Chapter Index

    রোলাণ্ডের গল্প

    অনেকদিন আগে ছিল এক বুড়ি—সে ছিল সত্যিকারের এক ডাইনি। তার ছিল দুটি মেয়ে। একটি মেয়ের ছিল যেমন কুশ্রী চেহারা তেমনি নোংরা মন; কিন্তু ডাইনি তাকে ভালবাসত কারণ সে-ই ছিল তার নিজের মেয়ে। অন্যটি ছিল সুন্দরী, স্বভাবও তেমনি ভাল। কিন্তু ডাইনি তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না; কারণ সে ছিল তার সৎমেয়ে।

    সৎমেয়েটির ছিল একটি সুন্দর নক্সা-করা ঝাড়ন। অন্য মেয়েটির তার উপর ছিল লোভ। সে গিয়ে তার মাকে বললে—ওটা আমার চাই-ই চাই।

    ডাইনি বললে—চুপচাপ থাকো মা, ওটা আমি তোমায় পাইয়ে দেব। আজ রাত্রে তোমার বোন যখন ঘুমাবে আমি ওর মাথাটা কেটে ফেলব। শুধু তুমি শুয়ে থেকো দেওয়াল ঘেঁসে আর ওকে যতটা পারো খোলা দিকে ঠেলে দিয়ো।

    এ সবই ঘটত ঠিক; কিন্তু সেই মেয়ে বেচারিটি এক কোণে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল বলে বেঁচে গেল। রাত্রে যখন শোবার সময় এল ডাইনির মেয়ে আগে ঢুকল গিয়ে বিছানায়, যাতে সে দেয়ালের দিকে শুতে পারে। কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়তেই ভাল মেয়েটি তাকে আস্তে আস্তে বাইরের দিকে ঠেলে দিয়ে জায়গা বদল করে শুলো।

    মাঝরাতে ডাইনি হাতে এক দা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। ডান হাতে দা নিয়ে বাঁ হাত বিছানায় বুলিয়ে দেখে নিল সেদিকে কেউ আছে কি না। তারপর দু-হাতে দা ধরে এক কোপে উড়িয়ে দিল তার নিজের মেয়ের মাথাটা।

    ডাইনি চলে যেতে মেয়েটি উঠে পড়ে তার বন্ধু রোলাণ্ডের বাড়িতে গিয়ে ধাক্কা দিলে। রোলাণ্ড আসতে মেয়েটি বললে—শোনো রোলাণ্ড, এক্ষুনি আমাদের পালাতে হবে! আমার সৎমা আমায় মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু তার বদলে নিজের মেয়েকেই মেরেছে। দিনের আলো হলে যখন সে বুঝবে নিজের হাতে সে কী করেছে তখন আর আমার রক্ষা নেই!

    রোলাণ্ড বললে—কিন্তু তুমি শিগগির ওর জাদু-কাঠিটা নিয়ে এস, তা নইলে ও আমাদের ধরতে এলে আমরা পালাতে পারব না।

    মেয়েটি জাদু-কাঠিটি নিল। তারপর সে তার সৎবোনের মাথাটি নিয়ে তার থেকে তিন ফোঁটা রক্ত ফেলল—এক ফোঁটা বিছানায়, এক ফোঁটা রান্নাঘরে আর এক ফোঁটা সিঁড়িতে। শেষে সে তার বন্ধু রোলাণ্ডের কাছে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

    সকালবেলা উঠে বুড়ি ডাইনি তার মেয়েকে নক্সা-করা ঝাড়ন দেবার জন্যে ডাকতে লাগল, কিন্তু সে এল না। তখন সে বললে—কোথায় তুমি বাছা?

    রক্তের ফোঁটা জবাব দিল—এইখানে সিঁড়ির উপর।

    ডাইনি সিঁড়িতে গেল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তখন সে আবার ডাকল—কোথায় তুমি বাছা?

    দ্বিতীয় রক্তের ফোঁটা জবাব দিলে—এই তো রান্নাঘরে নিজেকে তাপাচ্ছি।

    ডাইনি রান্নাঘরে ঢুকে কাউকে দেখতে পেল না। তখন সে আবার ডাকল—কোথায় বাছা তুমি?

