Chapter Index

    তখন শীতের মাঝামাঝি। সাদা পালকের মত বরফ আকাশ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে। এক রানী তাঁর জানলার ধারে বসে আবলুস কাঠের কাঠাঁমোয় কাপড় পরিয়ে তাতে ছুঁচের কাজ তুলছেন। থেকে থেকে তিনি দেখছেন বরফের দিকে তাকিয়ে। এমন সময় তাঁর আঙুলে ছুঁচ ফুটে গেল আর তিন ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল বরফের উপর। সাদার উপর লাল রক্ত টক-টক করছে দেখে রানী নিশ্বাস ছেড়ে বললেন—হায় আমার যদি একটি সন্তান থাকত বরফের মত সাদা, রক্তের মত লাল আর আবলুসের মত কালো!

    এর কিছুদিন পরেই রানীর একটি মেয়ে হল, তার গায়ের চামড়া বরফের মত সাদা, তার ঠোঁট রক্তের মত রাঙা আর তার চুল আবলুস কাঠের মত কালো। তার নাম তুষারিনী। তুষারিনী যেই জন্মালো রানীও অমনি মারা গেলেন।

    এক বছর যেতে না যেতেই রাজা আবার বিয়ে করলেন। নতুন রানী সুন্দরী, কিন্তু যেমন তাঁর জাঁক তেমনি তাঁর স্বভাব। কেউ যে তাঁর চেয়ে রূপসী হবে এ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর একখানি জাদু-করা আয়না ছিল। সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলতেন—

    বল দেখি আরসি,
    দুনিয়ায় কোন জন সবচেয়ে রূপসী?

    অমনি আয়না জবাব দিত—

    তোমা চেয়ে দুনিয়ায় কেউ নেই রূপসী।

    এই শুনে রানী খুশি হতেন ; কারণ, তিনি জানতেন আয়না সব সময় সত্যি কথা বলে।

    তুষারিনী এদিকে ক্রমেই সুন্দরী হয়ে বেড়ে উঠছিল ; যখন তার সাত বছর বয়েস তখন তার রূপ হয়ে উঠল দিনের আলোর মত। রানীর চেয়েও সে হয়ে উঠল সুন্দরী। সেই সময় একদিন রানী যখন জাদু-করা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—

    বল দেখি আরসি,
    দুনিয়ায় কোন জন সবচেয়ে রূপসী?

    তখন আয়না জবাব দিলে—

    তুমি রানী রূপবতী, ছিল নাকো তুলনাই
    তোমা চেয়ে সুন্দরী তুষারিনী ভুল নাই।

    শুনে রানী চমকে উঠলেন। হিংসেয় তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল। সেই থেকে তাঁর মন তুষারিনী উপর বিরূপ হয়ে গেল। তাকে তিনি ঘৃণা করতে শুরু করলেন। অহঙ্কার আর ঘৃণা দুই তাঁর মনের মধ্যে আগাছার মত বেড়ে উঠতে লাগল। শেষে এত বেড়ে গেল যে দিবারাত্রি তাঁর মনে আর শান্তি রইল না।

    তখন তিনি একজন শিকারীকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন— এই মেয়েটিকে বনের মধ্যে নিয়ে যাও। এর চেহারা আর আমি দেখতে চাই না। বনে নিয়ে গিয়ে একে মেরে ফেলে এর কলজেটা আমায় এনে দেখাবে।

    শিকারী মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু যখন সে তার তলোয়ার বার করে মেয়েটির বুকে বিঁধিয়ে দিতে যাচ্ছে তুষারিনী কেঁদে বললে— দয়া করো শিকারী! আমায় প্রাণে মেরো না। আমায় ছেড়ে দাও, আমি গভীর বনের মধ্যে চলে যাব, আর কোনোদিন বাড়ি ফিরব না।

    মেয়েটি এতই সুন্দরী যে তাকে মেরে ফেলতে শিকারীর মায়া করল। সে বললে— তবে চলে যাও।

    শিকারী ভাবলে, বুনো জন্তুতেই মেয়েটিকে খেয়ে ফেলবে নিশ্চয়। তাকে যে নিজের হাতে মেরে ফেলতে হল না এইতে তার বুক থেকে একটা গুরুভার নেমে গেল।

    ঠিক সেই সময় একটা বুনো শুয়োর ছুটে আসছিল। শিকারী তাকে ধরে মেরে ফেললে আর তার কলজেটা কেটে নিয়ে রানীকে গিয়ে প্রমাণ হিসেবে দেখালো। দুষ্টু রানী সেটাকে নুন দিয়ে মেখে রান্না করে খেয়ে ফেললেন। মনে করলেন তুষারিনী শেষ হয়ে গেল।

