Chapter Index

    খোঁড়া ভিক্ষুক

    বাইরের
    অন্ধকার বারান্দায় এসে জগন্নাথ হাতের টর্চটা টিপতেই দেখলে, উপরেও নীচের তলার মতই
    বারান্দার গায়ে পর পর চার-পাঁচটি ঘর। উঃ, কি নিস্তব্ধ! সারা বাড়িটা মত্যুর মতই
    বিভীষিকাময় যেন। মনটা সত্যি কেমন যেন সিরসির করে ওঠে। আশঙ্কায় থমথম করে। বারান্দায়
    কতকালের ধুলো
    যে পড়তে পড়তে জমে উঠেছে তার ঠিক নেই।

    জগন্নাথ টর্চ হাতে একে একে উপরের সব ঘরগুলোই পরীক্ষা করে দেখলে,
    কিন্তু কোন ঘরেই জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ বা চিহ্ন পর্যন্ত নেই। যুগ যুগ ধরে যেন এখানে কেউ বাস করেনি। কারও পায়ের স্পর্শও
    যেন পড়েনি।

    কই, কেউ তো এখানে নেই। তবে কার অস্ফুট কাতর শব্দ কানে আসছিল? কে
    অমন করুণ স্বরে
    গোঙাচ্ছিল? মনে মনে বলতে বলতে জগন্নাথ দোতলার সিঁড়ি বেয়ে একসময় ছাদে গিয়ে উঠল।
    ছাদও নির্জন জমাট আঁধারে থমথম করছে।

    উপরে তারায় ভরা কালো আকাশ। সামনেই চোখে পড়ে সেই পোড়ো মাঠটা। সেটাও
    রাতের আঁধারে অস্পষ্ট আবছা হয়ে উঠেছে। ওদিকটার তালগাছটার পাতায় পাতায় নিশীথের হাওয়া
    কেমন একরকম সিপ, সিপ শব্দ তুলেছে।

    ছাদে মাত্র চিলেকোঠা। সে ঘরের দুটো কপাটই খোলা, হাওয়ায় মাঝে মাঝে
    ঢপ ঢপ করে বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। আর কেউ নেই।

    জগন্নাথ নীচে নেমে এল আবার। নীচের তলার ঘরগুলো আর একবার ভাল করে
    দেখল। কিন্তু বৃথা।
    সেখানেও কিছু পাওয়া গেল না। আর তো দেরি করা সঙ্গত নয়, যদি দলের কেউ আবার এসে পড়ে!
    অতঃপর জগন্নাথ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল।

    গলিটা এর মধে বেশ নির্জন
    হয়ে উঠেছে। জগন্নাথ সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে গলিপথ ধরে এগোতে লাগল।

    গলিটা যেখানে এসে বড় রাস্তার সঙ্গে মিশেছে, সেখানে গ্যাস-পোস্টের
    নীচে মৃদু
    আলোয় একজন খোঁড়া ভিক্ষুক-শ্রেণীর
    লোক লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে করুণ
    স্বরে পথিকের করুণা ভিক্ষা করছে : বাবু গো,
    দয়া করে এই খোঁড়াকে একটি পয়সা দিয়ে যান। কত দিকে কত পয়সা আপনাদের যায়, মা জননী গো!

    জগন্নাথ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভিক্ষককে দেখতে লাগল। তার মনে সহসা
    জাগে, কে-কে এই ভিক্ষুক?
    কোথায় যেন ওকে দেখেছে। কোথায়?

    জগন্নাথ চিন্তা করতে লাগল এবং চিন্তা করতে করতেই একসময় তার মনে হয়,
    লোকটাকে সে সেদিনই দেখেছে। ঐ পোড়ো বাড়িতে লোকটাকে দেখেছে সে। বগলে ক্রাচ ছিল লোকটার। জগন্নাথ এবার দৃষ্টি আরও প্রখর ও
    অনুসন্ধিৎসু
    করে ভিক্ষুকটাকে দূর থেকে দেখতে লাগল।

    তারপর একসময় জগন্নাথ ধীরে ধীরে গাঢাকা দিয়ে ওপাশের ফুটপাত দিয়ে পা
    চালিয়ে এগিয়ে গেল। এবং সোজা, এসে সে সুব্রতদের
    বাড়ির দরজায় কড়া ধরে নাড়া দিলঃ খট-খট-খটা-খট।

    কে? সুব্রতর
    গলা শোনা গেল ভিতর থেকে।

    আমি। দরজাটা খুলেন।

    দাঁড়ান, খুলছি।

    দরজাটা খুলতেই জগন্নাথ-বেশী কিরীটী রায় হাসতে হাসতে মাথায় বসানো
    রবারের পরচুলাটা
    খুলতে খুলতে বললে, মতে জগন্নাথ সাহু।
    কত্ত ঘুরি
    ঘুরি কটক জিলা কো মতে কলকাতার–

    কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুব্রত হা হা করে হেসে বললে, উঃ, কি বিভীষণ লোক আপনি মশাই!

