Chapter Index

    এই
    দিকে এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি
    দুটো। কাছে—আরো কাছে। ততক্ষণে তাদের অস্পষ্ট কথাবার্তার দু-একটা টুকরো টুকরো শব্দও
    কানে আসছে।

    চমকে উঠলাম এবার, চিনতে পেরেছি ওদের। শতদল ও সীতা। দূরের একটানা সমূদ্রগর্জনকে ছাপিয়েও ওদের মৃদু কথার শব্দতরঙ্গ আমার
    কানে এসে প্রবেশ করছিল। অন্ধকারে স্পষ্ট না দেখতে পেলেও কণ্ঠস্বরে ওদের চিনেছি।
    সীতা বলছিল, তুমি জান না শতদল
    মায়ের দৃষ্টি
    কী অসম্ভব প্রখর। আমার মনে হয়, ঘুমের মধ্যেও তাঁর দুচোখের দৃষ্টি আমার সমস্ত
    গতিবিধির ওপরে রেখেছেন। তিনি যদি ঘুর্ণাক্ষরেও
    জানতে পারেন এত রাত্রে তোমার সঙ্গে আমি বাড়ির বাইরে এসেছি।

    সেই জন্যই আরও ‘নিরালা’র বাইরে এলাম। তোমার মার
    শকুনির মত দৃষ্টি। সত্যি বলছি, আমার গা শিরশির করে। শতদল জবাব দেয়, তাই তো চিঠি লিখে তোমায় এত রাত্রে এই
    বাইরে ডেকে এনে তোমার সঙ্গে দেখা করবার ব্যবস্থা আমাকে করতে হয়েছে!

    কিন্তু আমি যে তোমার চিঠি পেয়ে এত রাত্রে বাইরে আসব ভাবলে কী করে?
    যদি না আসতাম?

    আমি জানতাম তুমি আসবেই, সেই জন্যই চিঠি দিয়েছিলাম। যাক, এই
    পাথরটার উপরেই এস বসা যাক।

    পথের ধারে একটা বড় পাথরের উপর দুজন পাশাপাশি বসল আমার দিকে পিছন
    ফিরে। এ একপক্ষে ভালই হল। আমি যে পাথরটার আড়ালে আত্মগোপন করে ছিলাম সেই পাথরটা
    থেকে হাত-তিনেক দুরেই বড় পাথরটার উপরে দুজনে পাশাপাশি বসেছে।

    মাথাটা একটু উঁচু
    করে দেখলাম, পিছন ফিরে সীতা বসে আছে, সাগরবাতাসে তার শাড়ির আঁচলটা ও খোলা চুলের রাশ উড়ছে। সীতার একেবারে গা
    ঘেষে বসে আছে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে শতদল।

    শতদলের কথায় সীতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর একসময় বলে, সব কিছুর পরেও তুমি কি আশা
    করেছিলে শতদল যে আমি আসব তোমার চিঠি পেয়ে?

    তুমি আমাকে আগাগোড়াই ভুল বুঝেছ সীতা!

    সব জায়গায় ভুল করলেও একটা জায়গায় মেয়েমানুষ বড় একটা ভুল করে না। সীতা জবাব দেয়।

    মানুষ মাত্রেই ভুল করতে পারে সীতা, তা সে কি মেয়েই হোক বা পুরুষেই হোক। একতরফা তুমি
    বিচার করেছ।

    একতরফা বিচার করেছি! সীতার কণ্ঠে যেন বিস্ময়ের সুর ধনিত হয়ে ওঠে।

    নিশ্চয়ই। কেন যে তুমি হঠাৎ আমার ওপরে বিরাগ হয়ে উঠলে সেটা তুমি
    আমায় জানানো পর্যন্ত কর্তব্যবোধ করলে না!

    জলের মতই যেখানে সব কিছু পরিষ্কার, সেখানে গলা উচিয়ে জানাতে যাওয়াটা
    কি বিড়ম্বনা নয়? কিন্তু কাসুন্দি ঘেটেই বা কি আর লাভ বল?

    তাহলে সত্যি-সত্যিই তুমি আমাদের অতীত সম্পর্কটাকে একেবারে
    নিশ্চিহ্ন করে ধুয়ে-মুছে ফেলতে চাও সীতা?

    সব দিক দিয়ে এক্ষেত্রে সেটাই তো বাঞ্ছনীয় শতদল। সেতারের একবার তার
    ছিড়ে গেলে আর কি ছেড়া তার জোড়া লাগালে পূর্বের
    সেই সুরে
    বের হয়! তবে কেন আর?

    কোন কথাই তাহলে তুমি আর আমার শুনতে চাও না?

