার! এই পর্যন্ত বলেই বুড়ো ভয়ে চোখ বুজল।

    সমবেত সমস্ত লোকের মনেই কেমন একটা অস্পষ্ট আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
    সকলেই একটা শঙ্কিত চাউনি নিয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ক্যাপ্টেনের মুখটাও গম্ভীর হয়ে গেল।

    রাত্রি আর বেশী নেই। একটি দুটি করে আকাশের তারাগুলো নিভতে শুরু
    করেছে।

    টীকা