হাতকাটা মেয়ে
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক চাকিওয়ালা—বড় অবস্থা খারাপ। দেখতে দেখতে সে খুব গরিব হয়ে পড়ল। শেষে আর কিছুই রইল না, রইল শুধু তার চাকি আর তার পিছনে এক মস্ত আপেল গাছ। একদিন বনে সে কাঠ কাটতে গেছে, সেই সময় এক বুড়ো তার দিকে এগিয়ে এল—তাকে সে কোনদিন দেখেনি। বুড়ো এসে বললে—এত কষ্ট করে গাছ কাটছ কেন তুমি? আমি তোমায় অনেক ধন দিতে পারি তুমি যদি শুধু বল তোমার চাকির পিছনে যা দাঁড়িয়ে আছে তাই আমায় দেবে।
চাকিওয়ালা ভাবলে—চাকির পিছনে আমার আপেল গাছ ছাড়া আর কী। আছে? আর তো আমার কিছু নেই। সে বুড়োকে বললে—বেশ তাই দেব।
বুড়ো একটু হেসে বললে—তিন বছর পরে আমি আবার আসব। সেইদিন আমার হক নিয়ে যাব। বলে সে চলে গেল।
চাকিওয়ালা বাড়ি ফিরতেই তার বৌ এসে বললে—চাকিওলা, আমাদের বাড়িতে এত ধন হঠাৎ কোথা থেকে এল? হঠাৎ দেখছি সব আলমারি দেরাজ সোনায় ভর্তি হয়ে গেছে! কেউ তো আনে নি, কোথা থেকে এল কী জানি!
চাকিওয়ালা বললে—আমি জানি। একজন অচেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার বনে। সে বললে, আমার চাকির পিছনে যা দাঁড়িয়ে আছে তা যদি আমি তাকে দিই তাহলে সে আমায় অনেক ধন দেবে। আমি জানি যে চাকির পিছনে আছে আমার শুধু প্রকাণ্ড আপেল গাছ। তাই আমি বলেছি দেব।
চাকি বৌ ভয় পেয়ে বলে উঠল—হা গো স্বামী, এ তো তাহলে সেই সর্বনেশে জাদুকর! ও কক্ষনো আপেল গাছের কথা বলে নি। ও বলেছে আমাদের মেয়ের কথা। চাকি-কলের পিছনে মেয়ে আমাদের উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিল।
চাকিওয়ালার মেয়ে ছিল ভারি নম্র, ভারি সুন্দরী। বাপ-মার বাধ্য হয়ে তিন বছর সে সরল জীবন কাটালো। তারপর সেই সর্বনেশে জাদুকরের আসবার দিন এল। মেয়েটি জানত যে জাদুকর আসছে। সে জানত, একটু নোংরা না থাকলে জাদুকর ছুঁতে পারে না। সে তাই ধুয়ে মুছে নিজেকে সাদা বরফের মতো পরিষ্কার করে তুলল। তারপর খড়ি দিয়ে একটা গণ্ডি কেটে দাঁড়িয়ে রইল তার মধ্যে।
ভোরেই এসে হাজির হল জাদুকর, কিন্তু গণ্ডি পার হবার সাহস তার হল না। ভীষণ চটে গিয়ে জাদুকর চাকিওয়ালাকে বললে—সমস্ত জল সরিয়ে ফেল এখান থেকে, যাতে ও গা ধুতে না পারে। একটু নোংরা না হলে আমি ওকে ছুঁতে পারছি না।
ভয় পেয়ে চাকিওয়ালা তাই করল—সমস্ত জল সরিয়ে রেখে দিল মেয়ের কাছ থেকে। কিন্তু তার পরদিন জাদুকর এসে দেখে মেয়ের হাত যেমন পরিষ্কার ছিল তেমনিই আছে। সারাদিন ধরে চোখের জলে মেয়েটির হাত ধুয়ে গেছে। জাদুকর তাকে ছুঁতে পারল না, কাজেই সে আরো রেগে গেল। চেঁচিয়ে বললে—কেটে ফেল মেয়ের হাত, নইলে আমি ওকে ধরতে পারছি না।
চাকিওয়ালা বললে—নিজের মেয়ের হাত আমি নিজে কেমন করে কাটব?
সর্বনেশে জাদুকর ভীষণ মূর্তি ধরে বললে—পারবি নে? যদি না করিস, তবে তোর মেয়ের বদলে তোকেই আমি ধরে নিয়ে যাব!
