চাষীর চালাক মেয়ে
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক ছিল চাষী, সে ছিল ভারি গরিব। তার ছোট একটি বাড়ি ছিল, কিন্তু একফোঁটা জমি ছিল না। তার ছিল একটি মাত্র মেয়ে। একদিন সেই মেয়ে বললে—আমার মনে হয় রাজা যদি জানতেন আমরা কত গরিব, তিনি নিশ্চয় আমাদের একটু পতিত জমি দিতেন। আমি কাউকে দিয়ে রাজার কানে কথাটা পৌঁছে দেব।
রাজা যখন শুনতে পেলেন চাষীটি কত গরিব তখন তিনি শুধুই যে তাকে একটু অ-চষা জমি দিলেন তাই নয়, সেইসঙ্গে খানিকটা ভাল ঘেসো জমিও দিলেন। বাপ আর মেয়ে যত্ন করে জমি চষল। তাদের ইচ্ছে তাতে ভুট্টা লাগাবে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ তারা একটি সোনার মোহর পেয়ে গেল। বাপ সেটি কুড়িয়ে নিয়ে মেয়েকে বললে—রাজা যখন দয়া করে আমাদের জমিটি দিয়েছেন, আমাদের উচিত এই সোনার টুকরোটি তাঁকে দিয়ে আসা।
কিন্তু মেয়েটি বললে—না বাবা। এই সোনার কথা যদি আমরা বলি তাহলে দেখো আমাদের বিনি পয়সায় খাটতে হবে আর ভবিষ্যতে আমরা যা কিছু পাই সব দিয়ে দিতে হবে। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভাল।
চাষী মেয়ের কথা শুনল না। সোনার টুকরোটা নিয়ে গিয়ে রাজাকে দিলে। বললে—মহারাজ, যে জমিটি আপনি দয়া করে আমায় দিয়েছেন সেইখানেই এটা কুড়িয়ে পেয়েছি। আমার কৃতজ্ঞতা আর সম্মানের চিহ্ন স্বরূপ এটা গ্রহণ করুন।
রাজা সোনাটা নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—তুমি কি আরো মোহর পেয়েছ?
চাষী বললে—আজ্ঞে না।
কিন্তু রাজা বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন—সমস্ত সোনা আমার চাই। তুমি যা পেয়েছ তার সবটা যে আমায় দেবে না এ তো জানি। কাজেই যাও নিয়ে এস।
চাষী অনেক চেষ্টা করল রাজাকে বোঝাতে যে তার আর সোনা নেই। কিন্তু হাওয়ার সঙ্গে কথা বললেও একটু ফল হত। রাজা কোন কথা শুনলেন না; সেই গরিব সৎ লোককে জেলে পুরলেন। তাকে বলে দেওয়া হল, যতক্ষণ সে সমস্ত ধন এনে না দেয় তাকে ছাড়া হবে না। জেলরক্ষীদের বলে দেওয়া হল তাকে শুধু রুটি আর জল দিতে। জেলের কয়দিনের ঐ ছিল বরাদ্দ। কিন্তু চাষী রুটি বা জল কিছুই ছুঁতো না। সে শুধু কাঁদত এই বলে—হায়, যদি আমি আমার মেয়ের কথা শুনতুম! হায়, যদি আমি আমার মেয়ের কথা শুনতুম!
জেলরক্ষীরা তাই শুনে রাজার কাছে গিয়ে চাষী কী বলে সারাদিন কাঁদে তাই জানালো। বললে, কয়েদি রুটি জল কিছুই ছোঁয় না। রাজা তাকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন—কী বলেছে তোমার মেয়ে যা শুনলে তোমার উপকার হত?
