Chapter Index

    কিরীটী
    কিছুক্ষণ আবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

    হঠাৎ আবার কতকটা যেন খাপছাড়া ভাবেই কিরীটী বলে উঠল, এমন সুন্দর
    পৃথিবী অথচ মানুষগুলোর কি বিচিত্র স্বভাব! শান্তির মধ্যে নিশ্চয় তার মধ্যে যেন ওরা
    কিছুতেই দিন কাটাতে চায় না!

    মৃদু
    হেসে বললাম, কেন, তোর আবার শান্তির অভাব ঘটল কিসে?

    এখনো বলছিস
    অভাব হল কিসে? এর পরও শান্তিতে থাকতে পারব বলে মনে করিস? দুর্ঘটনাটা ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে স্থির
    করেছিলাম ওদিকে চোখ দেব না কিন্তু শতদল আর রাণু,
    নাঃ, কিছুতেই যোগে মিলছে না। কিন্তু তারও আগে সর্বাগ্রে আমাকে একটিবার ঐ নির্জন
    সাগরকূলে
    পাহাড়ের উপরে নিরালা নামক বাড়িখানি দেখতে হচ্ছে—

    তোর কি তাহলে ধারণা যে, ঐ বাড়িটার সঙ্গেই কোন রহস্য জড়িয়ে আছে
    কিরীটী?

    নিশ্চয়ই, নচেৎ এমন অকস্মাৎ বুলেটের আবির্ভাব ঘটবে কেন?

    কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না। বুলেটটা যেন বুঝলাম,
    কিন্তু রিভলবারের—

    কথাটা আমায় কিরীটী শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠে, আওয়াজটা শুনতে
    পাসনি, এই তো?
    কিন্তু বললাম তো

    কিন্তু–

    রিভলবারের সঙ্গে সাইলেন্সার ফিট করা ছিল। কিন্তু গুলিটা এল কোন দিক থেকে?

    পূর্ব
    দিক অর্থাৎ সাগরের দিক থেকেই এসেছে বলে আমার মনে হয়।

    ঐসময় সেই দিকে অত লোকজন ছিল!

    সেটা তো আরো চমৎকার কেমোফ্লাজ-শতদলবাবুর দিক থেকে সামান্য একটুক্ষণের জন্য আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম সুব্রত, তোর সঙ্গে কথা বলতে
    বলতে এবং ঠিক সেই মুহূর্তটিতে
    ব্যাপারটা ঘটে গেল, নচেৎ আমার
    দৃষ্টিকে সে এড়াতে পারত না।

    সহসা একটা আনন্দ-মিশ্রিত হাসির শব্দে চমকে ফিরে তাকালাম। মাত্র
    হাত-আট-দশ দূরে
    সমুদ্রের ধার দিয়ে শতদল ও রাণু,
    পাশাপাশি হেঁটে
    চলেছে।

    এবং রাণু
    ও শতদল দুজনেই খুব হাসছে।

    চমৎকার মানিয়েছে কিন্তু ওদের দুজনকে কিরীটী! চেয়ে দেখ, a nice
    pair!

    আমি ওদের সম্পর্কে বিশেষ করে বলা সত্ত্বেও কিরীটী ফিরে তাকাল না,
    কেবল মৃদুকণ্ঠে
    বললে, নির্জন সাগরকূলে
    পাহাড়ে উপরে এক দুর্গ গড়ে তুলেছিল এক আপনভোলা শিল্পী। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত
    সেই দুর্গের মধ্যে শিল্পী বসে বসে কখনো আঁকত ছবি, কখনো গড়ত মূর্তি, কিতু তার চাইতে বড় কথা—আমাদের দেশে যে
    একটা প্রবাদ আছে, মরা হাতির দামও লাখ টাকা—যদি সেই দিক দিয়ে ভাবা যায়, তাহলে কী
    দাঁড়ায় বল?