শুনে বাপের কষ্ট হল, কিন্তু ভয়ের চোটে রাজি হয়ে গেল। সে মেয়ের কাছে গিয়ে বললে—শোন মা, তোমার দু-হাত যদি কেটে না ফেলি তাহলে জাদুকর আমায় ধরে নিয়ে যাবে বলছে। আমি তাই তোমার হাত কাটতে রাজি হয়েছি। এই বিপদ থেকে এখন আমায় বাঁচাও মা, আর আমার এই দুষ্কর্মের জন্যে ক্ষমা কর!
মেয়েটি বললে—আমাকে নিয়ে যা করতে চাও কর বাবা, কারণ আমি তোমারই সন্তান। বলে টেবিলের উপর সে তার দুটি হাত রাখল। চাকিওয়ালা মেয়ের হাত কেটে ফেলল। জাদুকর পরদিন সকালবেলা এল বটে, কিন্তু মেয়েটি মনের কষ্টে এমন অঝোরে চোখের জল ফেলেছিল সেই কাটা হাতের উপর যে তা ধুয়ে গিয়ে সাদা ধব-ধব করছিল। জাদুকরের আর কিছু করবার ছিল না। সে মেয়েটির উপর অধিকার ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে।
জাদুকর চলে যেতে চাকিওয়ালা এসে বললে—মা, তোমার জন্যে আমি এত ধনলাভ করেছি যে তোমার চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই আমার জীবনে নেই।
মেয়েটি বললে—কিন্তু এখানে আমি আর থাকতে পারব না বাবা। এখানে আমি নিরাপদ নই। যার কাছ থেকে আমি দরদ পাব এমন লোকের সঙ্গে আমায় চলে যেতে দাও বাবা। আমি ভালবাসা চাই।
তার বাবা বললেন—এমন লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছে। যাই হোক তিনি তাকে যেতে দিলেন। সে তার কাটা হাত বেঁধে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল।
সারাদিন সে চলল না খেয়ে। যখন রাত হল, দেখল সে এক রাজ-উদ্যানের কাছে এসে পড়েছে। চাঁদের আলোয় সে দেখল ফলে ভরা অনেকগুলি গাছ, কিন্তু তাদের কাছে পৌঁছতে পারল না। জায়গাটা জলে পূর্ণ, খালে ঘেরা। সারাদিন মুখে কিছু পড়েনি, বেচারার এত খিদে পেয়েছিল যে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—হায়, যদি ঐ সুরসাল ফলের একটাও আমি পেতাম! কিছু খেতে না পেলে এবার আমি নিশ্চয় মরে যাব!
সেই সময় হঠাৎ এক পরী এসে হাজির। পরী এসেই খালের জল সরিয়ে শুকনো মাটির উপর দিয়ে একটি সরু রাস্তা বার করে দিল মেয়েটির জন্যে।
মেয়েটির সঙ্গে পরীও এসে ঢুকল বাগানে। মেয়েটি অবশ্য তাকে দেখতে পেল না। সে একটি গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তাতে অনেক পাকা নাসপাতি ঝুলছে।
হাত ছিল না বলে পাড়বে কী করে—তাই গাছের কাছে গিয়ে একটি ঝুলন্ত নাসপাতি মুখ দিয়ে পেড়ে খেল। বাগানের মালী একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে আর তার সঙ্গের পরীকে দেখল, কিন্তু ভূত ভেবে কথা কইতে বা নড়তে সাহস করলে না।
খিদে কমতে মেয়েটি ঝোপের আড়ালে গিয়ে শান্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে এলেন রাজা। তাঁর বাগানের সমস্ত ফল আগে থেকে গুনতি করা থাকত। নাসপাতি গাছের কাছে গিয়ে নাসপাতি গুনে দেখলেন, একখানা কম। ভাবলেন হয়ত পড়ে গেছে। কিন্তু গাছের তলায় কোথাও ফল নেই। কাজেই তিনি মালীর কাছে জিজ্ঞেস করতে গেলেন, একখানা নাসপাতির কী হল?
মালী বললে—কাল রাত্রে বাগানে এক হাতকাটা ভূত এসেছিল। সে মুখ দিয়ে গাছ থেকে পেড়ে নাসপাতি খেয়ে গেছে।
রাজা বললেন—ভূত জল পার হল কী করে? আর নাসপাতি খাবার পর সে গেল কোথায়?
