Chapter Index

    তিন টুকরো সাপ

    একটি লোক ছিল সে ছিল বড় গরিব। এত গরিব যে প্রায়ই তাকে আর তার ছেলেকে উপোস করতে হত। ছেলেটি একদিন বলল— বাবা তুমি আর কত করবে? রোজই তো দেখি বেরোও আর দুঃখভরা মুখে ক্লান্ত হয়ে ফের। এ আর আমি দেখতে পারি না— দুনিয়ার পথে আমি বেরিয়ে পড়ব, দেখব কিছু রোজগার করতে পারি কি না।

    বাবা আর কি করেন, চোখের জলে ছেলেকে বিদায় দিলেন। ঠিক সেই সময় মস্ত এক রাজা আর এক দেশের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ছেলেটি সেই রাজার কাছে সৈন্যের চাকরি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেল। শত্রুর সঙ্গে প্রথম সংঘর্ষেই সে এক মহা বিপদ থেকে অদ্ভুতভাবে উদ্ধার পেয়ে গেল। তার বাঁ পাশে ডান পাশে অনেক সৈন্য কাটা পড়ল কিন্তু সে গেল বেঁচে। সেনাপতি নিজেই আহত হয়েছিলেন; তাই দেখে অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার জন্যে প্রস্তুত; সেই সময় ছেলেটি এগিয়ে এসে চীৎকার করে বলল— পালিও না ভাই সব, জন্মভূমি আমাদের জননী, তাঁর সম্মান আমাদেরই হাতে। সেই শুনে পলায়মান সৈন্যরা ফিরে দাঁড়াল; তাদের সাহস ফিরে এল, তারা সেই তরুণ নেতার পিছনে এসে দাঁড়াল, তারপর তার নেতৃত্বে এমন লড়াই লড়ল যে শত্রুদল ছত্রভঙ্গ হয়ে হার স্বীকার করল।

    রাজা যখন শুনলেন কার বীরত্বের ফলে তিনি এমন জয় লাভ করেছেন তখন তিনি ছেলেটিকে ডেকে পাঠালেন। ডেকে পাঠিয়ে তিনি তাকে মস্ত সম্মানের অধিকারী করলেন।

    এখন রাজার ছিল একটি ভারি সুন্দরী মেয়ে; কিন্তু মেয়েটি ছিল খামখেয়ালি। রাজকন্যা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি যদি কাউকে বিয়ে করেন তাহলে তাকে এই শপথ করতে হবে যে রাজকন্যা যদি আগে মারা যান তাহলে তার স্বামীকেও তাঁর সঙ্গে জীবন্ত কবরে যেতে হবে। রাজকন্যা বলতেন— সে যদি আমায় সত্যিই ভালবাসে তাহলে আমি মারা যাবার পর সে আর বাঁচতে চাইবে না। এর বদলে আমিও শপথ করব যে সে যদি আগে মারা যায় আমি তার সঙ্গে জীবন্ত কবরে যাবো।

    যারাই রাজকন্যার লোভে আসত তারাই রাজকন্যার এই প্রতিজ্ঞা শুনে ভয়ে পালিয়ে যেত। কিন্তু এই ছেলেটি রাজকন্যার রূপ দেখে এমনই মুগ্ধ হল যে প্রতিজ্ঞা শুনে ভয় পাবার কথা তার মনেই হল না। রাজা তাকে বললেন— রাজকন্যাকে পেতে গেলে কী ভয়ানক শপথ তোমায় করতে হবে তা কি বুঝতে পারছ?