    না মশাই, বিভীষণের মত আমি স্বজাতিদ্রোহী
    নই।

    বিভীষণ স্বজাতিদ্রোহী?
    কি বলেন আপনি?

    তা বৈকি। যে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের মত্যুবাণ ও তার সঙ্গে সঙ্গে
    সমগ্র জাতির স্বাধীনতা মানসম্ভ্রম
    অপরের হাতে তুলে দিতে পারে, তাকে শ্রীরামচন্দ্র যতই পূত আশীর্বাদ দিয়ে গরীয়ান করে তুলুন না কেন,
    তথাপি আমি বলব সে নীচ; সে কলঙ্ক—সে
    সমাজদ্রোহী-স্বজাতিদ্রোহী—বিশ্বাসঘাতক।
    উত্তেজনায় ও ভাবের দোলায় কিরীটীর কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে এল; কিন্তু সে কথা থাক, তার
    চাইতেও বড় কাজ আমাদের সামনে। খোশগল্প করে
    আসর জমাবার মত অবকাশ আমাদের এখন এতটুকুও নেই।– বলতে বলতে
    ক্ষিপ্রহস্তে কিরীটী রায় গায়ের ছদ্মবেশগুলো
    খুলে ফেলতে লাগল।

    ব্যাপার কি বলুন
    তো মিঃ রায়? কণ্ঠস্বরে সুব্রতর
    খানিকটা উদ্বেগ ও কৌতুহল
    প্রকাশ পায়।

    তাড়াতাড়ি একটা চাদর আর একটা লাঠি আনতে পারেন?

    কি হবে?
    কাউকে লাঠ্যৌষধির ব্যবস্থা করছেন নাকি?

    রহস্যচ্ছলে জবাব দিল কিরীটীঃ

                           শৃণু শৃণু
    রে বর্বর!
    দেরি
    যদি কর, বিপদ হবে বড়।
    শীঘ্ৰ
    আন লাঠি ও চাদর।

    সুব্রত
    হাসতে হাসতে লাঠি ও চাদর সংগ্রহ করতে উপরে চলে গেল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা
    বাঁশের লাঠি ও সাদা চাদর এনে কিরীটীর হাতে দিল।

    এবারে পকেট থেকে একটা টিকিওয়ালা পরচুলা বের করে কিরীটী মাথায় বেশ
    করে বসিয়ে নিল, তারপর চাদরটা গায়ে জড়িয়ে লাঠিটা হাতে নিয়ে দাঁড়াল সোজা হয়ে,
    সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে। কার সাধ্যি এখন তাকে একটু আগের কিরীটী রায় বলে চিনতে পারে! এখন সে
    অতি নিরীহগোছের একটি পুজারী ব্রাহ্মণ।

    মৃদু
    হেসে ব্রাহ্মণোচিত
    গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে
    কিরীটী রায় বলল, বৎস, তোমার কল্যাণ হোক। ক্ষণেক অপেক্ষা কর। তারপর কি মনে করে
    বললে, হ্যাঁ ভাল কথা, আপনাদের পা-গাড়ি আছে?

    হ্যাঁ আছে, কেন বলুন তো?

    আপনি বাইকটা নিয়ে, বড় রাস্তাটা যেখানে ট্রাম রাস্তার গায়ে গিয়ে
    মিশেছে সেখানে অপেক্ষা করবেন। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে যাব। বলতে বলতে কিরীটী
    রায় ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পথে বেরিয়ে পড়ল।

    রাস্তায় নেমে কিরীটী ধীরে ধীরে লাঠি হাতে গলির পথ দিয়ে এগোতে
    থাকে।

    রাত্রি তখন সাতটার বেশী হবে না। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটরগাড়ি
    রাস্তা দিয়ে হস, হস, শব্দে ছুটে যাচ্ছে। দু-একটা রিকশার মৃদু ঠুং-ঠাং আওয়াজ শোনা যায়। সামনেই একটা মস্তবড়
    ফটকওয়ালা বাড়িতে কোন উৎসব হচ্ছে বোধ হয়। রকমারী আলোতে আর লোকজনের গোলমালে বাড়িটা
    সরগরম। রাস্তার দুপাশে সারি সারি নানা রংয়ের ও নানা আকারের মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে।