মালী উত্তর দিলে—প্রথমে বরফের মত সাদা পোশাক পরা কে একজন স্বর্গ থেকে নেমে এলেন। তিনি এসে খালের জল আটকে দিয়ে ভূতের জন্যে শুকনো মাটির উপর দিয়ে রাস্তা করে দিলেন। নিশ্চয় কোন দেবদূত। সেইজন্যেই আমি কোন প্রশ্ন করতে বা লোক ডাকতে সাহস করিনি। একখানি নাসপাতি খাওয়া হতেই ভূত চলে গেল।
রাজা বললেন—যা দেখেছ কাউকে বোলো না। আজ রাত্রে আমি নিজে পাহারা দেব।
যেই অন্ধকার হল, রাজা বাগানে ঢুকলেন। ভূতের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে একজন যাজককে নিয়ে এলেন। তারপর দু-জনে বসলেন এক গাছতলায়, মালী রইল দাঁড়িয়ে। সবাই চুপ। মাঝরাত হলে মেয়েটি ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল। নাসপাতি গাছের কাছে গেল। তিনজন পাহারাদারই দেখলেন সে গাছ থেকে নাসপাতি না তুলেই একটা খেয়ে ফেলল। দেখলেন তার পাশে সাদা পোশাক পরা এক দেবদূত দাঁড়িয়ে।
যাজক তার কাছে গিয়ে বললেন—তুমি কি পৃথিবীর, না স্বর্গের? তুমি কি মানুষ, না প্রেতাত্মা?
মেয়েটি বললে—মাগো, আমি প্রেতাত্মা কেন হব? আমি গরিব বেচারা—সবাই আমায় ত্যাগ করেছে, এক ভগবান ছাড়া!
রাজা বললেন—সারা পৃথিবী তোমায় ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু তুমি যদি আমার বন্ধু হও তাহলে আমি কোনদিন তোমায় ত্যাগ করব না।
মেয়েটিকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হল। মেয়েটি ছিল এত নম্র এত সুন্দরী তে রাজা তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। রাজা তাকে রূপোর হাত করে দিলেন। তারপর মহা ধুমে তাঁদের বিয়ে হয়ে গেল।
বছর খানেক পরে রাজাকে যুদ্ধে যেতে হল। যাবার আগে তিনি তাঁর মায়ের হাতে ভার দিয়ে গেলেন তরুণী রানীর।
এর কিছুদিন পরেই রানীর একটি ছেলে হল। রাজ-মাতা চিঠি লিখে খবরটি এক দূতের হাতে পাঠিয়ে দিলেন।
দূত অনেক পথ চলে ক্লান্ত হয়ে এক নদীর ধারে জিরোতে বসল। বসে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমোতেই সেখানে এসে হাজির সেই জাদুকর। রানীর কি করে ক্ষতি করা যায় এতদিন সেই চেষ্টাতেই সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে করল কি, ঘুমন্ত দূতের কাছ থেকে রাজমাতার চিঠিটা চুরি কবে আর-একটা চিঠি রেখে দিল তার কাছে। তাতে লিখে দিল যে রানী কোথা থেকে এক পরের ছেলেকে জোগাড় করে এনে রাজার ছেলে বলে চালাবার চেষ্টা করছেন।
দূত চিঠি-চুরির কিছুই জানতে পারল না। সে নকল চিঠি নিয়ে রাজার হাতে দিল। রাজা চিঠি পড়ে বড়ই দুঃখিত হলেন, তাঁর মনও অস্থির হয়ে উঠল। যাই হোক, তিনি জবাবে লিখে দিলেন যে রাজা যতদিন না ফেরেন রানীর যেন কোন অযত্ন না হয়।
দুষ্ট জাদুকর আবার অপেক্ষ করে রইল দূতের পথে। দৃত যখন ঘুমোচ্ছে তখন সে রাজার চিঠি বদল করে আর-একটা চিঠি দিয়ে দিলে। তাতে লিখল—তাঁর হুকুম, রাজমাতা যেন রানী এবং তার ছেলে উভয়কেই হত্যা করেন।
বুড়ী মা চিঠি পড়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। রাজা যে এমন ভয়ানক একটা কিছু করতে বলতে পারেন এ তাঁর বিশ্বাসই হতে চাইল না। তিনি আবার রাজাকে লিখে পাঠালেন, কিন্তু তার কোন উত্তর এল না। দুষ্টু জাদুকর প্রতিবারেই চিঠি চুরি করে নকল চিঠি চালান করতে লাগল। কিন্তু শেষের চিঠিটা এল সবচেয়ে ভয়ানক। তাতে রাজা লিখেছেন যে রানীকে আর ছেলেকে মেরে ফেলবার দরকার নেই। তার বদলে ছেলের জিভ কেটে ফেলা হোক আর তার মায়ের চোখ উপড়ে ফেলা হোক!