    কিন্তু উত্তরাধিকারী শতদলবাবুই
    তো একটু
    আগে বলে গেলেন, অবশিষ্ট এখন মাত্র ঐ গৃহখানিই।
    সম্পত্তির আর কিছু অবশিষ্ট নেই–

    তারই দাম লাখ টাকা। চল, ওঠা যাক। হোটেলে গিয়ে আপাততঃ তো এক কাপ
    গরম চা সেবন করা যাক। বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল এবং হোটেলের দিকে চলতে শুরু
    করল। আমি তাকে অনুসরণ
    করলাম।

    সমস্তটা দ্বিপ্রহর কিরীটী হোটেলের সামনের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারের
    উপরে হেলান দিয়ে একটা মোটামত বাংলা উপন্যাস নিয়েই কাটিয়ে দিল।

    সকালের ব্যাপারে তাকে বিশেষভাবে যে একটু উত্তেজিত বলে মনে হয়েছিল, সে উত্তেজনার যেন
    এখন অবশিষ্টমাত্রও নেই। তার হাবভাব দেখে মনে হয় ব্যাপারটা যেন সে ইতিমধ্যেই
    একেবারে ভুলেই গিয়েছে। মনের মধ্যে তার কোন চিহ্নমাত্রও নেই।

    বাইরে শীতের রৌদ্র ইতিমধ্যেই ঝিমিয়ে এসেছে। নিভন্ত দিনের আলোয়
    সমুদ্রও যেন রূপ বদলিয়েছে। বিষণ্ণ ক্লান্তিতে সমুদ্রের নীল রঙ কালো রূপ ক্রমে ক্রমে নিচ্ছে যেন।
    এ বেলা আর স্নানার্থীদের
    কোন ভিড় নেই। তবু
    বায়ুসেবনকারীদের
    চলাচল শুরু হয়েছে।

    হোটেলের ভৃত্য শিবদাস চায়ের ট্রেতে করে চা ও কিছু কেক বিস্কুট রুটি জ্যাম সামনের টেবিলের
    ওপরে এনে নামিয়ে রাখল।

    কিরীটী একমনে পড়ছে দেখে আমিই উঠে চায়ের কাপে চা ঢেলে কাপটা এগিয়ে
    দিতে দিতে বললাম, চা!

    কিরীটী হাতের বইটা মুড়ে কোলের উপর নামিয়ে রেখে চায়ের কাপটা হাতে
    তুলে নিল। উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, তোর সঙ্গে টর্চ আছে না সুব্রত?

    আছে।

    কেডস জুতো
    আছে?

    না,
    তবে আমার ক্রেপ-সোলের জুতো—
    ওতেই হবে। কোথাও বের হবি নাকি?

    হ্যাঁ, নিরালা দর্শনে যাব।

    আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে দুজনে নিরালার দিকে অগ্রসর হলাম।
    সূর্যাস্তের পূর্বে
    ওখানে আমাদের পৌঁছতে হবে। কিরীটী বলল।

    তা আর পারা যাবে না কেন?

    ক্ৰমে লোকালয় ছেড়ে সমুদ্রের কোল ঘেষে অপ্রশস্ত একটা পায়ে-চলা পথ
    ধরে আমরা দুজনে এগিয়ে চললাম। সমুদ্র যেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। টের পাচ্ছি
    সমুদ্রের পাড় যেন ক্রমে সমুদ্র থেকে উঁচু
    হয়ে চলেছে। সমুদ্রের গর্জমান
    ঢেউগুলো পাড়ের গায়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। এ জায়গাটায় সমুদ্রের
    পাড়টা বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। মধ্যে মধ্যে বড় বড় এক-একটা ঢেউ বাঁধানো পাড়ের উপরে
    ঝাঁপিয়ে পড়ে জলকণার ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
    বিকেল থেকেই হাওয়াটাও যেন বেড়েছে।

    ক্ৰমে খাড়াই পথ ধরে আমরা উপরের দিকে উঠছি। চমৎকার বাঁধানো পথ।
    সূর্য ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে অনেকটা নেমে এসেছে পশ্চিম দিগবলয়ে।

    তিন-চারশো ফুটের
    বেশী পাহাড়টা উঁচু
    হবে না।

    ক্রমে যত উপরের দিকে উঠছি, ডান দিকে সমুদ্র আরো স্পষ্ট ও অবারিত হয়ে
    ওঠে। ভারি চমৎকার দৃশ্যটি।

    এমন জায়গায় শিল্পী না হলে কেউ এত খরচ করে বাড়ি করে!