    কিরীটী এগিয়ে চলে।

    খোঁড়া ভিক্ষুকটা তখনও চেচাচ্ছে বাবা গো! এই খোঁড়া ভিখারীকে একটি
    আধলা দাও বাবা। কত দিকে, কত ভাবে, কত পয়সা নষ্ট হয় বাবা গো। দয়া কর মাগো জননী।

    কিরীটী একটা পয়সা হাতে নিয়ে ভিক্ষুকের দিকে এগিয়ে বলল, এই নে, পয়সা
    নে।

    ভিক্ষুক বা হাতটা বাড়িয়ে দিল। আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী ভিক্ষুকটাকে দেখে নিয়ে পয়সাটা
    ভিক্ষুকের
    হাতে ফেলে দিল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।

    ভিক্ষুক
    তখনও একই ভাবে চেচিয়ে চলেছে। হঠাৎ কিরীটী দেখলে আর একজন ভিক্ষুক যেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে উলটো দিক থেকে ওদিকেই আসছে।

    কিরীটী চলার গতিটা একটু
    শ্লথ করে দিল এবং আড়চোখে ভিক্ষুকটাকে
    লক্ষ্য করতে লাগল দূর থেকেই।

    দ্বিতীয় ভিক্ষুকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে আগের ভিক্ষুকটার কাছাকাছি আসতেই দুজনে ফিস ফিস করে কি
    যেন বলাবলি করতে লাগল পরস্পরের মধ্যে।

    কিরীটী আর অপেক্ষা না করে পা চালিয়ে চলল বড় রাস্তার মোড়ের দিকে
    এবারে।

    মোড়ের পানের দোকানটার কাছে এক হাতে বাইক ধরে সুব্রত একটা সিগারেট ধরিয়ে
    টানতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু অনভ্যাসের দরুনে
    মাঝে মাঝে কাশিতে তার দম আটকে আসতে চায়।

    কিরীটী সুব্রতর
    কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর সুব্রতর হাত থেকে বাইকটা নিয়ে বাগিয়ে ধরতে ধরতে তাড়াতাড়ি
    বললে, ট্রামে চেপে লালবাজারের মোড়ে চলে যান সোজা। সামনেই যে রাস্তাটা বরাবর নয়া রাস্তায়
    মিশেছে, তার দুপাশে চীনাদের জুতোর দোকান আছে, ঐখানেই আমি যাচ্ছি। একটা ছুরি, সিল্ক কর্ড ও একটা টর্চ নিতে
    ভুলবেন না যেন।

    কথাগুলো বলেই কিরীটী একলাফে বাইকে চেপে সজোরে প্যাডেল করে অদৃশ্য
    হয়ে গেল।

    কিরীটীর নির্দেশমত তখনই সুব্রত
    ক্ষিপ্রপদে বাড়ির দিকে চলে গেল।

    কিছুদূর এগিয়ে কিরীটী রাস্তার মোড়ে বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে
    অপেক্ষা করতে লাগল। সহসা একসময় তার নজরে পড়ল দ্বিতীয় খোঁড়া ভিক্ষুকটা ঐদিকেই আসছে।

    মহাপ্রভু নিশ্চয়ই এতক্ষণ যাত্রা করেছেন! কিরীটী বাইকে চেপে গলির
    দিকে চলল এবারে। কাছাকাছি আসতেই ক্রিং
    ক্রিং আওয়াজ পাওয়া গেল এবং পরক্ষণেই গলির মুখ দিয়ে একজন সাইকেল-আরোহী দ্রুত বেরিয়ে এল।

    লোকটার পরনে ঢিলা পায়জামা, গায়ে ঢোলা কালো জামা, মাথায় কালো টুপি-কপাল
    পর্যন্ত টেনে দেওয়া হয়েছে; চোখে কালো কাঁচের গগলস।

    গলিপথ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে লোকটা ট্রাম রাস্তার দিকে সাইকেল
    চালাতে লাগল। কিরীটীও তার পিছু পিছ সাইকেল নিয়ে অনুসরণ করলে।

