Chapter Index

    অনুসন্ধান

    রাত্রি
    তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা।

    বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট প্রায় জনশূন্য হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে শুধ,
    দু-একটা মোটরগাড়ির হর্ন কিংবা রিকশার ঠং ঠং আওয়াজ পাওয়া যায়।

    জনহীন শহরে যেন ক্ষীণ প্রাণস্পন্দন।

    দোকানপাট প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দু-একটা জুতোর দোকান তখন অবিশ্যি খোলা।
    কোন দোকানে খদ্দের নেই, কেবল দোকানে ক্যাশিয়ার খাতার ওপর ঝুকে পড়ে সারা দিনের
    বেচাকেনার জমাখরচ ঠিক করছে। এক দোকানের পাশে কয়েকটি চীনা জটলা পাকিয়ে নিজেদের
    মধ্যে তর্কবিতর্ক করছে।

    একটা তেতলা বাড়ির নীচে বাঁধানো রোয়াকে কতকগুলো ভিখারী জড়ো হয়ে নিজেদের
    সুখ-দুঃখের কথা বলছে। তাদের কেউ কেউ আবার দেয়াল থেকে প্ল্যাকার্ড ছিড়ে নিয়ে শোবার
    ব্যবস্থা করছে।

    কিরীটী সে-সব দিকে লক্ষ্য না করে এগিয়ে চলল। লালবাজার থানাটা ছাড়িয়ে
    একট, এগিয়ে এসেই কিরীটী কি ভেবে দাঁড়াল।

    একখানা ট্যাক্সি সেদিকে আসছে। ট্যাক্সিটাকে হাত-ইশারায় দাঁড় করিয়ে
    ট্যাক্সিতে উঠে বললে, টালিগঞ্জ–

    ক্লান্ত অবসন্ন কিরীটী চলমান ট্যাক্সির নরম গদিতে গা এলিয়ে দেয়।

    ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে-মুখে এসে যেন শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে যায়।
    ট্যাক্সি ছুটে চলেছে টালিগঞ্জের দিকে।

    নিস্তব্ধ নিশীথ রাত্রি।

    মাথার ওপরে সীমাহীন কালো আকাশ যেন সর্বাঙ্গে তারার রত্নখচিত ওড়না
    জড়িয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন।

    চৌরঙ্গীর দীপমালা-শোভিত পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি বেগে ছুটে
    চলেছে। গাড়ির সীটে দেহভার এলিয়ে দিয়ে কিরীটী চোখ বুজে পড়ে থাকে।

    বাড়িতে পৌঁছে কড়া নাড়তেই জংলী এসে দরজা খুলে দেয়। ট্যাক্সির ভাড়াটা
    দিয়ে দেয় জংলী।

    ভাড়া মিটিয়ে ওপরে এসে জংলী দেখে কিরীটী একটা সোফয়ি হেলান দিয়ে চোখ
    বুজে পড়ে আছে। জংলী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কিরীটীর জামায় রক্ত দেখে সবিস্ময়ে বলে, ও
    কি বাবুজি,
    এমন করে জখম হল কি করে বাবুজি!

    পিছন হতে অন্ধকারে ছুরি মেরেছে রে! তুই এক কাজ কর—ইলেকট্রিক
    স্টোভে খানিকটা জল গরম করে নিয়ে আয়। আর ঐ পাশের ঘরের সেলফে আইডিন আর তুলে আছে, নিয়ে
    আয়।

    জখম খুব গুরতর হয়নি। ক্ষতস্থান বেশ ভাল করে চেপে বেধে দিয়ে জংলী
    কিরীটীকে হাত ধরে এনে শয্যায় শুইয়ে দিল। ফাস্ট এইড দেওয়া কিরীটীর নিকটেই জংলীর
    শিক্ষা।

