ফুর্তিভায়ার অ্যাড্ভেঞ্চার
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক রাজার দেশে অনেকদিন ধরে যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধ যখন শেষ হল সৈন্যদের আর কিছু করার রইল না। তারা সব চাকরি থেকে বরখাস্ত হল। বরখাস্ত সৈনিকদের মধ্যে ছিল একজন, তার নাম ফুর্তিভায়া। সে ছিল ভারি ফুর্তিবাজ, ভারি মজার মানুষ। বরখাস্ত হয়ে সে হাতে পেল মাত্র চারটে টাকা আর ছোট একটুকরো রুটি। তাইতেই সে খুশি হয়ে হালকা মনে খোশ মেজাজে বেরিয়ে পড়ল দুনিয়া টহল দিতে।
কিছু দূরে গিয়েই সে দেখল একটি ভিখারী রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করছে। আসলে যে ভিখারী একজন ছদ্মবেশী সাধু পুরুষ তা সে জানত না। ভিখারী ভিক্ষে চাইতে ফুর্তিভায়া বললে— কী দেব তোমায়? আমি গরিব মানুষ, নাম-কাটা সেপাই। সবশুদ্ধ আমি পেয়েছি একটুকরো রুটি আর চারটে টাকা। সেগুলি ফুরিয়ে গেলেই আমিও ভিক্ষে করব তোমার মত। যাই হোক, আমি তোমায় কিছু দেব। বলে সে রুটিটিকে চার-টুকরোয় ভাগ করল। করে তার একটা টুকরো আর সেইসঙ্গে একটি টাকা ভিখারীর হাতে তুলে দিলে।
সাধু তাকে ধন্যবাদ দিয়ে সেখান থেকে উঠে গেলেন। কিন্তু কিছু দূরে গিয়েই তাঁর চেহারা আর পোশাক বদলে আবার রাস্তার ধারে বসে পড়লেন। ফুর্তিভায়া সেখানে এসে পড়তেই তার কাছ থেকে আবার তিনি ভিক্ষে চাইলেন। ভালোমানুষ সৈনিকটি ভিখারীকে তিনটুকরো রুটির এক টুকরো আর বাকি তিনটি টাকার একটি টাকা দিয়ে দিলে।
সাধু ধন্যবাদ জানালেন। তারপর কিছুদূর হেঁটে গিয়ে তিনবারের বার আবার চেহারা বদলে ফুর্তিভায়ার কাছ থেকে ভিক্ষে চাইলেন। এবারেও সে তার তৃতীয় রুটির টুকরো আর একটি টাকা দিয়ে দিলে। ভিখারী তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।
দয়ালু লোকটির বাকি রইল ভাগের এক ভাগ রুটি আর একটি টাকা। এই নিয়ে সে এক সরাইখানায় গিয়ে উঠল। রুটিটা খেয়ে শেষ টাকাটা দিয়ে একমগ সরাব কিনলে। খাওয়া সেরেই সে বেরিয়ে পড়ল। একটু দূরে সেই সাধু দাঁড়িয়ে ছিলেন ফুৰ্তিভায়ারই মতো এক নামকাটা সেপাই সেজে।
তিনি বললেন— সান্ধ্যপ্রণাম ভাই! একটুকরো রুটি আর কিছু পয়সা দিতে পারো একমগ সরাব কেনবার?
