Chapter Index

    প্রকাণ্ড এক বনের ধারে ছিল এক কাঠুরে আর তার স্ত্রী। তাদের ছিল তিন বছরের একটি মেয়ে। এতই গরিব ছিল তারা যে রোজ রুটি জুটতো না। বাচ্চার মুখে যে কি দেবে ভেবেই পেত না। একদিন সকাল বেলা কাঠুরে মন খারাপ করে বনে গেল। বনে গিয়ে যখন সে কাঠ কাটছে, হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহা অতি সুন্দরী এক মহিলা— মাথায় তাঁর জ্বলজ্বলে তারা সাজানো মুকুট। মহিলা বললেন— আমি কুমারী মেরি—যীশু খ্রীস্টের মা। তুমি বড় গরিব, তোমার বড় অভাব। নিয়ে এস তোমার শিশুকে আমার কাছে। আমি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব, তার মা হব, তাকে দেখব শুনব।

    কাঠুরে তাই শুনে মেয়েকে নিয়ে এল। এনে কুমারী মেরির হাতে তাকে তুলে দিল। মেরি তাকে নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন! মেয়েটি ভাল ভাবেই মানুষ হতে লাগল। মিষ্টি কেক, মিষ্টি দুধ খেতে পেল; জরির পোশাক পরতে পেল। দেবশিশুদের সঙ্গে খেতে পেল। যখন তার বয়েস চোদ্দ, কুমারী মেরি তাকে ডেকে একদিন বললেন— দেখ বাছা আমি অনেক দূরে যাচ্ছি। এই তেরখানি চাবি তোমার কাছে রাখ। স্বর্গের তেরটি দরজা এতে খুলবে। এদের মধ্যে বারোটি দরজা খুলে স্বর্গের যা কিছু গরিমা সব তুমি দেখতে পারো— আমার কোনো আপত্তি নেই। তের নম্বর ঘরটি এই ছোট্ট চাবি দিয়ে খোলা যায়— সেটি কিন্তু তোমার খুলতে মানা। কখনও খুলো না, বুঝলে? খুললে অনেক দুঃখ পাবে।

    মেয়েটি বাধ্য হয়ে থাকবে বলে কথা দিলে।

    কুমারী মেরি চলে যেতেই সে স্বর্গের ঘরদোর পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল। প্রতি দিন সে একটি করে দরজা খুলত। ক্রমে বারোটি দরজাই খোলা হয়ে গেল। প্রত্যেক ঘরে একটি করে ধর্মবীর বসেছিলেন। তাঁদের চারিদিক ঘিরে আলোর বন্যা; সব কিছু ঝলমল করছে আর তার মাঝে খেলে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট দেবশিশু। শেষে বাকি রইল শুধু নিষিদ্ধ দরজাটি। মেয়েটির দারুণ কৌতূহল হল এই দরজার পিছনে কি আছে তাই জানার জন্যে। সে দেবশিশুদের বললে— আমি দরজাটা পুরোপুরি খুলবো না, ভিতরেও ঢুকব না, শুধু একটু উঁকি মেরে দেখব ভিতরে কি আছে। দেবশিশুরা বললে— খবরদার নয়। ভীষণ পাপ হবে। কুমারী মেরি যখন বারণ করেছেন তখন ও দরজা খুলে তুমি প্রচুর দুঃখ পাবে। শুনে মেয়েটি চুপ করে গেল। কিন্তু তার মন থেকে দরজা খোলার চিন্তা দূর হল না। কী যেন তার অন্তরকে কুরে কুরে খেতে লাগল— মনের শান্তি দূর হয়ে গেল। তারপর দেবশিশুরা যখন সবাই চলে গেল, সে ভাবলে— এখন তো আমি সম্পূর্ণ একা; একবার উঁকি মেরে দেখতে পারি। যদি দেখি কেউ টের পাবে না। ভেবে সে চাবি বার করে তালায় লাগাল। লাগিয়ে এক পাক ঘুরিয়ে দিল। দিতেই দরজা আপনি খুলে গেল আর মেয়েটি দেখল আগুনের উজ্জ্বলতার মধ্যে স্বয়ং ভগবান বসে আছেন। সে অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগল, তারপর আগুন থেকে আলোর যে রশ্মি বেরচ্ছিল তাকে নিজের আঙুল দিয়ে একটু খালি ছুঁল। ছুঁতেই তার আঙুল হয়ে গেল সোনালি। মেয়েটি ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। দুম্‌ করে দরজা বন্ধ করে দিল। দিয়ে সেখান থেকে ছুটে পালালো। কিন্তু সে আর শান্ত হতে পারল না। ভয় যেন তাকে তাড়া করে ফিরতে লাগল; হৃৎপিণ্ড এমন দুম্‌ দুম্‌ করে উঠতে পড়তে লাগল যে মনে হল এ আর থামবে না। আঙুল তার সোনালিই রয়ে গেল। যতই ঘষুক, কিছুতেই তার রং উঠলো না।