    কিরীটীর কথায় সায় না দিয়ে আমি পারলাম না, যা বলেছিস। লোকটা সত্যিই
    শিল্প-পাগল ছিল।

    আরো কিছুর উপরের দিকে উঠতেই একটা লোহার গেট দেখতে পেলাম। এবং
    গেটের সামনে দাঁড়াতেই বাড়িটার সামনের দিকটা সুস্পষ্ট হয়ে চোখের উপর ভেসে উঠল।

    মুঘল যুগের স্থাপত্যশিল্পের পরিপূর্ণ একটি নিদর্শন যেন বাড়িখানি।
    দ্বিতল বাড়িটা, চারদিকে চারুটি গোলাকার গম্বুজ। গম্বুজের গায়ে বোধ হয় নানা
    রঙের পেটেন্ট স্টোন বসানো, অস্তমান সূর্যের শেষ রশ্মি সেই পাথরগুলোর ওপরে
    প্রতিফলিত হয়ে যেন মরকতমণির মতো জ্বলছে।

    বাড়িটার সামনেই একটা নানাজাতীয় ফুল-ফলের বাগান। গেট বন্ধ ছিল, এক পাশের থামে
    শ্বেতপাথরের প্লেটে সোনালী অক্ষরে বাংলায় লেখা নিরালা।

    গেট ঠেলে দুজনে ভিতরের কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করলাম। হাত-চারেক চওড়া
    লাল সুরকি ঢালা পথ বরাবর বাড়ির সদর দরজার
    সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দুজনে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম।

    দোতলার ও একতলার সব জানালাগুলোেই দেখছি ভিতর থেকে বন্ধ।

    মাঝামাঝি রাস্তা এগিয়েছি, হঠাৎ একটা কর্কশ কণ্ঠস্বরে চমকে পাশের
    দিকে তাকালাম। একঝাড় গোলাপগাছের সামনে হাতে একটা খুরপি নিয়ে একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে।

    কাকে চান?

    দেখলাম লোকটা বেশ রীতিমত ঢ্যাঙা। এবং একটু কুঁজো হয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছে। পরিধানে একটা ধুতি
    ও গায়ে একটা গরম গেঞ্জি। গেঞ্জির হাতা দুটো গোটানো এবং দুই হাতেই কাদামাটি লেগে
    আছে। বুঝলাম প্রৌঢ় বাগানের গোলাপ গাছগুলোর সংস্কার করছিল।

    প্রৌঢ়ের মাথার চুলগুলো সবই প্রায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। কপালের
    উপর বলিরেখাগুলো বয়সের ইঙ্গিত দিলেও দেহের মধ্যে যেন একটা বলিষ্ঠ কর্মপটুতা দেহের সমগ্র পেশীতে
    পেশীতে সুস্পষ্ট ও সজাগ হয়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায়, এককালে ভদ্রলোক শরীরে যথেষ্ট
    শক্তি তো ধরতেনই, এখনও অবশিষ্ট যা আছে তাও নেহাত কম নয়।

    দেহের ও মুখের রঙ অনেকটা তামাটে। রৌদ্র-জলে পোড়-খাওয়া দেহ। হাতের
    আঙুলগুলো কী মোটা মোটা ও লম্বা!

    ভদ্রলোকের প্রশ্নে এবার কিরীটী জবাব দিল, শতদলবাবু আছেন?

    শতদল! সে তো এমন সময় কখনো বাড়িতে থাকে না। গোটাচারেকের সময় বের হয়ে
    যায়।

    ফেরেন কখন?

    তা রাত্রে ক্লাব থেকে ফিরতে রাত এগারোটা সাড়ে-এগারোটা হয়।

    এখানকার ক্লাব বলতে সাগর-সৈকত হোটেলেরই নিচের একটা ঘরে নাচগান তাস
    দাবাখেলা ও ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা আছে, সেটাই এখানকার ক্লাব। এখানকার স্থানীয় ভদ্রলোকেরা
    সেইখানেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে মিলিত হন। এবং রাত দশটা পর্যন্ত আনন্দ চলে সেখানে।

    আমি যতদূর
    জানতাম, শতদলবাবু
    এখানে একাই থাকেন! কিরীটী প্রৌঢ়কে আবার প্রশ্ন করে।

    শতদল তো মাত্র মাসখানেক হল এসেছে। আমি আমার স্ত্রী ও আমার মেয়েকে
    নিয়ে এক বছরের উপরে এখানে আছি। তা ছাড়া চাকর অবিনাশ, মালী রঘুনাথ আছে।

    ওঃ, তা আপনি শতদলবাবুর—

    রণধীর
    আমার সম্পর্কে শ্যালক হত।

    ওঃ, রণধীরবাবুর
    আপনি তাহলে ভগ্নীপতি হন?