ফুর্তিভায়া বললে— কোত্থেকে পাব ভাই? আজই আমি বরখাস্ত হয়েছি। আমাকে দিয়েছে একটুকরো রুটি আর চারটে টাকা। কিন্তু রাস্তায় তিনজন ভিখারীর সঙ্গে দেখা, তাদের প্রত্যেককে আমি সিকি টুকরো রুটি আর একটা করে টাকা দিয়েছি আর শেষ টাকাটি দিয়ে আমি সরাব কিনে তার সঙ্গে আমার শেষ রুটিটি খেয়েছি। এখন আমার হাত খালি, আর তোমারও যদি তাই অবস্থা হয় তাহলে এস দুজনে মিলে ভিক্ষে করা যাক।
সাধু বললেন— না, তার দরকার হবে না। আমার কিছু ডাক্তারি বিদ্যে, ওষুধ-বিষুধ জানা আছে। কাজেই আমার রোজগারের অভাব হবে না।
ফুর্তিভায়া বললে— আমি তো আর ডাক্তারি জানিনে! আমি চললুম একাই ভিক্ষে করতে।
সাধু বললেন— না, আমার সঙ্গে এস। আমি যা রোজগার করব, তোমার সঙ্গে অর্ধেক ভাগ করে নেব।
ফুর্তিভায়া বললে— এ তো ভালো কথা। বলে চলল তার সঙ্গে।
কিছুক্ষণ পরে তারা যখন এক চাষীর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে, শুনলে খুব কান্নাকাটি হচ্ছে। ভিতরে ঢুকে দেখল চাষীটির ভারি অসুখ, মারা যায়-যায়। চাষী-বৌ চিৎকার করে কাঁদছে।
সাধু বললেন— চেঁচিও না। আমি তোমার স্বামীকে সারিয়ে দেব। বলে তিনি তাঁর পকেট থেকে খানিকটা মলম বার করে লোকটির গায়ে মাখিয়ে দিতেই সে উঠে দাঁড়ালো। দেখা গেল তার আর রোগই নেই।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাঁকে ধন্যবাদ দিলেন আর বললেন— আপনার দয়ার প্রতিদানে আমরা কী দিতে পারি?
কিন্তু সাধু কিছুই নিলেন না। তারা যা নিয়ে এল তা-ই তিনি ফিরিয়ে দিলেন। ফুৰ্তিভায়া কয়েকবার তাকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলেন কিছু নেবার জন্যে, কিন্তু সাধু বললেন— না, আমি কিছুই নেব না। আমাদের দরকার নেই।
শেষে চাষা-চাষানী একটি ভেড়া নিয়ে এল। এনে বললে— এটি তাঁকে নিতেই হবে। ফুর্তিভায়া তাঁর পাঁজরে এক খোঁচা মেরে বললে— বোকামি করবেন না, নিয়ে নিন। জানেন তো যে আমাদের যথেষ্ট অভাব! তবে এমন করছেন কেন?
অবশেষে সাধু বললেন— বেশ, আমি ভেড়াটা নিতে পারি। কিন্তু বইতে পারব না। তোমার যখন এতই ইচ্ছে, তোমাকে বইতে হবে।
সে বললে— তাতে আমার কোন কষ্ট হবে না। বলে ভেড়াটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়ল আবার সাধুর সঙ্গে। কিছুক্ষণ পরে তার এক বনে এসে পৌঁছল। ফুর্তিভায়া বড় ক্লান্ত। খিদে পেয়েছে, ভেড়াটাও ভারি ঠেকছে। সে বললে— এবার কোথাও থেমে একটু জিরোনো যাক। দেখুন, ভেড়াটি রান্না করে খাবার পক্ষে জায়গাটি বেশ চমৎকার।
সাধু বললেন— আপত্তি নেই, তবে, আমি রান্না-টান্না করতে পারব না। তোমাকেই করতে হবে। যতক্ষণ রান্না হবে আমি একটু ঘুরে আসি। কিন্তু আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছু খেও না যেন।
ফুর্তিভায়া বললে— যান না আপনি, ঘুরে আসুন। ঠিক সময় আমি রান্না সেরে রাখব।
সাধু চলে গেলেন আর ফুর্তিভায়া ভেড়াটাকে কেটে আগুন জ্বালিয়ে হাঁড়িতে মাংস সিদ্ধ করতে বসে গেল। সাধু সেই যে গেলেন আর ফেরবার নাম নেই। মাংস রান্না হয়ে গেছে— গন্ধে ফুর্তিভায়া অধৈর্য হয়ে উঠছে। শেষে আর থাকতে না পেরে হাঁড়ি থেকে সে একটুকরো মাংস বার করে নিলে। বার করে দেখে, ভেড়ার কলজেটা।
—সবচেয়ে ভালো খেতে কলজে। এই বলে সে একটু চাখল। দেখল চমৎকার হয়েছে খেতে। তখন লোভে পড়ে সবটাই খেয়ে ফেললে।
সবে খাওয়া শেষ করেছে, সেই সময় তার সঙ্গী ফিরে এসে বললেন— তুমি ভেড়ার সবটাই খেতে পার, আমার খিদে নেই ; আমায় শুধু কলজেটা দাও— ঐটেই আমি খাব।
ফুর্তিভায়া তখন একটা কাঁটা আর ছুরি নিয়ে মাংসের মধ্যে কলজে খুঁজতে লেগে গেল। কলজে তো ছিল না— পাবে কোথা থেকে? তাই সে খুঁজেটুজে বললে— কই নেই তো!