    তুষারিনী বেচারা যখন দেখল বনের মধ্যে সে একা, কেউ আর কোনদিকে নেই, তার বড় ভয় হল। গাছের পাতা খসে পড়ে, তার শব্দে পর্যন্ত সে ভয়ে আঁতকে ওঠে। ভয়ের চোখে সে ছুটতে লাগল ধারালো পাথর টপকে খোঁচাখোঁচা কাঁটা-ঝোপের মধ্যে দিয়ে। তার দু-পাশ দিয়ে বুনো জন্তুরা দৌড়তে লাগল কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করল না। যতক্ষণ পারে সে ছুটল। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়-হয়, সে একটি ছোট্ট বাড়ি দেখতে পেয়ে তার মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিলে। বাড়ির মধ্যে সবই খুব ছোট্ট, কিন্তু সবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর। ছোট একখানি টেবিল, তাতে খাবার সাজানো। সাদা চাদরে ঢাকা টেবিল। তার উপর সাতখানি খুদে-খুদে থালা, কাঁটা, ছুরি আর জলের পেয়ালা। দেয়ালের গা ঘেঁসে সাতখানি ছোট-ছোট বিছানা, তার উপর পরিষ্কার সাদা বালাপোশ।

    তুষারিনীর এত খিদে এত তেষ্টা পেয়েছিল যে সে প্রত্যেক থালা থেকে একটু করে পরিজ আর রুটি খেয়ে নিলে আর প্রত্যেক পেয়ালা থেকে একটু করে সরবত চুমুক দিয়ে নিলে, যাতে কারুরই কম না পড়ে। তার এতই ক্লান্তি বোধ হতে লাগল যে সে একটার পর একটা বিছানায় শুয়ে দেখে নিলে। কিন্তু কোনোটাতেই তার আরাম হল না। কোনোটা খুব বড়। কোনোটা বেজায় ছোট। শেষে সাতের বিছানাটা তার ঠিক লেগে গেল। সেটায় শুয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

    যখন বেশ অন্ধকার হয়েছে তখন বাড়ির কর্তারা বাড়ি ফিরল। এরা সাতটি বামন। এদের কাজ পাহাড়ের মাটির নিচে খনি খুঁড়ে বার করা। সাতটা মোমবাতি জ্বালতেই ঘরে যখন বেশ আলো হয়ে গেল, তারা বুঝল যে ঘরে কেউ ঢুকেছিল। কারণ ঘরের জিনিসপত্র যেমনভাবে তারা রেখে গিয়েছিল তা আর তেমন নেই—কেউ এদিক-ওদিক করেছে।

    প্রথম বামন বললে— আমার চৌকিতে কে বসেছিল?

    দ্বিতীয় বামন বললে— আমার থালা থেকে কে খেয়েছে?

    তৃতীয় বামন বললে— আমার রুটি কে কামড়েছে?

    চতুর্থ বামন বললে— আমার পরিজ কে চেখেছে?

    পঞ্চম বামন বললে— আমার কাঁটা নিয়ে কে নাড়াচাড়া করেছে?

    ষষ্ঠ বামন বললে— আমার ছুরি নিয়ে কে কাটাকাটি করেছে?

    সপ্তম বামন বললে— আমার পেয়ালা থেকে কে সরবত খেয়েছে?

    তারপর প্রথম বামন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, তার বিছানা দাবানো রয়েছে।

    সে বললে— কে আমার বিছানায় শুয়েছিল?

    আর সবাই তাই শুনে ছুটে এসে নিজেদের বিছানার কাছে গিয়ে বললে— আমাদেরও বিছানায় কেউ শুয়েছিল!

    কিন্তু সপ্তম বামন যখন তার বিছানার দিকে তাকালো সে দেখলে, ছোট্ট তুষারিনী তার বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। সে সেই কথা বলতে আর সবাই দৌড়ে এল আর মোমবাতি তুলে ধরে তুষারিনীর মুখে আলো ফেলে দেখতে লাগল।

    তারা বললে— আরে বাস্‌রে! কী সুন্দরী মেয়েটি! মেয়েটিকে দেখে তাদের এত আনন্দ হল যে তারা তাকে জাগালে না—ঐখানেই ঘুমোতে দিলে। সপ্তম বামন প্রত্যেকের খাটে এক ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দিলে।