    হ্যাঁ।

    চমৎকার জায়গায় বাড়িটি কিন্তু–, কতকটা যেন তোষামোদের কণ্ঠেই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।

    আর মশাই চমৎকার জায়গা! নেহাত আটকা পড়ে গিয়েছি, নইলে এমন জায়গায়
    মানুষ থাকে? আধ মাইলের মধ্যে জন-মনিষ্যি পর্যন্ত একটা নেই। রাতবিরেতে ডাকাত পড়লে চেঁচিয়েও কারো সাড়া পাবার
    উপায় নেই।

    কিরীটী হাসতে হাসতে জবাব
    দেয়, বাইরে থেকে যেভাবে বাড়িটা তৈরী দেখছি তাতে ডাকাত পড়লেও বিশেষ তেমন কিছু একটা
    সুবিধা করতে পারবে বলে তো মনে হয় না।

    এমন সময় সুমিষ্ট মেয়েলী গলায় আহান শোনা গেল, বাবা গো বাবা! এত করে
    তোমাকে ডাকছি, তা কি শুনতে পাও না? ওদিকে চা যে জড়িয়ে জল হয়ে গেল!

    চেয়ে দেখি একটি উনিশ-কুড়ি বৎসরের শ্যামবর্ণ একহারা চেহারার মেয়ে
    আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

    মেয়েটির পরিধানে চমৎকার একটি নীলাম্বরী শাড়ি, কলকাতার কলেজের মেয়েদের মত স্টাইল
    করে পরা, গায়ে সাদা ব্লাউজ।

    মেয়েটি ততক্ষণে একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

    কখন আবার তুই ডাকলি আমায় সীতা! মেয়েটির বাপ জবাব দেন।

    রোগা একহারা চেহারা হলে কী হয় এবং গায়ের রঙ শ্যাম হলেও অপরূপ একটা লাবণ্য যেন মেয়েটির
    সর্বদেহে।
    সর্বাপেক্ষা মেয়েটির মুখখানির যেন তুলনা হয় না—চোখে-মুখে একটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ
    রয়েছে।

    মেয়েটির দেহের সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ তার পর্যাপ্ত কুঞ্চিত কেশ। বর্মীদের ধরনে মাথার উপরে প্যাগোডার
    আকারে বাঁধা। হাতে একগাছি করে কাঁচের চুড়ি।

    এইটিই আমার মেয়ে সীতা। হ্যাঁ, ভাল কথা—আপনাদের নাম তো জানা হল না!
    আমার নাম হরবিলাস ঘোষ। হরবিলাস নিজের পরিচয় দিলেন।

    পরিচয়টা দিলাম এবারে আমিই, আমার নাম সুব্রত রায়, আর ইনি হচ্ছেন
    কিরীটী রায়।

    আবার একদফা নমস্কার প্রতি-নমস্কারের আদান-প্রদান হল।

    আসুন
    না কিরীটীবাবু, শতদলের কাছে এসেছেন, সে যখন বাড়িতে নেই আমার আতিথেয়তাটুকু না হয়
    গ্রহণ করুন,
    এক কাপ করে চা—আপত্তি আছে নাকি কিছু?
    কথাগুলো বলে হরবিলাস একবার কিরীটী ও একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন।

    আমি একটু
    ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু কিরীটী দ্বিধামাত্র না করে বললে, সানন্দে। বিশেষ করে চা
    যখন। কিন্তু সীতা দেবী, আপনার আপত্তি নেই তো?
    কথাটা শেষ করল কিরীটী সীতার মুখের দিকেই তাকিয়ে।

    আপত্তি! বা রে, আপত্তি হবে কেন? আসুন না—

    হ্যাঁ, চলুন। এই পাণ্ডব-বর্জিত বাড়িতে লোকের মুখ দেখবারও তো উপায়
    নেই। তাছাড়া আমার স্ত্রীও আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে সুখী হবেন। রোগী মানুষ, কোথাও তো
    বের হতে পারেন না।