সাধু বললেন— তাহলে গেল কোথায়?
ফুর্তিভায়া বললেন— জানি না তো! দাঁড়াও— আরে আমরা আচ্ছা বোকা তো? এতক্ষণ ধরে ভেড়ার কলজে খুঁজছি! পাব কী করে? ভেড়ার তো কলজেই হয় না!
—বেশ কথা বললে ভাই! সব প্রাণীরই কলজে আছে, শুধু ভেড়ার থাকবে না?
—সত্যি নেই দাদা! ভেড়ার কোনো কলজে নেই। আপনি একটু ভেবে দেখুন, আপনি নিশ্চিত জানবেন যে ওর কলজে নেই।
—যাই হোক, বেশ বোঝাই যাচ্ছে যে এ ভেড়াটার কলজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি যখন অন্য কোন অংশ খাব না, তখন তুমিই খেয়ে ফেল ভেড়াটা।
—সবটা তো আমি খেতে পারব না। তাহলে যা বাকি থাকবে আমি বরং আমার পিঠ-ঝুলিতে ভরে নিই।
খাওয়া-দাওয়া সেরে তারা আবার বেরিয়ে পড়ল পথে।
সাধুভাই করলেন কি, ঠিক যে-পথ দিয়ে তাঁরা যাবেন, মন্ত্রের জোরে সেখানে একটা ছোট নদী করে দিলেন। নদীর ধারে এসে পৌঁছতে সাধুভাই বললেন— তুমি আগে পার হও।
ফুর্তিভায়া বললে— না, আপনিই আগে যান বরং। সে মনে মনে ভাবলে, যদি দেখি যে নদী খুব গভীর তাহলে আমি পারই হব না।
কাজেই সাধুভাই নদীতে নামলেন। তাঁর হাঁটু পর্যন্ত জল উঠল। তাই দেখে ফুর্তিভায়াও পার হবার জন্যে তৈরি হল। কিন্তু একটু যেতে তার গলা পর্যন্ত জল হয়ে গেল। সে চিৎকার করে ডাকলে— দাদা, আমাকে বাঁচান!
তিনি বললেন— এখন কি তুমি স্বীকার করবে যে তুমি ভেড়ার বাচ্চার কলজে খেয়েছিলে?
—না আমি খাইনি তো!
সঙ্গে সঙ্গে জল বেড়ে তার মুখ পর্যন্ত উঠল। সে চেঁচিয়ে উঠল— বাঁচান দাদা, আমাকে বাঁচান!
—এখনও তুমি স্বীকার করবে যে তুমি ভেড়ার কলজে খেয়েছিলে?
—না আমি খাইনি!
