Chapter Index

    গোলাপ-খুকি

    এক ছিল বিধবা, সে ভারি গরিব। তার ছিল দুটি মেয়ে—সাদা গোলাপ আর লাল গোলাপ। বিধবার কুটিরের সামনে দুটি গোলাপেরও ঝাড় ছিল, তাতে সাদা আর লাল ফুল ফুটত। মেয়ে দুটিকে দেখতে ছিল সেই ফুলগুলিরই মতো। এদের নিয়ে বিধবা একাই থাকত তার কুটিরে। মেয়ে দুটি ছিল বড়ই ভাল, কাজ-কর্মে পটু, হাসিখুশি আর মিশুকে। শুধু সাদা গোলাপ ছিল লাল গোলাপের চেয়েও আরো একটু নম্র, আরো একটু শান্ত।

    লাল গোলাপ মাঠে ছুটোছুটি করে লাফিয়ে বেড়াতো, ফুল খুঁজে আর প্রজাপতি ধরে ধরে, আর সাদা গোলাপ বাড়িতে বসে মাকে ঘর-সংসারের কাজে সাহায্য করত। আর যখন কাজ না থাকত তখন মাকে বই পড়ে শোনাতো।

    মেয়ে দুটি পরস্পরকে এত ভালবাসত যে যখনই তারা বেড়াতে যেত দু-জনে হাত-ধরাধরি করে যেত, আর সাদা গোলাপ যখন বলত—আমরা কখনও দু-জনে দু-জনকে ছেড়ে থাকব না, লাল গোলাপ জবাব দিত—যতদিন বেঁচে থাকি, কোনদিন নয়! আর মা বলতেন—যা এক বোন পাবে, অন্য বোনের সঙ্গে সে তা ভাগ করে নেবে।

    প্রায়ই তারা গভীর বনের মধ্যে গিয়ে বুনো বেরি সংগ্রহ করত। কোনদিন বুনো জন্তু তাদের কিছু বলেনি। বুনো খরগোস এসে তাদের হাত থেকে বাঁধাকপি খেয়ে যেত। হরিণ তাদের পাশেই চরত। ছাগল তাদের ঘিরে লাফালাফি করত আর পাখিরা তাদের পাশে গাছের ডালে বসে গান গেয়ে শোনাতো। কোনদিন তাদের কোন বিপদ হয়নি। বনের মধ্যে যদি তাদের দেরি হয়ে যেত, হঠাৎ রাত হয়ে যেত, তাহলে তারা শুকনো শেওলার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। তাদের মা জানতেন বনের মধ্যে তাদের কোন অনিষ্ট হবে না, তাই তিনিও নিশ্চিন্ত থাকতেন।

    একবার সারা রাত বনে কাটাবার পর ভোরে যখন তাদের ঘুম ভাঙল, তারা চোখ মেলে দেখল যে তাদের ঘাসের বিছানার পাশে বসে রয়েছে সাদা কাপড় পরা ভারি সুন্দর দেখতে ছোট্ট একটি ছেলে। তাদের ঘুম ভাঙতেই ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো, তাদের দিকে চেয়ে একটু হাসল, কিন্তু কথাটি না বলে বনের মধ্যে চলে গেল। তখন সাদা গোলাপ আর লাল গোলাপের চোখে পড়ল তারা যেখানে সারা রাত ঘুমিয়েছে ঠিক তার পাশেই প্রকাণ্ড গভীর এক খাদ। অন্ধকারে আর দু-পা এগিয়ে গেলেই তারা নিশ্চয় খাদের মধ্যে পড়ে যেত। বাড়ি গিয়ে মা-কে এই কথা বলতে মা বললেন—উনি নিশ্চয় স্বর্গের দেবদূত—ছোট ছেলেমেয়েদের যাতে ইষ্ট হয় তাই দেখেন।