    রোগী! কিরীটী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে।

    হ্যাঁ, আজ দু বছর ধরে নিম্ন-অঙ্গের পক্ষাঘাতে ভুগছেন। তাঁর জনেই তো
    এখানে আসা আমার শ্যালকের অনুরোধে।

    ইতিমধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার প্রকৃতির বুকে ঘন হয়ে এসেছে। দূরে সন্ধ্যার অষ্পষ্ট আলোয়
    মনে হয়, সমুদ্রের জলে কে যেন একরাশ কালো কালি ঢেলে দিয়েছে, কেবল মধ্যে মধ্যে ঢেউয়ের
    চূড়ায়
    শুভ্র ফেনাগুলো কোন ক্ষধিত
    করাল দানবের হিংস্র দন্তপাতির
    মত ঝিকিয়ে উঠছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে চাপা ক্রদ্ধ গর্জন একটানা ছেদহীন।

    প্রকাণ্ড দরজা
    পার হয়ে আমরা সকলে
    বাড়ির মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।

    সামনেই একটা বারান্দা এবং বারান্দা অতিক্রম করে একটা সুসজ্জিত
    হলঘর, সেটা পার হয়ে মাঝারি গোছের একটা আলোকিত কক্ষমধ্যে এসে আমরা প্রবেশ করলাম।

    ঘরে সিলিং থেকে একটা বাতি ঝুলছে।
    সেই আলোয় প্রথমেই নজরে পড়ে ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা টেবিলের পাশে একটা ইনভ্যালিড
    চেয়ারের উপর বসে একজন স্থূলাঙ্গী
    মধ্যবয়সী মহিলা উল ও কাঁটার সাহায্যে কী যেন একটা বুনে চলেছেন অত্যন্ত ক্ষিপ্র
    হস্তে।

    ভদ্রমহিলা আমাদের পদশব্দে মুখ তুলে আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন,
    কিন্তু হাত দুটি যেন মেশিনের মতই অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে বয়নকার্য চালিয়ে যেতে
    লাগল।

    সিলিং থেকে ঝুলন্ত আলোর স্বল্প রশ্মি যা সেই উপবিষ্ট ভদ্রমহিলার মুখের
    উপরে এসে পড়েছিল তাতেই তাঁর মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পাথরের মত ভাবলেশহীন এমন
    মুখ
    ইতিপূর্বে
    খুব কমই যেন চোখে পড়েছে। আর তাঁর দুটি চক্ষুর
    স্থির দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমাদের অন্তস্তল পর্যন্ত ভেদ করে চলে যাচ্ছে।
    আমাদের চোখে-মুখে এসে যেন বিধছে। মুখের একটি রেখারও এতটুকু পরিবর্তন দেখা গেল না।

    আড়চোখে একবার কিরীটীর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না, কিন্তু কিরীটীর
    চোখে-মুখে কোন কিছুরই সন্ধান পেলাম না।

    হিরণ
    দেখ, এরা আজ আমাদের গৃহে
    সান্ধ্য-অতিথি। সুব্রতবাবু,
    কিরীটীবাবু—এই আমার স্ত্রী হিরন্ময়ী—হরবিলাস শেষের কথাগুলো আমাদের উভয়ের
    দিকে ফিরে তাকিয়ে শেষ করলেন।

    আসুন।
    বসুন। কী সৌভাগ্য আমাদের! হিরন্ময়ী আমাদের নিষ্প্রাণ কণ্ঠে যেন আহ্বান জানালেন। আমরা উভয়ে
    পাশাপাশি দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।

    আশ্চর্য একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম, ঘরের সব কটি জানলাই বন্ধ।
    একটা চাপা গুমোট ভাব যেন সমস্ত ঘরটার মধ্যে থমথম করছে। বুকটা কেমন চেপে ধরছে।