    সকাল হতে তুষারিনী যখন চোখ খুলল সে সাতটি বামন দেখে বেজায় ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু তারপর সে দেখল, তারা বেশ ভালোমানুষ। তারা তার নাম জিজ্ঞেস করল। তুষারিনী নাম বললে। তারা বললে, কেমন করে তুমি এখানে এলে? সৎমা কেমন করে তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন, শিকারী কেমন করে তার প্রাণ-ভিক্ষা দিল, কেমন করে সে সারাদিন ছুটে শেষে এই বাড়িতে পৌঁছল— সব সে বললে।

    তখন বামনরা বললে— তুমি যদি আমাদের বাড়ি ঘর-সংসার চালাও, রান্না করা, বাসন ধোওয়া, বিছানা করা, সেলাই করা আর সব কিছু গুছিয়ে রাখা এইতে রাজি থাকো তাহলে তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকতে পারো। তোমার তাহলে কিছুরই অভাব হবে না।

    তুষারিনী বললে— এতে তো আমি খুবই রাজি। সেই থেকে সে বামনদের ঘরদোর গুছিয়ে রাখতে লাগল। সকালবেলা বামনরা পাহাড়ে যেত সোনা খুঁড়তে। সন্ধেবেলা ফিরত। তুষারিনী তাদের জন্যে খাবার তৈরি করে রাখত।

    সারাদিন মেয়েটি একাল থাকত। বামনরা তাকে সাবধান করে দিত এই বলে—তোমার সৎমাকেই ভয়। তিনি কিছুদিনের মধ্যেই জেনে ফেলবেন তুমি এখানে আছ। খবরদার কাউকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দিও না!

    এদিকে রানী তুষারিনীর কল্‌জে খেয়ে খুবই নিশ্চিন্ত ছিলেন যে তিনিই দুনিয়ার সেরা সুন্দরী। তাই অনেকদিন পরে একদিন তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন—

    বল দেখি আরসি,
    দুনিয়ায় কোন জন সবচেয়ে রূপসী?

    আয়না উত্তর দিল—

    রূপবতী তুমি তাহে ভুল নাই
    তুষারিনী বন-মাঝে পেল ঠাঁই
    সাতটি বামন তার সাত ভাই ;
    তোমা চেয়ে শতগুণ সুন্দরী তুষারিনী—
    সন্দেহ তাতে আর নাই নাই।

    শুনে রানী একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাঁর বুকের রক্ত শুকিয়ে গেল। হৃৎপিণ্ড থেমে গেল। তিনি বুঝলেন তুষারিনী এখনও বেঁচে আছে। আরো সুন্দরী হয়েছে।

    তিনি বললেন— এবারে আমি তাকে একেবারে শেষ করে দেব! তিনি জাদু-বিদ্যার বলে একটি বিষাক্ত চিরুনি তৈরি করলেন। তারপর এমন পোশাক পরলেন যাতে তাঁকে এক বুড়ির মত দেখায়, যাতে তাঁকে কেউ চিনতে না পারে। তারপর সাত পাহাড় পার হয়ে তিনি এলেন সাত বামনের বাড়ি। দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন—মনিহারি জিনিস চাই! মনিহারী জিনিস!

    তুষারিনী জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললে— চলে যাও! আমি কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে পারব না।

    বুড়ি বললে— ঢুকতে দিও না। কিন্তু দেখতে তো পারো। এই দেখ। বলে সেই বিষাক্ত চিরুনিটা উঁচু করে দেখালো। সুন্দর চিরুনিটা দেখে তুষারিনীর এত লোভ হল যে সে দরজা খুলে দিলে। দর-দাম হল। চিরুনি দিয়ে বুড়ি বললে— কতদিন তুমি চুল আঁচড়াওনি মা, এসো তোমার চুল আঁচড়ে দিই।

    তুষারিনী কোনো সন্দেহ না করে বুড়িকে তার মাথায় হাত দিতে দিলে। বুড়ি চিরুনি বুলোতে বুলোতে যেই না চিরুনিটা তুষারিনীর চুলে গুঁজে দিলে অমনি বিষের কাজ শুরু হয়ে গেল আর বেচারি মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে।

    দুষ্টু বুড়ি বললে— এইবার, সবার সেরা রূপসী! এই তোমার শেষ! বলে বুড়ি চলে গেল।

    ভাগ্যক্রমে সন্ধে তখন হয়ে এসেছে। সাত বামন বাড়ি ফিরল। তারা এসে যখন দেখলে তুষারিনী মড়ার মত মাটিতে পড়ে রয়েছে তারা তখন ভাবল, এ নিশ্চয়ই সৎমার কাজ। তারা খুঁজে দেখতে পেল চুলের মধ্যে চিরুনি গোঁজা রয়েছে। বিষের চিরুনি তুলে ফেলে দিতেই তুষারিনী চোখ মেলে উঠে বসে যা যা হয়েছিল সব বলে গেল। সাত বামন আবার তাকে সাবধান করে দিল। বললে— আর যেন কখনো কাউকে দরজা খুলে দিও না।

    রানী বাড়ি ফিরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন—

    বল দেখি আরসি,
    দুনিয়ায় কোন জন সবচেয়ে রূপসী?