    লোকটা সোজা আমহার্স্ট
    স্ট্রীট দিয়ে বৌবাজার স্ট্রীটে পড়ে বরাবর গিয়ে চিৎপুরে
    পড়ল।

    দুপাশে যত সব ছবি আর আয়নার দোকান। কাঁচের গায়ে গায়ে উজ্জল
    বৈদ্যুতিক আলোর রশ্মিগুলি প্রতিফলিত হয়ে বিচিত্র রঙের রামধনু জাগিয়েছে।

    রাত্রি কতই বা হবে! বড় জোর আটটা, তার বেশী নয়। কলকাতা শহরে সন্ধ্যা বললেই চলে।
    দোকানে লোকের ভিড়। পথে ট্রামে ঢং ঢং ঘণ্টার আওয়াজ আর রিকশাওয়ালাদের ঠং ঠুং শব্দ ও মোটরের
    হন।

    লোকটা যে একজন পাকা সাইকেল-চালিয়ে, তা ওর গতি দেখেই বোঝা যায়। লোকটা
    অতি দ্রুত ভিড় বাঁচিয়ে লালবাজার ডাইনে ফেলে সোজা চীনাপট্টির মধ্যে ঢুকল।

    রাস্তার দুপাশে সারি সারি চীনাদের জুতার দোকান। মোড়ের একটা লাইটপোস্টের গায়ে
    হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ সুব্রতকে
    দেখতে পেল কিরীটী।

    সাইকেল চালিয়ে কিরীটী সুব্রতর
    পাশে এসে নামল।—যে লোকটিকে এতক্ষণে কিরীটী অনুসরণ করছিল, সে তখন খানিকটা দূরে
    সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল হাতে করে এগোচ্ছিল।

    এটা নিয়ে এখানে অপেক্ষা করুন। এই বলে কিরীটী বাইকটা সুব্রতর হাতে দিয়ে লোকটিকে
    অনুসরণ করল তাড়াতাড়ি। লোকটি বাইক নিয়েই সামনের অন্ধকার গলিটার মধ্যে গিয়ে পড়ল।
    কিরীটীও আঁধারে গা ঢাকা
    দিয়ে শিকারী বিড়ালের মত লোকটাকে অনুসরণ করল।

    গলিটা বেশ প্রশস্ত। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই ঠাওর করা যায় না।
    দুপাশে বাড়ির খাড়া দেওয়াল উঠে গেছে। হাত দশেক উচুতে একটা জানালার ফাঁক দিয়ে
    খানিকটা আলো এসে গলির অন্ধকারে ছিটকে পড়েছে যেন। অন্ধকার এত বেশী যে পাশের লোক
    পর্যন্ত নজরে আসে না। পচা মাছ ও চামড়ার বিশ্রী গন্ধে দম বন্ধ হবার যোগাড়।

    কিরীটী অতি সন্তর্পণে দেওয়াল ঘেষে ঘেষে এগিয়ে চলল। আগের লোকটাকে
    তখন আর দেখা যাচ্ছে না। সম্মুখে পশ্চাতে ডাইনে বামে সব দিকেই অন্ধকার। অন্ধকার যেন
    স্তরে স্তরে জমাট বেধে উঠেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার গলির মধ্যে বুঝি
    বাতাসও আসতে ভয় পায়। কিরীটী বুঝল,
    আর এগিয়ে চলা বৃথা,
    তাই দাঁড়িয়ে রুদ্ধনিঃশ্বাসে
    কান পেতে রইল।
    হঠাৎ একসময়ে একটা আওয়াজ কানে এল খটখটখট। .

    তারপরই খানিকক্ষণ চুপচাপ, আর কোন সাড়া-শব্দ নেই। আবার শব্দ
    হল-খট-খটখট।

    এবার যেন কাছেই কোথায় একটা দরজা খোলার শব্দ হল। অন্ধকার গলিপথে একটা ম্লান আলোর শিখা দেখা গেল।
    তার পরেই ঈষদুন্মুক্ত
    একটা দরজাপথে একটা কুৎসিত
    চীনা বুড়ীর চেপ্টা মুখ দেখা গেল। হাতে তার কেরোসিনের বাতি। বাতিটা
    যেন আলোর চাইতে ধূমোদগিরণই
    বেশী করছে।