    সামনে টেবিলটার ওপরে সূক্ষ্ম সূচের
    এমব্রয়ডারি করা একটি টেবিলক্লথ বিছানো, তার উপরে সজ্জিত চায়ের সাজসরঞ্জাম। ঘরের
    মধ্যে আসবাবপত্র
    সামান্য যা আছে তাও এক পরিপাটিভাবে যেখানকার যেটি ঠিক হওয়া উচিত রুচিসম্মতভাবে
    সাজানো। তথাপি মনে হচ্ছিল, সব কিছুর মধ্যে একটা সযত্ন সুচারু
    পরিচ্ছন্নতা থাকলেও
    কিসের যেন একটা অভাব আছে। সবই আছে অথচ কী যেন নেই! কোথায় যেন ছন্দপতন হয়েছে।

    সত্যিই সৌভাগ্য আমাদের কিরীটীবাবু, আপনাকে আজ আমার ঘরে অতিথি পেয়ে।
    হিরন্ময়ী দেবী কিরীটীকে লক্ষ্য করেই কথাটা উচ্চারণ করলেন, আপনাকে ইতিপূর্বে আমার দেখবার
    সৌভাগ্য না হলেও আপনার নাম আমি শুনেছি।

    কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটা হাসির আভাস যেন বঙ্কিম রেখায় জেগে উঠেই মিলিয়ে
    যায়।

    তা ছাড়া, হিরন্ময়ী দেবী আবার বলতে শুরু করেন, আজ দেড় বৎসরের মধ্যে
    এমন জায়গায় পড়ে আছি যে কারও সঙ্গে বড় একটা দেখাই হয় না, তাই কেউ এলে মনে হয় যেন বন্ধ
    এই ঘরটার মধ্যে একটা খোলা হাওয়ার ঝুলক
    বয়ে গেল। উঃ, এই ঘরটি
    এবং পাশের ছোট একটা ঘর—এরই এই সঙ্কীর্ণতার মধ্যে এই দীর্ঘ দেড় বছরের রাত্রি দিন
    দুপুরগুলো কীভাবে যে কাটাচ্ছি তা আমি জানি। একটা ক্লান্ত অবসন্নতা যেন হিরন্ময়ীর
    কণ্ঠস্বরে মূর্ত
    হয়ে ওঠে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন তাঁর বুকখানা
    কাঁপিয়ে বের হয়ে আসে।

    হরবিলাস কন্যাকে তাড়া দিলেন, কই রে সীতা, এদের চা দে!

    সীতা ইতিমধ্যে চায়ের কাপগুলো সাজিয়ে দুধ দিয়ে চা ঢালতে
    শুরু
    করেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের কে কয় চামচ করে চিনি নেন চায়ে?

    আমি বললাম, আমাকে ছোট চামচের এক চামচ দেবেন, আর ওকে দেড় চামচ
    দেবেন।

    সীতা আমাদের দিকে চা ও প্লেটে কিছু কেক এগিয়ে দিল।

    চা-টা নিতে নিতে বললাম, ও প্লেটটা সরিয়ে রাখুন সীতা দেবী-বিকেলে হোটেল
    থেকে বের হবার পূর্বেই
    একপেট খেয়ে এসেছি।

    তা হোক, তা হোক, একটু
    খেয়ে দেখুন বাজারের জিনিস নয়, আমার স্ত্রীরই
    নিজের হাতের তৈরী। হরবিলাস বলে উঠলেন।

    কিন্তু পেটে যে একেবারে জায়গা নেই হরবিলাসবাবু! কিরীটী হাসতে হাসতে বলে।

    আরে মশাই, এক পীস কেক আর খেতে পারবেন না? বললে হয়তো বলবেন লোকটা তার নিজের স্ত্রীর
    প্রশংসা করছে, কিন্তু তা নয়, ঊনত্রিশ বছর ঘর করছি তো, অমন রান্না মশাই কোথাও খেলাম
    না! আসবেন একদিন, এখানে দুপুরে আহার করবেন।

    না, উনি রোগী মানুষ—কিরীটী প্রতিবাদ জানায়।

    তাতেও কি উনি নিশ্চিন্ত থাকেন! ঐ invalid চেয়ারে বসে বসেই রোজ দুবেলা রান্নার যাবতীয় সব
    করেন।

    সত্যি আশ্চর্য তো! আমি বলি, কষ্ট হয় না আপনার?

