গোলাপ কুমারী
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাগোলাপ কুমারী
এক ছিলেন রানী, তাঁর কোনো সন্তান হয়নি। প্রতিদিন সকালে যখন তিনি বাগানে বেড়াতেন ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাতেন, যাতে তাঁর একটি ছেলে কি মেয়ে হয়। একদিন এক দেবদূত এসে তাঁকে বললেন—নিশ্চিন্ত হও রানী। তোমার একটি ছেলে হবে। সেই ছেলের হবে এক আশ্চর্য ক্ষমতা। সে যা চাইবে তাই পেয়ে যাবে। আড়াল থেকে বুড়ো রাঁধুনি শুনলে এই কথা। কাউকে সে কিছু বললে না। রানী তাড়াতাড়ি রাজার কাছে গিয়ে সুখবর দিলেন। সময় হলে তাঁদের একটি ছেলে হল। আনন্দে তাঁদের প্রাণ ভরে উঠল।
প্রতিদিন সকালে রানী তাঁর ছেলেকে বাগানে নিয়ে যেতেন। সেখানে বুনো জন্তুদের পোষ মানিয়ে রাখা হত। ফোয়ারার টলটলে জলে রানী ছেলেকে স্নান করাতেন। একদিন হল কি, ছেলেটি তখন একটু বড় হয়েছে, বাগানে রানী তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
বুড়ো রাঁধুনি সেই সময় চুপিচুপি এসে রাজপুত্রকে চুরি করে নিল। তারপর একটা মুরগী মেরে তার রক্ত রানীর কাপড়ের উপর ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। শেষে এক গোপন জায়গায় ছেলেটিকে নিয়ে গিয়ে রেখে দিল। সেখান থেকে ফিরে এসে রাজার কাছে ছুটে গিয়ে নালিশ জানালো যে রানীর অসাবধানতায় বুনো জন্তু এসে রাজপুত্রকে খেয়ে গেছে।
রানীর পোষাকে রক্ত দেখে রাজার মনে বিশ্বাস জন্মালো যে বুড়ো রাঁধুনি যা বলেছে তা সত্যি। তিনি রাগে অন্ধ হলেন। বললেন—খুব উচু এক বুরুজ করা হোক যার মধ্যে সূর্যের আলো চাঁদের আলো কোনো আলোই ঢুকতে পারবে না। রানীকে তার মধ্যে রেখে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হোক। এর মধ্যে সাত বছর রানী থাকবেন না খেয়ে না জল পান করে। বিনা আহারে তাঁর মৃত্যু হোক।
কিন্তু স্বর্গ থেকে দুই দেবদূত সাদা পায়রার রূপ ধরে রোজ দুবেলা রানীর জন্যে খাবার নিয়ে আসত। এমনি করে সাত বছর কেটে গেল।
এদিকে সেই বুড়ো রাঁধুনি ভাবল—ছেলেটির যদি সত্যিই ইচ্ছাশক্তি থাকে আর আমি এখানে বসে থাকি, তাহলে যে-কোনো সময় আমি ধরা পড়ে যাবো। ভেবে সে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে ছেলেটির কাছে চলে গেল। ছেলে ততদিনে বড় হয়ে উঠেছে। রাঁধুনি ছেলেকে বললে—তুমি একটা সুন্দর প্রাসাদ চাও, যাতে বাগান-টাগান সব কিছু আছে। ছেলের মুখ থেকে কথাটি উচ্চারণ হবার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেলো সে যা চেয়েছে পেয়ে গেছে।
কিছুদিন পরে রাঁধুনি বললে—তোমার এত একা একা থাকা ভাল নয়। একটি সুন্দরী মেয়ে চাও, যে তোমার সঙ্গী হবে।
রাজপুত্র কথাগুলি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দেখলেন তাঁর সামনে এক অপূর্বসুন্দরী কন্যা দাঁড়িয়ে। চিত্রকরও এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে না। দুজনের ভারি ভাব হয়ে গেল। তারা একসঙ্গে খেলা করতে লাগল। আর বুড়ো রাঁধুনি বড় জমিদারের মতো বনে গিয়ে শিকার খেলিয়ে বেড়াতে থাকল। একদিন তার হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, রাজপুত্র কোনোদিন হয়তো তাঁর বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইতে পারেন। তাহলে কিন্তু রাঁধুনি ভারি অসুবিধায় পড়ে যাবে। সে তখন করল কি, মেয়েটিকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে—আজ রাত্রে ছেলেটি যখন ঘুমোবে এই ছুরিটা তার বুকে বসিয়ে দিও। তারপর তার কলজে আর জিভ আমাকে এনে দেখাবে। বুঝলে? না করলে তোমারই প্রাণ নেব।
বলে সে চলে গেল। কিন্তু পরদিন মেয়েটি তার হুকুম পালন করল না। সে বললে—ও তো নির্দোষ, ওকে আমি মারব কেন? ও তো কোনো প্রাণীর কোন ক্ষতি কখনো করেনি!