    কয়েকদিনের মধ্যেই কুমারী মেরি ফিরে এলেন। তিনি মেয়েটিকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন— দেখি স্বর্গের চাবিগুলি। মেয়েটি চাবির গোছা ফেরত দিলে তিনি বললেন— তের নম্বরের ঘরটি খোলোনি তো বাছা?

    মেয়েটি বলল— না।

    মেরি মেয়েটির বুকে হাত রেখে দেখলেন বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পড়ছে, তখনই বুঝলেন যে সে তাঁর আদেশ অমান্য করেছে।

    তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন— ঠিক বলছ তো বাছা যে তুমি খোলোনি?

    মেয়েটি আবার বলল— ঠিক বলছি।

    মেরি তখন মেয়েটির আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তা সোনালি হয়ে গেছে। মেয়েটি পাপ করেছে।

    তিনি তৃতীয় বার জিজ্ঞেস করলেন— খোলোনি ত?

    মেয়েটি তৃতীয় বার বলল— না।

    কুমারী মেরি তখন বললেন— তুমি আমার অবাধ্য হয়েছ। তা ছাড়া মিথ্যে কথা বলেছ। স্বর্গে থাকবার তোমার আর অধিকার নেই।

    মেয়েটি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল, সে দেখল সে পৃথিবীতে। অজানা এক জনহীন স্থানে আটকা। সে চিৎকার করতে চাইল কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বার হল না। সে পালাবার চেষ্টা করল কিন্তু যেদিকেই ফেরে সেদিকেই ঘন কাঁটার জঙ্গল তাকে বাধা দিতে লাগল। মরুর মধ্যে যেখানে সে আটকা পড়েছিল সেখানে একটি পুরোনো ফাঁপা গাছ দাঁড়িয়ে ছিল। সেই ফাঁপা গাছই হল তার বাসা। রাত হলে তার ভিতরে গিয়ে সে ঢুকত। সেইখানেই ঘুমোতো। ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচবার সেইটিই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়। এই দুর্বিষহ জীবন সে যাপন করতে শুরু করল। যখন তার মনে পড়ত স্বর্গে সে কত সুখে ছিল, দেবশিশুরা কেমন তার সঙ্গে খেলা করত, তখন ঝর ঝর করে তার চোখ দিয়ে জল পড়ত। খাবারের মধ্যে ছিল শুধু গাছের মূল আর বুনো বেরি। এই সংগ্রহ করতে তাকে অনেক হাঁটাহাঁটি করতে হত। হেমন্তকালে সে গাছ থেকে পড়া বাদাম আর শুকনো পাতা কুড়িয়ে তার কোটরে নিয়ে আসত। শীতের সময় সেই বাদাম ছিল তার খাদ্য আর যখন বরফ পড়তো তখন শুকনো পাতাই ছিল তার একমাত্র শীতের আশ্রয়। বুনো জন্তুরা যেমন পাতার মধ্যে দেহ গুঁজে শুয়ে থাকে তেমনি করে সে শীতে জমে যাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতো। কিছুদিনের মধ্যে তার কাপড়-চোপড় সমস্ত ছিঁড়ে গেল। টুকরোর পর টুকরো তার গা থেকে খসে পড়তে লাগল। তারপর শীতের শেষে যখন রোদ উঠল, উত্তাপ বাড়ল তখন সে গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে বসল। দেখা গেল যে তার লম্বা লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়ে তার সমস্ত দেহ ঢেকে রেখেছে—গায়ে একটিও বস্ত্র নেই।