    সাদা গোলাপ আর লাল গোলাপ তাদের মা-র কুটির এত পরিষ্কার করে রাখত যে দেখে আনন্দ হত। গ্রীষ্মকাল এলে প্রতিদিন সকালবেলা লাল গোলাপ ঘর গোছগাছ করে ওঠবার আগেই একটি ফুলের মালা মায়ের বিছানায় পেতে দিত আর সেই মালায় থাকত দুটি গোলাপ গাছের একটি করে কুঁড়ি। শীতকাল এলে প্রতিদিন সকালে সাদা গোলাপ আগুন জ্বালিয়ে কাতলিতে জল ভরে ফুটোতে দিত; আর তাদের তামার কাতলিকে সব সময় ঘষে ঘষে এমনই চকচকে করে রাখত যে দেখে মনে হত সোনার।

    সন্ধ্যাবেলায় যখন তুলোর মত বরফ পড়তে থাকত, মা বলতেন—যাও মা সাদা গোলাপ, দরজায় খিল দিয়ে এস। তারপর তারা সবাই মিলে আগুনের ধারে বসলে মা চোখে চশমা লাগিয়ে একটা মস্ত বই নিয়ে পড়তে শুরু করতেন আর মেয়েরা চরকা কাটতে থাকত। তাদের পাশে শুয়ে থাকত একটি ভেড়ার বাচ্চা আর তাদের পিছনে ঝোলানো দাঁড়ে ডানার নিচে মাথা গুঁজে চুপটি করে পড়ে থাকত সাদা একটি পায়রা।

    এমনি একদিন, যখন সবাই তারা আরাম করে বসে আছে, সেই সময় দরজায় কে ধাক্কা দিলে। কে যেন ভিতরে আসতে চায়।

    মা বললেন—শিগগির ওঠ লাল গোলাপ! দরজা খুলে দাও! নিশ্চয় বাইরে কোন অতিথি দাঁড়িয়ে। আশ্রয় চাইছেন।

    লাল গোলাপ উঠে গিয়ে খিল তুলে দরজা খুলে দিলে। ভাবলে বাইরে কোন অসহায় পথিক দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু পথিকের বদলে প্রকাণ্ড এক ভাল্লুক তার মাথা বাড়িয়ে দিলে। লাল গোলাপ চিৎকার করে ভয়ে পিছিয়ে গেল। ভেড়ার বাচ্চাটা ডেকে উঠল। পায়রাটা দাঁড়ে লট্‌-পট্‌ করে উঠল। সাদা গোলাপ মায়ের বিছানার পিছনে গিয়ে লুকোলো।

    কিন্তু ভাল্লুক মানুষের গলায় বললে—ভয় পেয়ো না তোমরা। আমি তোমাদের কোন অনিষ্ট করব না। আমি শীতে প্রায় জমে গেছি, তাই ভিতরে এসেছি শুধু একটু গরম হবার জন্যে।

    মা বললেন— আহা! বেচারা ভাল্লুক! ভিতরে এসে আগুনের ধারে বস। তবে দেখো বাপু, তোমার গায়ের লোম পুড়িয়ে ফেলো না যেন। তারপর তিনি মেয়েদের ডেকে বললেন—বেরিয়ে এস লাল গোলাপ সাদা গোলাপ। ভাল্লুক তোমাদের কিছু বলবেন না, উনি লোক ভাল।

    মেয়ে দুটি তখন কাছে এল। ভেড়ার বাচ্চা আর পায়রাও আস্তে আস্তে আগুনের ধারে এগিয়ে এল। ভালুককে দেখে আর ভয় পেল না।

    ভাল্লুক বললে—এদিকে এস তো খুকিরা! আমার লোম থেকে বরফগুলো ঝেড়ে ফেলে দাও তো!

