কে কত বোকা
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাকে কত বোকা
একদিন এক চাষী মাঠ থেকে ফিরল হাতে এক লাঠি নিয়ে। বৌ-এর কাছে গিয়ে বললে—ইরিনে, আমি দূরে যাচ্ছি, তিন দিন পরে ফিরব। গ্রামে গরুর দালালের আসবার কথা আছে। গরুর দালাল যদি আমাদের ঘরে এসে আমাদের গরু তিনটে কিনতে চায় তাহলে দেখতে দিয়ো। কিন্তু দেখো, দু-শো টাকার এক পয়সা কমে গরু তিনটেকে বেচো না। শুনলে?
চাষানী বললে—যেতে হয় তো বেরিয়ে পড় এখনি। যেমনধারা বলে গেলে শুনলাম; তেমনিই করব।
চাষী বললে—কে জানে বাবা, তোমার তো কচি খুকির মতো বুদ্ধি! এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই যা বললুম সব ভুলে যাবে! কিন্তু এই বলে যাচ্ছি, গরু বেচায় যদি ঠকো তাহলে এই যে আমার হাতে লাঠি দেখছ এইটে ভাঙব তোমার পিঠে যতক্ষণ না পিঠ নীল থেকে কালো হয়ে যায়! সেই দাগ অন্তত এক বছর থাকবে। কাজেই ভুলো না।
পরদিন সকালে গরুর দালাল এল। চাষানীকে বিশেষ কিছু বলতে হল না। গরুগুলি দেখে তাদের দাম শুনেই বললে—বেশ, এগুলিকে আমি নেব। সস্তাই মনে হচ্ছে। চাষানী তাদের শিকল খুলে গোয়াল থেকে বার করে নিয়ে এল।
দালাল উঠোনের ফটক দিয়ে তাদের বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই চাষানী তার আস্তিনে একটা টান দিয়ে বললে—আগে দু-শো টাকা দিন কর্তা, তবে তো গরু নিয়ে যাবেন!
দালাল বললে—সে তো ঠিক কথা। তবে দেখুন বৌদিদি, আজ সকালে আমার টাকার থলিটা ট্যাঁকে করে নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছি। যাই হোক ভাববেন না; যতক্ষণ না আমি টাকা দিই ততক্ষণ কিছু বন্ধক রেখে যাব। দুটো গরু নিয়ে গেলুম, আর একটা রেখে যাচ্ছি আমার ফেরার জামিন হিসেবে।
এইভাবে চাষানী ঠকল। দালালকে দুটো গরু নিয়ে যেতে দিল আর মনে মনে বললে—হান্স ফিরে এসে যখন দেখবে কী সুন্দর ব্যবস্থা আমি করেছি, কী খুশিই হবে!
যেমন কথা ছিল, তিন দিনের দিন চাষা ফিরল। এসে জিজ্ঞেস করল, গরু বিক্রি হয়েছে কি না।
চাষানী বললে—নিশ্চয় হান্স, বিক্রি হয়েছে বৈকি! তুমি যেমন বলে গিয়েছিলে দুশো টাকাতেই হয়েছে। গরুগুলোর সত্যি কি আর অত দাম হবে? কিন্তু লোকটা কোন কথা না বলেই নিয়ে গেল।
চাষা বললে—টাকা কই?
চাষী বললে—টাকা এখনও পাইনি। দালাল তার টাকার থলি ফেলে এসেছিল কিনা—আনতে গেছে, শিগগিরই নিয়ে আসবে। আর ভালো জামিন রেখে গেছে।
চাষা বললে—কী রেখে গেছে?
চাষানী বললে—তিনটে গরুর একটা। বললে যে অন্য দুটোর দাম দিয়ে তবে ওটা নিয়ে যাবে। আমি বুদ্ধি করে সবচেয়ে ছোটটা রেখে দিয়েছি, কারণ ওটাই সবচেয়ে কম খায়।
রাগে অন্ধ হয়ে চাষা লাঠি তুলল চাষানীকে মারবে বলে! কিন্তু হঠাৎ সে হাত নামিয়ে হাত থেকে লাঠি ফেলে দিয়ে বললে—তোমার মতো এত বড় বোকা বোধকরি পৃথিবীতে আর কেউ নেই! যাই হোক আমি একবার খুঁজে দেখব। আবার তিন দিনের জন্যে আমি দূরে যাচ্ছি। এই তিন দিনে যদি তোমারই মতো আর একজন বোকা খুঁজে বার করতে পারি তো বেঁচে গেলে। আর যদি না পাই তাহলে তোমার যা পাওনা হয়েছে তা কড়ায় গণ্ডায় শুধে দেব! কোনো দয়া দেখাবো না!
