ব্যাঙ ও রাজকন্যা
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাঅনেকদিন আগের কথা। তখনকার দিনে মানুষ মনে মনে কিছু চাইলে অনেক সময় পেয়ে যেত। এ হচ্ছে সেই সময়কার কথা। সেই সময় ছিলেন এক রাজা। তাঁর মেয়েরা ছিল সবাই সন্দরী, কিন্তু ছোট মেয়েটি এতই সুন্দরী ছিল যে যে-সূর্যদেব জগতের এত কিছু দেখেছেন, তিনি যখন মেয়েটির উপর তাঁর কিরণ ছড়িয়ে দিতেন তিনিও অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। রাজপ্রাসাদের কাছে এক প্রকাণ্ড অন্ধকার উপবন ছিল আর সেই উপবনে এক বুড়ো লিনডেন গাছের তলায় মাটি খুঁড়ে বেরোতো এক ঝর্নার কলকলে জল। যেদিন গরম পড়ত, ছোট রাজকন্যা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে ঝর্নার ঠাণ্ডা পাড়টিতে গিয়ে বসতেন। বসে থাকতে থাকতে যখন মনে হত সময় আর কাটতে চাইছে না, তখন তিনি একটা সোনার গোলা বার করে লোফালুফি খেলতেন। এই খেলাটি ছিল তাঁর ভারি প্রিয়।
একদিন হল কী, রাজকন্যা যখন সোনার গোলা ছুঁড়ে খেলা করছেন, একবার হাত ফস্কে গোলাটা মাটিতে পড়ল আর গড়াতে গড়াতে একেবারে ঝর্নার জলের মধ্যে। রাজকন্যা ঝর্নার কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখলেন, এত গভীর তার জল যে তার তলাই দেখা যায় না। গোলার শোকে রাজকন্যার চোখে জল এল। সেইখানে বসে তিনি এমনই কাঁদতে লাগলেন যে মনে হল কেউই তাঁকে সান্ত্বনা দিতে পারবে না।
কাঁদছেন, কাঁদছেন, কান্নার মাঝখানে তিনি শুনতে পেলেন কে যেন বলছে— কিসের কষ্ট তোমার রাজার কন্যে? তোমার চোখের জলে যে মনে হয় পাথরও গলে যাবে!
রাজকন্যা মুখ ঘোরালেন দেখতে, কোথা থেকে শব্দটা আসছে। তাঁর চোখে পড়ল একটা ব্যাঙের বিশ্রী মাথা। জলের উপর দিয়ে সেটা উঁকি দিচ্ছে। আর কিছু দেখতে পেলেন না।
তিনি বললেন— “ও, তুমি বুঝি ব্যাঙ-বুড়ো? শোনো ব্যাঙ-বুড়ো, আমার সোনার গোলাটি জলের মধ্যে পড়ে গেছে, তাই কাঁদছি।’’
ব্যাঙ বললে— পড়েছে তো হয়েছে কী? কেঁদো না। আমি তোমায় সাহায্য করব। কিন্তু বল কী দেবে? যদি তোমার সোনার গোলা তুলে দিতে পারি তো বল আমায় কি দিয়ে খুশি করবে?
রাজকন্যা বললেন— যা তুমি চাও তাই দেব ব্যাঙ-ভাই। আমার কাপড়-চোপড়, আমার হীরে মুক্তো, চাই কি আমার মাথার সোনার মুকুটটিও দিতে পারি।
ব্যাঙ বললে— তোমার কাপড়, তোমার হীরে মুক্তো, তোমার মাথার মুকুট নিয়ে আমি ব্যাঙ কী করব? কিন্তু তুমি যদি আমায় ভালবেসে তোমার সঙ্গী করে নাও, তোমার খেলার সাথী করে নাও, যদি তোমার খাবার টেবিলে আমায় পাশে বসতে দাও, তোমার খাবার থালা থেকে, তোমার দুধের পেয়ালা থেকে আমায় খেতে দাও আর তোমার বিছানায় তোমার পাশে শুতে দাও, এইসব যদি অঙ্গীকার কর তাহলে আমি ঝর্নার জলে ডুব দিয়ে তোমার হারানো গোলা তুলে আনতে পারি।
রাজকন্যা বললেন— হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সব অঙ্গীকার করছি। যা চাও তাই দেব শুধু যদি আমার গোলাটিকে উদ্ধার করে দাও।
রাজকন্যা মনে মনে ভাবলেন— ভারি তো একটা ব্যাঙ! জলের মধ্যে থেকে গ্যাঙোর গ্যাঙোর করে অন্য ব্যাঙদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শুধু ডাকতেই পারে। ও কি আবার মানুষের খেলার সাথী হতে পারে নাকি!