    তারা ঝাঁটা এনে ভাল্লুকের গায়ের সমস্ত বরফ ঝেড়ে সাফ করে দিল। তখন হাত পা মেলে ভাল্লুক শুয়ে পড়ল আর একটু পরেই মেয়েরা সেই প্রকাণ্ড ভাল্লুকের সঙ্গে নানারকম খেলা জুড়ে দিলে। তার লম্বা জট ধরে টানতে লাগল। ভাল্লুকের গায়ে পা দিয়ে তাকে গড়িয়ে দিতে লাগল, এমনকি হেজেল গাছের লাঠি দিয়ে তাকে মারতেও লাগল। ব্যথা লাগলে ভালুক ঘোঁৎ করতে মেয়েরা খিল-খিল করে হেসে গড়াতে থাকল। ভাল্লুক ভাল মেজাজে সবই সহ্য করতে থাকল। শুধু তারা যখন খুব জোরে তাকে মারল ভাল্লুক তখন ছড়া কেটে বললে—

    গোলাপ-খুকি
    জানো না কি
    মারতে আমায় নেই যে লাঠি দিয়ে,
    আমায় মেরে
    ফেললে পরে
    তোমাদের আর হবে না যে বিয়ে!

    যখন ঘুমোবার সময় হল, সকলে যখন ঘুমোতে গেল, মা ভাল্লুককে বললেন—তুমি বাছা এই আগুনের ধারেই শুয়েই থাকো; তাহলে আর তোমার ঠাণ্ডা লাগবে না।

    যেই সকাল হল খুকিরা ভাল্লুককে বার করে দিলে। ভাল্লুকও বরফের মধ্যে দিয়ে নড়বড় করতে প্রতে চলে গেল। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ঠিক এক সময়ে ভাল্লুক আসতে লাগল। আগুনের ধারে সে বসে থাকত আর লাল গোলাপ সাদা গোলাপ মনের আনন্দে তার সঙ্গে খেলা করত। শেষে ভাল্লুকের সঙ্গে এত জানাশোনা হয়ে গেল যে যতক্ষণ না তাদের কালো ভাল্লুক-বন্ধু আসে ততক্ষণ তারা দরজায় খিলই দিত না।

    কিন্তু তারপর যেই বসন্তকাল এল আর বাইরের সবকিছু সবুজে ঢেকে গেল, ভাল্লুক একদিন সকালবেলা সাদা গোলাপকে বললে—এইবার আমি বিদায় নেব। সারা গ্রীষ্মকাল আর ফিরতে পারব না।

    সাদা গোলাপ বললে—কোথায় চললে তুমি ভাল্লুক-বন্ধু?

    —আমায় যেতে হবে বনের মধ্যে যেখানে আমার ধনরত্ন লুকোনো আছে। বনের দুষ্ট বামনদের হাত থেকে তা আমায় বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যতক্ষণ শীত ছিল মাটি ছিল শক্ত, বামনরা নিজেদের গর্তে লুকিয়ে ছিল, মাটি খোঁড়া সহজ ছিল না। এখন রোদের তেজে বরফ গলেছে। মাটি গরম হয়ে নরম হয়েছে। বামনরা ইচ্ছে করলেই মাটি খুঁড়ে সবকিছু চুরি করে নিয়ে পালাতে পারে। আর একবার তাদের হাতে কিছু পড়লে তাদের গুহার মধ্যে কোথায় যে সব লুকিয়ে ফেলে কিছু খুঁজে বার করা যায় না।

    ভাল্লুকের বিদায়ে সাদা গোলাপের মন খারাপ হয়ে গেল। সে এত আস্তে আস্তে দরজা খুলল যে ভাল্লুক যখন তার গোটা শরীর নিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে ঠেলে বেরোতে যাবে, তখন ছিটকিনিতে লেগে তার একগোছা লোম গেল ছিঁড়ে। গায়ের যেখান থেকে তার লোম উঠে গেল, সাদা গোলাপের মনে হল তারই ফাঁক দিয়ে সে যেন দেখতে পেলে সেই ফাঁকে নিচে সোনা চকচক করছে। কিন্তু সত্যি সোনা কি না তা সে বুঝতে পারলে না। ভাল্লুক তার আগেই হুড়মুড় করে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

