কুঁড়ে হরি
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাহরি ছিল কুঁড়ে। একমাত্র কাজ ছিল তার ছাগলটিকে চরাতে নিয়ে যাওয়া, কিন্তু রোজ বাড়ি ফিরে এসে সে খুঁৎ খুঁৎ করত এই বলে—বড় খাটুনি যাচ্ছে। বছরের পর বছর হেমন্তকাল না আসা পর্যন্ত মাঠে ছাগল চরানোর এই একঘেয়ে কাজ—আর পেরে উঠিনে। ওঃ যদি শুয়ে একটু ঘুমোতে পারতুম! কিন্তু তার কি জো আছে? সমস্তক্ষণ চোখ খুলে রাখতে হবে, তা সে চোখ ব্যথাই করুক আর যাই হোক। উপায় তো নেই, দেখতে হবে ছাগলে কচি গাছ খেয়ে ফেলল কি না, কারুর বেড়া ভেঙে ঢুকল কি না কিংবা পালিয়েই গেল কি না! এরকম করে কারুর জীবনে কি বিশ্রাম বা শান্তি থাকে?
হরি ভাল করে ভাবতে বসল কি উপায়ে তার কাঁধের গুরুভার থেকে একটু রেহাই পায়। অনেকক্ষণ ধরে ভেবে কিছু কূল পেল না। তারপর হঠাৎ সে যেন আলো দেখলে পেলে। চেঁচিয়ে বলে উঠল—ঠিক হয়েছে! এইবার মাথায় বুদ্ধি এসেছে। তৃণার একটা ছাগল আছে। মুটকী তৃণাকে আমি বিয়ে করব; তাহলে তৃণা তার ছাগলের সঙ্গে আমার ছাগলকেও চরাতে নিয়ে যেতে পারবে, আমার আর কোনো ভাবনা থাকবে না।
ভেবে হরি উঠে পড়ল; তার ক্লান্ত পা-কে টেনে নিয়ে নিয়ে চললো এগিয়ে। তারপর রাস্তাটা পার হল। রাস্তার ওপারেই ছিল তৃণার বাবার বাড়ি। হরি তৃণার বাপ-মার কাছে গিয়ে বললে সে তাঁদের ধর্মপ্রাণা পরিশ্রমী মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়। বাপ-মার মনস্থির করতে বিশেষ দেরী হল না। তাঁরা ভাবলেন—চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। ভেবে তাঁরা মত দিলেন।
মুটকী তৃণা হল হরির বৌ। দুটো ছাগল নিয়েই সে চরাতে চলল। হরির হল ভারি মজা। কোন কাজ রইল না। শুধু রইল অলস জীবন। মাঝে মাঝে সে তৃণার সঙ্গে বেড়াতে যেত আর বলত—বেড়াচ্ছি কেন জান? যাতে বেশ ভাল করে একটু জিরতে পারি। এ না করলে জিরনো জিনিসটা কি তা-ই বুঝতে পারব না।
মুটকী তৃণা, সে-ও বড় কম অলস ছিল না। একদিন সে বললে—শোনো হরি, এত খেটে কী আমাদের লাভ হচ্ছে? কম বয়েস আমাদের; এখনই তো জীবনকে উপভোগ করতে হবে! এত খাটবার কিছু দরকার নেই। এক কাজ করলে হয় না? ঐ ছাগল দুটো রোজ ব্যা ব্যা করে আমাদের সকালের মিষ্টি ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয়। ও দুটোকে আমাদের প্রতিবেশীকে দিয়ে দিই। তিনি তার বদলে আমাদের একটা মৌচাক দেবেন। আমাদের বাড়ির পিছনে একটা রোদভরা জায়গায় মৌচাকটা রাখব, তাহলে আর ও নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা থাকবে না। মৌমাছির তো যত্ন দরকার হয় না। মাঠেও তাদের চরাতে হয় না। ওরা নিজেরাই উড়ে যায় আবার নিজেরাই ঘরে ফেরে মধু নিয়ে। কোনো হাঙ্গামা নেই।
হরি বললে—খুব বিচক্ষণ মেয়ের মতো কথা বলেছ তৃণা। তোমার প্রস্তাব এখনই আমরা কাজে লাগাব। তা ছাড়া ছাগলের দুধের চেয়ে মৌচাকের মধু খেতে ভাল, পোষ্টাই, তা ছাড়া রাখাও যায় অনেক দিন।