ইচ্ছে করলেই সাধু তাকে ডুবিয়ে মারতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মায়া করল। তিনি জল নামিয়ে দিলেন, আর ফুর্তিভায়া নদীটা পার হয়ে চলে এল। এর পর তারা দুজনে চলতে চলতে শেষে এক বিদেশে এসে হাজির। সেখানকার রাজধানীতে এসে শুনল রাজকন্যার বেজায় অসুখ, তিনি বোধহয় বাঁচবেন না।
সৈনিক বললে— ও দাদা, এ এক ভাল সুযোগ পাওয়া গেছে। এঁকে যদি আপনি সারিয়ে দিতে পারেন তাহলে আর আমাদের কোনো অভাব থাকবে না।
কিন্তু সাধুভাই বিশেষ কিছু ব্যগ্রতা বা ব্যস্ততা দেখালেন না। সঙ্গী যত বলে তাড়াতাড়ি চলুন, তিনিও তত আস্তে হাঁটেন। ফুর্তিভায়া তাঁকে টানতে লাগল, ঠেলতে লাগল, কিন্তু কিছুই লাভ হল না। শেষে শোনা গেল, রাজকন্যা মারা গেছেন। ফুর্তিভায়া বললে— হল তো? আপনি যেমন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছিলেন, তারই এই ফল।
সাধুভাই বললেন— চুপ কর। আমি যে শুধু রুগী আরাম করতে পারি তা নয়, আমি মরা মানুষকেও বাঁচাতে পারি।
সৈনিক বললে— তা যদি হয় তাহলে নিশ্চিত থাকুন, রাজা আনন্দের চোটে অর্ধেক রাজ্যই দিয়ে ফেলবেন।
তারা তখন রাজপ্রাসাদে গিয়ে হাজির হল। দেখল সবাই গভীর দুঃখে মগ্ন। সাধুভাই রাজাকে বললেন— শোক করবেন না। আমি রাজকন্যাকে বাঁচাতে পারব।
তাঁদের দুজনকে তখনই রাজকন্যার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আর সকলকে ঘর থেকে বার করে দেওয়া হল। মৃত রাজকন্যাকে নিয়ে শুধু তারা দুজনে রইল ঘরে। সাধুভাই রাজকন্যার গা থেকে কবরের পোশাক খুলে ফেললেন। তারপর একটব খুব গরম জল আনতে বলে তাইতে রাজকন্যাকে শুইয়ে দিলেন। তারপর মন্ত্র পড়তে লাগলেন। মন্ত্রগুলি তাঁর সঙ্গী শুনে শুনে মনে রাখবার চেষ্টা করতে লাগল। শেষে রাজকন্যার দিকে ফিরে তিনি বললেন— আমার হুকুম, তুমি টব থেকে উঠে নিজের পায়ে দাঁড়াও।
বলতেই রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালেন। দেখা গেল তিনি বেঁচে উঠেছেন, অসুখ সেরে গেছে। রাজকন্যা রাজোচিত পোশাক পরে বাবার কাছে গেলেন। রাজার যা আনন্দ হল! রাজা বললেন— বলুন আপনাদের কী পুরস্কার দেব? যা চান পাবেন। অর্ধেক রাজ্য যদি চান তা-ও।
কিন্তু সাধুভাই বললেন— না, আমি যা করেছি তার জন্যে আমি কোন পুরস্কার নেব না।
ফুর্তিভায়া ভাবলে, উঃ লোকটা কী বোকা! সে আর-একবার তাঁর পাঁজরে খোঁচা দিয়ে বললে— হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে আছে? আপনার যদি কিছু দরকার না থাকে না থাকুক, আমার আছে।
তবুও সাধুভাই কিছু নিতে চাইলেন না। কিন্তু রাজা যখন দেখলেন যে সঙ্গীটি কিছু পেলে নেবে, তিনি কোষাধ্যক্ষকে বলে দিলেন যে তার পিঠ-ঝুলি ভর্তি করে যেন সোনা দিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর তারা শহর ছেড়ে চলে গেল। ক্রমে এক বনের ধারে এসে পৌঁছল। সাধুভাই বললেন— সোনা যা পাওয়া গেছে বোধকরি ভাগ করে ফেলা ভাল।
ফুর্তিভায়া বললে— নিশ্চয়, নিশ্চয়!
সাধুভাই সোনাগুলি নিয়ে তিন ভাগে ভাগ করলেন।
ফুর্তিভায়া জিজ্ঞেস করল— ব্যাপার কী? আপনার মাথার মধ্যে কী ঢুকেছে? আমরা তো দুজন!