    এই ভাবে বছরের পর বছর কেটে যায়। মেয়েটি বোঝে পৃথিবীর দুঃখকষ্ট দারিদ্র্য কি। একদিন যখন গাছেরা আবার কচি সবুজ পাতার সাজে সেজেছে, দেশের রাজা বনের মধ্যে শিকার করতে এসেছেন। তিনি এক হরিণের পিছনে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে দেখলেন যে হরিণ কাঁটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে মিলিয়ে গেছে। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে তলোয়ার খুলে কাঁটা ঝোপ কাটতে কাটতে এগুতে লাগলেন। শেষে অনেকটা এগিয়ে এক খোলা জায়গায় এসে দেখেন এক পরমা সুন্দরী কন্যা গাছের তলায় বসে রয়েছে। তার সোনার চুলে সারা দেহ পা পর্যন্ত ঢাকা। রাজা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন— কে তুমি? এই অরণ্যের মধ্যে বসে আছ কেন?

    সে কোনো উত্তর দিল না। মুখ খুলতেই পারল না।

    রাজা বললেন— তোমাকে আমার প্রাসাদে নিয়ে যাবো— যাবে?

    মেয়েটি একটু ঘাড় নাড়ল।

    রাজা তখন তাকে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘোড়ায় বসালেন। বসিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন। রাজপ্রাসাদে এনে তাকে সুন্দর সুন্দর পোষাকে মুড়ে দিলেন, তার যা কিছু দরকার প্রচুর দিলেন। মেয়েটি কথা বলতে না পারুক, তাকে দেখতে ছিল এত সুন্দর যে রাজা তাকে বিয়ে করে ফেললেন।

    এক বছর কেটে যাবার পর রানীর একটি ছেলে জন্মালো। এক রাতে রানী যখন একা তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন কুমারী মেরি তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন। মেরি বললেন— এখনও তুমি যদি সত্যি কথা বলো, যদি বলো যে নিষিদ্ধ দরজা তুমি খুলেছিলে, তাহলে তোমার মুখ আমি খুলে দেব, তুমি আবার কথা বলতে পারবে। কিন্তু যদি তুমি এখনও পাপের মধ্যে থাকতে চাও, নিজের দোষ অস্বীকার কর, তাহলে তোমার নবজাত ছেলেকে নিয়ে আমি চলে যাবো।

    রানীর মুখে কথা ফুটিয়ে দিলেন মেরি। কিন্তু রানী আগেরই মতো কঠিন হয়ে রইলেন, বললেন— না আমি নিষিদ্ধ দরজা খুলিনি।

    কুমারী মেরি অমনি নবজাত সন্তানকে রানীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। পরদিন যখন কচি ছেলেকে পাওয়া গেল না, লোকে বলাবলি করতে লাগল যে রানী তাহলে বোধ হয় মানুষ-খেকো— নিজের ছেলেকে খেয়েছে। রানী সবই শুনলেন, কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতে পারলেন না। তবে রাজা এসব বিশ্বাস করলেন না। কারণ তিনি রানীকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।

    আরো এক বছর কেটে যেতে রানীর আর একটি ছেলে হল। রাত্রে কুমারী মেরি আবার তাঁর কাছে এসে বললেন— তুমি যদি এখনও স্বীকার কর যে তুমি নিষিদ্ধ দরজা খুলেছ তাহলে তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেব, তোমার মুখ খুলে দেব। কিন্তু তুমি যদি এখনও পাপের মধ্যে ডুবে থেকে ওকথা অস্বীকার করতে চাও তাহলে এই নতুন বাচ্চাটিকেও আমি নিয়ে যাব।