প্রতিবেশী খুশী হয়েই ছাগল-জোড়ার সঙ্গে মৌচাক বদল করল। মৌমাছিরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অক্লান্তভাবে উড়ে যেত আর উড়ে আসত। তারা দেখতে দেখতে চমৎকার মধুতে ভরে ফেলল চাক। হেমন্তকাল এলে হরি তার থেকে এক ঘড়া মধু বার করে নিল।
মধুর ঘড়াটা নিয়ে তারা তাদের শোবার ঘরের কড়িকাঠে টাঙিয়ে রাখল। ভয়, পাছে চোরে চুরি করে কিংবা ইঁদুরে মুখ দেয়, তাই তৃণা বাদাম গাছ থেকে একটা মোটা ডাল কেটে এনে তার বিছানার পাশে রেখে দিলে—যদি কেউ মধু চুরি করতে আসে তাহলে বিছানা থেকে না উঠেই যাতে তাকে ঠেঙানো যায়।
কুঁড়ে হরি কোনোদিন দুপুরের আগে বিছানা ছেড়ে উঠতে ভালবাসত না। সে বলত—যারা সকাল সকাল ওঠে তারা দেহের সার বস্তু নষ্ট করে।
একদিন সকালে দিব্যি আলো হয়ে গেছে, হরি তখনও তার বিছানায় শুয়ে সারা রাতের লম্বা ঘুমের পর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। সেই সময় সে তার বৌকে বলল—মেয়েরা মিষ্টির ভক্ত। তুমি সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে মধু চাকছ। সব মধুটা শেষ করবার আগে ওটার বদলে একটা হাঁস আর হাঁসের বাচ্ছা নিয়ে এলে হয়।
তৃণা বললে—আগে আমাদের একটা ছেলে হোক যে হাঁসের ভার নিতে পারবে, তবে তো? আমার কি ঐ হাঁসের বাচ্ছার পিছনে ঘুরে ঘুরে অযথা শক্তিক্ষয় করা পোষায় ?
হরি বললে—তোমার কি মনে হয় আজকালকার ছেলেরা হাঁসের পিছনে ঘুরে হাঁস চরাবে? ছেলেপুলেরা আজকাল কথাই শুনতে চায় না। তারা যা ইচ্ছে তাই করে। তারা ভাবে বাপ-মায়ের চেয়েও তারা চালাক। সেই যে এক ছেলে ছিল যাকে গরু খুঁজতে পাঠানো হয়েছিল আর সে তিনটে বুলবুলির পিছনে ঘুরে বেরিয়েছিল, তার কথা জানো না ?
তৃণা জবাব দিলে—আমাদের ছেলে যদি আমার কথা না শোনে তাহলে তার কপালে দুঃখ আছে। লাঠি নিয়ে তাকে এমন মার দেব যে ক’ ঘা পিঠে বসালুম তা নিজেই গুনে শেষ করতে পারব না। দেখ হরি! বলে মহা উৎসাহে সে ইঁদুর তাড়াবার লাঠিটা তুলে নিল।
—এমনি করে মারব—দেখ। বলে শূন্যে বসিয়ে দিল এক ঘা। আর সেটা লাগবি তো লাগ, লাগল গিয়ে বিছানার উপর মধুর ঘড়ায়। ঘড়াটা দেয়ালের গায়ে ঠুকে চৌচির হয়ে ভেঙে পড়ল মাটিতে। আর সেই চমৎকার মধু গড়িয়ে পড়ল সারা মেঝেয়।
হরি বলল—ঐ যে হাঁস আর হাঁসের বাচ্ছা মেঝেয় গড়াচ্ছে। ওদের আর দেখা-শোনা করবার দরকার হবে না। তবে আমাদের ভাগ্য ভাল যে ঘড়াটা আমার মাথায় এসে পড়েনি। কপালটা ভালই বলতে হবে।
তারপর যখন সে দেখল ঘড়ার একটা ভাঙা টুকরোর উপর খানিকটা মধু রয়েছে, সে হাত বাড়িয়ে সেটা টেনে নিয়ে ফূর্তি ভরে বলে উঠল—যেটুকু মধু বাকি আছে, এস দুজনে তৃপ্তি করে খাই। তারপর—ওঃ যা ভয় পেয়েছিলুম—ভয়টাকে ভোলবার জন্যে বেশ এক চোট ঘুম দেওয়া যাবে। আজকে বিছানা থেকে না হয় একটু দেরী করেই উঠব—দিন তো আর শেষ হয়ে যাচ্ছে না!
তৃণা বললা—হ্যাঁ হ্যাঁ, শেষ অবধি যেখানে পৌঁছবার আমরা ঠিক পৌঁছব। শামুকের গল্প জান তো? শামুককে বিয়ের নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। শামুক যখন পৌঁছল তখন অন্নপ্রাশনের খাওয়া হচ্ছে। শামুক নেমন্তন্ন বাড়িতে পৌঁছে বলেছিল—তাড়াহুড়ো করে কিছু লাভ হয় না।