তিনি বললেন— এক অংশ আমার, এক অংশ তোমার। আর এক অংশ যে ভেড়ার কলজে খেয়েছে তার।
ফুর্তিভায়া বললে— আহা, ভেড়ার কলজে আমিই তো খেয়েছি! বলে তাড়াতাড়ি সোনার ভাগটা বাগিয়ে নিল। নিয়ে বললে— আমিই সত্যি খেয়েছিলুম। বিশ্বাস হচ্ছে না?
সাধুভাই বললে— তা কী করে হয়? ভেড়ার তো কলজে নেই!
—কী বলেন দাদা! কী ভাবছেন? অন্য জন্তুর মত ভেড়ারও কলজে আছে। থাকবে না কেন?
সাধুভাই বললেন— যাক, শুনে খুশি হলুম। যাই হোক তুমি সব সোনাটাই রাখতে পারো। কিন্তু এবারে আমি একাই যাব।
সৈনিক বললে— যেমন আপনার ইচ্ছে দাদা, বিদায়!
তখন সাধুভাই এক পথ ধরলেন, ফুর্তিভায়াকে ছেড়ে দিলেন তার যেদিকে মন চায় যেতে। ফুর্তিভায়া ভাবলে— ভালই হল একরকম। কিন্তু আশ্চর্য মানুষ ঐ লোকটা!
ফুর্তিভায়ার এখন যথেষ্ট টাকা হয়েছে, কিন্তু টাকা কী করে খরচ করতে হয় তা সে শেখেনি। সে টাকা যেমন নষ্টও করতে লাগল তেমনি একে ওকে দিয়েও দিতে লাগল। তাই কিছুদিনের মধ্যেই আবার সে কপর্দকহীন হয়ে পড়ল। সেই সময় সে এক শহরে এসে শুনলে যে সে দেশের রাজার মেয়ে এইমাত্র মারা গেছেন। সে ভাবলে— এই তো সুযোগ এসেছে! আমি জানি কী করে রাজকন্যাকে বাঁচানো যায়। এবারে মোটারকম কিছু লাভ করা যাবে। ভেবে সে রাজার কাছে গিয়ে বললে সে রাজকন্যাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।
এই রাজা এক বরখাস্ত সৈনিকের কথা শুনেছিলেন যে কিছুদিন আগে এক রাজকন্যাকে নতুন প্রাণ দিয়েছিল। তিনি ভাবলেন ফুৰ্তিভায়াই হচ্ছে সেই লোক। কিন্তু নিঃসন্দেহ হবার জন্যে জিজ্ঞেস করলেন— রাজকন্যা যদি সত্যিই মারা গিয়ে থাকেন তাহলেও আপনি তাকে জীবন দান করবার চেষ্টা করবেন নাকি?
সৈনিক বললে— চেষ্টা কেন? জীবন দানই করব। সে একটব’গরম জল আনতে বললে। তারপর রাজকন্যার শব নিয়ে একা গিয়ে ঢুকল ঘরে। রাজকন্যাকে টবের জলে শুইয়ে সাধুভাইয়ের মুখে শোনা যে মন্ত্র তার মনে ছিল সেগুলি উচ্চারণ কতে লাগল। কিন্তু মৃতদেহ নড়ল না। তিনবার মন্ত্র উচ্চারণ করেও কোনো ফল হল না। তখন তার ভয় হল। রাগত সুরে চেঁচিয়ে বললে— উঠে দাঁড়াও বলছি! নইলে দেখাচ্ছি তোমায় মজা!