    মনে মনে আমি সীতার কথা শুনে না হেসে পারি না। এমনই মেয়েদের মন
    বটে! সমস্ত সম্পর্ক
    শতদলের সঙ্গে ধুয়ে-মুছে গেছে বলেই বুঝি শতদলের একখানা চিঠি পেয়ে এই নিশুতি রাত্রেও
    বাড়ির বাইরে আসতে দ্বিধাবোধ করেনি?

    শোন সীতা, কি কারণে তুমি হঠাৎ আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছ না।
    জানি না। তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় তো আজকের নয়—গত তিন বৎসর হতে—এই তিন বৎসরেও কি
    আমাকে তুমি বুঝতে পারনি?

    এতদিন তোমাকে আমি বুঝতে পেরেছি বলেই আমার ধারণা ছিল কিন্তু এখন
    বুঝতে পারছি আমার সে জানাটাই ভুল! কিন্তু সে কথা থাক। কি জন্য এত রাত্রে এভাবে
    চিঠি লিখে তুমি আমাকে এখানে ডেকে এনেছ বল?

    আমাকে যখন তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না, তখন সে-কথা তোমার আর
    শুনেই বা লাভ কী বল? যাক সে কথা,—শতদলের কণ্ঠে সুস্পষ্ট অভিমানের সুর।

    এরূপর
    কিছুক্ষণ দুজনেই স্তব্ধ হয়ে থাকে। কেউ কোন কথা বলে না। অখণ্ড রাত্রির স্তব্ধতা শুধু, অদূরবতী গর্জমান সাগরের কলকল্লোলে পীড়িত হতে
    থাকে।

    এদের মান-অভিমানের পালাগান কতক্ষণ চলবে কে জানে! কিরীটীর উপরে
    সত্যিই রাগ ধরছিল। নিজে দিব্যি হোটেলের বিছানায় আরাম করে নাক ডাকাচ্ছে, আর আমাকে
    এই শীতের রাতে ঠেলে দিয়েছে! কী কুক্ষণেই যে ওর পাল্লায় পড়ে এই জায়গায় মরতে
    এসেছিলাম! ভেবেছিলাম কয়েকটা নিশ্চিত দিন আরামে কাটিয়ে দিয়ে যাওয়া যাবে সাগর-সিনারি
    দেখে, তা না, কী এক ঝামেলায়ই না পড়া গিয়েছে! কোথাকার কে এক পাগলা আর্টিস্ট, পাহাড়ের
    উপরে এক হানাবাড়ি, যত সব ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা, তার মধ্যে মিথ্যে মিথ্যে এমন করে জড়িয়ে
    পড়বার কি প্রয়োজন ছিল বাপ?

    হঠাৎ আবার সীতার কথায় চমক ভাঙল।

    তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছ শতদল!

    প্রতারণা করেছি?
    এ-সব তুমি কি বলছ সীতা? শেষ পর্যন্ত তুমি এ কথা বললে যে তোমার সঙ্গে আমি প্রতারণা
    করেছি!

    হ্যাঁ, প্রতারণা। নিশ্চয়ই প্রতারণা বৈকি। আজ বুঝতে পারছি, দিনের
    পর দিন তুমি আমার সঙ্গে প্রেমের খেলাই খেলে এসেছ। মনের মধ্যে একজনের চিন্তা অহোরাত্র
    করে বাইরে আর একজনের সঙ্গে তুমি খেলা করেছ। কিন্তু কী এর প্রয়োজন ছিল? আমি তো যেচে তোমার কাছে
    কোনদিন দাঁড়াইনি। তুমি, শেষের দিকে সীতার কণ্ঠস্বর কান্নায় যেন বুজে আসে। হায় রে!
    সেই চিরাচরিত ত্রিকোণ রহস্য। শতদল,
    সীতা ও রাণু।
    একটি পুরষ, দুটি নারী। সেই চির-পুরাতন চির-নতুন খেলা। সেই পঞ্চশরের একঘেয়ে রসিকতা।

    ছি ছি! এতদিন এ কথা তুমি আমাকে বলনি কেন? রাণু-রাণুকে
    নিয়ে তুমি সন্দেহ করেছ? রাণু তো কুমারেশের বাগদত্তা। ওরা পরস্পর পরস্পরকে
    ভালবাসে। আর কুমারেশের সঙ্গে যে আমার কতখানি বন্ধুত্ব তাও নিশ্চয়ই তোমার অজানা নেই!

    কুমারেশ?
    কোন কুমারেশ?