    আয়না জবাব দিলে—

    রূপবতী তুমি তাহে ভুল নাই
    তুষারিনী বন-মাঝে পেল ঠাঁই
    সাতটি বামন তার সাত ভাই ;
    তোমা চেয়ে শতগুণ সন্দরী তুষারিনী—
    সন্দেহ তাতে আর নাই নাই।

    আয়নার কাছে এই উত্তর শুনে রানী রাগে থর-থর করে কাঁপতে লাগলেন। রেগে বললেন— তুষারিনীকে মারতেই হবে! তাতে যদি আমার প্রাণ যায় তা-ও ভাল!

    তিনি একটা লুকোনো ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ঘর বন্ধ করে এক বিষাক্ত আপেল তৈরি করলেন। সুন্দর দেখতে হল আপেলটি— সাদার উপর যেন লাল গাল— যে দেখবে তারই নিতে ইচ্ছে হবে আর যে তার একটুখানি টুকরোও খাবে সে তখনই মরবে। আপেল তৈরি করে রানী নিজের মুখে রং মাখলেন, চাষীর মেয়ের পোশাক পরলেন, তারপর সাত পাহাড় পার হয়ে যেখানে সাত বামন থাকে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন।

    তিনি দরজায় ধাক্কা দিতে তুষারিনী জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললে— কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিতে আমার মানা। সাত বামন বারণ করে গেছে।

    চাষীর মেয়ে বললে— বেশ তো। আমি তবে অন্য জায়গায় আপেল বেচি গিয়ে। তুমি এইটি বরং অমনিই নাও।

    তুষারিনী বললেন— না, আমার নেবার সাহস নেই!

    চাষীর মেয়ে বললে— তোমার কি ভয় হচ্ছে বিষ? এই দেখ আপেলটাকে দু-টুকরো করে কাটছি। তুমি লাল দিকটা নাও, আমি সাদা দিকটা খেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি।

    এমন চালাকি করে আপেলটাকে তৈরি করা হয়েছিল যে বিষটা ছিল শুধু লাল দিকটায়। তুষারিনীর আপেলটার উপর ভারি লোভ। সে যখন দেখলে চাষীর মেয়ে আপেলের টুকরো মুখে দিয়ে বেশ চিবোচ্ছে, তাই দেখে সে-ও হাত বাড়িয়ে বাকি আধখানা নিলে। কিন্তু যেই না সেই আধখানা থেকে এক টুকরো কামড়ে মুখে দিয়েছে অমনি মাটির উপর ঢলে পড়ে গেল।

    রানী এক নজর দেখে নিয়ে হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে বললেন— বরফের মত সাদা, রক্তের মত রাঙা, আবলুসের মত কালো! এবারে আর বামনরা তোকে বাঁচাতে পারবে না!

    রানী বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন আয়নাকে জিজ্ঞেস করলেন—

    বল দেখি আরসি,
    দুনিয়ায় কোন জন সবচেয়ে রূপসী?

    আয়না এবার জবাব দিল—

    তোমা চেয়ে দুঁনিয়ার কেউ নাই রূপসী।

    শুনে তার হিংসে-ভরা মন শান্ত হল।

    বামনরা সন্ধেবেলা যখন বাড়ি ফিরল, দেখল তুষারিনী মাটিতে পড়ে রয়েছে, তার নাক দিয়ে কোন নিশ্বাস বেরোচ্ছে না। তার মৃত্যু হয়েছে। তারা তাকে তুলল। কোথাও কোনো বিষ আছে-কি না খুঁজে দেখল। জামা খুলে দেখল, চুল আঁচড়ে দেখল, জল দিয়ে গা ধুয়ে দেখল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। মেয়েটি মারাই গেছে— বাঁচবার কোনো আশা নেই। তারা তাকে এক শবাধারে শুইয়ে দিয়ে তার চারিদিকে ঘিরে বসল। তিন দিন ধরে সবাই মিলে খুব কাঁদল। তারপর তাকে কই দেওয়া হত, কিন্তু দেখা গেল তুষারিনী মরলেও তার চেহারা একটুও মলিন হয়নি, দেখে মনে হয় সে যেন বেঁচেই আছে। ঘুমোচ্ছে। গালে পর্যন্ত গোলাপি আভা। কাজেই তারা বললে—কালো মাটির তলায় একে আমরা ঢাকা দিতে পারব না।