রাঁধুনি আবার বলল—দেখ, তুমি যদি আমার কথা না শোনো, তাহলে তোমার প্রাণ নেব।
রাঁধুনি চলে যেতে মেয়েটি একটি হরিণের বাচ্ছাকে মেরে তার কলজে আর জিভ একটি থালায় রাখল। তারপর যখন দেখল বুড়ো আসছে সে ছেলেটিকে বললে—শিগগির বিছানায় ঢুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়।
বুড়ো হতভাগা এসে বললে—ছেলের জিভ আর কলজে কোথায় ?
মেয়েটি তাকে থালাটা এগিয়ে দিল। সেই সময় রাজপুত্র তাঁর চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন—তুমি হচ্ছ পুরোনো পাপী। কেন আমাকে মারতে চেয়েছ? তবে শোনো তোমার শাস্তি। তুমি হবে কালো কুকুর; গলায় থাকবে সোনার চেন। তোমাকে জ্বলন্ত কয়লা খাওয়ানো হবে, যাতে করে মুখের মধ্যে থেকে তোমার আগুন বেরিয়ে আসে।
রাজপুত্র আরো কিছুদিন প্রাসাদে থেকে গেলেন। তিনি ভাবতেন—মা কি আমার বেঁচে আছে? অবশেষে একদিন তিনি মেয়েটিকে বললেন—আমি আমার নিজের দেশে যাবো। তুমি যদি চাও আমার সঙ্গে আসতে পারো। তোমায় নিয়ে যাবো।
মেয়েটি বলল—হায়, সে কত দূর ? অত দূর বিদেশে গিয়ে যেখানে আমি কাউকে চিনি না, কি করব?
মেয়েটির যাবার ইচ্ছে নেই, অথচ কি করে দুজনে কাছ-ছাড়া হয়? তখন সে মেয়েটিকে একটি গোলাপ করে সঙ্গে নিয়ে চলল।
রাজপুত্র বেরিয়ে পড়লেন দেশের পথে। কালো কুকুরকে ছুটিয়ে নিয়ে চললেন সঙ্গে। শেষে রাজপুত্র এসে পৌঁছলেন দেশে। সেখানে এসে তিনি সোজা গেলেন যে বুরুজের মধ্যে তাঁর মা-কে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেইখানে। প্রকাণ্ড উঁচু বুরুজ। রাজপুত্র ইচ্ছে করলেন একটা মই হোক। মই হল। রাজপুত্র তাতে চড়ে নীচের দিকে তাকিয়ে ডাকলেন—মা গো, রানী মা, তুমি কি এখনও বেঁচে?
রানী ভাবলেন, দেবদূত তাঁর জন্যে খাবার এনেছেন। তিনি বললেন, আমি এইমাত্র খেয়েছি। আর তো কিছু চাই না।
রাজপুত্র বললেন—আমি তোমার আদরের ছেলে, যাকে বুনো জন্তুতে খেয়ে ফেলেছিলো বলে তোমরা ভেবেছিলে। এই দেখ এখনও আমি বেঁচে আছি, শীঘ্রই আসব তোমায় উদ্ধার করতে।
রাজপুত্র সেখান থেকে নেমে তাঁর বাবার কাছে গেলেন। বললেন যে তিনি একজন বিদেশী শিকারি—রাজার কাছে চাকরি চান।
রাজা বললেন—বেশ তো, ও যদি বনের পশু পালনে দক্ষ হয়, বুনো হরিণ আর বনমোরগের মাংস সরবরাহ করতে পারে তাহলে ওকে আমি রাখব। কিন্তু এদেশে বহুদিন বুনো হরিণই কেউ চোখে দেখেনি।
শিকারি বললে—রাজভোজের জন্যে যত মাংস প্রয়োজন, বন থেকে আমি সংগ্রহ করে দেব।
তারপর তিনি দেশে যত শিকারি ছিল সবাইকে ডেকে বনে নিয়ে চললেন। সবাইকে সাজিয়ে দিলেন মস্ত এক চক্রের আকারে। চক্রের শুধু একটি দিক খোলা রইল। নিজে গিয়ে দাঁড়ালেন ব্যূহের ঠিক মাঝখানে। তারপর যত পারেন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে লাগলেন বনের হরিণদের উপর। সঙ্গে সঙ্গে দু-শো জন্তু ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ল ব্যূহের মধ্যে। শিকারিরা এদের উপর গুলি চালালো। তারপর সেই মরা জন্তুর পাহাড় ষাট ঘোড়ার টানা গাড়ির উপর বোঝাই করে তারা ফিরে চললো রাজার কাছে। বহু বছর পরে রাজার ভাঁড়ার আবার বুনো জন্তুর সুস্বাদু মাংসে পূর্ণ হল।
রাজা ভারি খুশি হয়ে যত রাজ-পারিষদ আছেন সবাইকে মস্ত এক ভোজে নিমন্ত্রণ করলেন। সবাই এসে উপস্থিত হলে রাজা শিকারিকে বললেন—তোমার এত যখন গুণ, তুমি আমার পাশে বসবে।
সে বলল—মহারাজ, আমি সামান্য গরীব শিকারি।
রাজা বললেন—তা হোক। আমার আদেশ।
রাজার পাশে বসে তার মন চলে গেল তার মায়ের খোঁজে। তার মনে হল কোনো পারিষদ যদি রানীর কথা বলেন তো ভাল হয়। মনে করতে না করতেই মহামান্য সেনাপতি বলে উঠলেন—মহারাজ, আমরা সবাই এখানে আনন্দ করছি। কিন্তু মহারানী কেমন আছেন? যে বুরুজের মধ্যে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে তিনি কি এখনও বেঁচে আছেন?