    ছেলেটি উত্তর দিলে— পারছি। ও মরবার পরেও যদি আমি বেঁচে থাকি, আমার জীবন্ত কবর হবে। কিন্তু রাজকন্যার প্রতি আমার ভালবাসা এত প্রবল যে আমি ওতে ভয় পাই না।

    রাজা যখন দেখলেন ছেলেটি সব বুঝেশুনেই বিয়ে করতে চাইছে তখন তিনি মত দিলেন। মহা ধুমধামে তাদের বিয়ে হয়ে গেল।

    বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের দিন কাটছিল কিন্তু তারপর হঠাৎ রাজকন্যার এক অসুখ হল। শত চেষ্টা করেও কবিরাজেরা তাঁকে রক্ষা করতে পারলেন না। রাজকন্যা মারা গেলেন। রাজকন্যার মৃতদেহ দেখে ছেলেটির মনে পড়ে গেল শপথের কথা। জীবন্তে কবরে যেতে হবে ভেবে সে ভয়ে সারা হয়ে গেল কিন্তু বুঝল এর কোনো চাড়া নেই। প্রাসাদের প্রতি দরজায় রাজা পাহারা বসালেন যাতে ছেলেটি পালিয়ে যেতে না পারে। তারপর যেদিন সমাধির দিন উপস্থিত হল, সেদিন রাজকন্যার দেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হল রাজপ্রাসাদের দৌলতখানায়। সেখানে এক বন্ধ ঘরে রাজকন্যাকে শুইয়ে রেখে তার পাশে ছেলেটিকে বসিয়ে বাইরে থেকে কুলুপ এঁটে দেওয়া হল। কাফিনের কাছে জ্বলতে লাগল চারটি বাতি, তার পাশে চারখানি রুটি, চার বোতল সরাব। ছেলেটি জানল এগুলি ফুরোলেই তাকে শুকিয়ে মরতে হবে তার রাজকন্যার পাশে। বেচারা মনোদুঃখে বসে রইল আর যতটুকু ছোট করে পারে রুটির টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল, যতটুকু কম পারে সরাবে চুমুক দিতে লাগল।

    একদিন যখন মনে হচ্ছে মৃত্যু আসছে, আর বোধ হয় দেরি নেই, সে হঠাৎ দেখতে পেল, সে যেখানে বসে আছে তার উল্টো দিকের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে একটা সাদা সাপ ঘরে ঢুকে রাজকন্যার মৃতদেহের দিকে এগিয়ে আসছে! সে ভয়ে উঠে দাঁড়াল। তার মনে হল সাপটা রাজকন্যার মাংস খেতে যাচ্ছে। সে বলে উঠল— যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি রাজকন্যাকে ছুঁতে দেব না। বলে তরোয়াল বার করে সাপটাকে তিন টুকরো করে কেটে ফেললে।

    খানিকক্ষণ পরে সেই কোণ থেকে আবার একটা সাপ বেরিয়ে এল। এসেই সে দেখল অন্য সাপটা তিন টুকরোয় কাটা হয়ে পড়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ফিরে গেল আর তিনটি সবুজ পাতা মুখে করে ফিরে এল। তারপর কাটা সাপের টুকরো তিনটিকে পাশাপাশি সাজিয়ে প্রতিটি কাটার উপর একটি করে পাতা রাখল। অমনি জোড়া লেগে গেল কাটা সাপ আর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তার সঙ্গীর সঙ্গে চলে গেল।

    মাটিতে পড়ে রইল পাতাগুলি। পাতাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছেলেটির মনে হল পাতার যে-রকম গুণ দেখছি— মরা সাপকে বাঁচাতে পারে, মরা-মানুষকে কি পারবে না? সে মাটি থেকে পাতাগুলি তুলে নিল। তারপর আস্তে আস্তে রাজকন্যার মৃতদেহর কাছে এগিয়ে গিয়ে একটি পাতা রাখল সে মুখের উপর আর অন্য দুটি রাখল দুই চোখের উপর। মুহূর্ত মধ্যেই সে ফল দেখতে পেল। ধীরে ধীরে শিরার মধ্যে দিয়ে রক্ত বইতে লাগল— পাণ্ডুর মুখে একটি লাল আভা ফুটে উঠল। রাজকন্যা একটি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে চোখ মেললেন। চোখ মেলে মৃদু স্বরে বললেন— কোথায় আমি?