বলে সে বেরিয়ে পড়ল। বড় রাস্তার ধারে এক পাথরের উপর সে বসে আছে আর ভাবছে, সেই সময় দেখল একটা গাড়ি আসছে, তাতে একবোঝা খড় তার উপর একটি মেয়েমানুষ বসে গরু হাঁকাচ্ছে। চাষী ভাবলে—পেয়েছি। দেখা যাক একে চেষ্টা করে। সে লাফিয়ে উঠে গাড়ির সামনে গিয়ে একবার এদিক একবার ওদিক ছুটতে লাগল, যেন কোন্ দিকে যাবে জানে না।
মেয়েমানুষটি বললে—কী চাই ঠাকুর্দা? তোমায় তো চিনি নে? কোথা থেকে এলে?
সে বললে—আমি স্বর্গ থেকে এইমাত্র পড়েছি। কেমন করে যে ফিরে যাব জানি না। তুমি কি আমায় নিয়ে যেতে পারবে?
মেয়েমানুষটি বললে—না, আমি তো রাস্তা জানিনে! যাই হোক তুমি যখন স্বর্গ থেকে এসেছ তুমি নিশ্চয় বলতে পারবে সেখানে আমার স্বামী কেমন আছেন? তিন বছর হল তিনি সেখানে গেছেন—তুমি নিশ্চয় তাঁকে দেখেছ?
লোকটি বলল—দেখেছি বইকি। কিন্তু বলি শোন, স্বর্গেও সব লোক সুখী নয়। তোমার স্বামীকে স্বর্গের ভেড়া চরাতে হয়। খুব খাটুনি। ভেড়ারা পাহাড় থেকে ছুট দিয়ে বনের মধ্যে পালায়, আর ওকে ছুটতে হয় তাদের পিছু-পিছু! ভেড়াদের ধরে ঘরে ফিরিয়ে আনতে হয়। এরই ফলে তার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গায়ে আর থাকছে না। স্বর্গে আবার কোন দর্জি নেই, কারণ জানই তো বইয়ে লেখা আছে, স্বর্গে দর্জির ঢোকা বারণ।
মেয়েমানুষটি বললে—আহা, ওর কপালে এত দুঃখ কেই বা জানত? দাঁড়াও দাদু, বলি। এখনি বাড়ি গিয়ে স্বামীর রবিবারের কোটটা এনে দিই—আলমারিতে ঝুলছে। সেটা পরলে তাঁর একটু ভদ্র চেহারা হবে। তুমি যদি একটু দয়া করে নিয়ে যাও দাদু!
চাষী বললে—ওতে কোন কাজ হবে না। কাপড় নিয়ে কাউকে স্বর্গে ঢুকতে দেওয়া হয় না। দরজাতেই কেড়ে নেয়।
মেয়েমানুষটি বলে উঠল—আচ্ছা বেশ। কালকে আমি আমার ঘেসো মাঠ বিক্রী করে অনেক টাকা পেয়েছি। সেটাই ওঁর কাছে পাঠিয়ে দেব। তুমি যদি পকেটের এক কোণে এই টাকার থলিটা রেখে দাও, কেউ লক্ষ করবে না।
চাষী বললে—আর যদি কিছু করবার না থাকে তবে তোমার উপকারের জন্যে তাই করব!
মেয়েমানুষটি বললে—একটু বোস তাহলে এখানে, আমি এখনই টাকার থলি নিয়ে ফিরব।
বলেই গরুর গাড়ি হাঁকিয়ে সে চলে গেল বাড়ির দিকে। চাষী ভাবল—এর ঘটে বুদ্ধি তো একফোঁটা দেখছি নে। সত্যি যদি টাকার থলি নিয়ে ফেরে তো আমার বৌয়ের কপাল ভাল। পিটুনির হাত থেকে রেহাই পাবে।
চাষীকে বেশিক্ষণ বসতে হল না। একটু পরেই দেখল হাতে থলে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে মেয়েমানুষটি। টাকার থলিটা চাষীর পকেটে ভরে দিয়ে মেয়েমানুষটি তাকে হাজারো ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে গেল।
বাড়ি ফিরে বুড়ি দেখল তার ছেলে মাঠ থেকে ফিরেছে। মেয়েমানুষটি ছেলেকে বললে, এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে।
—কী খুশি যে আমি হয়েছি! বেচারা স্বামীর সঙ্গে সত্যি-সত্যি-দেখা-হওয়া লোকের সঙ্গে কথা কইতে পারা বড় কম কথা নয়! তার উপর তার হাত দিয়ে স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দিতে পারলুম তো! লোকটি বললে ওঁর বড় কাপড়ের আর টাকার কষ্ট!