রাজা জবাব দিলেন—রানীর দোষে আমার প্রিয় পুত্র বন্যজন্তুর হাতে প্রাণ হারিয়েছে। রানীর নাম আমি শুনতে চাই না।
শিকারি তখন দাঁড়িয়ে উঠে বলল—পূজনীয় পিতা! রানী এখনও বেঁচে আছেন, আমি তাঁরই ছেলে। বুনো জানোয়ার আমায় খায়নি। আপনার বজ্জাত রাঁধুনি আমায় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মা যখন ঘুমোচ্ছিলেন মায়ের কোল থেকে আমায় চুরি করে মায়ের কাপড়ে মুরগীর রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল।
তারপর সেই সোনার শিকলে বাঁধা কালো কুকুরকে এনে বলল—এই হচ্ছে সেই শয়তান।
জ্বলন্ত কয়লা আনিয়ে কুকুরকে খাওয়ানো হল। সবাই দেখল তার মুখ দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসছে। তারপর সে রাজাকে বলল—রাঁধুনির নিজ রূপে আপনি কি তাকে দেখতে চান? আপনি কি তাকে ফিরে পেতে চান? বলতেই দেখা গেল সাদা ঝাড়ন পরে হাতে ছুরি নিয়ে রাঁধুনি বুড়ো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রাজা তাকে দেখে রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি আদেশ দিলেন সব চেয়ে গভীর যে কূপ-কারা—তাতে একে ফেলে দেওয়া হোক। তখন শিকারি আরও বলল—বাবা, যে কুমারীকে ঐ শয়তান হুকুম দিয়েছিল আমায় মেরে ফেলবার জন্যে, কিন্তু যে তার নিজের প্রাণের ভয় না করেও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে, তাকে কি আপনি দেখতে চান?
রাজা বললেন—হ্যাঁ, তাকে দেখলে আমি খুবই আনন্দ পাবো।
তাঁর ছেলে বলল—বাবা, তাকে আমি প্রথমে দেখাবো একটি সুন্দর ফুলের রূপে।
বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে গোলাপ ফুলটিকে টেনে বার করল। এমন সুন্দর গোলাপ রাজা কখনও দেখেননি। তখন ছেলে বলল—এইবার দেখুন তাকে তার সত্যিকার রূপে।
সঙ্গে সঙ্গে অপূর্বসুন্দরী এক মেয়ের আবির্ভাব হল। কোনো চিত্রকরও অমন সুন্দর করে আঁকতে পারবে না।
রাজা সভাসদ পারিষদ আর পুরমহিলাদের পাঠিয়ে দিলেন বুরুজে রানীকে নিয়ে আসবার জন্যে। কিন্তু তাঁরা বুরুজে পৌঁছে দেখলেন রানী মুখে জলও দিচ্ছেন না, খাবারও খাচ্ছেন না, সব ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বললেন—দয়াল ভগবান এতদিন আমার প্রাণরক্ষা করেছেন, এবার তিনিই আমায় মুক্ত করবেন।
তিন দিন পরে রানী মারা গেলেন। রানীকে যখন কবর দেওয়া হচ্ছে সেই সময় যে দুটি সাদা পায়রা তাঁকে খাবার দিয়ে যেত তারা তাঁর কবরের উপরে উড়ে বেড়াতে লাগল।
রাজা বললেন—দুষ্টু ঐ রাঁধুনিকে চার টুকরো করে কেটে ফেলা হোক।
রাজার মন কিন্তু ভেঙে গিয়েছিল। তিনি শীঘ্রই মারা গেলেন।
রাজপুত্র সেই যে সুন্দরী মেয়েটিকে ফুলের রূপে নিয়ে এসেছিলেন তাকে বিয়ে করলেন। তারপর সুখে কাল কাটাতে লাগলেন তাঁরা।