Chapter Index

    ভগবান যখন পৃথিবী সৃষ্টি করে প্রত্যেক প্রাণী কে কতদিন বাঁচবে তাই ঠিক করতে বসলেন, গাধা এসে বলল—ঠাকুর আমি কতদিন বাঁচবো?

    ঠাকুর বললেন—ত্রিশ বছর ! খুশী তো?

    গাধা উত্তর দিলে—ঠাকুর তিরিশ বছর তো অনেকদিন। ভাবুন একবার আমার কি কষ্টের জীবন। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত ভারি ভারি মোট বইতে হবে। গমের বস্তা নিয়ে যেতে হবে যাঁতাকল পর্যন্ত যাতে আর সকলে রুটি খেতে পায়! আর আমার কপালে জুটবে কি? শুধু লাথি আর চাবুক! এই সুদীর্ঘ দুঃসহ জীবনের কিছুটা অংশ কমিয়ে দিন।

    শুনে ভগবানের দয়া হল—তিনি তার জীবন থেকে আঠারো বছর কেটে দিলেন।

    গাধা খুশী হয়ে চলে যেতেই কুকুর এল।

    ঠাকুর বললেন—তুমি কতদিন বাঁচতে চাও? কুকুরের পক্ষে ত্রিশ বছর তো খুবই লম্বা, তবে আশা করি তুমি তাতে খুশী থাকবে?

    কুকুর উত্তর দিলে—ঠাকুর এই কি আপনার ইচ্ছা? ভেবে দেখুন একবার বরফের উপর দিয়ে শ্লেজ গাড়ী টেনে কি রকম ছুটতে হবে আমাকে—অতক্ষণ নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতেই পারব না। তারপর যখন আমার গলার ঘেউ ঘেউ শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসবে, দাঁত দিয়ে কামড়াতে পারবো না, তখন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করা আর গোঁ গোঁ করা ছাড়া আর আমি কী করতে পারবো?

    ঠাকুর দেখলেন যে সে ঠিক কথাই বলছে। তার বারো বছর জীবন কমিয়ে দিলেন।

    তারপর এলো বাঁদর।

    ঠাকুর বললেন—তুমি নিশ্চয় ত্রিশ বছর বাঁচতে চাইবে—কি বল? তোমার তো আর গাধা বা কুকুরের মতো খাটতে হয় না, সব সময় নিজের মনে থাকতে পারো।

    বাঁদর বললে—বাইরে থেকে তাই মনে হয় বটে ঠাকুর, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে একেবারে অন্যরকম। আমার সব সময় নাচা-কোঁদা লাফালাফি করতে হয়। মুখ ভঙ্গি করতে হয়, যাতে লোকে দেখে হাসে। যদি কেউ দয়া করে আমার হাতে একটা আপেল দেয় তো কামড়ে দেখবো টক। ঠাকুর, আমোদ-প্রমোদের আড়ালে কত দুঃখ লুকিয়ে থাকে যদি জানতেন! তিরিশ বছরের জীবন আমার পক্ষে সহ্য করা একরকম অসম্ভব।

    ঠাকুর দয়া করে দশ বছর কমিয়ে দিলেন।

    অবশেষে এলো মানুষ—আনন্দে ফুর্তিতে, স্বাস্থ্যে, শক্তিতে পরিপূর্ণ। এসে ভগবানকে বলল—ঠাকুর আমার জীবনের সীমা নির্দেশ করুন।

    ঠাকুর বললেন—ত্রিশ বছর বাঁচবে তুমি এই তো যথেষ্ট?

    মানুষ চেঁচিয়ে উঠল—মাত্র এইটুকু সময়? ঠিক যখন আমার বাড়ি তৈরি করা শেষ হবে, যখন আমার নিজের রান্নাঘরে আর চিমনিতে আগুন জ্বলবে, যখন আমার পোঁতা গাছে ফুল আর ফল ধরবে, ঠিক যখন আমি তৈরী জীবনকে উপভোগ করতে আরম্ভ করব, তখনই আমায় মরতে হবে! দয়া করে আমার জীবন বাড়িয়ে দিন ঠাকুর।

    ঠাকুর বললেন—বেশ, গাধার আঠারো বছর তোমার জীবনের সঙ্গে যোগ করে দিচ্ছি।

    মানুষ বলল—ও যথেষ্ট হল না।

    —বেশ, কুকুরের বারো বছর নাও।

    —এখনও কম হচ্ছে।

    তখন ঠাকুর বললেন—আচ্ছা এর উপর বাঁদরের দশ বছরও দেব। কিন্তু তার বেশী আর পাবে না।

    মানুষ চলে গেল কিন্তু খুব সন্তুষ্ট হল বলে মনে হল না।

    সেই থেকে মানুষের জীবন হল সত্তর বছর। প্রথম ত্রিশ বছর হচ্ছে তার মানুষের জীবন। সেটা বেশী দিন টেকে না। সে সময় তার স্বাস্থ্য থাকে, ফুর্তি থাকে, কাজ থাকে, আনন্দ থাকে, জীবন নিয়ে সে খুশী থাকে। তারপর আসে আঠারো বছরের গাধার জীবন। সে সময় একটা বোঝার পর আর একটা বোঝা তার উপর চাপে। যে শস্য সে বয়ে নিয়ে যায় তা খায় অন্যে। সেবার পুরস্কার স্বরূপ তার ভাগ্যে জোটে লাথি আর ঘুষি। তারপর আসে কুকুরের বারো বছর, যখন সে এক কোণে শুয়ে থাকে, গোঁ গোঁ করে কিন্তু কামড় দেবার মতো দাঁত থাকে না। এই জীবন শেষ হলেই আসে বাঁদরের জীবন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সে বোকার মতো কাটায়, ছেলেরা তাকে দেখলেই ঠাট্টা করে, খেপায়।

    টীকা