Chapter Index

    একদিন এক ভাল্লুক আর নেকড়ে বনের মধ্যে দিয়ে বেড়াচ্ছিল। তখন গ্রীষ্মকাল! ভাল্লুক শুনতে পেল আকাশে কোন একটি পাখি ভারি মিষ্টি করে গান গাইছে। ভাল্লুক বললে—নেকড়ে ভাই, এমন সুন্দর গাইছে ও পাখিটি কী?

    —উনি হচ্ছেন পাখিদের রাজা। এসো আমরা ওঁকে প্রণাম জানাই। আসলে সেটি ছিল একটি দোয়েল।

    ভাল্লুক বললে—তা যদি হয়, আমি তাহলে ওঁর রাজপ্রাসাদ দেখতে চাই। চল ভাই, আমায় নিয়ে চল সেখানে।

    নেকড়ে বললে—অত সহজে তো হয় না! আগে রানী ফিরুন, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

    একটু পরেই রানীকে দেখা গেল। ঠোঁটে করে তিনি খাবার নিয়ে ফিরছেন। রাজা উড়ে এসে রানীর সঙ্গে গেলেন বাসায় বাচ্চাদের খাওয়াতে। ভাল্লুকের ইচ্ছে তখনই গিয়ে দেখা, কিন্তু নেকড়ে তার লোম ধরে টেনে বললে—এখন নয়। আগে রাজা রানী উড়ে চলে যান, তারপর।

    তারা বাসাটা কোথায় ভাল করে দেখে নিয়ে ফিরে গেল। কিন্তু ভাল্লুক যতক্ষণ পর্যন্ত না রাজপ্রাসাদ দেখতে পাচ্ছে ততক্ষণ তার মনে স্বস্তি নেই। একটু পরেই সে আবার ফিরে এল। রাজা রানী তখন চলে গেছেন। ভাল্লুক উঁকি মেরে দেখল, পাঁচ-ছটা বাচ্চা বাসার মধ্যে শুয়ে রয়েছে।

    ভাল্লুক বলে উঠল—এই বুঝি রাজপ্রাসাদ? আহা, প্রাসাদের কী ছিরি! আর তোমরা? তোমরা কি রাজপুত্তর নাকি? নিশ্চয় তোমাদের কেউ বদলে দিয়ে গেছে!

    বাচ্চারা শুনে একেবারে ক্ষেপে উঠল। তারা চিৎকার করে বললে—বদলে দিয়ে গেছে? কেন, আমাদের বাপ মারা চোর নাকি? দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমাদের মজা!

    ভাল্লুক আর নেকড়ে বেজায় ভয় পেয়ে গেল। তারা পিছন ফিরে দৌড় দিল তাদের গাড়ার দিকে।

    কিন্তু দোয়েলের বাচ্চাগুলো চিৎকার করেই চলল। তাদের বাপ মা-রা যখন খাবার ঠোঁটে করে ফিরল, তারা বললে—যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা বলছ আমরা তোমাদের আসল ছেলে কি না ততক্ষণ আমরা ঠোঁটে করে মাছির ঠ্যাংটি পর্যন্ত কাটব না—তাতে উপোসীই থাকি আর যাই থাকি। ভাল্লুক আমাদের যা নয় তাই বলেছে!

    বুড়ো রাজা বললেন—বেশ, এখন চুপ কর। ব্যবস্থা করছি। বলে তিনি রানীকে সঙ্গে করে ভালুকের গাড়ায় উড়ে গেলেন। গিয়ে বললেন—ভালুকমশায়, আপনি কেন আমাদের ছেলেদের গালিগালাজ করেছেন? এর ফল ভাল হবে না—এর থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবে!

    কাজেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হল আর যত চারপেয়েরা ছিল সবাই এক হল—গরু, গাধা, ষাঁড়, হরিণ যেখানে যত পশু আছে।

    এদিকে দোয়েল ডেকে পাঠালো আকাশে যত প্রাণী উড়ে বেড়ায় সবাইকে। শুধু যে ছোট বড় পাখিদের ডেকে পাঠালো তা নয়—মৌমাছি, বোলতা, ভোমরা, ভীমরুল এদেরও।

    যুদ্ধ আরম্ভ হবার ঠিক আগে দোয়েল চর পাঠিয়ে দিল দেখে আসতে বিপক্ষের সেনাপতি কোথায়। সবচেয়ে চতুর ছিল ভীমরুল। যে বনে শত্ৰুদল জড় হয়েছিল সেইখানে গিয়ে তারা লুকিয়ে রইল।

    ভাল্লুক শেয়ালকে ডেকে পাঠিয়ে বললে—তুমিই হচ্ছ জন্তুদের মধ্যে সবচেয়ে চালাক। তুমিই হবে আমাদের সেনাপতি। তুমিই আমাদের চালনা করবে।

    শেয়াল বললে—বেশ। কিন্তু আমাদের সিগন্যাল কী হবে? সিগন্যাল যে কী হবে কেউ কিছু বলতে পারল না। তখন শেয়াল বললে—এই দেখ সবাই, আমার একটি লম্বা রোঁয়াওয়ালা মোটা ল্যাজ আছে—লাল পালকের ঝাঁটার মতো। এই ল্যাজ আমি যতক্ষণ খাড়া করে রাখব ততক্ষণ বুঝবে যে সব ঠিক আছে—সবাই মার্চ করে এগিয়ে আসবে। কিন্তু যদি দেখ ল্যাজ নুয়ে পড়েছে তাহলে যত জোরে পারো পালিয়ে যেয়ো।

    এই শুনে ভীমরুলরা শাঁ-শাঁ করে উড়ে গিয়ে দোয়েলের কানে খবরটা পৌঁছে দিল।

    সকাল হতেই চারপেয়েরা সব যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে এল। এমনভাবে পা ঠুকে ঠুকে তারা এল যে তার ফলে মেদিনী কম্পমান। দোয়েল আর তার দলও বাতাস কেটে উড়ে এল। তাদের সবাইকার ডানার শব্দও বড় কম ভয়ঙ্কর হল না।

    তারপর এগিয়ে গেল উভয় দল উভয় দলের দিকে।

    দোয়েল ভীমরুলকে পাঠিয়ে দিল যাতে সে শেয়ালের ল্যাজের নিচে বসে যত জোরে পারে হুল ফুটিয়ে দেয়।

    প্রথম হুলের খোঁচা খেয়ে শেয়াল একটু কেঁপে একটা পা আকাশে তুলল। কিন্তু তবু বীরের মতো সে ল্যাজটাকে খাড়াই রাখল। দ্বিতীয় হুলের খোঁচায় চকিতের মতো তাকে একবার ল্যাজ নামাতে হয়েছিল। তিনবারের বার সে আর সহ্য করতে পারল না। চিৎকার করে পায়ের মধ্যে ল্যাজ গুটিয়ে ফেললে। জন্তুরা তাই না দেখে ভাবলে, তবে তো আর আশা নেই! যে যেদিকে পারলে দৌড় দিলে।

    কাজেই পাখিরা জিতল লড়াইয়ে।

    লড়াই জিতে রাজা আর রানী রাজপুত্রদের কাছে উড়ে গিয়ে বললেন—বাছারা, আনন্দ কর! পেট ভরে খাও দাও! আমরা যুদ্ধে জিতেছি!

    কিন্তু দোয়েল-বাচ্চারা বললে—যতক্ষণ না ভাল্লুক এখানে এসে ক্ষমা চেয়ে বলবে যে আমরা তোমাদের আসল বাচ্চা, ততক্ষণ আমরা কিচ্ছু খাব না!

    দোয়েলরা ভাল্লুকের গাড়ায় উড়ে গিয়ে বললে—ভাল্লুকবুড়ো, তোমায় একবার আমাদের ছেলেদের কাছে এসে তাদের গালি দেওয়ার জন্যে ক্ষমা চেয়ে যেতে হবে। নইলে তোমার পাঁজরাগুলো ভেঙে গুড়ো করে দেব!

    ভাল্লুক বিষম ভয় পেয়ে বাচ্চাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইল। তখন দোয়েলের বাচ্চারা শান্ত হল। খেয়েদেয়ে ফুর্তি করল রাত পর্যন্ত।

    টীকা