    কুমারেশকে চেনো না? কুমারেশ সরকার! অধ্যাপক ডাঃ শ্যামাচরাণু সরকারের একমাত্র ছেলে।
    মস্ত বড় ধনী। কিন্তু তার চাইতেও তার বড় পরিচয় হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচাইতে বড় সাঁতারু। এবারে অলিম্পিকে যার
    সাঁতারে যোগ দেওয়ার কথা।

    ওঃ, তোমার সেই গায়ক কুমারেশ?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই কুমারেশ ও রাণু, ওরা পরস্পর পরস্পরকে বহুদিন হতে ভালবাসে। আজ
    পাঁচ-ছ বছর ওদের আলাপ দুজনের সঙ্গে। ছি ছি! দেখ তো কী একটা মিথ্যা কল্পনায়
    অনর্থক ব্যস্ত করেছ?

    আমি নিজে পুরুষ,
    শতদলও পুরুষ,
    তাই শতদলের শেষের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল শতদলের পরিস্থিতিতে আমি পড়লে আমিও হয়তো
    ঐরূপই
    অভিনয় করতাম। ঐ মুহূর্তে
    আমার মনে পড়ছিল, মাত্র কয়েক রাত্রি আগে হোটেলের বারে শতদল ও রাণুর কথোপকথন।

    তাহলে মিথ্যে তুমি দেরি করছ কেন? মাকে এবারে সব বললেই তো হয়! সীতা অনুরোধ
    জানায় শতদলকে।

    দাঁড়াও, আর কয়েকটা দিন যেতে দাও। অ্যাটর্নীকে আমি চিঠি দিয়েছি, এই বাড়িটা আমি বিক্রি
    করতে চাই। পেপারে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে।

    পাহাড়ের উপরে এই পুরনো বাড়ি কে তোমার কিনবে?

    কিনবে কী বলছ! জান, ইতিমধ্যেই দুজন খরিদ্দারের কাছ থেকে অফার পাওয়া
    গিয়েছে!

    অফারই যদি পেয়েছ তো বিক্রি করে দিচ্ছ না কেন?

    দাঁড়াও—ভাল দাম না পেলে ছাড়ব কেন?

    এইরকম একটা বাড়ির জন্য তুমি ভাল দাম পাবে আশা কর?

    নিশ্চয়ই। দাদুর
    হাতে আঁকা ছবিগুলোরই কি কম দাম! দাদুর
    মতই পাগল শিল্পী আছে যারা ঐ ছবির collections-এর জন্যই বাড়িটা হয়তো একটা fanatic
    দাম দিয়েও কিনবে।

     কিন্তু কয়েক দিন ধরে
    যেভাবে তোমার উপর দিয়ে বিপদ যাচ্ছে

    সেটাই তো চিন্তার কারণ
    হয়ে উঠেছে সীতা। ব্যাপারটার মাথা-মুন্ডু
    কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। প্রথমটায় কিরীটীবাবুর কথা আমি তো হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম,
    কিন্তু তার পরের ব্যাপারগুলো সত্যিই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এখন বেশ স্পষ্ট বুঝতে
    পারছি, কেউ আমার জীবন নিতে যেন বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন? কারও তো আমি কোন
    ক্ষতি করিনি?
    আমার তো কোন শত্রু
    নেই?

    বাবা কী বলেন জান?

    কী?

    এ ঐ মামার প্রেতাত্মা! এ-বাড়ির মায়া আজও তিনি কাটাতে পারেননি
    তাই–

    পাগল! বলতে বলতে শতদল হঠাৎ সীতাকে দুহাতে আরও কাছে টেনে নেয়।

    না—আমার সত্যি কিন্তু তাই মনে হয়—

    দাদু
    আমাকে কত ভালবাসতেন তা জান! আর কেউ হলে না-হয় বিশ্বাস করা যেত। দাদু আমার কোন ক্ষতি করবেন এ
    আমি ভাবতেও পারি না। স্বেচ্ছায় তিনি সব আমার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছেন

    মা কিন্তু তা বিশ্বাস করেন না।

    তা জানি, কিন্তু তাঁর চিঠি আছে—

    মা বলেন, ও চিঠির কোন মূল্য নেই—

    মূল্য আছে কি না আছে, সেটা কোর্টই স্থির করবে। সেজন্য আমি ভাবি না। তা ছাড়া
    আমি তো দিদিমাকে বলেছিই, বাড়ি বিক্রি হলে কিছু টাকা তাঁকে দেব—তাঁর কোন প্রাপ্য
    এ-বাড়ি থেকে নেই তা সত্ত্বেও। কিন্তু তা তিনি চান না। তিনি বলেন এ বাড়িতে তাঁর
    অর্ধেক অধিকার। তারপর একটু
    থেমে আবার বলে, বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে কিছু
    যে তাঁকে দেব বলেছি সেও তোমার জন্য সীতা। দাদুর
    বোন বলে নয়—তোমার মা বলে।

    এ তো খুব ভাল প্রস্তাব। মা বুঝি তাতে রাজী নন?