    এর কিছুদিন পরে বিধবা তার মেয়েদের বনে পাঠালো শুকনো কাঠি কুড়িয়ে আনবার জন্যে। কাঠি কুড়োতে কুড়োতে তারা দেখে, পথ জুড়ে মস্ত এক গাছ পড়ে রয়েছে আর তার গুঁড়ির কাছে ঘাসের উপর কি একটা তুড়ুক-তুড়ুক করে লাফাচ্ছে। জিনিসটা কী দেখবার জন্যে কাছে গিয়ে দেখে, ছোট্ট এক বামন। মুখের চামড়া তাঁর কুঁচকোনো, লম্বা সাদা দাড়ি প্রায় দু-হাত ঝুলছে। দাড়ির ছুঁচোলো দিকটা একটা চেরা কাঠের মাঝখানে আটকে গেছে বলে ছোট্ট বামনটা শিকলে বাঁধা কুকুরের মতো তড়াক-তড়াক করে লাফাচ্ছে। কেমন করে যে দাড়ি ছাড়িয়ে নেবে বুঝতে পারছে না।

    মেয়ে দুটির দিকে সে কটমট করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললে—হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? আমাকে ছাড়িয়ে না দিয়েই চলে যাবে নাকি?

    লাল গোলাপ জিজ্ঞাসা করল—তুমি করছিলে কী বামন-ভাই?

    বামন বললে—ওরে গরু, এই গাছটাকে আমি ফাঁড়ছিলুম রান্নার কিছু কাঠ নেবার জন্যে। তোদর মতো তো বড়-বড় কাঠের কুঁদো দিয়ে উনুন জ্বাললে আমাদের চলে না। তাহলে আমাদের রান্না সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর তোদের মতো অমন রাক্ষসের খাবারও আমরা লোভীর মতো খাই না। কাঠটাকে চিরে একটা কাঠের গোঁজ দিয়েছি। বেশ কাজ হচ্ছিল। গোঁজটা এত মসৃণ যে কখন চেরা কাঠের ফাঁক থেকে পিছলে বেরিয়ে গেছে টেরও পাইনি। দেখ দিকি, আমার অমন সুন্দর দাড়িটা আটকে গেছে! কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেসো না বলছি! ও কী বিশ্রী দেখতে তোদের!

    মেয়েরা অনেক চেষ্টা করলে বামনের দাড়িটা ছাড়িয়ে দেবার। কিন্তু চেরা কাঠ এমন এঁটে বসেছিল যে কোন ফল হল না। লাল গোলাপ তখন বললে—দেখি আমি কাউকে ডেকে আনি গিয়ে!

    বামন হাত-পা ছুঁড়ে বললে—ওরে তোদের মাথায় কি শুধুই গোবর? দু-জনে হয় না আবার লোক জড় করতে চাইছিস! ভেবে দেখ্‌ না আর কিছু করতে পারিস কি না!

    সাদা গোলাপ বললে—ব্যস্ত হবার দরকার নেই, আমি ভেবে নিয়েছি কী করা যায়। বলে তার কাঁচি বার করে কচাৎ করে বামনের দাড়ির আগাটা কেটে দিলে।

    ছাড়া পেতেই বামন তার সোনা-ভর্তি যে বস্তাটা গাছের গুঁড়ির কাছে পড়ে ছিল সেটা তুলে নিলে আর তা কাঁধে ফেলে গট্‌মট্‌ করে চলে গেল বলতে বলতে— মাথায় যদি একটুও বুদ্ধি থাকে! আমার এমন সুন্দর দাড়িটা কেটে ফেললে গা! মেয়ে দুটির দিকে একবার সে ফিরেও তাকালো না।

    কিছুদিন পরে সাদা গোলাপ আর লাল গোলাপ মাছ ধরতে গেছে। পুকুরের ধারে এসে দেখে, প্রকাণ্ড একটা গঙ্গাফড়িং-এর মতো কি পুকুরের পাড়ে তিড়িংতিড়িং করে লাফাচ্ছে, মনে হয় যেন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। তারা দৌড়ে গেল, গিয়ে দেখল, আবার সেই বামন।

    লাল গোলাপ বললে— করছ কী বামন-ভাই? এখনি যে জলে পড়ে যাবে!