ছেলে শুনে অবাক হয়ে গেল। তারপর বললে—মা, স্বর্গ থেকে হামেশাই লোক আসে না। আমি যাই দৌড়ে লোকটিকে দেখে আসি; সে নিশ্চয় আমায় বলতে পারবে স্বর্গের বিলি-ব্যবস্থা কেমন, ওখানে কী কাজই বা পাওয়া যায়। বলে সে ঘোড়ায় জিন চড়িয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল।
কিছু দূরে গিয়েই দেখল উইলো গাছের তলায় বসে এক চাষী থলি থেকে টাকা বার করে গুণছে। ছেলেটি বললে—এইখান দিয়ে একটি লোককে কি যেতে দেখেছেন যিনি এইমাত্র স্বর্গ থেকে এসেছেন?
চাষী বললে—হ্যাঁ, দেখেছি। কিন্তু তিনি তো এখন স্বর্গে ফিরেছেন। ঐ পাহাড়ের পথে গেছেন। ঐ দিক দিয়েই কাছে হয়। যদি জোর ঘোড়া ছুটিয়ে যাও তাহলে তাঁকে ধরতে পারবে।
ছেলেটি বললে—দেখুন, সারাদিন আমি মাঠে খেটেছি, আর এই ঘোড়ায় করে ছুটে এসে ক্লান্তি বোধ করছি। আপনি তো লোকটিকে দেখেছেন। আপনি কি দয়া করে আমার ঘোড়াটি নিয়ে তাঁকে ধরে একটু আমার কাছে নিয়ে আসতে পারেন?
চাষী ভাবল—এই আর এক। এরও ঘটে কিছু নেই। ভেবে বললে—এইটুকু উপকার আর করব না? বলে ঘোড়ায় চড়ে জোর কদমে বেরিয়ে গেল।
ছেলেটি যেখানে বসে ছিল সেইখানেই বসে রইল যতক্ষণ না সন্ধ্যা নেমে আসে। লোকটি আর ফিরল না। ছেলেটি ভাবল—লোকটির বোধহয় স্বর্গে ফিরে যাবার বড্ড তাড়া, তাই চাষীর কাছ থেকে ঘোড়াটা নিয়ে চলে গেছে আমার বাবার কাছে।
তারপর সে বাড়ি ফিরে গিয়ে তার মাকে বলল কি ঘটেছে। বললে—লোকটি নিশ্চয় বাবার কাছে ঘোড়াটাকে নিয়ে গেছে যাতে বাবাকে অত হেঁটে হেঁটে ভেড়ার পিছনে ঘুরতে না হয়।
মা বললে—ভালই হল। তোমার পা তো এখনও বুড়ো হয়নি। তুমি ঘোড়া ছাড়াই চলতে পারবে।
চাষী বাড়ি ফিরেই ছেলেটির কাছ থেকে পাওয়া ঘোড়াটি আস্তাবলে ঢোকালো যেখানে বাকি গরুটি ছিল। তারপর তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললে—ইরিনে, তোমার কপাল ভাল। একজন নয়, দু-দুজন পেয়েছি যাদের বুদ্ধি তোমার চেয়েও কম। এবারে তাই আর তোমার পিঠে কিছু পড়ল না। এর পরের বারের জন্যে জমা রইল।
বলে সে তার পাইপ বার করে তাতে তামাক ভরে ধরালো। তারপর পুরোনো আরাম কেদারায় বসে বললে—ব্যবসা মন্দ হল না। দুই রোগা গরুর বদলে একটা তেজি ঘোড়া পেলুম। উপরন্তু একথলি টাকা। বোকামির ফলে যদি সব সময় এইরকম অর্থসাকুল্য হয়, তাহলে চাষানী, তোমায় আমি তোয়াজে রাখব!