    না।
    এক-একবার কি মনে হয় জান সীতা?

    কী?

    দিয়ে দিই বাড়িটা তাঁকে। কী হবে মিথ্যে আপনার জনের সঙ্গে ঐ একটা
    পুরনো বাড়ি নিয়ে গোলমাল করে?
    শেষ পর্যন্ত বাড়িটা তো আমাদেরই হবে—

    কী রকম?

    আরে তোমাকে বিয়ে করলে তো আর আমি পর থাকব না! আর তুমি ছাড়া ওঁদের
    বা আর কে আছে সংসারে?
    যাক গে চল, অনেক রাত হল-এবারে ওঠা যাক।

    চল।

    অতঃপর দুজনে উঠে দাঁড়াল। আমারই পাশ দিয়ে তারা দুজনে পাশাপাশি এগিয়ে
    গেল।

    নিঃশব্দে আমি তাদের অনুসরণ
    করলাম।

    একটা নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। শতদল আর সীতার সম্পর্ক। কিন্তু
    সেই সঙ্গে আর একটা নতুন সংশয় মনের মধ্যে এসে উঁকি দিচ্ছে। বেশ কিছুটা দুরত্ব রেখে
    ওদের আমি পিছনে পিছনে চলেছি। দেখতে পেলাম, দূর
    হতে অন্ধকারে অস্পষ্ট, ওরা নিরালার গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। আমি দাঁড়ালাম,
    ভাবছি এবারে কী করব, সহসা কার মৃদু
    করস্পর্শ
    পৃষ্ঠদেশে অনুভব করতেই চকিতে চমকে ফিরে তাকাতেই দেখি, সর্বাঙ্গে একটা কালো বস্ত্র জড়িয়ে ঠিক আমার
    পশ্চাতেই দাঁড়িয়ে মুখের ওপরে ঘোমটা তোলা, কেবলমাত্র মুখটা অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখা
    যাচ্ছে

    কে?

    চুপ!
    আস্তে-আমি।

    চাপা সতর্ক কণ্ঠস্বরেও চিনতে কষ্ট হয় না। কিরীটী।

    কিরীটী!

    হ্যাঁ চল, ফেরা যাক।

    কিন্তু

    চল। ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। বলে কিরীটী সত্যি-সত্যিই ঢালু পাহাড়ী পথ ধরে নিঃশব্দে
    নীচের দিকে নামতে লাগল। অগত্যা আমিও তার পিছু
    নিলাম।

    দুজনে পাশাপাশি আবার হোটেলের দিকে হেঁটে চলেছি।

    এদিকে কোথায় এসেছিলি?

    নিরালার স্টুডিও-ঘরে কাজ ছিল। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়। তারপর একটু থেমে পথ চলতে চলতেই বলে, কী এত মনোযোগ দিয়ে
    ওদের কথা শুনছিলি?

    শুনছিলাম বলেই জানতে পেরেছি—

    কি? ওদের আগে থাকতেই পরস্পরের সঙ্গে ভাব ছিল?

    আশ্চর্য হই কিরীটীর কথায়। কিন্তু আমার কোনরূপ প্রশ্ন করবার আগেই কিরীটী বলে, সে-রহস্যও
    সন্ধ্যাবেলাতে জানা হয়ে গিয়েছে। Nothing new!

    তুই জানতে পেরেছিলি?

    নিশ্চয়ই। শতদলের চায়ের কাপে সীতার তিন চামচ চিনি দেওয়াটা অনিচ্ছাকৃত
    অন্যমনস্ক হয়ে ভুল নয়। শতদলের চায়ে তিন চামচ চিনি খাওয়ার অভ্যাসটার সঙ্গে সীতা পূর্ব হতেই সুপরিচিত। এবং তা থেকেই আমি
    বুঝেছিলাম ওদের—শতদল ও সীতার মধ্যে একটা জানাশোনা আছে এবং দুটি তরুণ-তরুণীর জানাশোনা
    মানেই রঙের ব্যাপার! একান্ত অবলীলাক্রমেই যেন কিরীটী কথাগুলো বলে গেল।

    বিস্ময়ে একেবারে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিরীটীর অতীব সক্ষম
    দৃষ্টিশক্তির সঙ্গে আমি একান্তভাবেই সুপরিচিত, কিন্তু তবু যেন নতুন করে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকে না।
    কত সামান্য তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে কিরীটী তার মীমাংসার সূত্ৰ খুঁজে
    বের করে, আবার নতুন করে যেন আমার উপলব্ধি হল।

    হিরণ্ময়ী
    দেবী ওদের এই সম্পর্কের কথা জানেন বলে তোর মনে হয় কিরীটী?