    পরের দিন সকালে যখন কিরীটীর ঘুম ভাঙল তখন ভোরের সোনালী রোদে সুনীল
    আকাশ যেন ঝকঝক করছে। খোলা জানালা দিয়ে খানিকটা প্রভাতী রোদ পায়ের ওপর এসে পড়েছে।
    বারান্দায় খাঁচায় পোষা ক্যানারী পাখিটা থেকে থেকে শিস দিচ্ছে। বাগানে বোধ হয়
    রজনীগন্ধা তার মধুর মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে আনে।

    কিরীটীর গা-হাত-পায়ে অল্প অল্প বেদনা আছে, মাথাটাও যেন একটু ভারী-ভারী মনে হয়।
    শয্যার উপর চোখ বুজে শুয়েই কিরীটী গতরাত্রের সমস্ত কথা আগাগোড়া একবার ভাববার
    চেষ্টা করে। গতরাত্রের দুঃসাহসিক অভিযানের ব্যাপারটা এখনও মনের উপর ছায়াবাজির মত
    ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

    নিঃশব্দে জংলী এসে ঘরে প্রবেশ করে। বললে, বাবুজি! তবিয়ত আচ্ছি হ্যায় তো?

    হ্যাঁ, বহুৎ
    তন দুরস্তি মালুম হোতা,
    এক কাপ চা নিয়ে আয় তো বাবা! শয্যা ত্যাগ করে কিরীটী বাথরুমে গিয়ে প্রবেশ করল।

    মুখ হাত ধুয়ে মাথাটা বেশ করে জলে ভিজিয়ে, স্নানের ঘর থেকে
    নিষ্ক্রান্ত হয়ে শিস দিতে দিতে কিরীটী বসবার ঘরে এসে ঢুকতেই সুব্রত ও রাজুকে সেখানে বসে থাকতে দেখল। অভ্যর্থনার পরে
    হাসতে হাসতে বলে ওঠে, সুপ্রভাত—সুপ্রভাত! কতক্ষণ এলেন?

    অল্পক্ষণ। তারপর কেমন আছেন? শুনলাম কাল রাত্রে নাকি হাতে জখম হয়েছেন।
    প্রশ্ন করে সুব্রত।

    হ্যাঁ, ও কিছু নয়। চলুন চা-পর্বটা শেষ করে একবার কালকের আড্ডাটায়
    হানা দিয়ে আসা যাক, যদি কিছুর সন্ধান মেলে।

    তাতে কি কোন ফল হবে, আপনি মনে করেন? বলা যায় না, তাছাড়া যদি—

    সুব্রত ও রাজু,
    কিরীটীর কথায় হো হো করে হেসে উঠল। সুব্রত বলল, —যদি কি? যদি একপাটি ছেড়া জুতো বা
    একটা ভাঙা ছুরির
    বাঁট নিদেনপক্ষে দেওয়ালের গায়ে একটা হাতের ছাপ পাওয়া যায়?

    কিরীটী ওদের কথার ভঙ্গিতে মৃদু
    মৃদু হাসতে লাগল। বললে, হ্যাঁ, ডিটেকটিভরা নাকি ঐ সব সুত্র ধরেই অনেক
    সময় বড় বড় পাপানুষ্ঠানেরও কিনারা করে ফেলেন শুনতে পাওয়া যায়।

    জংলী এসে চায়ের ট্রে হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। এবং সামনের পিয়ের
    ওপর ট্রে-টা নামিয়ে রাখল।

    চা-পানের পর তিনজন রাস্তায় এসে নামল।

    এর মধ্যেই বাইরে রৌদ্রের তাপ বেশ প্রখর হয়ে উঠেছে। একটা ট্যাক্সি
    ভাড়া করে তিনজনে উঠে বসল।

    একসময় কিরীটী বললে, আমরা তো কালই রওনা হচ্ছি! কি বলেন, সুব্রতবাবু?

    হু।
    কিন্তু সনৎদার কোন একটা কিনারা তো হল না এখনও! বললে সুব্রত।

    সনৎবাবু আপাততঃ কলকাতাতেই আছেন।

    কিরীটীর কথায় রাজু
    ও সুব্রত
    চমকে উঠে বিস্ময়-ভরা কণ্ঠে শুধাল, সে কি!

