অলস বৌ
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক গ্রামে একটি লোক আর তার বৌ থাকত। বৌটি এত কুঁড়ে ছিল যে কোনো কাজে হাত দিতে চাইত না। তার স্বামী তাকে একটি চরকা দিয়েছিল, কিন্তু পশম বা তুলো যাই সে এনে দিক না কেন, চরকা কাটা আর হত না। যেটুকু সুতোও বৌ কাটত তা সে কোনোদিন লাটাইয়ে গুটিয়ে রাখত না। অমনি পড়ে থাকত মেঝেয়, জট পাকিয়ে। স্বামী যদি কিছু বলত তো সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিত—ভাল লাটাই নেই তো গুটোবো কিসে? বনে গিয়ে কাঠ কেটে একটা লাটাই বানিয়ে নিয়ে এস।
স্বামী বলল—শুধু এর জন্যেই যদি তোমার কাজ আটকে থাকে, বেশ যাচ্ছি। বনে কাঠ আনতে। কাঠ এনে লাটাই বানিয়ে দেব।
বৌয়ের তখন ভয় হল, স্বামী যদি সত্যিই কাঠ আনে তাহলে তো সত্যিই লাটাই বানিয়ে দেবে। তখন সুতো গুটোতেই হবে। আর সুতো গুটোলেই তকলি খালি—তখন আরো সুতো কাটো!
সে একটু ভাবলে। এক বুদ্ধি এল তার মাথায়। আড়ালে আড়ালে সে তার স্বামীর পিছু পিছু বনে গিয়ে উপস্থিত হল। তারপর স্বামী যখন গাছে উঠে একটা শুকনো ডাল বেছে কাটতে শুরু করেছে, সে ঝোপের আড়াল থেকে অন্যরকম গলায় বলে উঠল—
লাটাই তরে কাঠ কেটো না—মরবে।
গোটাও যদি সুতো—শমন এসে ধরবে।
লোকটি শুনে খানিকক্ষণ কুঠার হাতে চুপ করে রইল। ভাবল, ব্যাপারটা কি? শেষে বলল—কি আর হবে? নিশ্চয় আমার কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করছিল তাই কি শুনতে কি শুনেছি। কুড়ুল তুলে ঘা দিতে যাবে, আবার সেই ছড়া—
লাটাই তরে কাঠ কেটো না—মরবে
গোটাও যদি সুতো—শমন এসে ধরবে।
সে হাত গুটিয়ে নিল। ভয় পেল। ভাবতে লাগল কি হয়েছে? কিন্তু কয়েক মিনিট যাবার পর তার সাহস ফিরে এল। আবার কুড়ুল তুলে নিয়ে বসালো এক কোপ। এবার আরেকটু জোরে—
লাটাই তরে কাঠ কেটো না—মরবে
গোটাও যদি সুতো—শমন এসে ধরবে!
বাস্ আর বলতে হল না। কাঠ কাটবার আর একটুও ইচ্ছে তার বাকি রইল না। তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরল। বৌটি দৌড়তে দৌড়তে অন্য পথ দিয়ে স্বামীর আগেই বাড়ি পৌঁছে গেল। স্বামী যখন ঢুকল, যেন কিছুই হয়নি এইরকম মুখ করে সে বললে—কি গো? ভাল দেখে বেছে এক টুকরো কাঠ আনলে লাটাইয়ের জন্যে?
স্বামী বলল—না আনিনি। যে রকম দেখছি তাতে মনে হচ্ছে সুতো গোটানো চলবে না। বলে বনের মধ্যে কি ঘটেছিল সব বলল। সেই থেকে বৌ-কে আর সে লাটাইয়ে সুতো গোটানো নিয়ে জ্বালাতন করেনি।
যাই হোক, কিছুদিন পরে আবার লোকটি অগোছাল বাড়ি দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল। সে বলল—দেখ বৌ, কাটা সুতোগুলো চারিদিকে কি রকম জট পাকিয়ে পড়ে রয়েছে!
বৌ বলল—আমার মাথায় এক বুদ্ধি এসেছে। লাটাই যখন হবেই না তখন এক কাজ কর। তুমি মাচায় গিয়ে ওঠ, আমি নীচে থাকি। আমি নীচে থেকে সুতোর তকলি উপরে ছুঁড়ে দেব, তুমি উপর থেকে তকলি আমার কাছে ফেলে দেবে, এমনি করে বেশ সুতো গুটোনো হয়ে যাবে।
স্বামী বলল—বেশ তাই করা যাক।
সুতো গোটানো হয়ে যেতে স্বামী বললে—গোটানো তো হল, এবার সুতো জলে ফুটোতে হবে।
শুনে বৌয়ের মহা ভাবনা। একটা চালাকি তার মাথায় এল। সে বললে—বেশ, কাল সকালে তাহলে ফুটোবো।
ভোরে উঠে সে আগুন জ্বাললো, কড়া চাপালো। কিন্তু সুতোর বদলে কড়ার মধ্যে খানিকটা পাটের ফেঁশো ফেলে দিয়ে ফোটাতে লাগল। তার পর স্বামীকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলল। তুলে বলল—আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। উনুনে কড়া বসিয়েছি, কড়ায় সুতো চাপিয়ে গেলুম—ওটা দেখো। কিন্তু সাবধান, যখন মোরগ ডাকবে তখন যদি তুমি কড়ার মধ্যে নজর না রাখো তাহলেই পশমী সুতো হয়ে যাবে পাটের ফেঁশো।
স্বামী তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে কলতলায় ছুটল। সেখানে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসতে আসতেই খানিকটা সময় কেটে গেল। দৌড়ে গিয়ে কড়ার মধ্যে উঁকি মেরে দেখে—কি সর্বনাশ! সুতো কোথায়? কড়ার মধ্যে যে এক পিণ্ডি পাটের ফেঁশো। দেখে ভাবলো তবে তো তারই দোষ। যতক্ষণ হাত মুখ ধুচ্ছিল নিশ্চয় মোরগ ডেকে উঠেছে! কি করা যায়?
আর কি করা যায়? সেই থেকে সে আর বৌ-কে সুতো কাটা, সুতো গোটানো, সুতো ফোটানো এ সব কথা বলাই ছেড়ে দিল।