    রানী আবার বললেন— না, আমি নিষিদ্ধ দরজা খুলিনি।

    কুমারী মেরি অমনি তাঁর কাছ থেকে তাঁর সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। পরদিন যখন এই শিশুটিকেও খুঁজে পাওয়া গেল না লোকে তখন খোলাখুলি ভাবেই বলতে শুরু করলে যে রানী তাকে খেয়েছেন। সভাসদেরা দাবি করলেন যে রানীর বিচার হোক। কিন্তু রাজা তাঁকে এত ভালবাসতেন যে তিনি কোনো কথা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, সভাসদেরা যদি এই নিয়ে আবার আলোচনা করেন তো তাঁদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

    পরের বছর রানীর একটি টুকটুকে মেয়ে হল। তিন বারের বার কুমারী মেরি আবির্ভূত হয়ে বললেন— এসো আমার পিছনে। রানীর হাত ধরে তিনি তাঁকে স্বর্গে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁর বড় ছেলে আর মেজ ছেলেকে দেখালেন। ছেলেরা মায়ের দিকে চেয়ে হাসল। রানীর ভারি আনন্দ হল।

    কুমারী মেরি বললেন— এখনও কি তোমার মন নরম হয়নি? এখনও তুমি যদি স্বীকার কর যে নিষিদ্ধ দরজা খুলেছিলে, তাহলে তোমার দুই ছেলেকে ফেরত পাবে।

    তিন বারের বার রানী বললেন— না। আমি নিষিদ্ধ দরজা খুলিনি।

    কুমারী মেরি তাঁকে আবার পৃথিবীতে নামিয়ে দিলেন আর যাবার সময় রানীর খুকিকে নিয়ে চলে গেলেন।

    পরদিন সকালে যখন সবাই খবর পেয়ে গেল, সকলে একযোগে চিৎকার করে বলল— রানী মানুষ-খেকো। রানীর বিচার চাই! রাজা আর তাঁর সভাসদদের সংযত করতে পারলেন না। বিচার সভা বসাতেই হল। বিচার-সভায় বোবা রানী কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলেন না, আত্মরক্ষা করবেন কি করে? বিচারে রানীকে জীবন্ত পোড়ানোর আদেশ হল। রানীর হাত-পা বেঁধে দেওয়া হল এক খুঁটির সঙ্গে— চারিদিকে কাঠের স্তূপ জড় করা হল। তারপর যখন তাঁর চারিদিক ঘিরে আগুন জ্বলে উঠল, তাঁর অহঙ্কারের কাঠিন্য গলতে আরম্ভ করল, অনুতাপে স্নিগ্ধ হয়ে গেল তাঁর মন। তিনি মনে মনে ভাবলেন— হায়, যদি আমি মরবার আগে স্বীকার করতে পারতুম যে আমি দরজাটা খুলেছি!

    ভাবতেই তাঁর গলায় স্বর ফিরে এল। তিনি চেঁচিয়ে বললেন— হাঁ মেরি, আমি পাপ করেছি। দরজা খুলেছি।

    বলতেই সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আগুন নিভে গেল। রানীর মাথার উপর আলো জ্বলে উঠল আর দেখা গেল দু’ হাতে দুই ছেলেকে ধরে, কোলে নবজাতা কন্যাকে নিয়ে কুমারী মেরি আকাশ থেকে নেমে আসছেন। মেরি মিষ্টি গলায় বললেন— যে তার পাপ স্বীকার করে আর তার জন্যে অনুতাপ করে তাকে ক্ষমা করা হয়।

    বলে শিশু তিনটিকে রানীর হাতে সঁপে দিলেন। রানীর মুখ খুলে দিলেন আর বললেন— রানী, তুমি চিরজীবন সুখী হও।

    টীকা