    বামন বললে—তোদের মত বুদ্ধি হলেই হয়েছিল আর-কি! ওরে মুখ্যু, দেখতে পাচ্ছিস না, ঐ মাছটা আমায় জলে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে?

    বামনটি জলের ধারে বসে বসে মাছ ধরছিল। কখন বাতাসে তার লম্বা দাড়ি ছিপের সুতোর সঙ্গে পাক খেয়ে জড়িয়ে গেছে, আর ঠিক সেই সময় মস্ত এক মাছ এসে গিলেছে টোপ। মাছ টোপ গিলে জলে পালাতে চায় ছিপের সুতোর সঙ্গে দাড়ি-শুদ্ধ টেনে। অত বড় মাছের সঙ্গে ঐটুকু বামন পারবে কেন? ঘাসের চাপড়া, নালের ভাঁটা ধরে এতক্ষণ নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু মাছ ক্রমেই তাকে টেনে দিয়ে যাচ্ছে জলের কাছে। ডুবেই যেত, কি ভাগ্যিস মেয়ে দুটি এসে পড়ে বামনের দাড়ি ধরে ফেললে। ছিপের সুতো থেকে দাড়ি ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করলে তারা, কিন্তু এমনই জড়িয়ে গেছে যে দেখলে তা অসম্ভব। তখন মেয়েটি আবার তার কাঁচি বার করে বামনের আরও একটুকরো দাড়ি কেটে দিলে।

    ছাড়া পেয়েই বামন রাগে চিৎকার করতে লাগল—কোথাকার গর্দভ। আমার চেহারাটা খারাপ করে তবে কি ছাড়বি? একবার দাড়ির আগা কেটেছিস—তাই কি যথেষ্ট হয়নি? এবার যে অর্ধেকটা কাটা গেল গাধা! আমি এখন লোকের কাছে মুখ দেখাই কী করে? ওরে, এখানে আসবার আগে তোদের মাথায় বাজ পড়েনি কেন?

    বলেই, নলখাগড়ার বনের মধ্যে মুক্তোভরা একটা বস্তা পড়েছিল, সেটা পিঠে তুলেই আর একটি কথাও না বলে একটা পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    তারপর মেয়ে দুটি এক ভীষণ চিৎকার শুনতে পেল। দৌড়ে গিয়ে দেখে, এক ঈগল পাখি তাদের সেই বামনটিকে ধরে উড়িয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। মেয়ে দুটি তাড়াতাড়ি বামনের ঠ্যাং চেপে ধরল। বেশ খানিকটা ঝটাপটির পর যখন ঈগল দেখলে আর পারে না, তখন সে বামনকে ছেড়ে দিয়ে উড়ে পালালো।

    বামন এদিকে সংবিৎ ফিরে পেতেই চিৎকার শুরু করল—অত জোরে চেপে ধরতে হয় নাকি? দেখ দিকিনি, ঈগলের নখের টানাটানিতে আমার এমন সুন্দর খয়েরি কোটটা ছিঁড়ে গেল! এখানে ফুটো, ওখানে গর্ত! যাতে হাত দেবে তাতেই কি একটা লোকসান ঘটাবে মুখ্যুর দল।