    তৃতীয় রক্তের ফোঁটা জবাব দিলে—এই যে বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছি।

    ডাইনি শোবার ঘরে গিয়ে দেখলে, তার নিজের মেয়ের গলা সে নিজে কেটেছে।

    সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল। অনেক, অনেক দূর পর্যন্ত দেখবার ক্ষমতা ছিল ডাইনির। সে দেখতে পেল যে তার সৎ-মেয়ে রোলাণ্ডের সঙ্গে পালাচ্ছে।

    ডাইনি চেঁচিয়ে উঠল—পালিয়ে বাঁচবে ভেবেছ? যত দূরেই যাও আমার হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই!

    ডাইনি তখন পায়ে পরল একুশ-ক্রোশ জুতো, আর সেই জুতো পরে দেখতে দেখতে সে প্রায় ধরে ফেলল তার সৎমেয়ে আর রোলাণ্ডকে। মেয়েটি যখন দেখল ডাইনি এগিয়ে আসছে, সে জাদুকাঠি দিয়ে তার বন্ধুকে করে দিল একটি হ্রদ আর নিজেকে একটি হংসী। ডাইনি হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে জলে রুটির টুকরো ছুঁড়ে ফেলতে লাগল; যতরকম ভাবে পারে চেষ্টা করতে লাগল হাঁসকে লোভ দেখিয়ে পারের কাছে আনবার। কিন্তু কোনই ফল হল না। রাত হয়ে যেতে নিষ্ফল হয়ে ডাইনি ফিরে গেল বাড়ি।

    ডাইনি চলে যেতে রোলাণ্ড আর মেয়েটি নিজেদের চেহারায় ফিরে এসে সারা রাত ধরে আবার হেঁটে চলল। যতক্ষণ না ভোর হয় থামল না।

    ভোর হতে মেয়েটি জাদুকাঠি দিয়ে নিজেকে করল একটি বুনো গোলাপ আর রোলাণ্ডকে বেহালা-বাজিয়ে। একটু পরেই ডাইনি ছুটতে ছুটতে এসে বেহালা-বাজিয়েকে বললে—দেখ ভাই, এই গোলাপ ফুলটি আমি তুলতে পারি?

    সে বললে—নিশ্চয়, নিশ্চয়। সেইসঙ্গে আমার বেহালার বাজনাও শুনিয়ে দিই তোমায় একটু।

    গোলাপ-কাঁটার মধ্যে দিয়ে পা বাড়িয়ে ডাইনি যেই না এগিয়ে গেল গোলাপ ফুলটি তুলতে, অমনি রোলাণ্ড বেহালায় ছড় টানল। বেহালার মধ্যে থেকে জাদু-নাচের সুর বেরিয়ে এল। আর যায় কোথা—ডাইনিকে নাচতে হল সেই জাদু-সুরের তালে তালে। ডাইনি কিছুতেই থামতে পারল না, কাঁটা-ঝোপ থেকে বেরোতেও পারল না। বাজিয়ে যত দ্রুততালে বাজাতে লাগল ডাইনিকেও লাফাতে হল তত তাড়াতাড়ি। তার কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে গেল, শেষে গায়ের চামড়ায় কাঁটা ফুটে, ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। কিন্তু বাজিয়ের থামবার নাম নেই। শেষে নাচতে নাচতে ডাইনি মরে গেল।

    ডাইনির মায়া কেটে যেতে রোলাণ্ড বললে—এবার আমি বাবার কাছে ফিরে চললুম আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে।

    মেয়েটি বললে—বেশ, তাহলে আপাতত আমি এখানেই থাকি। জাদু-কাঠি দিয়ে নিজেকে আমি পাথর করে রাখব, যাতে কেউ আমায় চিনতে না পারে।

    রোলাণ্ড চলে গেল আর মেয়েটি মাঠের মধ্যে পাথর হয়ে পড়ে রইল তার অপেক্ষায়।

    কিন্তু রোলাণ্ড বাড়ি পৌঁছতেই আর-একটি মেয়ে তাকে জাদু করল। তার ফলে সে একেবারে ভুলে গেল তার বিয়ের কনের কথা। ওদিকে বেচারা মেয়েটি বহু বহু দিন ধরে অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু রোলাণ্ড যখন ফিরে এল না সে মনের দুঃখে নিজেকে একটি ফুলে পরিবর্তিত করলে আর ভাবলে—কেউ অন্তত আমাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে পিষে ফেলুক!