ব্যাঙ রাজকন্যার প্রতিজ্ঞা শোনামাত্র এক ডুবে জলের তলায় চলে গেল আর খানিক পরে মুখে করে তুলে দিয়ে এল গোলাটা। তারপর সেটাকে ছুঁড়ে ঝর্নার বাইরে ঘাসের উপর ফেলে দিলে।
রাজকন্যার গোলা পেয়ে যা আনন্দ! তিনি সেটাকে লুফে নিয়ে ছুটতে ছুটতে রাজবাড়ির দিকে চলে গেলেন।
ঝর্নার মধ্যে থেকে ব্যাঙ চেঁচাতে লাগল— দাঁড়াও রাজকন্যে দাঁড়াও! আমাকে তুলে নিয়ে যাও! আমি কি তোমার মত অত জোরে ছুটতে পারি?
কিন্তু রাজকন্যা কানে নিলেন না সে চিৎকার। ব্যাঙের কথা তিনি তখন ভুলেই গেছেন। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে আর কিছুই তাঁর মনে রইল না। ব্যাঙ বেচারা ঝর্নার মধ্যেই রয়ে গেল।
পরদিন রাজকন্যা যখন রাজা আর সভাসদদের সঙ্গে মস্ত টেবিলে তাঁর সোনার থালা সামনে নিয়ে খেতে বসেছেন সেই সময় রাজপ্রাসাদের শ্বেতপাথরের সিঁড়িতে শোনা গেল কি যেন থপ্-থপ্ করে উঠছে। তারপরেই দরজায় ধাক্কা, আর কে যেন বলে উঠল— রাজার ছোট কন্যে, আমায় ভিতরে আসতে দাও
রাজকন্যা আসন ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি দেখতে গেলেন, কে। দরজা খুলে দেখেন, দরজার বাইরে বসে রয়েছে ব্যাঙ। রাজকন্যা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে বসে পড়লেন। মনে মনে তাঁর ভারি অস্বস্তি হতে লাগল।
রাজা লক্ষ করলেন। বললেন— কিসের এত ভয় মা? দরজার বাইরে কি তোমায় ধরে নিয়ে যাবার জন্যে কোনো দৈত্য দাঁড়িয়ে আছে?
রাজকন্যা বললেন— না বাবা, দৈত্য কেন হবে? একটা বিশ্রী ব্যাঙ।
রাজা বললেন— ব্যাঙ কী চায়?
রাজকন্যা বললেন— শুনুন বাবা, কাল যখন আমি ঝর্নার ধারে বসে আমার সোনার গোলা নিয়ে খেলছিলুম, হঠাৎ গোলাটা জলে পড়ে গিয়েছিল। আমার কান্না শুনে ব্যাঙ এসে আমার গোলা উদ্ধার করে দিল। আমি তাকে বললুম, তাকে আমার খেলার সাথী করে নেব। তাই বলে যে সে কুয়োর মধ্যে থেকে বেরিয়ে সত্যিই আমার পিছনে পিছনে আসবে এ আমি ভাবতেই পারিনি। কিন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যাঙটা, আর ভিতরে ঢুকে আমার কাছে আসতে চাইছে।
ঠিক সেই সময় আবার একবার দরজায় ধাক্কা শোনা গেল আর কে, যেন বললে—
রাজার ছোট কন্যে,
জলের ধারে যা বলেছ
ভুললে কিসের জন্য?