    বলেই মাটি থেকে হীরে-মানিক-ভরা একটা বস্তা তুলে নিয়ে পাহাড়ে, তার গুহার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    বামনের ব্যবহার আর অকৃতজ্ঞতা দেখে দেখে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল মেয়ে দুটির। তারা কিছু না বলে শহরের দিকে চলে গেল। শহর থেকে বেরোবার পথে আবার সেই মাঠের ধারে বামনের সঙ্গে দেখা। বামন তখন তার বস্তার মধ্যেকার যত কিছু সম্পত্তি একটা নিরালা পরিষ্কার জায়গা দেখে ঢেলেছে। ভেবেছে কাছে কেউ নেই। রোদের আলোয় নানা রঙের দামি পাথরগুলি এমন চক্‌চক্‌ করছে যে মেয়ে দুটি দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

    রাগে মুখ টকটকে লাল করে বামন বললে—ওখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছ কী? এই বলে সে মেয়ে দুটিকে যা খুশি তাই বলে গালাগালি দিতে শুরু করলে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটা ঘড়ঘড়ানি শব্দ শোনা গেল আর দেখা গেল, বনের মধ্যে থেকে প্রকাণ্ড কালো একটা ভাল্লুক বেরিয়ে আসছে। বামন ভয়ে লাফিয়ে পালাতে যাবে, কিন্তু তার গুহায় ঢোকবার আগেই ভাল্লুক তাকে ধরে ফেললে।

    তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বামন বললে—হে ভাল্লুক-দেব, আমার প্রাণ নেবেন না! আমার যা কিছু আছে সব আপনাকে দেব। এই দেখুন কত দামি দামি পাথর পড়ে রয়েছে। এগুলি নিয়ে আমায় ছেড়ে দিন। আমার মতো ছোট্ট প্রাণীকে আপনার কিসের ভয়? আমাকে খেলে আপনার দাঁতের ফাঁকও ভরবে না। বরং এই দুটি দুষ্টু মেয়েকে আপনি নিন। ওদের দিয়ে বেশ আপনার পেট ভরবে। কচি হাঁসের মতো মোটা-সোটা মাংস খেতেও ভাল হবে। ওদেরই খান আপনি দয়া করে।

    ভাল্লুক কোন কথার জবাব না দিয়ে বামনকে এমন এক থাবড়া মারল যে সে আর নড়লও না চড়লও না।

    মেয়ে দুটি পালাতে যাবে, ভাল্লুক তাদের ডাকল—সাদা গোলাপ, লাল গোলাপ, ভয় পেয়ো না। দাঁড়াও আমি তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি।

    মেয়েরা তার গলা শুনে চিনতে পারল। তারা থমকে দাঁড়ালো। ভাল্লুক তাদের কাছে এসে দাঁড়াতেই তার খসখসে লোমের আবরণ গা থেকে খসে পড়ে গেল, আর তার মধ্য থেকে বেরিয়ে এল লম্বা একটি মানুষ—সারা গা তার সোনার পোশাকে মোড়া।

    তিনি বললেন—আমি রাজার ছেলে। এই বামনের শাপে বনের মধ্যে ভাল্লুক হয়ে ঘুরেছি। আমার সমস্ত সম্পত্তি ঐ বামন চুরি করেছে। বামন মরতে আজ আমি ছাড়া পেলুম। যেমন কর্ম, বামন তেমনি তার ফল পেল।

    তারপর তারা বাড়ি গেল। সাদা গোলাপের বিয়ে হল রাজপুত্রের সঙ্গে, আর লাল গোলাপের তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে। বামন যত ধন-রত্ন জমিয়েছিল তার সব এরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। বিধবার মা মেয়েদের কাছে গিয়ে রইলেন।

    তাঁর কুটিরের সামনে যে দুটি গোলাপ-ঝাড় ছিল তাদের তুলে এনে রাজপ্রাসাদের সামনে লাগিয়ে দেওয়া হল। প্রতি বছর তাতে ফুটত অপূর্ব লাল আর সাদা গোলাপ ফুল।

    টীকা