বলতেই সাধুভাই সেই আগেকার নামকাটা সেপাইয়ের রূপে জানলার মধ্যে দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন।
তিনি ধমকে বললেন— গর্ধভচন্দ্র। মরা মানুষকে বাঁচানো কি তোমার কাজ? এবারকার মতো আমি তোমায় সাহায্য করব। কিন্তু কখনও আর এ চেষ্টা কোরো না।
এই বলে মন্ত্র পড়তেই রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালেন। আগের মতো শক্তি ফিরে পেলেন, স্বাস্থ্য ফিরে পেলেন। সাধু জানলা দিয়ে চলে গেলেন। রাজকন্যা। রাজপোশাক পরে রাজার কাছে গিয়ে হাজির হলেন। সাধুভাই সৈনিককে বলে দিয়েছিলেন কোনোরকম পুরস্কার যেন সে না চায়। রাজা যখন জিজ্ঞেস করলেন সে কী চায়, তার মনে মনে লোভ থাকলেও মুখে বলল কিছুই চায় না। তবু রাজা হুকুম দিলেন সোনা দিয়ে তার পিঠ-ঝুলি ভরে দিতে। সৈনিক তখন আর না বলল না। সোনা-ভরা পিঠ-ঝুলি নিয়ে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে সে বিদায় নিলে।
রাজপ্রাসাদের ফটকের বাইরে তার সাধুর সঙ্গে দেখা। সাধু বললেন— দেখ, তোমায় আমি বারণ করলুম, তবু তুমি পিঠ-ঝুলি ভরে সোনা নিয়েছ?
সৈনিক বললে— ওরা যদি জোর করে ভরে দেয়, আমি কী করতে পারি?
তিনি জবাব দিলেন— তাহলে শোনো। এর পরে যদি তুমি যা পারো না তাই করতে গিয়ে মুশকিলে পডো তাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।
—বেশ দাদা! সোনা যখন পেয়েছি তখন আর তোয়াক্কা করিনে। এর পরে গরম জলের টবে মড়া শুইয়ে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করার আমার দরকারও হবে না।
সাধু বললেন— তোমার সোনা কিন্তু বেশিকাল থাকবে না। যাই হোক, এর পর থেকে তুমি যদি বে-আইনি পথে না যাও, আমি তোমার পিঠ-ঝুলিকে একটা বর দেব, তুমি যা চাও তাই ওর মধ্যে আসবে। এবার বিদায়। এর পর থেকে তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না।
সৈনিক বললে— বিদায়। তারপর ভাবলে— উনি চলে গেলেন, খুশি হলুম। লোকটি বড় চমৎকার সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর সঙ্গে যাওয়ার চেয়ে একলা যাওয়াই ভালো। সাধুভাই তার পিঠ-ঝুলিকে যে আশ্চর্য বর দিয়ে গেলেন তার কথাটা সে তখন ভাবলই না।
সোনা নিয়ে সে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরতে লাগল। আগেরই মত খরচ কতে লাগল, নষ্ট করতে লাগল। শেষে তার বাকি রইল শুধু চারটি টাকা। এই চারটি টাকা নিয়ে সে রাস্তার ধারের এক সরাইখানায় গিয়ে ঢুকল। তার হাত নিশপিশ করতে লাগল সবকটা টাকা খরচ করে ফেলবার জন্যে। তিন টাকার সে সরাব কিনল, আর এক টাকার রুটি।
বসে বসে যখন সে সরাব আর রুটি খাচ্ছে, তার নাকে চমৎকার হাঁসের মাংস ভাজার গন্ধ এল। ফুর্তিভায়া এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, সরায়ের গিন্নি উনুনে দুটো হাঁস রোস্ট করছেন।
তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল সাধুভাই তাকে কি বলেছিলেন। সে যা চাইবে তাই তার পিঠ-ঝুলির মধ্যে চলে আসবে। সে মনে মনে বললে— দাঁড়াও ঐ হাঁসদুটোই তাহলে চাওয়া যাক। বলে দরজা পার হয়ে গিয়ে ফিস্ফিস্ করে বললে— উনুনে যে দুটো হাঁস রান্না হচ্ছে, আমি চাই যে তারা আমার পিঠ-ঝুলির মধ্যে আসুক। পিঠ-ঝুলিটা নামিয়ে তার মধ্যে উঁকি মেরে দেখে দুটো হাঁসই তার ভিতরে। সে বললে— আমার মত ক্ষমতা আর কার? বলে মাঠের মধ্যে গিয়ে বসল আরাম করে হাঁসদুটোকে খেতে।
একটা হাঁস খাওয়া হয়ে যাবার পর দ্বিতীয় হাঁসটা যখন সে বার করেছে, সেই সময় দুজন খেতমজুর সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। হাঁস দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেল। মনে হল চোখ দিয়েই সেটাকে গিলে খেতে চায়। ফুর্তিভায়া ভাবলে, একটা খেয়েছি যথেষ্ট। মজুরদের ডেকে সে বললে— ওহে ভায়া, এই হাঁসটা নিয়ে যাও। খাবার সময় আমার কথা মনে কোরো।
তারা ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁসের মাংসটা নিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে ঢুকল সরাইখানায়। কিছু সরাব আর রুটি কিনে হাঁসের মাংসটা বার করে তারা খেতে আরম্ভ করলে।
সরাইখানার গিন্নি দেখলেন। দেখে তাঁর স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন— ঐ যে মজুর দুজন হাঁস খাচ্ছে— দেখ তো উনুনের মধ্যে থেকে আমাদের একটা হাঁস খোয়া গেছে কি না!