    বরং এমনি করে সারাটা দিন চেয়ারের উপর নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকাটাই
    আমার দুঃসহ লাগে। তাই যত পারি নিজেকে engaged রেখে দেহের এই অভিশাপটা ভুলে থাকবার
    চেষ্টা করি। তাছাড়া দেখুন, এমন জায়গায় পড়ে আছি, একটা লোকজনের মুখে পর্যন্ত দেখবার
    উপায় নেই। তাই তো ওকে বলি, যে ভাই এত আদর
    করে এখানে নিয়ে এল আমায়, সেই যখন চলে গেল আর কেন, চল অন্য কোথাও চলে যাই। দেহটা
    অকর্মণ্য হয়ে গিয়েছে বলে বেশী দিন এক জায়গায় থাকতেও ভাল লাগে না।

    ঘরের মধ্যে অত্যন্ত গরম বোধ হচ্ছিল। শীতকাল হলেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। কিরীটীরও বোধ হয় গরম লাগছিল
    ঘরের মধ্যে। সে-ই বলে উঠল, ঘরটার মধ্যে বেশ গরম মনে হচ্ছে যেন।

    ওঃ, সত্যিই তো, আমারই ভুল হয়ে গিয়েছে। সীতা, দাও তো মা দক্ষিণের
    জানালাটা খুলে। এ বাড়িতে এত বেশী হাওয়া যে বিরক্ত ধরে যায়, তাই বেশীর ভাগ সময়
    জানালাগুলো এঁটে
    রাখি—

    না, থাক না, তেমন কিছু বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। কিরীটী প্রতিবাদ
    জানাবার চেষ্টা করে। সীতা কিন্তু ততক্ষণে মায়ের আদেশে এগিয়ে গিয়ে ঘরের একটা জানালা
    খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের সমুদ্রবক্ষ থেকে একঝুলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে হু-হু করে বয়ে এল সমুদ্রের নোনা স্বাদ নিয়ে। সেই
    সঙ্গে এল অদূরাগত
    সমুদ্রের
    শব্দকল্লোল। বাইরের দূরন্ত
    খ্যাপা সমুদ্রের স্পর্শ যেন সমস্ত ঘরটার মধ্যেকার পীড়িত বন্ধ আবহাওয়াটাকে মুহূর্তে এসে একটা মুক্তির
    স্নিগ্ধ পরশ দিয়ে গেল।

    দেখলাম জানালাটা খুলে সীতা আর ফিরে এল না, খোলা জানালার গরাদ ধরেই
    দাঁড়িয়ে রইল ঘরের দিকে পিছন ফিরে। বাইরের রহস্যময় সমুদ্রের মত সীতার দেহটাও যেন
    একটা রহস্যে পরিণত হয়েছে।

    এখানে বুঝি বেড়াতে এসেছেন মিঃ রায়?
    হিরন্ময়ী আবার প্রশ্ন করলেন কিরীটীকেই লক্ষ্য করে।

    হ্যাঁ। সী-সাইডটা এখানকার ভারী চমৎকার!

    শতদলের সঙ্গে আপনার আগেই বুঝি আলাপ ছিল?

    না।
    আজই সকালে সবে আলাপ হয়েছে।

    ওঃ, সবে আজই আলাপ
    হয়েছে?

    হ্যাঁ।

    আপনারা আসবেন সে কি জানত না?
    আবার প্রশ্ন করলেন হিরন্ময়ী দেবী!

    না।
    ভেবেছিলাম একটা surprise visit দেব।

    সহসা এমন সময় বাইরের অন্ধকার ভেদ করে সমুদ্রের একটানা গর্জনকে ছাপিয়ে ক্রুদ্ধ একটা জন্তুর চিৎকার
    কানে ভেসে এল। বাইরের অন্ধকার যেন সহসা একটা আর্তনাদ করে উঠলো। চমকে হিরন্ময়ী
    দেবীর মুখের দিকে তাকাতেই দ্বিতীয়বার আবার সেই ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, এবারে
    বুঝলাম কোনো বড় জাতীয় বিলেতী কুকুরের ডাক সেটা।

    হঠাৎ সীতা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুতপদে কক্ষ হতে বের হয়ে গেল।

    কুকুরটার গম্ভীর ডাকটা বাইরের অন্ধকারকে যেন ফালি ফালি করে
    দিচ্ছে।

    টীকা