কিন্তু রাজার মা ছিলেন বড়ই দয়ালু। রাজার এই ভয়ানক হুকুম পালন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে রানীর কাছে গিয়ে বললেন—রাজার হুকুম-মতো আমি তোমাদের দু-জনকে মেরে ফেলতে পারব না। কিন্তু এখানেও আর আমি তোমাদের থাকতে দিতে পারি না। যেদিকে দু-চোখ যায় সেইদিকে চলে যাও তোমার ছেলে নিয়ে। আর এখানে ফিরো না। বলে ছেলেকে মায়ের পিঠে বেঁধে দিলেন। বেচারি রানী কাঁদতে কাঁদতে রাজপুরী ছেড়ে চলে গেলেন।
কিছুদূর হেঁটে রানী এসে পৌঁছলেন এক গহন বনের কাছে। বনের ধারে এসে রানী ভেবে পেলেন না এইবার কোন্ পথ নেবেন। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে তিনি প্রার্থনা করতে লাগলেন। তারপর যখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন, দেখতে পেলেন একটি ছোট্ট কুটিরের জানলা থেকে আলো আসছে। জানলার উপরে কে যেন লিখে রেখেছে—এখানে যে থাকবে তার কোন বিপদ হবে না।
কুটির থেকে একটি কুমারী বেরিয়ে এলেন, তার গায়ে বরফের মতো সাদা পোশাক। কুমারী বেরিয়ে এসে বললেন—আসুন রানী। বলে তাঁকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তারপর মায়ের পিঠ থেকে ছেলেকে খুলে কোলে নিয়ে দোল দিতে লাগল। ছেলেও আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। ছেলেটির পাশের ঘরে একটি বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কুমারীটি ফিরে এলেন মায়ের কাছে।
রানী তার দিকে তাকিয়ে বললেন—কেমন করে জানলে যে আমি রানী?
সাদা পোশাক পরা কুমারীটি বললেন—আমি একজন দেবদূতী। আমায় পাঠানো হয়েছে তোমার আর তোমার ছেলের দেখাশোনা করবার জন্যে।
সেই থেকে রানী সেই কুটিরেই রয়ে গেলেন। এমনি করে অনেক বছর কেটে গেল। রানী সুখে রইলেন। রানী এত ধার্মিক ছিলেন, এত ভাল ছিলেন যে তাঁর কাটা হাত আবার ভাল হল। ছোট ছেলেটি হল তাঁর চোখের মণি।
রাজপুরী থেকে রানী চলে যাবার কিছুদিন পরেই রাজা ফিরে এলেন। ফিরে এসেই বললেন—রানী আর ছেলে কোথায়?
শুনে রাজার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন—নিষ্ঠুর তুমি! অমন সব ভয়ানক চিঠি লেখবার পর এখন জানতে চাইছ তোমার রানী আর ছেলে কোথায়? দুই নিস্পাপ প্রাণীকে তুমি কি মেরে ফেলতে বলনি?
রাজা ভেবে পেলেন না মা কী বলছেন। তিনি তখন রাজার চিঠিগুলি যেগুলি দুষ্টু জাদুকর বদলে দিয়েছিল, দেখালেন। চিঠি পড়ে রাজা এমনই কাঁদতে লাগলেন যে তাঁর মায়ের দয়া হল, তিনি বললেন—অমন করে কেঁদো না। তারা মরে নি। আমি তাদের মারতে পারি নি। কিন্তু তোমার রানী আর ছেলে তোমার ক্রোধের ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। এখানে আর তারা ফিরবে না।
রাজা বললেন—পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত আমি তাদের খুঁজব! যতদিন আমার রানীকে আমি খুঁজে না পাই ততদিন আমি খাবার বা জল স্পর্শও করব না। তাতে আমার মৃত্যু হয় হোক। রাজা বেরিয়ে পড়লেন তাঁর পথে। পাহাড় পর্বত উপত্যকা রাস্তা পার হয়ে চললেন তিনি সাত বছর। কিন্তু রানীকে কোথাও পেলেন না। তিনি ভাবলেন, রানী না খেয়েই মারা গেছেন, রাজা কোনদিন আর তাঁকে দেখতে পাবেন না।
রাজা খাবার বা জল এতদিন কিছুই খাননি, কিন্তু স্বর্গ থেকে তিনি সাহায্য পাচ্ছিলেন। অবশেষে তিনি প্রকাণ্ড এক বনে এসে পৌঁছলেন। সেখানে এসে দেখলেন ছোট্ট একটি কুটির, তার গায়ে লেখা—এখানে যে থাকবে তার কোন বিপদ হবে না।
রাজা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেখা পড়ছিলেন। হঠাৎ সেই বরফের মত সাদা পোশাক পরা কুমারী বেরিয়ে এসে রাজার হাত ধরে তাঁকে কুটিরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন—মহারাজকে আমন্ত্রণ জানাই। কিন্তু মহারাজ এখানে এসেছেন কেন?