সরাইয়ের মালিক উনুনের ঢাকা খুলে দেখলেন, ভিতরটা একেবারে খালি। তাদের কাছে ছুটে গিয়ে বললেন— চোর! রোস্ট হাঁসের মাংস কোত্থেকে পেলে তোমরা? এখনই বল, নইলে পিঠের ছাল তুলে নেব!
তারা বললে— আমরা চোর নই। ঐখানে ঐ মাঠে একজন বরখাস্ত সৈনিক আমাদের দিয়েছে।
মালিক চেঁচিয়ে বললেন— এ কথা আমায় বিশ্বাস করতে হবে? কখ্খনো না।ঐ সৈনিক এখানে এসেছিলেন। উনি অতি ভদ্রলোক। উনি যখন বেরিয়ে যান, আমি লক্ষ করেছিলাম ওঁর সঙ্গে কিছুই ছিল না। না না, তোরাই চোর ; হাঁসের দাম দিতে হবে। তারা যখন দাম দিতে পারল না, মালিক তখন লাঠি মারতে মারতে তাদের বার করে দিলেন।
ফুর্তিভায়া এসবের কিছুই জানতে পারলে না— সে চলল তার পথে। অবশেষে সে এক জায়গায় এসে পৌঁছল— সেখানে সুন্দর একটি রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদের পাশেই মস্ত এক সরাইখানা। দেখে মনে হয় সরাইখানাটি বড় দরিদ্র। সৈনিক সরাইখানায় গিয়ে এক রাতের মত আশ্রয় চাইল।
সরাইয়ের মালিক বললেন— এখানে একটিও ঘর খালি নেই। বড় বড় লোকেরা এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে আছেন।
ফুর্তিভায়া বললে— ভারি আশ্চর্য তো! পাশেই অমন সুন্দর প্রাসাদ থাকতে বড়লোকেরা এখানে এসে থাকবেন কেন?
মালিক বললেন— এ কথা অনেকেই বলেছেন আপনার মত। আপনি বোধহয় বিদেশী মানুষ, তাই জানেন না। এই সরাইয়ে না থেকে যিনিই ঐ প্রাসাদে এক রাত কাটাতে গেছেন তিনি আর প্রাণ নিয়ে ফেরেন নি। যারা মাথায় হেঁটে প্রাসাদে ঢোকে শুধু তাদেরই ভিতরে থাকতে দেওয়া হয়।
সৈনিক বললে— মাথায় হেঁটে আমি যেতে পারব না। কিন্তু দেখুন মালিক, আমার সঙ্গে কিছু খাবার আর পানীয় দিন। আমি যাব।
মালিক তখন তাকে বেশ একপ্রস্থ খাবার দিয়ে দিলেন। ফুর্তিভায়া তাই নিয়ে প্রাসাদে চলল। প্রাসাদে পৌঁছে সে প্রথমে এক জায়গায় বসে বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে নিল। যখন তার ঘুম পেয়ে এল সে চারদিকে খুঁজে দেখল, কোথাও কোনো বিছানা নেই। তাই মাটিতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাত্রে এক ভীষণ শব্দে তার ভেঙে গেল ঘুম। চোখ মেলে দেখে, নটা কুৎসিত চেহারার বামন ঘরের মধ্যে। তারা হাতে একটা করে লাঠি নিয়ে তার চারদিকে নাচছে আর ঘুরছে। ফুর্তিভায়া বললে— যত খুশি নাচো তোমরা। কিন্তু আমার কাছে এসো না। বামনরা কিন্তু নাচতে নাচতে ক্রমেই তার কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। শেষে