    না জানলেও তিনি সন্দেহ করেন।

    কিন্তু শতদলের রাণুর সঙ্গে সম্পর্কটা?

    রাণু
    ও শতদলের পরস্পর পরস্পরের প্রতি চিন্তাধারাটা আলাদা। বলতে বলতে হঠাৎ যেন কথার মোড়টা
    ঘুরিয়ে দিয়ে বললে, শতদল আর সীতার মানভাঙাভাঙি নিয়ে তুই ব্যস্ত ছিলি, ওদিকে নিরালায়
    গেলে অন্য কিছু
    তুই দেখতে পেতিস—more interesting! আসলে সেইজন্যই তোকে আমি এই রাত্রে ওইদিকে পাঠিয়েছিলাম।

    কেন, সেখানে আবার কি হল?
    শতদলের হত্যাকারীর কোন সন্ধান পেলি নাকি? শেষের কথাটা যেন কতকটা ঠাট্টা করে আমি
    বলি।

    চোখ থাকলে
    দেখতে পেতিস
    শতদলের হত্যাকারী দূরের
    লোক তো নয়ই, ধোঁয়াটেও নয়। কিন্তু তার চাইতেও যে ব্যাপারটা বর্তমানে আমাকে বিশেষ
    চিন্তিত করে তুলেছে

    কী

    বুড়ো শিল্পীর চিঠিটা। যেটা শতদলের কাছ হতে আমি আজ সন্ধ্যায় চেয়ে
    এনেছি। চিঠিটা শুধু যে বুড়োর শেষ উইল তাই নয়, নিরালা-রহস্যের আসল চাবিকাঠিই ওর
    মধ্যে আছে। ওই চিঠির মধ্যের প্রতিটি অক্ষরের আঁচড়ের মানে আছে। তাছাড়া শতদল মুখে যাই বলক, নিরালার কোন
    মূল্য নেই—একটা পুরনো বাড়ি ও কতগুলো ছবি, আসলে নিশ্চয়ই তা নয়। অন্যথায় হিরণ্ময়ী ও তার স্বামী হরবিলাসু শতদল ও বাড়ির পুরাতন
    ভৃত্য অবিনাশ এরা
    অমনি করে খুঁটি
    পেতে বসে থাকত না।

    তোর তাহলে মনে হয় কোন গুপ্তধন ঐ বাড়ির মধ্যে কোথাও না কোথাও লুকোনো আছে?

    গুপ্তধন আছে কিনা বলতে পারি না, তবে থাকলেও আশ্চর্য হব না। সেটাই বরং স্বাভাবিক।

    শতদলের প্রাণের উপরে এই যে পর পর attemptগুলো হল, তাহলে তাঁরও কারণ তাই?

    তাছাড়া আর কি!

    শতদলের এখন কিন্তু বিশ্বাস হয়েছে যে সত্যি-সত্যিই তার প্রাণ নেবার
    চেষ্টায় কেউ না কেউ ঘুরছে।

    হলেই ভাল। কতকটা উদাসীন ভাবেই যেন কিরীটী কথাটা বলে।

    এতক্ষণে হঠাৎ যেন আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে এতক্ষণ নানা ধরনের কথা
    বললেও তার মনের মধ্যে অন্য কোন চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    কী ভাবছিস বল তো? প্রশ্ন করি।

    ভাবছিলাম একটা মজার কথা।

    কী রে?

    তোদের হিরণ্ময়ী
    দেবীও পঙ্গু
    নন, আর তোদের ভুখনাও কালা নয়।

    বলিস কী!

    হ্যাঁ। কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন একজন পঙ্গুর অভিনয়—আর কেনই বা অন্যজন কালার অভিনয় করে
    যাচ্ছে? আর

    আর আবার কী?

    দুজনের একজনের ইতিমধ্যে মরবার কথা ছিল, কিন্তু এখনো মরছে না কেন?

    বোকার মতই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাই। ওর কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই
    বুঝতে পারছি না। তবু
    প্রশ্ন না করে পারি না, দুজন কারা?

    কুব্জী
    মন্থরা
    বা প্রিয়সখী ললিতা! কিরীটী জবাব
    দেয়।

    টীকা