    তখন তারা একটা কাঁচের শবাধার তৈরি করলে— চারিদিক থেকে যাতে দেখা যায়। তার মধ্যে তারা তুষারিনীকে শুইয়ে উপরে সোনার অক্ষরে তার নাম খোদাই করে দিলে। লিখে দিলে যে সে রাজার মেয়ে। তারপর সেই শবাধার নিয়ে পাহাড়ের উপর বসিয়ে দিলে। পালা করে একজন করে পাহারা দিতে থাকল। পাখিরা এসেও তুষারিনীর জন্যে চোখের জল ফেলত। প্রথমে পেঁচা, তারপর এল দাঁড়কাক, শেষে এল পায়রা।

    এইভাবে বহুদিন তুষারিনী শবাধারের মধ্যেই রইল। তার চেহারা একটুও বদলালো না। মনে হত সে ঘুমোচ্ছে— বরফের মত সাদা, রক্তের মত লাল আর আবলুস কাঠের মত কালো!

    একবার হল কি, এক রাজপুত্র বনের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে তিনি বামনদের বাড়ির কাছে এসে পড়লেন। তিনি দেখলেন পাহাড়ের উপর সেই কাঁচে মোড়া শবাধার, তার মধ্যে সুন্দরী তুষারিনী। সোনার অক্ষরে যা লেখা আছে পড়লেন।

    রাজপুত্র বামনদের বললেন— এ শবাধারটি আমায় দাও। এর জন্যে তোমরা যা চাও আমি দেব।

    বামনরা বললেন— সারা দুনিয়ায় যত সোনা আছে তার সব দিলেও ওটি দিতে পারব না।

    রাজপুত্র বললেন— আমি হাতজোড় করে ভিক্ষে চাইছি বামন ভাইরা, ওটি আমায় দাও। তুষারিনীর মুখ না দেখতে পেলে আমি বাঁচব না। যদি রাজি হও তোমাদের সবাইকে আমি ভাইয়ের মত ভালোবাসব।

    এত করে বলতে বামনদের দয়া হল। তারা শবাধারটি দিয়ে দিল। রাজপুত্র তখন তাঁর অনুচরদের ডেকে বললেন কাঁধে তুলে শবাধারটি নিয়ে যেতে। যেতে যেতে হল কি, যারা শবাধারটি কাঁধে করে যাচ্ছিল তাদের পা একটা ঝোপে হোঁচট খেল আর সেই ঝাঁকানির ফলে বিষ আপেলের টুকরোটা তুষারিনীর গলার মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল।

    তুষারিনী আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইল। শবাধারের ঢাকনি খুলে উঠে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললে— আমি কোথায়?

    রাজপুত্র আনন্দের স্বরে জবাব দিলেন—তুমি আমার কাছে। তারপর যা-যা হয়েছিল সব বলে তিনি বললেন— তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুই আমি চাই না। চল আমার সঙ্গে আমার বাবার প্রাসাদে। তুমি আমার বৌ হবে।

    তুষারিনী রাজপুত্রের সঙ্গে গেল প্রাসাদে। খুব ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হল।

    বিয়ের ভোজে তুষারিনীর সৎমাকে নিমন্ত্রণ পাঠানো হল। সৎমা ভালো ভালো পোশাক পরে সাজলেন, তারপর তাঁর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—

    বল দেখি আরসি,
    দুনিয়ায় কোন জন সবচেয়ে রূপসী?

    আয়না জবাব দিল—

    সুন্দরী তুমি তাহে ভুল নাই,
    আজিকার বিবাহের কন্যাটি
    তোমার হতে শতগুণ রূপবতী
    সন্দেহ তাতে আর নাই নাই।

    শুনে রানী রাগে গর-গর করে উঠলেন। শাপ শাপান্ত করতে লাগলেন। যেমন মনমরা হলেন তেমন মাথা গরম হতে থাকল। প্রথমে মনে করলেন বিয়েতে যাবেন না। তারপর মনে হল, যতক্ষণ না তিনি বিয়ের কনেকে দেখছেন ততক্ষণ তাঁর শান্তি নেই। সেখানে গিয়ে দেখলেন, একি, এ তো তুষারিনী! রাগে আর ভয়ে সেখান থেকে তিনি নড়তেই পারলেন না। রানীর শাস্তির জন্যে রাজা ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, আগুনে লাল-করা লোহার জুতো পরে তাঁকে নাচতে হবে। রানীকে তাই পরিয়ে দেওয়া হল আর সেইভাবে নাচতে নাচতে রানী পড়ে মরে গেলেন।

    টীকা