    একদিন হল কি, এক রাখাল যখন ভেড়া চরাচ্ছিল সে দেখতে পেল চমৎকার সুন্দর একটি ফুল। সে সেটি তুলে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আলমারির মধ্যে রেখে দিলে। সেই থেকে রাখালের কুটিরে আশ্চর্য এক বদল এল। সকালে উঠে সে দেখল, সব কাজ সারা হয়ে গেছে। টেবিলের বেঞ্চির ধুলো ঝাড়া, উনুনে আঁচ দেওয়া, বালতিতে জল-ভরা, কিছু বাকি নেই। সন্ধেবেলা যখন সে বাড়ি ফিরল, দেখল টেবিল সাজানো; টেবিলের উপর রাঁধা খাবার সাজানো। কী করে যে হল সে কিছুই বুঝতে পারল না—কারণ বাড়িতে কাউকে সে দেখতে পেল না; তার সেই ছোট কুটিরের মধ্যে কারুর লুকিয়ে থাকাও সম্ভব নয়। এমনিভাবে সেবা পাওয়ায় প্রথমটা সে ভারি খুশি হয়েছিল, কিন্তু শেষে তার কেমন ভয় হল। সে এক গুণিন বুড়ির কাছে গেল পরামর্শ নিতে।

    গুণিন বুড়ি বললে—এর পিছনে জাদু আছে। ভোরে উঠে খুব সাবধানে ঘরের চারিদিক ভাল করে দেখবে। যা দেখতে পাবে তার উপর একটা সাদা কাপড় চাপা দিয়ে দেবে—তাহলেই কেটে যাবে জাদু।

    বুড়ি যা বলেছিল রাখাল তাই করল। পরদিন ঠিক যখন ভোর হচ্ছে, রাখাল দেখল আলমারির দরজা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে আর তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে সেই ফুলটি। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তার উপর একটা সাদা কাপড় ফেলে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে জাদু কেটে গেল আর রাখাল দেখল, তার সামনে একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি স্বীকার করল, সে-ই ছিল ফুল আর কুটিরের সব কাজ সে-ই করত। তার দুঃখের কাহিনীও সে বলল। রাখালের তাকে এত পছন্দ হয়ে গেল যে রাখাল বলল মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে চায়।

    কিন্তু মেয়েটি বললে—না। আমি চাই আমার রোলাণ্ডকে। সে যদিও আমায় ত্যাগ করেছে, তাহলেও আমি তার কাছে বিশ্বাসী থাকব।

    মেয়েটি আবার বললে—যাই হোক, আমি এখন তোমায় ছেড়ে যাব না, তোমার ঘর-সংসার গুছোনোর ভার আমারই রইল।

    এদিকে রোলাণ্ডের বিয়ের সময় এসে গেল। সে-দেশের পুরোনো প্রথা অনুযায়ী ঘোষণা করা হল, দেশের যেখানে যত মেয়ে আছে তারা এসে বর-কনের জন্যে গান গাইবে।

    মেয়েটির কানে যখন খবর এসে পৌঁছল, সে ভারি মনমরা হয়ে গেল। তার মনে হল তার বুক ভেঙে যাবে। বিয়েতে যাবার তার একটুও ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু আর সবাই এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল। কিন্তু যতবারই তার গানের দান আসতে লাগল সে অন্য কারুর পিছনে লুকিয়ে পড়তে লাগল। শেষে সবার গান গাওয়া হয়ে যেতে বাকি রইল সে-ই শুধু একা।

    যেই সে গেয়ে উঠল, আর তার গলার স্বর গিয়ে পৌঁছল রোলাণ্ডের কানে। অমনি রোলাণ্ড লাফিয়ে উঠে বললে—ঐ হচ্ছে আমার সত্যিকারের কনে! আমি আর কাউকে বিয়ে করব না।

    যত কিছু সে ভুলে গিয়েছিল সব আবার তার মনে পড়ল। মন ভরে উঠল আনন্দে। কাজেই মেয়েটির সঙ্গে রোলাণ্ডের বিয়ে হয়ে গেল। তার দুঃখের দিনের, কষ্টের দিনের অবসান হল, বইল শুধু সুখের স্রোত।

    টীকা