    ছেলেটি বলল— তুমি আমার কাছে। বলে যা যা হয়েছিল আর কেমন করে সে তাকে বাঁচিয়েছে তা বর্ণনা করে গেল।

    এক টুকরো রুটি আর এক চুমুক সরাব খাবার পর রাজকন্যা সুস্থ বোধ করলেন। কাফিন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্বামীর সঙ্গে দরজা অবধি গেলেন। সেখানে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন, চিৎকার করতে লাগলেন অনেকক্ষণ ধরে। শেষে প্রহরীর কানে শব্দ গেল। প্রহরী তখন রাজাকে খবর দিলে। রাজা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এসে দরজা খুলতে হুকুম দিলেন। দরজা খুলে রাজা যা দেখলেন তাতে তাঁর আনন্দ আর ধরে না। মেয়ের অকস্মাৎ মৃত্যুতে, তার উপর জামাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে পাঠিয়ে রাজা বড়ই কষ্ট পাচ্ছিলেন, এখন নির্ভাবনা হলেন।

    ছেলেটি পাতা তিনটি সঙ্গে নিয়ে গেল। একজন চাকরের হাতে সেগুলি দিয়ে বললে— খুব সাবধানে রাখ এগুলি। প্রতিদিন দেখবে পাতাগুলি ঠিক আছে কিনা। কবে যে এরা আবার কাজে লাগবে বলা যায় না।

    এই ঘটনার পর কিন্তু রাজকন্যার মধ্যে এক মস্ত বদল এল। মরণের ডেরা থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই রাজকন্যার মন থেকে তার স্বামীর প্রতি সব ভালবাসা লোপ পেয়ে গেল। কেমন যেন হয়ে গেলেন রাজকন্যা।

    ছেলেটি একদিন বললে— এবার আমি আমার বুড়ো বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে যাবো সমুদ্রের ওপারে।

    রাজকন্যা বললেন— আমিও যাবো।

    জাহাজে উঠে রাজকন্যা তার স্বামী যে তাঁর জন্যে কত করেছেন, মৃত্যুর পরও তাঁকে জীবন দান করেছেন, এ সব ভুলে গেলেন। ভুলে গিয়ে জাহাজের যে কাপ্তেন তার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে ভাব করলেন।

    একদিন ছেলেটি যখন জাহাজের ডেক্‌-এ ঘুমোচ্ছে রাজকন্যা কাপ্তেনকে ডেকে বললেন— তুমি ওর পা ধর আমি ওর মাথা ধরছি। বলে ছেলেটি জেগে ওঠবার আগেই দুজনে মিলে তাকে ধরে ছুঁড়ে জলে ফেলে দিলেন। এই জঘন্য কাজ সমাপন হলেই রাজকন্যা কাপ্তেনকে বললেন— জাহাজের মুখ ফিরিয়ে দেশে চল। আমরা বলব আমার স্বামী অসুখে পড়ে মারা গেছেন। আর বাবার কাছে আমি তোমার নামে এত প্রশংসা করবো যে বাবা নিজেই আমাদের বিয়ে দেবেন। বাবার মৃত্যু হলে তুমিই তখন পাবে রাজমুকুট।

    কিন্তু সেই যে বিশ্বাসী চাকর, যার হাতে ছেলেটি সেই আশ্চর্য পাতাগুলি রাখতে দিয়েছিল, সে দেখল রাজকন্যার কুকীর্তি। চুপিচুপি সে জাহাজ থেকে একখানি নৌকো নামিয়ে তার উপর চেপে বসল। একটু দূরে গিয়েই দেখল তার প্রভুর দেহ ভেসে যাচ্ছে। তখন সে সেই দেহ টেনে তুললো নৌকোর উপর, তারপর জোরে জোরে দাঁড় ফেলে জাহাজ থেকে দূরে পালিয়ে গেল। বেশ খানিকটা এগোতে গিয়ে যখন তার মনে হল এবার আর কোনো বিপদ নেই তখন সে আস্তে আস্তে সেই আশ্চর্য পাতা তিনটি বার কল আর সাবধানে দুটি রাখল তার প্রভুর দুটি চোখের উপর আর তৃতীয়টি রাখল মুখের উপর। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি চোখ মেলে চাইল। উঠে বসে বললে— আমি কোথায়?