চাষী বললে—আমার মেয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে আমি যদি ঐ একটু সোনার টুকরো রাজার কাছে নিয়ে যাই তাহলে পরে আর যা কিছু পাব সবই আমাদের দিয়ে দিতে হবে।
রাজা বললেন—তোমার মেয়ে এত চালাক নাকি? তবে এখনি তাকে ডেকে পাঠাও, আমি দেখতে চাই।
চাষীর মেয়ে এল। রাজা তাকে দেখে বেশ খুশি হলেন। তার সঙ্গে দু-চারটি মিষ্টি কথা বলে বললেন—লোকে বলে তুমি নাকি ভারি চালাক। তোমায় একটি ধাঁধা দিচ্ছি ভাঙতে। যদি ভাঙতে পারো তাহলে তুমি আমার রানী হবে।
চাষীর মেয়ে বললে—চেষ্টা করে দেখব মহারাজ।
রাজা বললেন—বেশ, তাহলে আমার কাছে আসবে—পোশাক পরেও নয় পোশাক ছাড়াও নয়। কোন কিছুতে চড়েও নয়, হেঁটেও নয়। বড় রাস্তা দিয়েও নয়, পায়ে-চলা পথেও নয়। এইসব যদি করতে পারো তাহলে তোমায় আমি বিয়ে করব।
চাষার মেয়ে তখনই বাড়ি গেল। গিয়ে কাপড় খুলে একটি মস্ত সুতোর ফেটি বার করলে। তারপর সর্ব অঙ্গ জড়ালো সুতোর ফেটি দিয়ে, কিচ্ছু বাকি রাখল না। তারপর প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা গাধা চেয়ে নিলে। গাধার ল্যাজে বাঁধল সুতোর ফেটির শেষ অংশটা। গাধা তাকে টেনে নিয়ে চলল, কাজেই সে গাধার পিঠে চড়ল না, হাঁটলও না। মাটির উপর ছিল গাড়ির চাকার গভীর দাগ। গাধা তাকে এমনভাবে টেনে নিয়ে চলল, যাতে সে সব সময়ে দাগের মধ্যে থাকে, শুধু তার পায়ের বুড়ো আঙুলটি উপরের জমি ছুঁয়ে চলল। এইভাবে সে হাজির হল রাজার সামনে—পোশাক পরেও নয়, পোশাক ছাড়াও নয়, কিছুতে চড়েও নয়, হেঁটেও নয়, রাস্তা দিয়েও নয়।
রাজা তাকে দেখে বললেন—ধাঁধা তুমি ঠিকই ভেঙেছ। শর্ত অনুসারে রাজা তাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন। চাষীকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল। রাজা চাষীর মেয়েকে বিয়ে করে তাকে এবং তার বাবাকে সব রকম রাজকীয় সম্মান দিলেন।
তারপর এক বছর কেটে গেল। একদিন রাজা তাঁর পারিষদদের নিয়ে তাঁর প্রাসাদের সামনে বেড়াচ্ছিলেন। একদল চাষীর কাছ থেকে রাজবাড়ির জন্যে কাঠ কেনা হয়েছিল, তারা তাদের গাড়ি নিয়ে প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কতকগুলি গাড়িতে জোতা ছিল গরু, কতকগুলি গাড়িতে ঘোড়া। তাদের মধ্যে একজন চাষী ছিল, তার ছিল দুটি ঘোড়া আর একটি ঘোড়ার বাচ্চা। কখন যেন ঘোড়ার বাচ্চাটা পালিয়ে গিয়ে আরেক জনের দুই গরুর মাঝখানে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। এই নিয়ে লাগল এক ভীষণ ঝগড়া চাষীদের মধ্যে। যার গরু সে বললে যে বাচ্চাটা তার গরুদের। ঘোড়া যার সে বললে বাচ্চাটা তার ঘোড়াদের, কাজেই তার সম্পত্তি। চেঁচামেচি ঝগড়া লড়াই এমন বেড়ে উঠল যে শেষ অবধি সবাই তাদের রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজা রায় দিলেন এই বলে যে বাচ্চাটা যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেইখানেই থাকবে। যদি গরুর কাছে পাওয়া গিয়ে থাকে তাহলে গরু যার বাচ্চাটাও তারই হবে। ঘোড়াওলা ঘোড়ার বাচ্চা হারানোর দুঃখে মনে মনে অনুযোগ করতে করতে বাড়ি গেল। তার কানে এল যে যিনি রানী, একসময় যদিও চাষীর মেয়ে ছিলেন তাহলেও তিনি অতি দয়াবতী। চাষী রানীর কাছে গিয়ে বললে—মহারানী, আমার ঘোড়ার বাচ্চাটি হারিয়েছি। আপনি ছাড়া কে আর উদ্ধার করে দিতে পারবে? রানী সব শুনে বললেন—পারব, কিন্তু এই শর্তে যে আমি সাহায্য করেছি এ কথা কাউকে বলবে না।
রানী বললেন—কাল ভোরবেলা রাজা যখন তাঁর পারিষদদের নিয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে বেড়াবেন তুমি তখন রাস্তার উপর এমন জায়গায় দাঁড়াবে যাতে সবাই তোমায় দেখতে পান। হাতে একটা মাছ-ধরা ছিপ নিয়ে যেয়ো আর রাস্তার ধারে যে শুকনো নালাটা আছে, ভাব দেখাবে যেন তাতে কত মাছ ধরছ। ছিপ ধরে টান দেবে, রীলে সুতো গোটাবে; এমনভাবে এইসব করবে যেন মাছ টোপ খেয়েছে। আর রাজা কিংবা আর কেউ যদি তোমায় জিজ্ঞেস করেন কী করছ, তাহলে তাঁকে আমি যা বলছি ঠিক-ঠিক সেই উত্তর দিয়ো। এই বলে রানী তাকে বলে দিলেন কী উত্তর দিতে হবে।
কাজেই পরদিন চাষী রাস্তায় বসে শুকনো নালায় ছিপ ফেলে মাছ ধরা শুরু করে দিলে। রাজা সেখানে আসতেই তাঁর চোখে পড়ল। তিনি তাঁর অনুচরদের পাঠিয়ে দিলেন জিজ্ঞেস করে আসতে, উজবুকটা ওখানে কী করছে।
চাষী বললে—কেন, মাছ ধরছি।
অনুচর বললে—মাছ ধরছ? জল কোথায়? এখানে যদি এক বছরও বসে থাকো তাহলেও কোন মাছ উঠবে না!