    বুড়ী
    বাতিটি লোকটির মুখের উপর তুলে ধরল। অমনি লোকটা বাঁহাতের দুটো আঙুল কোণাকুনি করে
    দেখালে। সেই বিশ্রী বুড়ীটার কুৎসিত মুখে
    ততোধিক কুৎসিত এক টুকরো হাসি জেগে উঠল। বুড়ী রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াল।

    লোকটি বাড়ির মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। মুহূতে কিরীটী নিজের ভবিষ্যৎ
    কর্মপন্থা স্থির করে নেয়, এবং ত্বরিৎপদে গলির ভিতর থেকে বের হয়ে গিয়ে সুব্রত যেখানে অপেক্ষা করছিল
    সেখানে এসে বললে, এখনই আপনি বাড়ি যান সুব্রতবাব
    এবং যত শীঘ্র
    পারেন রাজেনবাবুকে
    নিয়ে এখানে চলে আসবেন। ঐ যে দেখছেন, হংকং সু
    ফ্যাক্টরীর পাশ দিয়ে একটা গলি দেখা যাচ্ছে, ওরই আশে-পাশে কোথাও অন্যের সন্দেহ
    বাঁচিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। একেবারে শূন্য হাতে আসবেন না।

    কি হাতিয়ার সঙ্গে আনি বলুন তো? সব্রত প্রশ্ন করে।

    একটা ছুরি
    বা একটা অন্ততঃ লোহার রড
    হলেও চলবে। ব্রিটিশ রাজত্বে তো আর পিস্তল বা রিভলবার চট করে পাওয়া যাবে না। কাজে
    কাজেই আমাদের ভগবানপ্রদত্ত বুদ্ধিকেই কাজে লাগাতে হবে।

    সুব্রত হেসে ফেলে।

    হাসছেন সুব্রতবাবু!
    প্রায় পৌনে দুই শত বৎসরের পরাধীনতায় আমরা যে একেবারে পঙ্গু ও অথর্ব হয়ে আছি। কিন্তু থাক, সে-সব কথা, পরাধীন
    দেশের দুঃখের শেষ কোথায়! হ্যাঁ শুনুন, আপনি আর রাজেনবাবু এসে ঐ হংকং সু ফ্যাক্টরীর কাছে অপেক্ষা করবেন, পর পর দুটো
    বাঁশীর আওয়াজ পেলেই ঐ গলির মধ্যে ছুটে
    যাবেন। বাঁশীর আওয়াজ না পাওয়া পর্যন্ত কোথাও যাবেন না। আচ্ছা আমি চললাম।

    কিরীটী কথাগুলো বলে দ্রুতপদে গলির মধ্যে অদশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে।

    সুব্রত
    আর ক্ষণমাত্র দেরি না করে, সামনেই একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে হাতের ইশারায় থামিয়ে
    ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, আমহার্স্ট স্ট্রীট!

    ট্যাক্সি নির্দিষ্ট পথে ছুটে চলল।

    এদিকে গলির মধ্যে ঢুকে কিরীটী কিছুক্ষণ যেন কি ভাবলে, তারপর
    আঁধারে আন্দাজ করে ক্ষণপূর্বের
    দেখা সেই দরজাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূত
    মাত্র চিন্তা করে টক-টক-টক করে দরজার গায়ে তিনটে টোকা দিল।

    কিন্তু কোন সাড়া নেই। অল্পক্ষণ পরে আবার টোকা দিল—টক-টক-টক।

    এবারে ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল এবং পরক্ষণেই দরজাটা খুলে গেল।
    আগের সেই চীনা বুড়ী বাতি হাতে বেরিয়ে এল।

    কিরীটী আঙুল দিয়ে পূর্বের
    লোকটির মত ইশারা করতেই বুড়ী
    পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল। সে বাড়ীর পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল তখন।

    সরু
    একটা অত্যন্ত স্বল্পপরিসর অন্ধকার গলিপথ বরাবর খানিকটা চলে গেছে। তার মধ্যে দিয়ে
    বাড়ী আলো নিয়ে এগিয়ে চলে আর কিরীটী পিছন পিছন চলে।

    কিছুদূর অগ্রসর হতেই আচমকা কিরীটী হঠাৎ দুই হাত দিয়ে পিছন থেকে বুড়ীর মুখটি চেপে ধরল এবং
    ক্ষিপ্রহস্তে পকেট থেকে একটা রুমাল
    বের করে বুড়ীর
    মুখে
    গুজে দিল; তারপর সিল্ক কর্ড দিয়ে বুড়ীকে
    বেধে ফেললে।

    টীকা