    হ্যাঁ। কাল রাত্রে সামান্য একটু ভুলের জন্য তাঁকে সেই শয়তানের
    আড্ডায় ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত আছি।

    কি?

    তাঁকে তারা প্রাণে মারবে না।

    তাদের আপনি চেনেন না মিঃ রায়। এ সংসারে তাদের অসাধ্য কিছুই নেই।
    এমন কোন পাপ কাজ বা দুষ্কর্ম নেই যা ওদের বিবেকে বাধে। ওরা নেকড়ের চেয়েও হিংস্র,
    সাপের চেয়েও খল।

    কিরীটী মৃদু
    মৃদু হাসতে লাগল। পরে গভীরভাবে বললে, কিন্তু এক্ষেত্রে মেরে ফেললে যে
    ওদের কাজ হাসিল হবে না সুব্রতবাবু।
    যে ফাঁদ ওরা
    পাততে চায় সে বড় বিষম ফাঁদ। কিন্তু ওদের হিসাবেই সামান্য একটু ভুল হয়ে গেছে এবং সেইটকু শুধরে নেওয়ার জন্য
    ওরা বোধ হয় সনৎবাবুকে
    নিয়েই কালকের জাহাজে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রেঙ্গুন রওনা হবে, এই পর্যন্ত বলে কিরীটী একে একে
    গতরাত্রের সমস্ত ঘটনাই আগাগোড়া খুলে ওদের বলে গেল।

    সুব্রত কিরীটীর মুখে গতরাত্রের আনুপূর্বিক কাহিনী শুনে বললে, তা
    হলে দেখছি সত্যসত্যই আপনি ভাগ্যবান। প্রথম যাত্রাতেই মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ মিলে গেল!

    কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, না, এবারেই প্রথম সাক্ষাৎ নয়। ইতিপূর্বে
    আরও একবার দর্শন মিলেছিল।

    সে কি! দুজনেই একসঙ্গেই প্রশ্ন করল।

    হ্যাঁ, খোঁড়া ভিক্ষুকই
    স্বয়ং মহাপ্রভু। বলে আবার কিরীটী খোঁড়া ভিক্ষুকের
    কাহিনীটাও ওদের বললে।

    ট্যাক্সি ছুটে চলেছে চীনাপট্টির উদ্দেশে। রাজপথে অসংখ্য লোক।
    পিপীলিকার সারির মত যে যার গন্তব্যপথে
    চলেছে। অফিস টাইম। বাসট্রামগুলো যাত্রীতে যেন একেবারে ঠেসা।

    কিরীটী বললে, একটা কথা ভাবছি, চীনাপট্টিতে হুট করে গিয়ে আগেই ওঠা বুদ্ধিমানের কাজ হবে
    না। আটঘাট বেধে কাজে নামতে হবে।

    কি করবেন তাহলে? সুব্রত
    প্রশ্ন করে।

    আমরা প্রথমে লালবাজারে যাব, সেখানে চৌধুরী বলে একজন সি. আই. ডি,
    ইন্সপেকটারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট আলাপ-পরিচয় আছে। তাকে সব কথা খুলে বলে লালপাগড়ির
    সাহায্য নিতে হবে।

    লালপাগড়ি!

    হ্যাঁ, জানেন না তো, চোর-ডাকাত-গুণ্ডা মহলে লালপাগড়ির মহিমা অপরিসীম।

    লালবাজারের কাছাকাছি এসে ওরা
    ট্যাক্সিটা বিদায় করে দিল ভাড়া মিটিয়ে।

    চৌধুরী অফিসেই ছিল। কিরীটী তাকে সংক্ষেপে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে
    বলবার পর চৌধুরী
    সানন্দে কিরীটীকে সাহায্য করতে রাজী হয়ে গেল। এবং চৌধুরীর নির্দেশমত তখনই থানা
    থেকে দুজন কনস্টেবল কিরীটী তার সাহায্যের জন্য পেল।