চাষী বললে—আরে ভাই, গরু যদি ঘোড়ার বাচ্চার মা হতে পারে তাহলে জল না থাকলেও মাছ ধরা এমন কিছু শক্ত নয়।
শুনে অনুচর ফিরে গিয়ে রাজাকে জানালো চাষীর উত্তর। রাজা তাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—দেখ, আমি নিশ্চয় জানি ওরকম উত্তর তোমার মাথা থেকে বেরুবে না। কে তোমায় শিখিয়ে দিয়েছে শিগগির বল।
কিন্তু চাষী কিছুতেই স্বীকার করতে চাইল না যে উত্তরটা তার নিজের নয়। কাজেই রাজার সামনে থেকে তাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বেদম পেটানো হল, তার উপর অত্যাচার করা হল, শেষে তাকে শিকলে বেঁধে রাখা হল। শেষে সে আর সহ্য করতে না পেরে বলে দিল যে রানী তাকে বলে দিয়েছিলেন কী বলতে, কী করতে হবে।
রাজা রাজপুরীতে ফিরেই বিষম ক্রোধে রানীর কাছে গেলেন। গিয়ে বললেন—তুমি আমায় বঞ্চনা করেছ! একজন চাষীর সঙ্গে চক্রান্ত করে আমায় অপমান করেছ! এখন যেখান থেকে তুমি এসেছ সেইখানে চাষী-বাড়িতে ফিরে যাও। আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী নও!
রাজা তারপর বললেন—প্রাসাদ থেকে যাবার সময় যে জিনিস তোমার সবচেয়ে প্রিয় তা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারো। সেটাই হবে তোমার আমার কাছ থেকে বিদায় উপহার।
রানী বললেন—মহারাজের যেমন অভিরুচি তাই হবে।
তারপর রানী রাজার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন—এখনি আমি যাবার জন্যে তৈরি। শুধু যদি তুমি রাজি থাকো, যাবার আগে দু-জনে এক পাত্র করে সরাব খেয়ে যাব—সেই হবে আমার বিদায়-পান।
রানী একপাত্র সরাবের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রাজার সামনে ধরে দিলেন। রাজা লম্বা চুমুক দিয়ে পান-পাত্র শেষ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হলেন গভীর ঘুমে অচৈতন্য। রানী রাজাকে সাদা চাদরে ঢেকে একজন চাকরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন—রাজাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফটকে যে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাতেই শুইয়ে দাও। রানী নিজেও সেই গাড়িতে উঠে হুকুম দিলেন—আমার বাবার কুটিরে নিয়ে চল।
রাজা অনেকক্ষণ ঘুমের পর যখন চোখ মেলে চাইলেন, দেখেন তিনি একা। তিনি চেঁচিয়ে বললেন—কোথায় আমি?
চাকরদের ডাকলেন। কেউ এল না। শেষে তাঁর স্ত্রী ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে এসে বললেন—মহারাজ, রাজ্যেশ্বর, তুমি বলেছিলে প্রাসাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে যা প্রিয় বস্তু তাই নিয়ে আসতে। তোমার চেয়ে প্রিয় পৃথিবীতে তো আর কিছুই নেই—তাই তোমায় এনেছি।
শুনে রাজার চোখ জলে ভরে এল। তিনি বললেন—আজ থেকে আর আমরা কাছ-ছাড়া হব না। তুমি চিরদিন আমারই থাকবে।
রানীকে নিয়ে রাজা রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন।