কাঁচের কাফিন
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএ কথা কারুরই বলা উচিত নয় যে সামান্য একজন দর্জি কোনদিনই সম্মানী লোক হতে পারবে না। যদি সে ঠিক পেরেকটির মাথায় ঘা দিতে পারে তাহলে নিশ্চয় তার ভাগ্য খুলে যাবে।
একটি নম্র ছেলে ছিল; সে তখন দর্জির কাজ শিখছে। সে একবার বেরিয়ে পড়ল বেড়াতে। বেড়াতে বেড়াতে পৌঁছল গিয়ে এক বনের মধ্যে। রাস্তা জানা ছিল না, তাই ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে গেল।
রাত নেমে এল। তখন সেই ভীষণ নির্জনতার মধ্যে কোথাও একটু আশ্রয় খুঁজে নিতে পারলে সে বেঁচে যায়। বনভূমির নরম শুকনো শ্যাওলায় শুয়ে পড়তে পারলে আরাম হত, কিন্তু বুনো জন্তুর ভয়। কাজেই উঁচু একটা গাছ দেখে নিয়ে সে তার মাথায় চড়তে বাধ্য হল। ডালপালার মধ্যেই শোবার ব্যবস্থা করে নিলে।
সেদিন ছিল জোর বাতাস। গাছের ডালপালা এমন দুলছিল যে ঘুমোয় কার সাধ্য! তার মনে হল, ভাগ্যিস সঙ্গে হাঁসটাকে এনেছিলুম! হাঁসের ভারে তবু তার ভার খানিকটা বেড়েছিল, নইলে হাওয়ায় উড়িয়ে ফেলে দিত তাকে গাছ থেকে।
অন্ধকারের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা গাছে বসে থাকবার পর সে হঠাৎ লক্ষ করল, কিছু দূরে কোথা থেকে যেন একটা আলো আসছে। আলো দেখে তার একটু সাহস হল। মন হল কাছেই হয়ত মানুষের বাস আছে, আর তাহলেই গাছের ডালের বদলে রাত কাটাবার একটু ভাল আশ্রয় হয়ত পাওয়া যাবে। কাজেই সে গাছ থেকে নেমে আলোর দিকে এগোলো।
এগিয়ে গিয়ে দেখল একটি কুটির, নল-খাগড়া আর শর দিয়ে ঢাকা। সাহস করে সে দরজায় ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতেই দরজাটি আপনি খুলে গেল। ভিতরে আলো। দর্জি সেই আলোয় দেখল, পাকা-চুল এক বুড়ো বসে রয়েছে। গায়ে তার নানা রঙের কাপড়ের টুকরো জোড়া এক পোশাক।
খেঁকিয়ে উঠে বুড়ো জিজ্ঞেস করলে—কে তুমি? কী চাও এখানে?
সে জবাব দিলে—আমি গরিব দর্জি। বনের মধ্যে অন্ধকারে পথ হারিয়েছি। দয়া করে সকাল অবধি আমায় আশ্রয় দিন।
বুড়ো রূঢ় গলায় বললে—সরে পড়! ভবঘুরেদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। অন্য কোথাও আশ্রয় খোঁজ গিয়ে।
এই বলে বুড়ো দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু দর্জি তার কোট ধরে এমন মিনতি-ভরা চোখে তাকিয়ে রইল যে বুড়োর মন গলল। বুড়োর মুখ যতই কঠিন হোক, মনটা তার নরমই ছিল। ছেলেটিকে ঘরে আসতে দিল। কিছু খেতে দিল। ঘরের কোণে ছিল এক বিছানা। আঙুল দিয়ে সেইদিকে দেখিয়ে বললে—যাও শোও গিয়ে।
ক্লান্ত ছিল দর্জি, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালেও তার ঘুম ভাঙত না, যদি না সে এক ভীষণ গর্জনের শব্দে ভয় পেয়ে জেগে উঠত। দেখল বাড়ির মধ্যে সে একা, আর বাইরে যেমন চিৎকার তেমনি গর্জন—দেয়াল ভেদ করে তা কানে আসছে।
দর্জি সাহসে ভর করে লাফিয়ে উঠল। গায়ে জামা দিয়েই বাইরে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসে দেখলে, বাড়ির কাছে এক প্রকাণ্ড কালো যাঁড়ের সঙ্গে এক হরিণের ভীষণ লড়াই লেগেছে। এমন তাদের রাগ আর এমন জোরে তারা পা ঠুকছে যে থর-থর করে কেঁপে উঠছে মাটি।