    থানা থেকে বের হয়ে কিরীটী সদলবলে যখন হংকং সু ফ্যাক্টরীর সামনে এসে হাজির হল, বেলা তখন
    প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।

    দোকানের ঠিক সামনে একজন প্রৌঢ়বয়সী চীনা একটা কাঠের টুলের ওপরে বসে
    একটা লম্বা পাইপ মুখে গুজে ঝিমোচ্ছিল। ওদের জুতোর শব্দে লোকটা হঠাৎ চমকে মুখ তুলে তাকাল
    এবং পরক্ষণেই সাদরে আহবান জানাল, জুতি
    সাব! আচ্ছা জুতি!

    দোকানের ভিতরে একটি অল্পবয়সী চীনা যুবতী কাঁচি দিয়ে চামড়া কাটছিল
    আর মেসিনে বসে একজন আধ্যবয়সী চীনা যুবক কি যেন সেলাই করছিল।

    কিরীটীদের সকলকে দোকানে প্রবেশ করতে দেখে ওরা দুজনেই মুখে তুলে
    একবার মাত্র চেয়ে আবার যে যার কাজে মন দিল। দোকানটি যে খুব বড়গোছের তা নয়।

    নাতিপ্রশস্ত একখানা হলঘর। ওপরে প্ল্যাটফরমের মত কাঠের রেলিং দিয়ে
    ঘেরা। একপাশে পুরানো
    চামড়ার টুকরো স্তুপাকার করে রাখা হয়েছে। অন্য একপাশে দেখা যায় ওপরে ওঠবার জন্য
    একটা কাঠের সিঁড়ি। কিরীটী তার খরসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে চারিদিকে ভাল করে দেখতে
    লাগল।

    কনস্টেবল দুজন কিরীটীর নির্দেশেই দোকানের ভিতর ঢোকেনি। তারা
    ওদিককার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

    কি জুতি
    চাই বাব?—প্রশ্ন করলে চীনা যুবকটি আধো আধো বাংলায়।

    কিরীটী গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা তোমাদের দোকানঘরটা একবার সার্চ করব
    বলে এসেছি।

    কথাটা শোনামাত্র চীনা যুবকটি মেশিন ছেড়ে উঠে এল এবং বেশ পরিষ্কার
    ইংরাজীতে শুধাল, কেন, কি কারণে জানতে পারি কি?

    কিরীটী দোকানের ভিতর চারিদিকে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করতে করতে উদাস স্বরে জবাব দেয়,
    সরকারের হকুম।

    চীনা যুবক রুক্ষ
    স্বরে
    জবাব দিল, তোমার ও হকুম আমি মানি না বাবু।
    এখনই তুমি আমার দোকান থেকে বেরিয়ে যাও, তা না হলে বিপদে পড়বে।

    কিরীটী গভীরভাবে জবাব দেয়, বিপদে আমি পড়ব না, আমায় না দেখতে দিলে
    তুমিই বিপদে পড়বে সাহেব।

    ইতিমধ্যে ওদের কথা-কাটাকাটির আওয়াজ পেয়ে পাশের একটা দরজা খুলে আরও
    দুজন হোমরাচোমরা গোছের চীনা বেরিয়ে এল। তারা বললে, কি হল বাবু?

    কিরীটী ওদের দিকে একান্ত তাচ্ছিল্যভরে চেয়ে জবাব দিল, এই দোকানটা
    একবার আমরা ভাল করে দেখতে চাই।

    কেন?
    রুক্ষ স্বরে একজন প্রশ্ন করে।

    কিরীটী যেন ওদের ভ্রুক্ষেপমাত্রও
    না করে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন সুব্রতবাবু, আমরা আমাদের কাজ করি।

    কিরীটীর মুখের কথা শেষ হল না, চোখের পলকে ওদের একজন সুব্রতর সামনে
    এসে দাঁড়াল এবং মুহূর্তে
    সেই পরিষ্কার দিবালোকেই একখানা সুতীক্ষ্ণ বাঁকানো ছুরি ওদের গতিপথ রোধ করে।

    টীকা