রাজা উত্তর দিলেন—সাত বছর ধরে আমার রানীকে আর ছেলেকে খুঁজে খুঁজে আমি সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু পাইনি। তুমি কি আমায় সাহায্য করতে পার?
দেবদূতী বললেন—বসুন আগে। বিশ্রাম করুন। কিছু খান, কিছু পান করুন।
রাজা এত ক্লান্ত, এত ক্ষুধার্ত হয়েছিলেন যে তিনি একটু খেয়ে শুয়ে পড়লেন। দেবদূতী এসে তাঁর মুখ ঢেকে দিলেন।
তারপর তিনি ভিতরের এক ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। রানী সেখানে বসে ছিলেন তাঁর ছেলেকে নিয়ে। দেবদূতী বললেন—যাও তোমরা দু-জন পাশের ঘরে। তোমার স্বামী এসেছেন।
রানী বেচারি গেলেন, কিন্তু মন তাঁর তখনও দুঃখে ভরা। যেসব নিষ্ঠুর চিঠি রাজা তাঁর মাকে পাঠিয়েছিলেন তার কথা রানী ভোলেননি।
রানী ঘরে ঢুকতেই রাজার মুখ থেকে ঢাকা সরে পড়ে গেল। রানী তাঁর ছেলেকে বললেন—ওটা তুলে দাও।
ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে সেই অজানা লোকটির মুখে কাপড় ঢেকে দিলে। কিন্তু রাজা ঘুমের মধ্যে কার গলার শব্দ শুনে মাথা নাড়তেই আবার টাকা খসে পড়ে গেল।
রানী বললেন—বাছা, তোমার বাবার মুখ ঢেকে দাও।
ছেলেটি অবাক হয়ে রাজার মুখের দিকে তাকালো। তারপর বললে—আমার বাবার মুখ আমি কী করে ঢাকব মা? এ পৃথিবীতে তো আমার কোন বাবা নেই! তুমি আমায় শিখিয়েছ প্রার্থনা করতে—আমাদের পিতার, যিনি স্বর্গে আছেন। আমি তাই জানি আমার বাবা ভগবান। এই অজানা লোকটি আমার বাবা নন। আমি এঁকে চিনি না।
রাজা এই শুনে উঠে বসলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন—কে তোমরা?
রানী বললেন—আমি তোমার স্ত্রী। এই তোমার ছেলে।
রাজা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন। বললেন—তোমার মুখ, তোমার গলার স্বর একই রকম। কিন্তু আমার স্ত্রীর ছিল রূপোর হাত। তোমার হাত তো সত্যিকারের।
রানী বললেন—ভগবানের দয়ায় আমার হাত আবার হয়েছে। রাজা তখনও সন্দেহ করছেন দেখে দেবদূতী রূপোর হাতদুটি নিয়ে ঢুকলেন।
রাজা তখন চিনলেন, এই হচ্ছে তাঁর হারিয়ে যাওয়া রানী, এই তাঁর ছেলে। আনন্দে তিনি তাঁদের জড়িয়ে ধরলেন।
দেবদূতী তাঁদের জন্যে রান্না করলেন। সকলে মিলে খেলেন, তারপর বিদায় নিয়ে রানী আর রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা ফিরে চললেন বাড়ি। প্রাসাদে পৌঁছতে রাজার মায়ের এবং আর সবার খুব আনন্দ হল।
আবার এক বিরাট বিয়ের ভোজ হল। আর সেই থেকে রাজা আর রানী সুখে স্বচ্ছন্দে দিন কাটাতে লাগলেন।