    —আপনি নৌকোয় আমার পাশে। বলে চাকর আদ্যোপান্ত সব বলল।

    এইভাবে যখন ছেলেটি বেঁচে উঠল তখন দুজনে মিলে নৌকো বাইতে শুরু করলে। যত জোরে পারে বাইতে লাগল আর দেখতে দেখতে তাদের ছিপছিপে নৌকো জাহাজকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল বহুদূরে। জাহাজ পৌঁছবার অনেক আগেই তারা এসে উঠল রাজপ্রাসাদের ঘাটে।

    রাজা তো এই দুজনকে ঢুকতে দেখে অবাক। তিনি বললেন— কি হয়েছে? তারপর যখন সব শুনলেন, বললেন— ছিঃ, আমার মেয়ে যে এমন ঘৃণ্য তা আমি ভাবতেই পারি না। যাই হোক, এর বিচার আমার হাতে। এখন তোমরা দুজনে ওই পাশের ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকো। জাহাজ ফিরে আসুক তারপর আমি যখন ডাকবো বেরিয়ে এস।

    প্রভু আর চাকর লুকিয়ে রইল। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রকাণ্ড জাহাজের মাস্তুল দেখা গেল। তারপর জাহাজ এসে লাগল রাজপ্রাসাদের ঘাটে। রাজার মেয়ে যেন কত শোক পেয়েছেন এই ভাবে মাথা নীচু করে রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

    রাজা বললেন— তুমি একা ফিরে এলে কেন? তোমার স্বামী কোথায়?

    রাজকন্যা বললেন— দুঃখের কথা কি বলব বাবা, বড় শোক সংবাদ বয়ে এনেছি। জাহাজ যাত্রার মাঝখানে আমার স্বামী হঠাৎ অসুখে পড়ে মারা গেলেন। এই সদাশয় কাপ্তেনটি যদি আমায় সাহায্য না করতেন তাহলে যে আমার কি হত তাই জানি না। ইনি আমার স্বামীর মৃত্যুশয্যার পাশে ছিলেন। ইনিই বলবেন কি হয়েছিল।

    রাজা উত্তর করলেন— আমি তোমার স্বামীকে আবার জীবন দান করতে পারি। কাজেই দুঃখ কোরো না। বলেই তিনি দরজা খুলে দিলেন। দরজার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলেন রাজার জামাই আর তাঁর চাকর।

    রাজকন্যা স্বামীকে দেখে বজ্রাহত। তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বললেন— আমায় ক্ষমা কর।

    রাজা বললেন— আমি তোমায় ক্ষমা করতে পারব না। তোমার স্বামী তোমার মৃত্যুর পর তোমার সঙ্গে জীবন্তে কবরে যেতে প্রস্তুত তো ছিলেনই, তিনিই আবার তোমায় বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। সেই দেবতুল্য স্বামীকে তুমি ঘুমন্তে হত্যা করেছ। কাজেই তোমার যা প্রাপ্য তাই তুমি পাবে।

    এই কথা বলে রাজা হুকুম করলেন রাজকন্যা আর জাহাজের কাপ্তেনকে ফুটোওয়ালা এক নৌকোয় তুলে দিতে। সেই নৌকো সমুদ্রের মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল আর দেখতে দেখতে ঢেউয়ের ধাক্কায় ডুবে গেল তা সমুদ্রের অতলে।

    টীকা