রাজার ছোট কন্যে,
দুয়ার খুলে নাও আমারে
ফেলো না নগণ্যে।
রাজা শুনে গম্ভীরভাবে বললেন— রাজার মেয়ে যদি প্রতিজ্ঞা করে থাকে তা তার পালন করা কর্তব্য। যাও দরজা খুলে ওকে নিয়ে এস।
কাজেই রাজকন্যা উঠে দরজা খুলে দিলেন আর তাঁর পিছনে পিছনে লাফাতে লাফাতে ব্যাঙ এসে রাজকন্যার আসন পর্যন্ত গেল।
সেখানে এসে ব্যাঙ বললে— আমাকে তুলে তোমার পাশে বসাও। রাজকন্যা ইতস্তত করছিলেন, কিন্তু রাজার হুকুমে তা-ও করতে হল। চৌকিতে বসে ব্যাঙ বললে সে টেবিলে উঠবে। টেবিলে উঠে বললে— তোমার সোনার থালাটা একটু এগিয়ে দাও যাতে আমরা একসঙ্গে খেতে পারি।
যতই অনিচ্ছা থাকুক রাজকন্যাকে তা-ও করতে হল। ব্যাঙ খুব আয়েস করে খেল, কিন্তু রাজকন্যার গলায় প্রতিটি গ্রাস আটকে যেতে লাগল।
শেষে ব্যাঙ বললে— যথেষ্ট খেয়েছি। এবার আমাকে তোমার ঘরে তোমার রেশমের বিছানায় নিয়ে চল। সেখানে আমরা দুজনে ঘুমোব।
গরম বিছানায় গায়ের পাশে ঠাণ্ডা ভিজে ভিজে ব্যাঙ শুয়ে থাকবে ভেবে রাজকন্যা কাঁদতে লাগলেন, কিন্তু ব্যাঙও রাজকন্যার অঙ্গীকার মত তাঁর বিছানায় তাঁর পাশে না শুয়ে ছাড়বে না।
রাজা মেয়ের অনিচ্ছা দেখে তাকে বকে বললেন— তোমার নিজের দরকারের সময় যা অঙ্গীকার করেছ এখন তা ভুললে চলবে না, প্রতিপালন কর।
কাজেই দু-আঙুলের ফাঁকে ব্যাঙকে তুলে নিলেন রাজকন্যা, নিয়ে উপরে তাঁর শোবার ঘরের এক কোণে রেখে দিলেন। তারপর রাজকন্যা যখন বিছানায় শুয়ে ঘুমের উদ্যোগ করছেন, থপাস্ থপাস্ করে ব্যাঙ এগিয়ে এসে বললে— রাজকন্যা, তোমার মত আমিও ঘুমে কাতর। আমাকে বিছানায় তুলে নাও, নইলে আমি তোমার বাবাকে বলে দেব!
রাজকন্যা আর সহ্য করতে পারলেন না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বিছানা থেকে উঠে ব্যাঙটাকে তুলে নিয়ে যত জোরে পারেন আছাড় মারলেন দেয়ালে। বললেন— হতচ্ছাড়া ব্যাঙ, এইবার চুপ্ কর্!
কিন্তু আছাড় খাবার পর দেখা গেল ব্যাঙ আর ব্যাঙ নেই। ব্যাঙের বদলে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন চমৎকার সুন্দর এক রাজপুত্র।
সবাই অবাক। রাজা এলেন। এসে রাজকন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে দিলেন। রাজপুত্র তখন বললেন যে এক ডাইনির জাদুতে তিনি এতদিন ব্যাঙ হয়ে ছিলেন। রাজকন্যাই সেই জাদু কাটিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছেন। রাজপুত্র বললেন, তাঁর ইচ্ছা তাঁরা দুজনে রাজপুত্রের বাবার রাজত্বে যান।
খবর পেয়ে রাজপুত্রের বিশ্বাসী চাকর হেনরি মাথায় সাদা পালক গোঁজা সোনার জিনে সাজানো আট সাদা ঘোড়ার গাড়ি সাজিয়ে গাড়ির পাদানিতে চেপে রাজপুত্র আর তাঁর বৌকে নিয়ে যেতে এল। রাজপুত্র যখন ডাইনীর মন্ত্রে ব্যাঙ হয়ে যান তখন বিশ্বাসী হেনরির এত কষ্ট হয়েছিল যে পাছে দুঃখে উদ্বেগে তার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায় এই ভয়ে সে তার বুকের উপর তিন ফের্তা লোহার পাত বেঁধে রেখেছিল। যখন রাজপুত্র তাঁর বৌকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন হেনরি গাড়ির পিছনে পাদানিতে পা দিয়ে দাঁড়ালো আর তার প্রভুর মুক্তিতে তার বুক আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
কিছুদূর যেতেই রাজপুত্র গাড়ির পিছনে একটা শব্দ পেলেন, মনে হল যেন কি একটা ভেঙে পড়ল। রাজপুত্র পিছন ফিরে চিৎকার করে বললেন— হেনরি, দেখ গাড়ির চাকা বুঝি ভেঙে পড়ল!
হেনরি গান গেয়ে উঠল—
ভাঙবে কেন চাকা?
বুক যে আমার ঢাকা!
লোহার পাতে বেঁধেছিলেম
তোমার দুখে দুখী—
সেই লোহা আজ পড়ছে ভেঙে—
তোমার সুখে সুখী।
আবার সেইরকম একটা ভাঙার শব্দ হল। রাজপুত্র আবার ভাবলেন চাকা ভেঙে পড়ল বুঝি। কিন্তু চাকা তো নয়! হেনরি নিরুদ্বিগ্ন হয়ে বুক ভরে যে নিশ্বাস নিতে লাগল তাতেই বাকি লোহার পাতগুলো তার বুকের উপর থেকে খুলে পড়ে গেল।