একজন তার ভারি পা দিয়ে তার মুখ মাড়িয়ে দিলে। ফুর্তিভায়া চেঁচিয়ে বললে— সরে যাও হতভাগারা— দূরে থাক! তবু তারা শুনল না, এগিয়ে আসতে লাগল। ফুর্তিভায়া তখন চটে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটা চৌকি তুলে নিয়ে চালালো ডাইনে বাঁয়ে। কিন্তু ন-জন বামনের সঙ্গে একজন মানুষ পারবে কেন? সামনের একজনকে যদি সে চেয়ার দিয়ে মারে তো পিছনের একজন তার চুল টেনে ছিঁড়ে দেয়। তখন হঠাৎ সে বলে উঠল— দাঁড়া দানোরা! দেখাচ্ছি তোদের মজা! আয় তবে সবকটা দানো আমার পিঠ-ঝুলিতে! সাঁ করে একটা শব্দ হল, আর সবাই এল তার পিঠ-ঝুলির মধ্যে। ঝট্ করে সে থলির মুখ কষে বেঁধে থলিটা এক কোণে ফেলে রেখে দিলে।
তারপর সব চুপ হয়ে গেল। ফুৰ্তিভায় শুয়ে পড়ল। শুয়েই ঘুম। যতক্ষণ না দিনের আলো হয় উঠল না। সকালে সরাইয়ের মালিক আর প্রাসাদের মালিক তাকে ডেকে তুললেন। তাঁরা তাকে দেখে আর তার অত ফুর্তি দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা বললেন— রাত্রে তুমি ভূত দেখনি? তোমার কোনো অনিষ্ট হয়নি?
ফুর্তিভায়া বললে— ভূতগুলোকে ধরে আমার পিঠ-ঝুলির মধ্যে পুরে রেখে দিয়েছি। তারা এখন বন্দী। কারো কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। ঘরের কোণে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ভূতগুলো কোথায় আছে। প্রাসাদের মালিককে বললে— এবার থেকে আপনার প্রাসাদে আপনি শান্তিতে থাকতে পারবেন। দানোরা আর আপনার কোনো অনিষ্ট করবে না।
বড়লোকটি ফুর্তিভায়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনেক উপহার দিলেন। তিনি তাকে তাঁর বাড়িতে কোন কাজ নিয়ে থাকতে বললেন। তিনি বললেন— সারা জীবন তুমি যাতে সুখে স্বচ্ছন্দে থাকতে পার আমি তার ব্যবস্থা করব।
কিন্তু সৈনিক বললে— না, আমার ঘুরুনি রোগ আছে। একজায়গায় আমি বেশিদিন থাকতে পারব না। আমি চললুম আরো দেশ ঘুরতে।
ফুর্তিভায়া এক কামারশালায় গিয়ে দানোভরা তার পিঠ-ঝুলিটা কামারশালার নেহাইয়ের উপর রাখলে। তারপর কামারকে আর তার সাকরেদদের বললে— তোমাদের ভারি-ভারি হাতুড়িগুলি নিয়ে এস। যত জোরে পার পেটাও ঝুলির উপর। মার খেয়ে দানোরা যা চিৎকার লাগালো তাতে কানে তালা লাগে আর-কি! ক্রমে সব শব্দ থেমে গেল। তখন পিঠ-ঝুলির মুখ খোলা হল। আটটা দানো একেবারেই মরে গেছে। নয়েরটা একটা ফাঁকের মধ্যে পড়ে গিয়ে কোনরকমে বেঁচে গিয়েছিল। পিঠ ঝুলির দড়ি খুলতেই পালিয়ে বাঁচল।