অনেকক্ষণ ধরে বোঝা যাচ্ছিল না কে জিতবে। শেষে হরিণ তার শিং দিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ফুঁড়ে ফেলল। ষাঁড় একটা গর্জন করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। তারপর হরিণ শিং দিয়ে আর একবার ফুঁড়তেই ষাঁড় মরে পড়ে রইল হরিণের পায়ের কাছে।
দর্জি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ষাঁড়কে মরে পড়ে যেতে দেখে সে একেবারে পাথর হয়ে গেল।
হরিণ তড়াক করে লাফিয়ে দর্জির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পালাবার আগেই সে দেখল যে হরিণ তাকে শিঙের উপর তুলে নিয়েছে। কী যে হল সে কিছুই বুঝতে পারল না, শুধু দেখল হরিণ তাকে প্রচণ্ড বেগে বন, মাঠ, পাহাড়, উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে। কোনরকমে দু-হাতে শিং আঁকড়ে ধরে ভাগ্যের হাতে সে নিজেকে ছেড়ে দিল। তার মনে হল যেন সে উড়ে চলেছে।
অবশেষে হরিণ এসে থামল এক পাথরের দেয়ালের সামনে। সেখানে পৌঁছে সে আস্তে আস্তে দর্জিকে মাটিতে নামিয়ে রাখল। যদিও আধমরা অবস্থা তবু সে ভাবল, এই সুযোগ। কিন্তু একটু নড়তেই হরিণ তার শিং দিয়ে পাথরের গায়ে একটা দরজার মতো কিসে সজোরে ধাক্কা দিলে। দিতেই সেটা খুলে গেল আর তার মধ্যে থেকে গনগন করে আগুনের শিখা বেরিয়ে এল, আর সেইসঙ্গে ধোঁয়া। তারই মধ্যে হরিণ মিলিয়ে গেল।
কি যে করবে, কোথায় যাবে দর্জি ভেবে পেল না, এই ভয়ানক বনের মধ্যে থেকে নিরাপদে বেরিয়ে মনুষ্য-সমাজে ফিরে যাবারও কোন নিশ্চয়তা নেই।
এমনি যখন সে কী করবে ভাবছে, পাথরের মধ্যে থেকে একটা শব্দ শোনা গেল। তাকে ডাকছে এই বলে—ভিতরে এস, কোন ভয় নেই। কেউ তোমার অনিষ্ট করবে না।
সে যখন ইতস্তত করছে, এক অজানা শক্তি মনে হল তাকে যেন টেনে নিয়ে চলেছে। সে ডাকে সাড়া দিল। এক লোহার দরজা দিয়ে সে গিয়ে ঢুকল এক উঁচু এবং প্রশস্ত হলে। হলের ছাদ, দেওয়াল, মেঝে সবই চৌকো চৌকে পালিশ-করা পাথরে তৈরি। আলো পড়ে তারা চক-চক করছে। পাথরগুলিকে দেখে মনে হয় এদের প্রত্যেকটার মধ্যে কোন অজানা রহস্য লুকোনো আছে।
ভয়ে এবং অবাক হয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে যখন সে পালিয়ে যাবর জন্যে প্রস্তুত, সেই সময় আবার সেই অজানা সুর বলে উঠল—ঘরের মাঝখানে যে পাথরটি, তার উপর উঠে দাঁড়াও। ঐখান থেকেই তোমার সৌভাগ্যের শুরু হবে।
সাহস ফিরে এল তার। সাহসে ভর করে সে পাথরের উপরে গিয়ে দাঁড়ালো। যেই না দাঁড়ালো অমনি সেটা আস্তে আস্তে নেমে চলল মাটির নিচে। যখন থামল দর্জি তার চারিপাশে তাকিয়ে দেখল সে এক মস্ত চওড়া হলে এসে দাঁড়িয়েছে। আগের হলটার চেয়ে এটা আরও সুন্দর।
হলের দেয়ালে নানা কুলুঙ্গি, তাতে সুচারু কাঁচের পাত্রে নানা রঙের তরল অথবা নীল বাষ্প। হলের মেঝেতে দুটি বড়-বড় কাঁচের বাক্স। তার ঔৎসুক্য হল জানতে বাক্সের মধ্যে কী আছে।
কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে গিয়ে সে একটি বাক্সের সামনে দাঁড়ালো। দেখল তার মধ্যে অতি সুন্দর একটি বাড়ি—খুদে একটি রাজপ্রাসাদ—তার মধ্যে সব আছে; গোলাবাড়ি, আস্তাবল, তোষাখানা সব কিছু অতি আশ্চর্যভাবে সাজানো—যেন এক দক্ষ শিল্পীর হাতের কাজ।
এই অপূর্ব দৃশ্য তাকে এমন মুগ্ধ করল যে সেদিক থেকে সে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। সেই সময় আবার সেই স্বর তাকে বললে—ও বাক্সটা তো দেখলে। এবার ওধারে যে বাক্সটা আছে সেটা একবার দেখ।
শুনে সে হলের অন্য দিকে এগিয়ে গেল। গিয়ে যা দেখলে তাতে তার মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না। সে দেখল, সেই কাঁচের বাক্সের মধ্যে অসামান্য সুন্দরী এক মেয়ে শুয়ে রয়েছে। মনে হয় যেন কাফিনে শুয়ে।
মেয়েটিকে দেখে মনে হয় সে ঘুমোচ্ছে। তার লম্বা সোনালি চুল তাকে ঢেকে রেখেছে একখানি দামি ওড়নার মতো। চোখ বন্ধ, কিন্তু গালে একটু গোলাপি আভা। বুক অল্প-অল্প উঠছে নামছে। যেন নিশ্বাস বইছে।
দুরু-দুরু বুকে তার দিকে তাকিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো দর্জির দিকে। সে দৃষ্টিতে আনন্দ এবং ভয় মেশানো। শেষে সে বলে উঠল—ভগবান আমায় বাঁচিয়েছেন! আমার মুক্তির সময় এসেছে। আর দেরি কোরো না। এই কারাগার থেকে পালাতে আমায় সাহায্য কর। কাঁচের কাফিনের ছিটকিনিটা খুলে দাও, তাহলে আমি মুক্ত হব।
দর্জি কোনরকম ইতস্তত না করেই কাফিনের ডালা তুলে ধরল। আর সুন্দরী মেয়ে তার থেকে বার হয়ে হলের এক কোণে চলে গেল রাজপোশাক পরতে।
তারপর সে এক পাথরের উপর বসে দর্জিকে কাছে ডাকল। ডেকে বললে—তুমি আমার মুক্তিদাতা। বহুদিন ধরে তোমার পথ চেয়ে আছি। আমার দুঃখ দুর করবার জন্যে ভগবান তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। আজ থেকে তোমারও সৌভাগ্যের শুরু। ঈশ্বর তোমাকে বেছে পাঠিয়েছেন আমার স্বামী হবার জন্যে। তুমি আমার কাছ থেকে শুধু যে আমার ভালবাসা পাবে তাই নয়, তাছাড়া পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব আমি তোমায় প্রচুর দেব। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তুমি সুখে থাকবে। আমার পাশে বসে আমার ভাগ্যের ইতিহাস শোন।
—মস্ত এক বড়লোক জমিদারের মেয়ে আমি। যখন আমি খুব ছোট তখনই আমার বাবা মারা যান। মারা যাবার আগে বাবা আমায় আমার দাদার হাতে সঁপে দিয়ে যান। তিনিই আমায় মানুষ করেন।
—দাদা আর আমি দু-জনে দু-জনকে খুব ভালবাসতুম। আমাদের ইচ্ছে, পছন্দ সবকিছু এক রকমের ছিল। তাই আমরা ঠিক করেছিলুম আমরা বিয়ে করব না—সারা জীবন দু-জনে দু-জনের কাছে কাছে থাকব। বাড়িতে আমাদের প্রচুর বন্ধু বান্ধবী ছিল। অনেক ছিল প্রতিবেশী, পরিচিত, যারা প্রায়ই আসত আমাদের বাড়ি। আমরাও তাদের বাড়িতে যেতুম।
—একদিন সন্ধ্যাবেলা হল কি, এক বিদেশী ঘোড়ায় করে আমাদের প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন—আজ মাঝরাতের আগে আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যাবে না। কাজেই দয়া করে যদি আজ রাতের মতো আমায় আশ্রয় দেন তো বড় ভাল হয়।
—আমরা তখনই তাঁর থাকার ব্যবস্থা করলুম, এবং বললুম আমাদের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে। খাবার সময় অতি ভদ্রভাবে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা কইলেন, তাঁর অনেক মজার মজার অ্যাডভেঞ্চারের কথা বললেন। দাদার তাঁকে খুব ভাল লাগল। দাদা তাঁকে অনুরোধ করলেন ক-টা দিন আমাদের সঙ্গে থেকে যাওয়ার জন্যে।
—বিদেশী খুশি হয়েই রাজি হলেন। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে কাটালুম। শেষে তাঁর শোবার ঘর তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে আমি চলে গেলুম নিজের ঘরে। এত ক্লান্ত লাগছিল যে তখন আমার শ্রান্ত হাত-পাগুলিকে নরম বিছানায় এলিয়ে দিতে পারলে যেন বাঁচি।
—সবে ঘুমিয়েছি, সেই সময় অতি নরম, অমি সুন্দর সঙ্গীতের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। শব্দ শুনে আমি চমকে উঠলুম, কিন্তু বুঝতে পারলুম না কোথা থেকে সঙ্গীত আসছে। আমার চাকরানী পাশের ঘরে ঘুমোত। উঠে যখন তাকে ডাকতে যাব, দেখলুম আমার নড়বার ক্ষমতা নেই। ঠিক যেন একটা পাহাড় আমার বুকে চেপে বসেছে; কি এক অদৃশ্য উপায়ে আমার কথা কইবার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে! একটি কথাও আমি উচ্চারণ করতে পারলুম না।
—সেই সময় প্রদীপের আলোয় আমার চোখে পড়ল, সেই বিদেশী দুটি দরজার মধ্য দিয়ে আমার ঘরে এসে ঢুকেছেন। আমি জানতুম সে দরজাদুটি তালা দিয়ে বন্ধ ছিল। বিদেশী এগিয়ে এসে আমায় বললেন, তাঁর জাদুবিদ্যার বলে তিনি সুমিষ্ট সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন, তালা দেওয়া দরজার মধ্যে দিয়ে অনায়াসে প্রবেশ করেছেন, আমাকে অনড় এবং বোবা করে দিয়েছেন। তিনি এসেছেন এই প্রার্থনা নিয়ে, আমি যেন তাঁকে বিবাহ করি। কিন্তু তাঁর অসৎ শক্তির কথা শুনে আমার এত ঘৃণা হল যে আমি কোন উত্তর দিলুম না।
—অনেকক্ষণ তিনি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু আমি চুপ করেই রইলুম। তখন তিনি রাগে অন্ধ হয়ে উঠলেন। বললেন যে তিনি প্রতিশোধ নেবেন। আমার দম্ভকে খর্ব করবেন। এই বলে তিনি বন্ধ দরজার মধ্যে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি ঘরে একা পড়ে রইলুম। ঘুমোতে পারলুম না। ছট-ফট করতে থাকলুম বিছানায়। সকালে উঠে দাদাকে তাড়াতাড়ি বলতে গেলুম কাল রাত্রের ঘটনার কথা, কিন্তু দেখলুম দাদা ঘরে নেই। চাকরেরা বললে, দাদা ভোরে উঠেই বিদেশীর সঙ্গে শিকারে গেছেন।
—আমার মনে হল এর ফল অশুভ হবে। তাড়াতাড়ি পোশাক পরে বললুম আমার টাট্টু ঘোড়াকে সাজ পরাতে। তারপর একজন অনুচর নিয়ে জোর- কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে বনে গিয়ে হাজির হলুম। আমার চাকরের ঘোড়া হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, তার পা গেল মচকে; কাজেই আমাকে একাই যেতে হল। অল্প খানিকটা পথ ঘোড়া ছুটিয়ে যেতেই দেখলুম বিদেশী একটি সুন্দর সাদা হরিণের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমায় দেখতে পেয়ে দড়ি ধরে হরিণটিকে টেনে আমার কাছে এগিয়ে এলেন।
—আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম, আমার ভাইকে তিনি কোথায় রেখে এলেন। দেখলুম সেই হরিণ বেচারার বড়-বড় চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে! আমি বলে উঠলুম—দাদাকে আপনি হরিণ করে দিয়েছেন নাকি? কোন উত্তর না দিয়ে তিনি উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
—আমি খুব রেগে গেলুম। পিস্তল বার করে সেই বর্বরের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়লুম। কিন্তু গুলি তাঁর বুকে লেগে ছিটকে এসে আমার ঘোড়ার মাথায় লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে আমার ঘোড়া গেল মরে। আমিও মাটিতে পড়ে গেলুম। বিদেশীও এগিয়ে এসে বিড়-বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে আমায় অজ্ঞান করে ফেললেন।
—চেতনা হবার পর দেখলুম মাটির তলার এই ঘরে কাঁচের কাফিনের মধ্যে আমি বন্দী। বদমাশটা আমার কাছে আর-একবার এসেছিল। এসে বললে—তোমার দাদাকে আমি হরিণ করে দিয়েছি। তোমাদের প্রাসাদ, জিনিসপত্র, আসবাব-সমেত গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে। সেটি বন্ধ আছে অন্য এক কাঁচের বাক্সে। তোমাদের চাকর-বাক লোক-লস্করদের রঙিন বাষ্প আর তরলে পরিবর্তিত করে কাঁচের পাত্রে রেখে দেওয়া হয়েছে। বদমাশ বললে—এখনও যদি তুমি আমার প্রস্তাব গ্রহণ কর তাহলে যা যেখানে ছিল সব আবার ফিরিয়ে দেব। সবাই নিজ রূপ ফিরে পাবে। শুধু পাত্রগুলির ঢাকা খুলে ফেলব, তাহলেই হবে। আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলুম।
—সে তখন আমায় বন্দীদশায় ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লুম। স্বপ্নে বা জাগরণে যেসব ছবি আমার কল্পনার পটে ফুটে উঠত তার মধ্যে একটি ছিল, যাতে আমি সান্ত্বনা পেতুম। আমি স্বপ্ন দেখতুম, যেন এক তরুণ এসে আমায় উদ্ধার করবে। আজ যেই চোখ খুললুম, দেখি তুমি দাঁড়িয়ে। বুঝলুম আমার স্বপ্ন সফল হয়েছে। এইবার আমি যা বলি তাই কর। প্রথমে যে কাঁচের বাক্সের মধ্যে প্রাসাদটি আছে তাকে খোলবার জন্যে বাক্সটা এই পাথরের উপর বসাতে হবে। তার পাশে দাঁড়াব আমরা।
—পাথরের উপর বাক্স বসাতেই পাথর ধীরে ধীরে উপরে উঠতে আরম্ভ করল। ছেলেটি এবং তার সঙ্গে মেয়েটিও ছাদ অবধি উঠে উপরের ঘরে এসে সেখান থেকে খোলা আকাশের তলায় এসে পৌঁছল। এখানে বদ্ধ প্রাসাদকে মুক্তি দেবার যথেষ্ট জায়গা। মেয়েটি কাঁচের বাক্সের ডালা খুলতেই দেখবার মত এক ঘটনা ঘটল। প্রাসাদ, বাড়ি, উঠোন সমস্ত বাড়তে বাড়তে আগে তারা যেমন ছিল আবার ঠিক তেমনি হয়ে গেল।
তারপর তারা মাটির নিচের হলে গিয়ে বাষ্প আর ধোঁয়া ভরা সব কাঁচের পাত্র পাথরের উপর বসালো; তাদের ঢাকা খুলে দিতেই সমস্ত ধোঁয়া আর বাষ্প তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে দেখতে দেখতে মানুষের আকার গ্রহণ করল। জমিদার-কন্যা বাড়ির চাকর-বাকরদের সবাইকে চিনতে পারলেন।
তাঁর দাদা হরিণের রূপে ষাঁড়-রূপী জাদুকরকে মেরে ফেলেছিলেন। সেই দাদা বন থেকে বেরিয়ে এলেন মানুষের রূপে। এসে বোনকে আলিঙ্গন করলেন। আর অঙ্গীকার-মতো সেইদিনই জমিদার-কন্যার সঙ্গে দর্জি ছেলেটির বিয়ে হয়ে গেল।